সীমান্ত গান্ধী এসে দাঁড়ালেন বাংলাদেশের পক্ষে
১৯৭১ সালে কলকাতায় স্থাপিত বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতি জনমত সংগঠনে সভাসমিতি, প্রদর্শনী প্রভৃতির আয়োজন করা ছাড়াও বেশ কিছু প্রচারপত্র/পুস্তিকা প্রকাশ করেছিল। এরকম একটি সংগ্রহের নাম স্বাধীন বাংলাদেশ কেন? | এই পুস্তিকায় সীমান্ত গান্ধী নামে পরিচিত খান আবদুল গাফফার খানের একটি নিবন্ধ অনূদিত হয়েছিল, নাম ‘-পাকিস্তানী ভাইবোনদের প্রতি’। প্রবন্ধটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এটি দুষ্প্রাপ্য বিধায় এখানে মুদ্রিত হলো। শুধু গাফফার খান নয়, পাকিস্তানের অনেক বুদ্ধিজীবী রাজনীতিবিদ বাংলাদেশকে সমর্থন করে লেখালেখি করেছেন, বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছেন। তালীন সরকার তাদের নানাভাবে নিগৃহীত করেছে, জেলে পুরেছে, বেত্রাঘাত করেছে। এদের অধিকাংশ ছিলেন বামঘেঁষা। আমরা সে বিষয়ে প্রায় জানি না বললেই চলে।পাকিস্তানের কবি আহমেদ সেলিমের নাম এখানে বেশ পরিচিত। বাংলাদেশকে সমর্থন করে কবিতা লেখায় তাকে শুধু জেলে পোরা হয়নি, বেত্রাঘাতও করা হয়েছিল। ইসলামাবাদে আলোচনার সময় এ পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে বলেছিলেন-“মুস্তাফা রহিম নামে একজন বাংলাদেশের সমর্থনে পুস্তিকা লিখেছিলেন। তাকে গ্রেফতার করা হয়। আরেক বিখ্যাত কবি হাবিব জালেব গ্রেফতার হন। যদুর মনে পড়ে, ঐ সময় বেশ কিছু ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশকে সমর্থন করে বিবৃতি দেন, যেমন, মাযহার আলী খান, তাহেরা মাযহার, আসগর খান প্রমুখ। আসগর খানের ছেলে ছিলেন সেনাবাহিনীতে। তাকেও বোধ হয় আটক করা হয়েছিল তিনি মারা গেছেন কয়েক বছর আগে) আরও অনেকে প্রতিবাদ করেছিলেন যাদের প্রতিবাদের রেকর্ড রক্ষিত হয়নি। আপনি শুনে হয়ত অবাক হবেন বাংলাদেশের সমর্থনে সিন্ধী ভাষায় ২০০টি কবিতা আমি সংগ্রহ করেছি। পশতু এলাকা থেকে সংগ্রহ করেছি ৫০টিরও বেশি। বেলুচিস্তান থেকে সংগ্রহ করেছি ২০টি কবিতা। পাঞ্জাবীতে লেখা কয়েকটি কবিতাও আছে আমার কাছে। এভাবে মিলে ৫০০ পাতার একটি বই হতে পারে। উর্দু আর ইংরেজীতে বেশ কিছু কবিতা রয়েছে। সিন্ধী ভাষায় বাংলাদেশ আন্দোলনের ওপর একটি উপন্যাস লেখা হয়েছে। ছোট গল্পও
লেখা হয়েছে কিছু। যেমন জাদিন, নাসিম খায়ের প্রমুখ। শেখ আয়াজ বহু | কবিতা লিখেছেন। তাকে জেলে পাঠানো হয়। তাঁর জেল ডায়েরিও আছে।সেখানে আছে, শেখ মুজিব কোথায় থাকতে পারেন তা কল্পনা করার চেষ্টা করছি। বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক ‘অন্তরঙ্গ’ আখ্যানও রয়েছে। দুখণ্ডে উর্দুতে লেখা একটি চিত্তাকর্ষক বই আছে। এ মুহুর্তে আরেকজন বিখ্যাত বালুচ কবির নাম করতে পারি-গুখ নাসির। বাংলাদেশকে সমর্থন করায় তাকে জেলে। পাঠানো হয়। আজমল খাটক কবিতা লেখায় তাকেও জেল বরণ করতে হয়।এসবই আমাদের অজানা। গাফফার খানের প্রবন্ধ প্রসঙ্গে আসি। তিনি তখন ছিলেন আফগানিস্তানের জালালাবাদে। সামরিক জান্তা তাদের কনসালকে পাঠায় পাকিস্তানের পক্ষে গাফফার খানকে একটি বিবৃতি দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই তিনি রাজি হননি বরং লিখেছিলেন এই প্রবন্ধ বা। চিঠিটি। তিনি লিখেছেন, বাঙালিদের প্রচেষ্টাতেই পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল। কারণ, দেশবিভাগের পূর্বে একমাত্র বাংলাদেশেই মুসলিম লীগের সরকার ছিল। সীমান্ত প্রদেশে, বালুচিস্তানে, সিন্ধুতে বা পাঞ্জাবে কোন মুসলিম লীগ সরকার ছিল না । কনসালকে আলোচনাকালে বলেছিলেন, পাকিস্তান গড়ে তোলার জন্য কী চিন্তা করা হয়েছিল এবং এ কাজ কি ট্যাঙ্ক, মেশিনগান ও বোমর সাহায্যে করা যায়? গাফফার খান দুঃখ করে লিখেছেন, “হতভাগ্য বাংলার কোন দোষ নেই। নির্বাচনে জয়লাভ করাই তার একমাত্র দোষ। আজ বাংলাদেশে যে খেলা চালানো হচ্ছে, পাকিস্তান গঠনের সময়ে আমাদের, পাশতুনদের সঙ্গেও তা খেলা হয়েছিল।