You dont have javascript enabled! Please enable it! সিআইএ যে কারণে মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র দেয়নি - সংগ্রামের নোটবুক

ভারত সরকারের পক্ষে সিআইএর মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র সরবরাহে কি কোনাে অনুরােধ করা হয়েছিল? সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গােপন মার্কিন নথি থেকে ইঙ্গিত মিলছে যে, ভারত মুক্তিযােদ্ধাদের স্মল আর্মস সরবরাহে অনুরােধ করেছিল, কিন্তু নানা বিবেচনায় তা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

৯ এপ্রিল, ১৯৭১ বিষয় ৪০ কমিটি বৈঠক, এপ্রিল ৯, অংশগ্রহণকারীগণ প্রেসিডেন্টের সহকারী হেনরি এ কিসিঞ্জার, আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট জন আরউইন, জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ চেয়ারম্যান এডমিরাল থমাস মুরার, সিআইএর উপ-পরিচালক রবার্ট কুশম্যান, সহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়ারেন্ট নাটার, সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী যােশেফ সিসকো, সিআইএর ডেভিড ব্লি এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল স্টাফ হেরাল্ড এইচ. স্যান্ডার্স।  শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান-সংক্রান্ত সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের বৈঠকের পটভূমিতে সিআইএ সদস্যদের অনুরােধে ‘ফোরটি কমিটির’ জন্য উপযুক্ত একটি বিষয় নিয়ে আলােচনার সূচনা ঘটে। জেনারেল কুশম্যান উল্লেখ করেন যে, একটি অনুরােধ পাওয়া গেছে। একটি বাক্যের কিছু অংশ (সাের্স টেক্সট) অবমুক্ত না করায় বােঝা যাচ্ছে না, এই অনুরােধের সূত্র কী ছিল। তবে বৈঠকের আগে বিষয়বস্তু সম্পর্কে এক সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু এটি মুদ্রিত হয়নি। বলা হয়েছে, সিআইএ অন্যান্য ক্ষেত্রে যেভাবে অচিহ্নিত ক্ষুদ্র অস্ত্র দিয়ে থাকে তা পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য সরবরাহ করতে। এ ক্ষেত্রেও সাের্স টেক্সস অবমুক্ত করা হয়নি। জেনারেল কুশম্যান। মন্তব্য করেন যে, তাদের এজেন্সির কাছে নিরাপদ চ্যানেল রয়েছে, যার মাধ্যমে উক্তরূপ অস্ত্র সরবরাহ করা যেতে পারে। কিন্তু তার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, এ সংক্রান্ত তাদের গােপন অপারেশন খুব বেশিদিন গােপন থাকবে না। তিনি একইসঙ্গে উল্লেখ করেন, সিআইএর পরিচালক হেলােস মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্রদানের প্রস্তাবিত প্রকল্প। সমর্থন করেন না। ড, কিসিঞ্জার এ ব্যাপারে অনেকের কাছে মতামত জানতে চান। উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই পরিকল্পনার ব্যাপারে আরউইন ছিলেন শিথিল। এডমিরাল মুরার অনুভব করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে উভয় পক্ষে সক্রিয় থাকা খুবই ভুল সিদ্ধান্ত হবে। জেনারেল কুশম্যান অভিমত দেন যে, এ মুহূর্তে সিনিয়ির রিভিউ গ্রুপ পূর্ব পাকিস্তান প্রশ্নে একটি বৃহত্তর নীতি প্রণয়নে চিন্তা-ভাবনা করছেন। এখন যদি ইতিবাচক কোনাে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তাহলে সম্ভাব্য সিদ্ধান্তে তার প্রভাব ফেলবে। সবার কথা শুনে ড, কিসিঞ্জার মত দেন, আমি মনে করি যে, প্রেসিডেন্ট কখনােই এই প্রকল্প সমর্থন করবে না। সিসকো উল্লেখ করেন যে, তিনি। মনে করেন, ভারতীয়রা আমাদের পরীক্ষা করছে। একটি বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রকে পূর্ব পাকিস্তানি প্রতিরােধ আন্দোলনে ভারতের গােপন সমর্থন সংক্রান্ত রিপাের্টগুলাের প্রতি। চোখ বন্ধ করে রাখা এবং মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র সরবরাহ করার ক্ষেত্রে ভারতীয়দের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গােপন মিশনে জড়িত হওয়া ভিন্ন বিষয়।

