ABC Channel Interview with Sheikh Mujibur Rahman | Part 3
প্রশ্নকর্তা : সোভিয়েত ইউনিয়নের উপস্থিতি সম্পর্কে আপনার কী মতামত? জনাব প্রধানমন্ত্রী, সোভিয়েত নৌ-বাহিনী এখন চট্টগ্রাম বন্দরে উদ্ধারের কাজ করছে ও এই ধরনের সংবাদ শুনা যাচ্ছে যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারত মহাসাগর ব্যবহারের জন্য অনুমতি চেয়েছে।
বঙ্গবন্ধু : আমি এই ধরনের কিছুই জানি না। আপনারা কোথা থেকে এ সংবাদ পেলেন?
চট্টগ্রাম বন্দরটিকে পরিস্কার করার জন্য একটি চুক্তি অনুসারে এরা এসেছে ও বন্দরটিতে কাজ করছে। আমার মাটি বা জল ব্যবহার করার জন্য কাউকে কোন অনুমতি দেওয়া হয় নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন এই ধরনের কোন অনুমতিও চায় নি।
প্রশ্নকর্তা : আপনি উপমহাদেশের সমস্ত দেশের কল্যাণের জন্য আপনাদের মধ্যে একটি মৈত্রী চাচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধু : মৈত্রী সম্বন্ধে কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। এই উপহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে আমি শান্তি চাই ও কোন বৃহৎ শক্তি আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ না করুক এই আমার কামনা। তাদের নিজের ব্যাপারে সুখী থাকুক, আমরা তাদের বিরক্ত করব না।
প্রশ্নকর্তা : জনাব প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে আবার বিরক্ত করছি। আপনি কী মনে করেন যে, কোন দেশ থেকে ব্যাপক আকারে সাহায্য কোন শর্ত ছাড়াই আপনি পেতে পারেন?
বঙ্গবন্ধু : ব্যাপক আকারে সাহায্য? কতটুকু আমি গ্রহণ করব ও হজম করতে পারব তার উপরই সাহায্যের পরিমাণ নির্ভর করছে। ব্যাপক আকারে সাহায্যের অর্থ এই নয় যে, আমার দেশের উপর কেহ সাহায্য চাপিয়ে দেবে। আমার জনগণের জন্য যে পরিমাণ সাহায্য প্রয়োজন তা আমি নেব ইহা একান্ত আমাদের ব্যাপার।
প্রশ্নকর্তা : অসংখ্য ধন্যবাদ জনাব প্রধানমন্ত্রী, আপনি বলেছেন যে, সংঘর্ষ লাগার পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে তিন বছর সময় লাগবে। আপনি কী মনে করেন যে, পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে তিন বছর সময় লাগবে?
বঙ্গবন্ধু : এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। প্রশ্নকর্তা : আরও কম সময় তো লাগতে পারে।
বঙ্গবন্ধু : হ্যা, তাই। প্রশ্নকর্তা : আপনি কীজন্য এত আশাবাদী? বঙ্গবন্ধু : আমি যেহেতু জনগণের উপর নির্ভর করি। আমার জনগণ অত্যন্ত ভালো ও তারা আমার কথা মেনে চলে। তারা অত্যন্ত বিশ্বাসী ও কঠোর পরিশ্রম করছে।
প্রশ্নকর্তা : জনাব প্রধানমন্ত্রী, আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে, বিগত চার মাসের কাজের জন্য আপনার সমালোচনা হচ্ছে। যারা স্বাধীনতার সময় সংগ্রাম করেছে ও সে কারণেই যারা সমস্ত দাবি-দাওয়া প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে-তাদের কী করে আগামী তিন বছর আপনি শান্ত রাখবেন।
বঙ্গবন্ধু : আমি তাদের স্বাধীনতা দিয়েছি-আমি তাদের জীবনে সুখ এনে দেবতারা কখনও বিভ্রান্ত নয়। আমি ভুল সংশেধন করতে পারব
প্রশ্নকর্তা : আপনি কী সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে রাখতে পারবেন?
