You dont have javascript enabled! Please enable it!

শিরোনামঃ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা প্রতিষ্ঠার পক্ষে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদীর প্রেস বিজ্ঞপ্তি

সুত্রঃ মর্নিং নিউজ, ২৮শে এপ্রিল ১৯৪৭। সূত্র- শীলা সেন, মুসলিম পলিটিক্স ইন বেঙ্গল। পৃষ্ঠা- ২৮১

তারিখঃ ২৭শে এপ্রিল, ১৯৪৭

 

. ২৭ এপ্রিল, ১৯৪৭এ নয়া দিল্লীতে মুখ্যমন্ত্রী এইচ. এস. সোহরাওয়ার্দীর কর্তৃক প্রদানকৃত সংবাদ বিবৃতির নির্যাস

 

যারা সাগ্রহে বাংলার কল্যাণ ও উন্নতির আশা করেছিলেন তাদের জন্য এটা পাওয়া খুবই পরিতাপের বিষয় যে বাংলা ভাগের জন্য কিছু আবাস স্থলে আশংকাজনক ভাবে প্রবল চেষ্টা করা হচ্ছে। এই ক্রন্দন কখনোই উঠত না যদি হিন্দুদের কিছু অংশে হতাশা ও অস্থিরতা না থাকত যেহেতু প্রদেশে তাদের সংখ্যা, সম্পদ, প্রভাব, শিক্ষা, প্রদেশের প্রশাসনে অংশগ্রহন, প্রচার এবং তাদের সহজাত বল থাকা সত্ত্বেও বাংলা মন্ত্রণালয়ে তাদের সম্প্রদায়ের সদস্যদের যথাযথ অংশিদারিত্ব নেই।

বাংলার বর্তমান অবস্থা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য প্রযোজ্য না যেমন বাংলা হবে আমি আশা করি, এটি অনুধাবন করার ব্যর্থতাই মূলত এই হতাশা সৃষ্টির জন্য অনেকাংশে দায়ী। আজ ভারতে আমরা সারা ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী দলসমূহের সংগ্রামের মাঝে আছি। প্রত্যেকে তার মতামত অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে থাকে এবং কেউই ছাড় দিতে রাজি নয় যদি না অন্যদল এমন মূল্য দিতে পারে যা দেওয়ার জন্য তারা প্রস্তুত নয়।

তাদের সঙ্ঘাত গভীরভাবে সব প্রদেশের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলে এবং এই সমস্যাগুলো সামগ্রীকভাবে মধ্যস্থতা করা হয়। যখন প্রতিটি প্রদেশের নিজে নিজেকে পরিচালনা করতে হবে এবং যখন প্রতিটি প্রদেশ নিশ্চিতভাবে প্রয়োগিক হয়, যদি পূর্ণ স্বাধীন না হয়, তখন সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থার সৃষ্টি হবে এবং বাংলার জনগনকে একে অপরের উপর নির্ভর করতে হবে।

এটা অবিশ্বাস্য যে এমন অবস্থা চক্রের মাঝেও বাংলায় একটি মন্ত্রণালয়ের অস্তিত্ব থাকতে পারে যেটা সমাজের সব গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের মিশ্রণ নয় অথবা যেটা সাম্প্রদায়িক দলের মন্ত্রণালয় হতে পারে অথবা যেখানে বিভিন্ন অংশের যে প্রতিনিধিত্ব বর্তমানে যেমন আছে তার চেয়ে ভাল হবে না। আমি মনে করি না যে, খুবই সামান্য ব্যবধানের সংখ্যা গরিষ্ঠতার ফলে মন্ত্রণালয়ে মুসলমানদের যে সামান্য আধিক্য রয়েছে এই তথ্যটি হিন্দুদের গাত্রদাহের কারণ হবে যেহেতু প্রকৃতপক্ষে এযাবতকাল পর্যন্ত বাংলার প্রকৃতিতে এটি সহজাতভাবে প্রচলিত।