যুদ্ধের জন্য ভুট্টো, কাইয়ুম খান ও সামরিক জান্তাকে দায়ী করে তিনি | লিখেছেন ধর্মের নামে পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ সব সময়ই আমাদের প্রতারণা করছে। তারা ইসলাম ও পাকিস্তানের নাম বড়াই করে কথা বলে। যে ঘটনা আজ বাংলাদেশে ঘটছে তা কি ইসলাম সম্মত এবং পাকিস্তানের জন্যেই কি ঘটানো হচ্ছে?নিচে তার পুরো প্রবন্ধটি উদ্ধৃত করছিপাকিস্তানী ভাই-বোনদের প্রতি খান আবদুল গফফর খান। আমার প্রিয় পাকিস্তানী ভাই ও বোনেরা,বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে আমি এতদিন পর্যন্ত কোন বিবৃতি দিইনি। কারণ, বিষয়টিকে সৌহার্দ্য ও ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে এবং শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে সমাধান করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আমি যোগাযোগ করেছিলাম।
দীর্ঘকাল প্রতীক্ষা করেও পাকিস্তান সরকারের তরফ থেকে আমার আবেদনের কোনও প্রত্যুত্তর পাইনি। ইতোমধ্যে, জনসাধারণের কাছ থেকে সত্য ঘটনা গোপন এবং তাদের বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে ভূট্টো ও কাইয়ুম বিবৃতি দান ও মিথ্যা প্রচার চালাতে ব্যস্ত ছিলেন।কুসা। এটা খুবই দুঃখজনক যে সামরিক আইন থাকা সত্ত্বেও তাদের বিবৃতি সমূহ এবং ভ্রান্ত প্রচারের উপর কোন নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়নি। বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার জন্য এই বিবৃতিসমূহ সংবাদপত্রে পর্যন্ত প্রকাশিত এবং বেতারে প্রচারিত হয়েছে। এই বিরোধী দলের নেতারা দেশ ও জনগণের স্বার্থে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান এবং পাকিস্তানের সমৃদ্ধির জন্য অবস্থাটাকে পরিষ্কার করে দেখানো এবং এখান থেকে যেমন দেখছি তার মূল্যায়ন করা আমার কর্তব্য হয়ে দাড়িয়েছে। | আমি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা শুনেছি এবং যে সামরিক আইন বাঙালীর ক্ষতিসাধন করেছে ও তাদের উপর সন্ত্রাসের রাজত্ব চাপিয়ে দিয়েছে, সেই সামরিক আইন জারির ঘোষণা শুনেছি। আমি মর্মাহত ও দুঃখিত হয়েছি। কী এই ঘটনা, কেমন করে এটা ঘটল, এবং কেন ঘটল? বাঙালীরা খাটি মুসলমান। তাদের প্রচেষ্টাতেই পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল, কারণ, দেশ-বিভাগের পূর্বে একমাত্র বাঙলাদেশেই মুসলিম লীগ সরকার ছিল না।পাকিস্তানের কনসাল জালালাবাদে যখন আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন তখন আমার মানসিক পরিস্থিতি ছিল দুঃখ ও উদ্বেগপূর্ণ। তিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসায় খুশী হয়েছিলাম। আলোচনাকালে তিনি বলেছিলেন, বাঙালীরাই পাকিস্তান ধ্বংস করছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পাকিস্তান গড়ে তোলার জন্য কী চিন্তা করা হয়েছিল এবং এ কাজ কি ট্যাঙ্ক, মেশিনগান ও বোমার সাহায্যে করা যায়?হিংস্রতা হিংস্রতা হল ঘৃণা এবং এটা জনগণের মধ্যেও ঘৃণা জাগ্রত করে। যদি জনসাধারণের মধ্যে ঘৃণা এবং অসৎ ইচ্ছা উদ্ৰিক্ত হয় তবে তাদের একত্রে থাকা, ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং একসঙ্গে স্থায়ীভাবে বসবাস করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। পাকিস্তান সরকার যে পথ গ্রহণ করেছেন তা কোন গঠনাত্মক পথ? আমি তাকে বলেছিলাম, ভালবাসা এবং সৌহার্দ্যের পথই গঠনমূলক পথ, একই বাড়িতে থেকে ভায়েরা যেমন পারস্পরিক উপদেশ ও নির্দেশ গ্রহণ করে তেমন পথ। আমি তাকে বলেছিলাম যে বাঙালীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং
সংখ্যাগরিষ্ঠরা কখনও একটি দেশকে বিভক্ত করতে চায়না; সুতরাং মুজিব সাহেব পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চাইছেন না। যদি পাকিস্তানি ঋণংস হয় তবে তা হবে কাইয়ুম এবং ভুট্টোর ভ্রান্ত নীতির জন্য। | আমি কনসালকে একথাও জিজ্ঞেস করেছিলাম যে পাকিস্তান সরকার যথার্থই দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করতে চান কি না। যদি তাই চান, তবে সমস্যাটির শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য মুজিব সাহেব ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যস্থতা করতে আমি রাজী আছি। যদি পাকিস্তান সরকার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য প্রস্তুত থাকেন তবে আমি বাংলাদেশে যেতে প্রস্তুত। সেক্ষেত্রে আমি আমার সঙ্গে পাঞ্জাব, সিন্ধু ও বালুচিস্তান থেকে কিছু সংখ্যক ব্যক্তিকে নিয়ে গঠিত এক ভ্রাতৃত্বমূলক প্রতিনিধিদলকে সঙ্গে নেব। আমি এ বিষয় প্রত্যয়বান যে বাঙালীরা এই প্রতিনিধি দলকে গ্রহণ করবে। কনসাল এই প্রস্তাব রাষ্ট্রদূতকে পৌছে দেবেন বলে জানালেন। আমি এতে সম্মত হলাম এবং একথাও রাষ্ট্রদূতকে জানাতে বলেছিলাম যে তিনি যেন অবশ্যই আমার সঙ্গে দেখা করেন। কনসাল চলে গেলেন। রাষ্ট্রদূত নিজে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন না। কিন্তু কয়েকদিন পর একজন প্রতিনিধি পাঠালেন। কনসাল তার সঙ্গে এলেন এবং আমাদের আলাপ শুরু হল। আলোচনাকালে তারা জানালেন যে পাকিস্তান সরকার আমাকে দিয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করাতে চান। আমি বলেছিলাম, বিবৃতির কোন প্রয়োজন নেই। আমার কাছ থেকে একটি বিবৃতি নিয়ে কী লাভ? যদি সরকার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য প্রস্তুত থাকেন, তবে আমি বাংলাদেশে যেতে প্রস্তুত। তারা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, মুজিব এই প্রস্তাব সমর্থন করবেন কিনা। আমি তাদের জানালাম, এটাই হবে আমার প্রচেষ্টা। তারা জিজ্ঞেস করলেন, কেন আমি পাকিস্তানে যাচ্ছিনা। আমি তাদের বলেছিলাম যে আমি পাকিস্তানে যেতাম যদি আমি বুঝতাম যে সরকার শান্তির জন্য আগ্রহী এবং আমাকে জনসেবার সুযোগ দেবেন।কনসাল আবার কয়েকদিন পর আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং বল্লেন যে তিনি ইসলামাবাদে ছিলেন। আমি তাকে ইসলামাবাদের পরিস্থিতির বিষয় জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ইসলামাবাদে গিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করাটা কি আমার পক্ষে ভাল নয়। আমি বলেছিলাম, পাকিস্তানে সামরিক আইন বলবৎ রয়েছে এবং যুদ্ধের প্রভুরা খেলাটাকে নষ্ট করে দিয়েছে। সাম্প্রতিক যুদ্ধ দেশের সংহতির জন্য নয়, তাহলে ক্ষমতার জন্য। পাঞ্জাবের পুঁজিপতি ও সামরিক প্রভুরা নিজেদের জন্যে ক্ষমতা দাবী করছে।
পুরানো খেলা হতভাগা বাংলার আর কোন দোষ নেই। নির্বাচনে জয়লাভ করাই তার একমাত্র দোষ। আজ বাংলাদেশে যে খেলা চালানো হচ্ছে, পাকিস্তানি গঠনের সময়ে আমাদের, পাশতুনদের সঙ্গেও তা খেলা হয়েছিলো। সীমান্ত প্রদেশের আইনসভায় আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। পঞ্চাশটি আসনের মধ্যে তেত্রিশটি আসন আমাদের ছিল। মুসলীম লীগের ছিল সতেরটি। জিন্নাহ সাহেব স্বেচ্ছাচারিতার সঙ্গে মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিলেন এবং সংখ্যালঘুদলকে মন্ত্রিসভা। গঠনে আহ্বান করলেন। বান্ন যাবার পথে আমাকে গ্রেপ্তার করা হল। তারা ইপির ফকিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার এবং তাদের মতানুযায়ী যে পাঁচ লক্ষ টাকা আমি সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিলাম, সেটা ফকির সাহেবকে দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করলেন।মিথ্যা অভিযোগ এ অভিযোগও তারা আমার বিরুদ্ধে করলেন যে আমি বলেছি পাকিস্তান হল বালির একটি দুর্গ যা একটি পদাঘাতে আমি ধ্বংস করব। দেশদ্রোহী এবং ভারতের চর বলেও তারা আমাকে অভিযুক্ত করলেন। এই সমস্ত অভিযোগেই আমার বিরুদ্ধে বানানো হয়েছিলো। বাবারার অধিবাসীরা, যাঁরা শুক্রবারের নামাজ পড়ার জন্য এবং ধৃত ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভূতি জানাবার জন্য জামায়েত হচ্ছিলেন তখন তাদের উপর বোমাবর্ষণ করা হল এবং মেশিনগানের গুলীতে হত্যা করা হল। শত শত শিশু, নারী ও পুরুষ নিহত হলেন, লুঠতরাজ, মারপিট এবং অসম্মানজনক ব্যবহার শুরু হল সমগ্র প্রদেশব্যাপী। সহস্র সহস্র খোদাই খিদমতগারকে জেলে পাঠানো হল। তার আমাদের খোদাই খিদৃমতগার আন্দোলন বন্ধ করে দিলেন এবং আমাদের কাগজের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করলেন।এখনও আমরা বিশ্ববাসীকে অনুসন্ধান করতে এবং এ বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠা করতে বলি যে কী আমাদের দোষ ছিল। আমরা একটা ছোট প্রদেশের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলাম, কিন্তু সমগ্র পাকিস্তানকে ভাঙবার অভিযোগ বাংলাদেশের উপরে চাপানো হচ্ছে এবং বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচী পাকিস্তান সংহতির পক্ষে বিপজ্জনক।আওয়ামী লীগের দাবী যদি ছয় দফা কর্মসূচী পাকিস্তান সংহতির পক্ষে মারাত্মক হয় তবে কেন সামরিক আইনের কর্তৃপক্ষ সূচনা থেকেই এর উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করলেন না? নির্বাচনের একবছর আগে থেকেই বাংলাদেশে ছয় দফার পক্ষে প্রচার।
চালানো হচ্ছিল এবং সেখানে এই কর্মসূচীর উপর ভিত্তি করেই নির্বাচনী লড়াই চলেছিল। এছাড়া, যখন রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশে গিয়ে মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন, তখন তিনি ঘোষণা করলেন যে মুজিবই হচ্ছেন ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রপতি। যদি ছয় দফা কর্মসূচী পাকিস্তানী সংহতির পক্ষে বিপজ্জনক হয়, তবে কেন একে এত প্রসারের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।ভূট্রার ভূমিকা ভূয়া সাহেব ছয় দফার পাঁচটি কর্মসূচী সমর্থন করেছিলেন। ভুট্রোসাহেব এক অদ্ভুত ব্যক্তি। কখনও একথা, কখনও অন্যকথা বলেন। তিনি মুজিব সাহেবকে দুটি আইনসভা ডাকার পরামর্শের জন্য দায়ী করেন। প্রকৃত তথ্য এই যে মুজিব সাহেব সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছেন এবং তিনিই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। দুটি আইন সভার পরামর্শে তার কী। স্বার্থ ছিল? এটা ভুট্টো সাহেবেরই প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্রোসাহেবকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা উচিত। এই দাবীর অর্থ, দুটো আইনসভা থাকা দরকার, একটি পশ্চিম পাকিস্তানের, অপরটি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য। ভুট্টোর প্রস্তাব থেকেই দুটো আইনসভার দাবীর উৎপত্তি হয়েছে। কী করে তিনি অস্বীকার করতে পারেন যে দুটি আইন সভার দাবী তাঁর নিজস্ব নয়? বেচারা মুজিব আপোষের জন্য এই প্রস্তাব গ্রহণে বাধ্য হয়েছিলেন। | আওয়ামী লীগের নেতারা এই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। তারা বলেছিলেন আমরা দেশকে দুভাগ করতে চাইনা। পাকিস্তানের আইনসভার জন্যই আমরা নির্বাচনে লড়েছি, পশ্চিম পাকিস্তানের আইনসভা বা পূর্বপাকিস্তানের আইনসভার জন্য নয় আমরা সমগ্র পাকিস্তানের আইনসভাতেই অংশ গ্রহণ করব কারণ পশ্চিম পাকিস্তান বলে কিছু নেই। এখানে চারটি প্রদেশ আছে। বিশ্বাসঘাতকতা আমি পাকিস্তানের ভগ্নী ও ভ্রাতৃগণকে এই তথ্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে চাই যে ধর্মের নামে পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ সব সময়েই আমাদের প্রতারণা করেছে। তারা ইসলাম ও পাকিস্তানের নাম বড়াই করে বলে। যে ঘটনা আজ বাংলাদেশে ঘটছে তা কি ইসলামসম্মত এবং পাকিস্তানের জন্যই কি ঘটানো হচ্ছে? অনুগ্রহ করে একথা মনে রাখবেন যে আমরা অস্থায়ী সামরিক আইনের মধ্যে আছি। ( পরিশেষে আমি পাঞ্জাবের পুঁজিপতি ও কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করছি, আল্লার দোহাই, তারা যেন এই দেশে ঘৃণা এবং বিভেদ সৃষ্টি না করেন। এই ভ্রান্ত এবং মিথ্যা প্রচার বন্ধ করুন। আসুন, আমরা ভাইয়ের মতো একসঙ্গে বসি এবং ভালবাসা ও হৃদ্যতার মধ্য দিয়ে এই বিষয়টির সমাধান করি।
শোষণ আমার একথা মনে রাখবেন যে আমরা কোনভাবেই পাকিস্তানকে ধ্বংস হতে দেবনা। এটাও বিবেচনা করুন যে মুজিব সাহেবের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে যদি সমর্থন করা না হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের অধিকার, প্রদেশের অধিকার অর্জনের কী আশা থাকতে পারে? কিভাবে তাহলে আমরা ভুট্টো সাহেবের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সমর্থন করতে পারি, আমাদের নিজেদের উপর একটি ইউনিটের (Unit) কর্তৃত্ব সহ্য করতে পারি? একটি ইউনিট থেকে বহু কষ্ট আমরা ভোগ করেছি। এত বত্সর যাবৎ আমরা অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিকভাবে শোষিত হয়েছি এবং আমাদের এক ইউনিটে গণতান্ত্রিক ও সেই সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারও অস্বীকৃত হয়েছে।জনগণ অনেক নির্যাতন ভোগ করেছেন, গরীব আরও গরীব এবং ধনী আরও ধনী হয়েছে। আবার আমরা এই তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে পারি না এবং কোন মূল্যেই এক ইউনিটের রাষ্ট্রকে স্বীকার করতে পারিনা। তোমরা যদি ভ্রাতৃরূপে আমাদের থাকতে দিতে চাও তবে আমরা আনন্দের সঙ্গেই তোমাদের ভ্রাতৃত্বকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত কিন্তু কোনো মূল্যেই দাসত্বের কাছে আমরা আত্মসমর্পণ করব না।