কিসিঞ্জার বলেন, তার ধারণা, পর্যাপ্ত অস্ত্র সরবরাহ করেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানের সম্ভাব্য ফলাফলে কোনাে পরিবর্তন সূচিত করতে সক্ষম নয় ।তিনি এটাও ধরে নিয়েছেন যে, যে কোনাে পরিস্থিতিতে ভারতের হাতে পর্যাপ্ত অস্ত্রের মজুদ রয়েছে এবং তারা মুক্তিযােদ্ধাদের চাহিদা মেটাতে পারবে। তিনি উল্লেখ করেন, পূর্ব পাকিস্তানিদের কিন্তু যথেষ্টসংখ্যক অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়ােজন, আর ভারতের কাছে অচিহ্নিত অস্ত্রের পরিমাণ কিন্তু ততটা বেশি পরিমাণে নেই। সুতরাং সেখানে কিন্তু প্রয়ােজন পড়তেই পারে। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় বামপন্থি ও উদারপন্থিদের প্রতিযােগিতায় ভারতীয় অস্ত্র সরবরাহ কিভাবে ফারাক সৃষ্টি করতে পারে তা এখনাে স্পষ্ট নয়। তিনি মনে করেন, শেষ পর্যন্ত বামপন্থিরাই সাফল্যমন্ডিত হবে। এমনটা ভাবা হবে এক আগাম সিদ্ধান্ত। ড. কিসিঞ্জার বলেন, বিষয়টি কিন্তু আমাদের নীতি-নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি মনে করি যে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে চরমপন্থিরা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে, তাহলে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটানাের প্রশ্নে আমাদের মূল্যায়নে তা প্রভাব ফেলতে পারে। কিসিঞ্জার এ প্রসঙ্গে আরাে উল্লেখ করেন। যে, ২৫ মার্চ যদি যুক্তরাষ্ট্রকে কোনাে বিকল্প বেছে নিতে সুযােগ দেয়া হতাে তাহলে ওয়াশিংটন নিশ্চয়ই সামরিক ব্যবস্থা না নিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে অনুরােধ জানাত। কিন্তু তিনি স্মরণ করেন যে, ঢাকায় আলােচনা যখন ভেঙে গেল এবং ইয়াহিয়া সামরিক ব্যবস্থা নিলেন, তখন তা কিন্তু আমাদের সবাইকে বিস্মিত করল। সিসকো উল্লেখ করেন, পূর্ব পাকিস্তানে মডারেট নেতৃত্ব বজায় রাখার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া উভয়ের বিরাট স্বার্থ নিহিত। তিনি উল্লেখ করেন, তিনি পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আগা হিলালিকে ব্যক্তিগতভাবে বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে একটি মডারেট নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কারাবন্দি কতিপয় নেতাকে ভূমিকা পালনের সুযােগ দিতে হবে। কিসিঞ্জারের এক প্রশ্নের জবাবে সিসকো মত প্রকাশ করেন যে, স্টেট ডিপার্টমেন্টের অনেক আগেই সিআইএ ইয়াহিয়ার সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণের সম্ভাবনা সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিল।

স্টেট ডিপার্টমেন্ট আপােসমূলক সমঝােতার ব্যাপারে অধিকতর আগ্রহী ছিল। আর সে কারণেই ২৫ মার্চের আগে তারা এই নিয়ে তেমন উদ্বেগ অনুভব করেনি। রি উল্লেখ করেন, মুজিবুর রহমানের প্রধান বিরােধী ছিল বামপন্থিরা। বর্তমানে মডারেট নেতৃবৃন্দের অধিকাংশই হয় কারাগারে, না হয় মৃত। তিনি এ কথা বলে বক্তব্য শেষ করেন যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এখন কিভাবে পূর্ব পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দের কাছে ছয়দফা মেনে নিতে পরিকল্পনা করছেন, তা ব্যাখ্যা করেছেন রাষ্ট্রদূত হিলালি। এ কথা। শুনে কিসিঞ্জার বিস্ময় প্রকাশ করেন। বলেন, ইয়াহিয়া যদি যে কোনােভাবেই ছয়দফাই মেনে নেয়ার কথা ভাববেন তাহলে তিনি কেন সামরিক সমাধানের চেষ্টা করলেন। ব্লি উল্লেখ করেন, পূর্ব পাকিস্তানকে দ্রুত বাগে আনার ক্ষেত্রে পাক সেনারা তাদের সামর্থ্য সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা পােষণ করেছিল। 

