You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.16 | মুজিব কলকাতা এসেছিলেন- কৃত্তিবাস ওঝা | সপ্তাহ - সংগ্রামের নোটবুক

মুজিব কলকাতা এসেছিলেন
কৃত্তিবাস ওঝা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতায় এসেছিলেন এবং একদিন কলকাতায় ছিলেন। এই একদিন অবস্থান কালে কলিকাতায় আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ সংগ্রাম কমিটির এক গুরুত্বপূর্ণ সভা হয়। সভা উপলক্ষ করেই বাঙলাদেশ থেকে আরাে সাতজন প্রধান নেতা আগেই কলকাতা এসেছিলেন। শেখ সাহেব সকলের সঙ্গে মিলিত হয়ে বাঙলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতির মূল্যায়ন করেন পরে সকলে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ফিরে যান। এই সংবাদদাতা যখন বাঙলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে ছিলেন তখন একজন সর্বোচ্চ নেতা এই সংবাদটুকু দেন। এই সংবাদ প্রকাশেও তিনি অনুমতি দিয়েছিলেন। কারণ শেখ মুজিবুর মারা গেছেন, শেখ মুজিবুরকে ইয়াহিয়া খা করাচী নিয়ে গেছেন, শেখ মুজিবুর সিন্ধু বা মুলতান কোনাে এক জেলে আটক আছেন, এইরকম নানা সংবাদের বিভ্রান্তি নিরসনের প্রয়ােজন ছিল। আমার সংবাদ, সূত্র কে বা কী তার পরিচয় সেই কথা কথনই প্রকাশ হবে না। এই সংবাদ ভবিষ্যতে সত্য হলেও নয় মিথ্যা হলেও নয়। উক্ত নেতাকে প্রশ্ন করেছিলাম তিনি কলকাতার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কিনা। তিনি বেশ রাগতস্বরে বলেছিলেন, দেখুন আপনাদের অনেক কৌতূহল, তবে এই কৌতূহল বহুসময় আমাদের উপকার না করে অপকার করছে। আমি চুপ করে থাকলে আমার মনের অবস্থা বুঝে সান্ত্বনার সুরে তিনি আমাকে বললেন—আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন—শেখ সাহেব শুধু জীবিত নন, তিনি আমাদের যুদ্ধক্ষেত্রের বিভিন্ন প্রান্তে ঘূরছেন আর মাঝে আগরতলা থেকে দমদম বিমান বন্দরে নেমে কলকাতা ঘুরে এসেছেন। তিনি বললেন কলকাতায় ফিরে খোজ করবার চেষ্টা করবেন না তিনি কোথায় ছিলেন বা কোথায় উঠেছিলেন, কারণ আজ কোনাে চেষ্টাতেই সেই তথ্য জানতে পারব না। শুধু শেখ সাহেব একাই নয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সাত নেতা আগেই শেখ সাহেবের সঙ্গে মিলিত হতে কলকাতা গেছিলেন এবং কলকাতাতেই একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়ে গেছে। অবশ্য আজ এখন সকলেই আবার যে যার জায়গায় চলে গেছেন। আর শেখ সাহেবকে এখন দেখলে খুব নিকটতম ব্যক্তি ছাড়া কেউ চিনতে পারার সম্ভাবনা নেই, কারণ—চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। দীর্ঘ সময় ধরে নানা কথার মধ্যে যা বােঝা গেল, তার সার কথা হলাে, ২ এপ্রিল শেখ মুজিবর রহমান আগরতলা সীমান্ত পার হন। তারপর ২ ও ৩ তারিখের মধ্যে কলকাতা আসেন এবং সামান্য সময়ের জন্য দলের বিশিষ্ট নেতাদের সঙ্গে মিলিত হন। তারপর যান যশােহর সীমান্তে, তারপর চুয়াডাঙা, মেহেরপুর ও কুষ্টিয়া সীমান্তে। আর কোন প্রশ্ন করবেন না, জবাব পাবেন না। তবে একটা কথাই শুধু জেনে রাখুন—শেখ সাহেব যেমন গ্রেপ্তার হন নাই—তেমনি কোন রাষ্ট্রে আশ্রয়প্রার্থী হয়েও যান নাই। একদল সশস্ত্র লােক শেখ সাহেবকে তার ধানমুণ্ডির বাড়ি থেকে বের করে আনে—তাদের দেখে অনেকের ধারণা হয় ওরা বুঝি ইয়াহিয়া খার লােক ছিল। আসলে তারা ছিল মুক্তিবাহিনীরই লােক। শেখ সাহেব আপত্তি করলেও ওরা তাকে বাড়ি থেকে বের করে আনতাে এবং বলা যায় এনেছিলও তাই।
এরপর আমি প্রশ্ন করেছিলাম যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের কী হবে। কতদিন যুদ্ধ চলবে? উত্তর দিলেন তিনি—জয় তাে আমাদের হয়েই গেছে। আমাদের যুদ্ধ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যায় শােষণ পীড়ন অত্যাচার থেকে নিজেদের মুক্ত করা। সেই মুক্তি বাঙলাদেশের মানুষ পেয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবী চক্র আর কোনদিনই আমাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে পারবে না, কারণ দ্বিজাতিতত্ত্বের যে শিকলে বেঁধে আমাদের শােষণ করা হতাে সেই শিকল ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। প্রশ্ন করলাম কিন্তু কতদিন এই যুদ্ধ চলবে? এই যুদ্ধ চলবে বহুকাল। যদি কেউ ভাবেন তিন দিন পরে সব মিটে যাবে তাহলে তারা মূখের স্বর্গে বাস করছেন।
সিপাহী বিদ্রোহ শুরুর কথা মনে আছে? সিপাহী বিদ্রোহ শুরু করেছিল মঙ্গল পাড়ে বারাকপুরে, মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে। আমাদের যুদ্ধও শুরু হয়েছে মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে, উত্তর দিলেন তিনি। তারপর কলকাতা ফিরে এসে আতিপাতি করে খোঁজ করতে সুরু করি। সত্যি ৩ এপ্রিল কলকাতায় মুজিবুর ও তার অন্য সঙ্গীরা এসেছিলেন। এ ছাড়াও পরে জেনেছি অনেক তথ্য, তবে তার মধ্যে প্রধান হলাে—গত ৩ আগরতলা থেকে সত্যই একজন কলকাতা এসেছিলেন। এছাড়াও বেশ কয়েকজন নেতা এসেছিলেন এই কথও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে। তার মধ্যে একজন নেতা ৩ তারিখের পরও দুই-একদিন ছিলেন। এই নেতৃবৃন্দের মধ্যে একজন সাংবাদিক ছিলেন তিনিও দুই-একদিন বেশি কলকাতায় ছিলেন। এর চেয়ে বেশি জানবার চেষ্টা করিনি—সংবাদের আরাে সত্যতা সম্পর্কে যাচাই-এর চেষ্টা করি নাই। কিন্তু এর পরই প্রথমে কৃষ্ণনগর থেকে, পরে আরাে দুই-একটি জায়গা থেকে সংবাদ প্রকাশ হয় যে, এখানে নাকি শেখ মুজিবুর এসেছিলেন হয় বাংলাদেশ সরকার গঠিত হচ্ছে। অন্য কোন সূত্রে না হােক বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুজিবুরের উপস্থিতির সংবাদ ও সরকার গঠনের সংবাদে অন্তত আমার সংবাদের সমর্থন পাওয়া যায় যে, হা সত্যই মুজিবুর কলকাতা এসেছিলেন।

সূত্র: সপ্তাহ, ১৬ এপ্রিল ১৯৭১