বঙ্গবন্ধু : সবসময় সমালোচকেরা কিছু না কিছু সমালোচনাও করেন। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, আমাকে সমালোচনা করতে আমি তাদের অনুমতি দিয়েছি। সমালোচনার ব্যাপারে আমার কোন আপত্তি নেই। কেননা, আমি জনগণকে ভালোবাসি-জনগণও আমাকে ভালোবাসে। সামান্যসংখ্যক লোকের সমালোচনায় আমার কিছুই আসে যায় না। আমি সৎ সমালোচনাকে স্বাগতম জানাই। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, আমি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে বিশ্বাসী।
আমাকে সমালোচনার অধিকার জনগণের রয়েছে। যদি দেশের কোথাও কোন অন্যায় কাজ হয় তার জন্য সমালোচনার প্রয়োজন রয়েছে, তাতে আমার ভুলও সংশোধন হবে। বিরোধীদল।
প্রশ্নকর্তা : আপনি কী বিরোধীদলের কাজকর্মে আস্থাবান?
বঙ্গবন্ধু: যদি আর কাউকে ভোট দিতে পারবে না-এই নীতিতে আমি বিশ্বাসী হতাম, তাহলে বিরোধীদল গঠন করতে নিশ্চয়ই অনুমতি দিতাম না। যেহেতু আমি নির্বাচনে বিশ্বাসী সেইহেতু জনগণ যদি বিরোধীদলের কাউকে চায় ভোট দেবে।
ও সে বিরোধীদলের আসনেও বসবে-তাতে আমার মনে করার কিছুই নেই। খাদ্য সমস্যা। প্রশ্নকর্তা : জনাব প্রধানমন্ত্রী, আপনি তো খাদ্য সমস্যা সমাধানের জন্য অনেকদূর এগিয়ে গেছেন। আপনার দেশে তো কেউ অনাহারে নেই; কিন্তু আমরা জানতে চাই যে, আপনি কী করে বেকার সমস্যা সমাধান করছেন? আপনি কী করে চাকরি সৃষ্টি করছেন? বেকার লোকদের চাকরির সংস্থান করতে আপনার কতদিন সময় লাগবে?
বঙ্গবন্ধু : আপনাদের কাছে সব ঘটনার বিবরণ দেওয়া আবশ্যক। আমার আড়াই কোটি বাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। এক কোটি লোক গৃহহারা হয়ে ভারতে চলে গিয়েছিল, তারাও ফিরে এসেছে। আমাকে তাদের বাসস্থান ও খাদ্য সরবরাহ করতে হচ্ছে। স্বভাবতঃই তাদের জন্য সবকিছু করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু অত্যন্ত খুশির কথা এই যে, গ্রাম পর্যায়ে সাহায্য সংস্থা গঠন করা হয়েছে যারা দরিদ্র জনগণের মধ্যে সাহায্য বিতরণ করছে। আমার যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে, রেল যোগাযোগ নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে ও ট্রাক এবং বাস পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবুও আমার জনগণ কাজ করে চলেছে। অবশ্য সমস্যা রয়েছে ও থাকবে। আমার জনগণ অত্যন্ত বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন ও অত্যন্ত ভালো। ষড়যন্ত্র প্রশ্নকর্তা : জনাব, আপনি এই সেই দিন দেশে ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। এই ষড়যন্ত্র কী?
বঙ্গবন্ধু : আমি জানি, পৃথিবীর সর্বত্র ষড়যন্ত্র চলে।
প্রশ্নকর্তা : আপনি আরও বলেছেন যে, এই ষড়যন্ত্রের পেছনে কতিপয় বৈদেশিক শক্তি টাকা যোগাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু : আমি কী করে সব বলব? আপনারাই বা কী করে আশা করেন যে, আমি আপনাদের সবকিছু বলব? আমার গােয়েন্দা কর্মরত রয়েছে। আমি জানি কারা আমার কিছু কিছু লোককে টাকা ঘুষ দিয়ে দেশের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। বাংলার প্রতিটি গৃহে আমার মানুষ রয়েছে। কোন দেশের পক্ষেই এ ধরনের কাজ করা সম্ভব নয়। তবুও কোন কোন দেশ তাদের অভিলাষ চরিতার্থ করার। জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। বাংলাদেশে যতদিন আমি বেঁচে থাকব ততদিন এ কাজ হতে পারবে না।
প্রশ্নকর্তা : ষড়যন্ত্র সম্পর্কে এ ধরনের খােলাখুলি আলোচনা করলে দেশের জনগণের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি কী হতে পারে না?