আলােচনায় এই পর্যায়ে মােড় নেয় ভারতীয়রা কী চাইছে তা মূল্যায়নে। ড. কিসিঞ্জার উল্লেখ করেন, সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের পূর্ববর্তী বৈঠকে ধরে নেয়া হয়েছিল যে, ভারতীয়রা একটি অখণ্ড পাকিস্তান চেয়েছে। ব্লি জবাবে বলেন, তার ধারণা, ভারতীয়রা প্রকৃতপক্ষে চেয়েছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে একটি অত্যন্ত শিথিল কনফেডারেল সম্পর্ক। এই নথির শেষ অংশে মন্তব্য কলামে লেখা আছে ভারতীয় অনুরােধের ব্যাপারে ড, কিসিঞ্জার প্রত্যেকের কাছ থেকে মতামত জেনে নিয়ে এই ধারণাই নিশ্চিত করেন যে, এটা অনুমােদনের প্রশ্নই আসে না।’ এরপর সম্পাদকীয় নােটে উল্লেখ করা হয়, প্রেসিডেন্ট নিক্সন হােয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ১২ এপ্রিল, ১৯৭১ কিসিঞ্জার ও হেন্ডম্যানের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। কিসিঞ্জার শুরুতেই প্রেসিডেন্টকে জানান, আমাদের ঢাকা কলেট এখন প্রকাশ্য বিদ্রোহে অবতীর্ণ। নিক্সন ও কিসিঞ্জার পাকিস্তানের আসন্ন গৃহযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য জড়িয়ে পড়া সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কিসিঞ্জারের মূল্যায়ন হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্রোহীদের সমর্থন দেয় তাহলে পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াবে। আর বাঙালিরা যে কোনােভাবেই হােক শেষ পর্যন্ত অনুসরণ করবে বামপন্থা।

নিক্সন একমত প্রকাশ করে বলেন, আমরা যদি মধ্যপন্থা অনুসরণ করি, তাহলে এটা হবে এক নরকতুল্য ভ্রান্তি। তিনি মত প্রকাশ করেন, ‘যেসব বেজন্মা ভিয়েতনাম প্রশ্নে আমাদের বিরােধিতা করেছিল, সেসব বেজন্মার কেউ কেউ পূর্ব পাকিস্তান ইস্যুতে বিপরীতমুখী নাক গলাচ্ছে। ভিয়েতনামে গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করায় এসব বেজম্মা আমাদের বিরােধিতা করে। অথচ এখন তারাই চাইছে আমরা পূর্ব পাকিস্তানে হস্তক্ষেপ করি। অথচ দুটোই গৃহযুদ্ধ।’ কিসিঞ্জার বলেন, এই লােকজনই চেয়েছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সহায়তা যেন বল্পব্দ করে দেয়। তার মতে, তাদের যুক্তি ছিল, পুরােদস্তুর মতবাদকেন্দ্রিক। এবং পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারতের কাছ থেকে অভিযােগ আসছিল চড়া সুরে। ভারত এখন কাদছে, কারণ তারা ভীত হয়ে পড়েছে যে, তাদের নিজেদের বাঙালিরা মারা যেতে পারে। ভারত প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান চায় না। কারণ ১০ বছরের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের জন্য চাপ দিতে শুরু করবে। তিনি মন্তব্য করেন, এই পরিস্থিতি থেকে দূরে থাকতে এটা আমাদের জন্য এক ক্লাসিক সিচুয়েশন’।

সূত্র:  ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন