You dont have javascript enabled! Please enable it! ইসলাম সম্পর্কে মওদুদীর অপব্যাখ্যা - সংগ্রামের নোটবুক

ইসলাম সম্পর্কে মওদুদীর অপব্যাখ্যা

বর্তমানে ও আগামী দিনে মুসলিম জীবনে যেসব সমস্যার উদ্ভব হবে কোরআন ও সুন্নাহর আলােকেই  সেগুলাের সমাধান করতে হবে। মওলানা মওদুদী সুদীর্ঘ কর্মজীবনে ইসলাম সম্পর্কেঅনেক কিছু লিখেছেন। তাঁর এসব লেখার শুদ্ধাশুদ্ধির বিচার-বিবেচনা না করলেও একটা বিষয় আমাদের ভাবিয়ে তােলে। সেটা হলাে তাঁর স্ববিরােধী উক্তি, একই বিষয় সম্পর্কে বৈসাদৃশ্য মতামত ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। ১৯৩৩ সালথেকে প্রকাশিত তরজমানুল কোরআনের সবগুলাে সংখ্যা এবং তাঁর লেখা সব কটি পুস্তক সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। কারণ তাঁর অনেক লেখাই আজকাল দুর্লভ। তবু যা কিছু পাওয়া যায় তাতে দৃষ্টিপাত করলেই আমাদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায় । মওলানা মওদুদীর হায়দরাবাদ জীবনের পরবর্তীকালের প্রবন্ধরাজিতে দেখা যায়, ‘ইসলাম ও মুসলমানেরতিনি একটা বিশেষ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “ইসলামের দৃষ্টিতে তারাই কেবলমাত্র মুসলিম সম্প্রদায় যারা গায়ের ইলাহীবা আল্লাহ– বিরােধী সরকার মিটিয়ে দিয়ে ইলাহী সরকার প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের গড়া আইন-কানুনের পরিবর্তে খােদায়ী আইন-কানুন দ্বারা দেশ শাসনের জন্য সংগ্রাম করে। যে দল বা জামাত এরূপ করে না, বরং গায়ের ইলাহী শাসনব্যবস্থায় মুসলমাননামক একটি সম্প্রদায়ের পার্থিব কল্যাণ সাধনে সংগ্রাম করে তারা ইসলামপন্থী নয় এবং তাদের মুসলিম সম্প্রদায়। বলাও বৈধ নয়।

সাধারণত কলমা বা একত্ববাদে যারা বিশ্বাসী তাদের তিনি মুসলমান ও মুসলিম। জামায়াত বলতে প্রস্তুত নন। কিন্তু হায়দরাবাদ জীবনে তিনি কেবলমাত্র কলমাকেই মুসলমানদের মধ্যকার ঐক্যসূত্র, অন্য অর্থে কলমায় বিশ্বাসীকেই মুসলমান বলে অভিহিত করেছেন। তরজমানুল কোরআনের উপরােল্লিখিত সংখ্যার একস্থানে তিনি বলেছেন, “ইসলাম জাতীয়তার যে বৃত্ত এঁকেছে তাঘিরে রয়েছে একটি কলমা…. লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। এই কলমার উপরই বন্ধুত্ব আর শক্রতা। এর স্বীকার ঐক্যবদ্ধ করে, অস্বীকার বিচ্ছিন করে।” হায়দরাবাদে শাসকগােষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার্থে তিনি মুসলমানের এই সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে পরিস্থিতি বুঝে এটা পাল্টে দিয়েছেন। অর্থাৎ,হায়দরাবাদে মুসলমানের যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তাতে সাধারণভাবে সবাই যাদের মুসলমান বলে তিনিও তাই বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর পরবর্তীকালের ব্যাখ্যায় মুসলিম বিশ্বের শতকরা একজনও মুসলমান কিনা বলা মুশকিল। এভাবে মুসলমান শব্দটিও তাঁর স্বার্থসিদ্ধির শিকার থেকে নিষ্কৃতি পায়নি। বিভিন্ন বিষয়ের ইসলামিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিতে গিয়ে তিনি অসংখ্য স্থানে এধরনের স্ববিরােধী মন্তব্য করেছেন। এসব লেখা দেখে যেকোন লােক মওলানা মওদুদী সম্পর্কে এরূপ ধারণা পােষণ করতে বাধ্য হবেন যে, ইসলাম প্রচার তাঁর উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য নয়। তিনি ইসলামকে স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর প্রায় অর্ধশতাব্দীকালের কর্মজীবনের প্রতি তাকালে আর একটা বিষয় আমাদের দৃষ্টিগােচর হয়। তিনি চিন্তাধারা ও সংগঠনপদ্ধতির ব্যাপারে কিছুসংখ্যক চিন্তাবিদের অনুকরণ করেছেন। অবশ্য তিনি | কোথাও এর স্বীকারােক্তি করেছেন কিনা আমাদের জানা নেই।

এজন্য বেশীদূর যেতে হবে  না । মরহুম মওলানা আবুল কালাম আজাদ ও মিসরের ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের প্রতিষ্ঠাতা শেখ। হাসান বান্নার রচনাবলী ও চিন্তাধারা পর্যালােচনা করলেই বিষয়টি প্রতিভাত হবে। সম্ভবত মওলানা আজাদ ১৯১২ সাল থেকে তাঁর আল-হেলালসাময়িকীর মাধ্যমে এক নতুন পদ্ধতিতে মুসলিম ভারতকে ইসলামের প্রতি আহবান জানাতে আরম্ভ করেন। অল্পদিনের মধ্যে মুসলমানরা তাঁর এ ডাকে সাড়া দেন। বৃটিশ সরকার আল-হেলালবন্ধ করে দেয়ার পরও তাঁর এ বিশেষ ধরনের প্রচারে ভাঁটা পড়েনি। তিনি আল-বালাগনামক আর একটি সাময়িকী বের করেন। তাঁর ক্ষুরধার লেখনী উর্দুভাষী মুসলিম ভারতে ইসলাম সম্পর্কে এক বৈপ্লবিক প্রেরণা সঞ্চার করে। তিনি হেজবুল্লাহদল গঠন করেন। সম্ভবত ১৯২০ সালের দিকে তাঁর চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটে। তিনি কংগ্রেসে যােগদান করেন। তাঁর মতের পরিবর্তন ঘটলেও লাখ লাখ উর্দুভাষী যারা মওলানার লেখা পড়ে ইসলামের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়েছিলাে, তাদের মতাদর্শে ব্যতিক্রম দেখা দেয় না। তারা যেখানে ছিলাে সেখানেই রয়ে যায়। কিন্তু মওলানা পুরনাে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাদের প্রতি মােটেও তাকাননি। পরবর্তীকালে মওলানা মওদুদী মওলানা আজাদের অনুসরণ করে তাঁর গড়া মহলকে নিজের দিকে আকৃষ্ট। করায় নিয়ােজিত হন। সম্ভবত মওলানা আজাদ ১৯১৮ কিংবা ১৯১৯ সালে একটি প্রবন্ধে বলেছেন, “, • • • • আমার প্রতি তাকাও। আমি একজন মানুষ, তােমাদের মধ্যে রয়েছি। গত দশ বছর থেকে একই আহবান ধ্বনি তুলে যাচ্ছি। কেবলমাত্র একটি কথার প্রতিই তােমাদের আহবান করছি। ফিরে ফিরে ডাকছি। কিন্তু তােমরা সব সময়ই এড়িয়ে চলেছে। •••••আমি তােমাদের প্রতিটি দল পরীক্ষা করেছি। প্রতিটি হৃদয় ও প্রাণের আনাচে-কানাচে খুঁজে ফিরেছি। যখনই কোনাে জনতার ভিড় দেখেছি ফরিয়াদ করেছি, নিজের দিকে ডেকেছি, কিন্তু সবাই আমার থেকে দূরে সরে রয়েছে। বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন খুব কম হৃদয়েরই সাক্ষাৎ মিলেছে। ••••আফসােস, তােমাদের ভিতর কেউ নেই যে আমার ভাষা বােঝে, আমাকে চেনে। সত্যি বলছি, আমি তােমাদের এই দেশে বন্ধু-বান্ধবহীন একজন দরিদ্র অধিবাসী।•••••” 

মওলানা মওদুদী ১৯৩৯ সালে তরজমানুল কোরআনের মার্চ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে বলেছেন, “.••••এসব আকাঙক্ষা অন্তরে পােষণ করছি এবং এগুলাে হাসিল করার জন্য গত ছবছর থেকে শরীরের পুরাে শক্তি ব্যয় করছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আমি একা। আমার শক্তি সীমিত, সম্পদহীন। যা করতে চাই, পারছি না। সঙ্গী খুঁজে ফিরছি, খুবই নগণ্য সংখ্যক পাওয়া যাচ্ছে। কোটি কোটি মুসলমানের ভিতর আমি নিজেকে অপরিচিত ও গরীব। বােধ করছি। আমি যে উন্মাদনায় পতিত হয়েছি তার প্রতি আসক্ত কোথাও পাওয়া যাচ্ছেবছরের পর বছর ধরে যাদের নিকট নিজের চিন্তাধারা পৌছাচ্ছি, যখনই তাদের নিকটস্থ হই, দেখতে পাই তারা আমার থেকে অনেক দূরে। তাদের সুর আমার সুর থেকে স্বতন্ত্র • • আমার হৃদয় তাদের হৃদয়ের অপরিচিত। তাদের কর্ণ আমার ভাষা বােঝে না। • • • • • ” উদ্ধৃতি দুটোতে শব্দগত পার্থক্য রয়েছে সত্য, কিন্তু একটু গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে  দেখা যায়, প্রায় বিশ বছর পূর্বে মওলানা আবুল কালাম আজাদ যা বলেছেন, ১৯৩৯ সালে মওলানা মওদুদী তারই প্রতিধ্বনি করেছেন।

Source: জামাতের আসল চেহারা–মওলানা আবদুল আউয়াল