বঙ্গবন্ধু : আমার জনসাধারণ জানে যে, বাংলাদেশে দীর্ঘ দিন ধরে ষড়যন্ত্র চলছে-ইহা এক বা দুদিনের বিষয় নয়। কোন কোন দেশ মধ্যপ্রাচ্যে ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ষড়যন্ত্র করছে।
প্রশ্নকর্তা : আপনি কী বৃহৎ শক্তিগুলোর কথা বলছেন?
বঙ্গবন্ধু : আমি এই সম্বন্ধে এখনও কিছু বলতে চাই না। অবশ্য যারা ষড়যন্ত্র করছে তাদের সাবধান থাকা প্রয়োজন। কেননা, আমি তাদের ধরতে চেষ্টা করছি। জনতার শক্তি দিয়ে মোকাবিলা করব.
প্রশ্নকর্তা : আপনি কী ষড়যন্ত্রকারীদের মোকাবিলা করতে চান? কিন্তু আপনার তো সংগঠিত পুলিশ বা সেনাবাহিনী নেই।
বঙ্গবন্ধু : আমি নিজেই সংগঠিত। আমার পুলিশের বা সেনাবাহিনীর প্রয়োজন নেই।
কেননা, আপনারা নিশ্চয় জানেন, দেশের জনগণ যখন কোন নেতার পিছনে থাকেন ও তার প্রশাসনকে সমর্থন করেন তখন তাকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারে সব শক্তির উৎস হলে জনগণ । যখন দেশের জনগণ কারও পেছনে থাকে, তাকে বিশ্বের কেউ দাবিয়ে রাখতে পারে না। এই হলো আমার ধারণা। খাদ্য দাঙ্গা।
প্রশ্নকর্তা : জনাব, আপনার দেশের কোন কোন এলাকায় খাদ্যের জন্য দাঙ্গা হয়েছে ওবিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে-এ সম্বন্ধে আপনার মতামত কী? বঙ্গবন্ধু : এ সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না, আপনারা এ খবর পেলেন কোথায়?
প্রশ্নকর্তা : আপনার খবরের কাগজে আমরা এ বিষয় জানতে পেরেছি। দৈনিক অবজারভার পত্রিকায় এ খবর প্রকাশিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু : খাদ্য নিয়ে দাঙ্গা হয়েছে এমন কোন খবর আমি জানি না। বাংলাদেশের কোথায়ও এ ধরনের ঘটনা ঘটে নি।
প্রশ্নকর্তা : এই একই সংবাদপত্রে দেশের বিভিন্ন এলাকায় রাহাজানি সম্বন্ধে খবর বের হয়েছে? আপনি পুলিশের প্রয়োজন মনে করেন না? আপনার তো মাত্র দুহাজার পুলিশ রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু : আমার পুলিশ বাহিনী রয়েছে। তারা দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করছে।
আপনারা রাত ১২ টায় বা দুটায় যেখানে খুশি হাঁটুন দেখবেন কোন বিপদ আপদ নেই। নিউইয়র্কে তো রাত দশটায় চলা যায় না। কেননা, ওখানে যে কোন সময়, রাহাজানি সঘটিত হতে পারে বা যে কেহ বিপদের সম্মুখীন হতে পারে। নিউইয়র্কের চেয়ে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালো। এতবড় একটা সশস্ত্র বিপ্লবের পর এখানে-সেখানে কিছু কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে যা নিতান্তই গৌণ ব্যাপার মাত্র।
প্রশ্নকর্তা : ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী সম্বন্ধে আপনার মতামত কী? আমরা তো সিদ্দিকী সম্বন্ধে শুনেছি- তিনি নাকি ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী গড়ে তুলছেন ও অস্ত্রশস্ত্র জমা দেয় নি।
বঙ্গবন্ধু : এ কথা সত্য নয়। ইহা নিছক বাজে কথা। জনাব সিদ্দিকী আমার কাছে ৫৮ ট্রাক অস্ত্রশস্ত্র সমর্পণ করেছে।
প্রশ্নকর্তা : জনাব প্রধানমন্ত্রী, আমি কোন দুরভিসন্ধি নিয়ে বলছি না যে, দেশে আইন ও শৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে বা দেশ অবনতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।
বঙ্গবন্ধু : আপনারা কোথায় বিশৃঙখল অবস্থা দেখতে পেয়েছেন? প্রশ্নকর্তা : আপনি তো গত জানুয়ারিতে দেশের নিরবচ্ছিন্ন অগ্রগতির জন্য সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র সমর্পণ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন-সম্ভবত তা হয় নি। বঙ্গবন্ধু : সবাই অস্ত্রশস্ত্র সমর্পণ করেছে। কে বলেছে তা হয় নি? এটা কী তামাশা যে, তারা এক লাখ পঞ্চাশ হাজার অসমর্পণ করেছে। তারা দুবার অস্ত্রশল সমর্পণ করেছে। অবশ্য অল্পসংখ্যক লোক রয়েছে যারা অস্ত্র জমা না দিয়ে কোথাও কোথাও চুরি ডাকাতি করছে, এর সাথে রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই। বিহারী।
প্রশ্নকতা : জনাব প্রধানমন্ত্রী, বিহারীদের ভাগ্য সম্বন্ধে কিছু জানাবেন কী? তাদের সমস্যার সঠিক কোন সমাধান আছে কী?
বঙ্গবন্ধু : তাদের অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। সবাই এমনকি জাতিসংঘের প্রতিনিধিগণ তাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখেছেন। তারা অবাঙালিদের দু অথবা তিনটি এলাকাও প্রত্যক্ষ করেছেন। আপনারা যদি সৈয়দপুর যান তবে দেখতে পাবেন অবাঙালিরা মিল ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে। আপনারা মিরপুর ও মোহাম্মদপুর দেখুন তারা ওখানে শান্তিতে বসবাস করছে। কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বিহারীদের বিষয়টিকে জোরালো করে তুলছেন, কিন্তু পাকিস্তানে আটকেপড়া সাড়ে চার লাখ বাঙালিদের ভাগ্য সম্বন্ধে তারা কিছুই বলছেন না। তারা কোন অন্যায় করে নি, তবুও তাদের উপর অত্যাচার করা হচ্ছে। তারা তাদের খাদ্য বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু আমি আন্তর্জাতিক রেডক্রসকে যেখানে খুশি যেতে দিচ্ছি। তারা আমাদের রেডক্রসের সহায়তায় সাহায্যদ্রব্য বিতরণ করছে। অবশ্য আমার জনগণ দরিদ্র, আমি আমার জনগনকে পুরো খাদ্য দিতে পারছি না। মানুষের পক্ষে যা সম্ভব আমি তাই করছি। কিন্তু পাকিস্তানে আমার যে সাড়ে চার লাখ লোক আটকা পড়েছে সে সম্বন্ধে বিশ্বের কোন মহল থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কেউই তাদের জন্য কোন কথা বলছে না। অথচ বিহারীদের জন্য সকলেই অস্থির। বিহারীরা এখানে আরামে বসবাস করছে। একথা আমি সুস্পষ্টভাবে বলেছি যে, বাংলাদেশকে যারা মাতৃভূমি বলে স্বীকার করবে তাদের আমি স্বাগত জানাব। বিহারীদের এখানে কাজে থাকতে দিন।
আমি নিশ্চিত যে, বিহারীরা আমেরিকার নিগ্রোদের তুলনায় সুখে আছে। প্রশ্নকর্তা : জনব প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। বঙ্গবন্ধু : ধন্যবাদ।
সূত্র : সংবাদ, ১৫ মে ১৯৭২