হিন্দু জনগণের সাথে কথিত আচরণ নিয়ে বাংলা সরকারের বিরুদ্ধে সবেচেয়ে তপ্ত সমালোচনা আমি পড়েছি। সবচেয়ে ঠুনকো ও কল্পনার উপর ভিত্তি করে এই প্রকাশ্য সমালোচনা সমূহ গড়ে উঠেছে। বিভাজনের দাবি, বাংলার অধিকাংশ হিন্দুদের কথা বাদ দিলাম, এমনকি পশ্চিম বাংলার অধিকাংশ হিন্দুদেরও এই দাবি তা আমি কোনভাবে স্বীকার করব না।

বাংলার প্রতিটি অংশে হিন্দুদের বন্ধন ও সংস্কৃতি এত সদৃশ যে ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে এসব বন্ধন ভাঙ্গা বাংলার এক অংশের হিন্দুদের জন্য সুবিধাস্বরুপ হয় না। প্রকৃতপক্ষে এই সাদৃশ্য অনুসারে বিভাজনের প্রশ্ন বাংলার সব মানুষ তথা মুসলমান, হিন্দু, উপজাতি এবং অন্যান্যদের মতামত অনুসারেই নিরুপন করা উচিত যা শুধুমাত্র তখন চেষ্টা করা যায় যখন তার পক্ষে তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যাধিক্য থাকে।

 

এই মুখ্য উপাদানগুলোই বাংলার জন্য বিশেষ যা বাংলা ভাগের প্রশ্ন মুসলিমদের ভারত ভাগের প্রশ্ন থেকে আলাদা করেছে, তবে অর্থনৈতিক ঐক্য, পারস্পরিক আস্থা এবং শক্তিশালী কার্যকর রাষ্ট্র তৈরীর প্রয়োজনীয়তার মত উপাদানগুলো ব্যতিরেকে। বিভাজনের নেতৃত্ব হিন্দু মহাসভা নিয়েছে যা আশা করে যে বাংলা ভাগের আশংকার চাবুক পরিচালনা করে, বাংলা মন্ত্রী পরিষদ ভাঙ্গার জন্য, ৯৩ এর ধারা আরোপ, আঞ্চলিক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা, মুসলমানদের বিরুদ্ধে ধর্মান্ধতা সৃষ্টির দ্বারা, হরতাল ও সহিংসতার মাধ্যমে বিশৃংখলা সৃষ্টির দ্বারা তারা হিন্দুদের দৃষ্টি তাদের দিকে ফেরাতে পারবে এবং কংগ্রেসের প্রভাব ধ্বংস করতে পারবে। হিন্দু মহাসভা দৃশ্যপটে ফেরার কামনা করে এবং কতিপয় নেতাও এই কামনা করে যারা নিজেদের জন্য বিন্দুমাত্র জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না।

*                                                                       *                                                           *

কিন্তু আমাদের আরো একবার দাবিটির নিজের বৈধতা বিবেচনা করতে দিন। কেন বাঙ্গালি হিন্দুদের উচিত আলাদা মাতৃভূমি দাবি করা?

বর্তমানে আমাকে একটা অনুমান করতে দিন যে এই দাবিটি শুধু গুটিকয়েকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং হিন্দুদের সকল জাত, উপজাতি ও নিজেদের জাতে না ফেরা মানুষদের দ্বারা সামনে আনা হয়েছে। বর্তমান শাসন আমলে তাদের সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষা কোনটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি এবং তারা কিভাবে ভাবে যে ভবিষ্যত কাঠামোয় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার ফলে তারা শুধু মাত্র তখনই তাদের সংস্কৃতি ও জীবনের উন্নতি করতে পারবে ও নিরাপদ থাকবে যদি তাদের পশ্চিম বঙ্গের ছোট একটা অংশ থাকে। আমার মতে, আমি মনে করি হিন্দুদের দৃষ্টিকোন থেকে এই দাবিটা আত্মঘাতি। এমনকি যদি তা ঘটে, একটি ঘটনাক্রম যা আমি কল্পনা করতে পারি না, যে এককভাবে মুসলমানদের দ্বারা পাসকৃত আইন, এবং মনোভাব যা সমগ্র হিন্দুদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাড় করিয়েছে, এমন পন্থা সফল করা অথবা কার্যকর করা কি সম্ভব, যেখানে বাংলার যেকোন সরকারকে নিজেদের কর্মচারিদের তার সাথে বহন করতে হয় এবং তাদের অধিকাংশই হিন্দু সম্প্রদায়ের? তারপরও আবার, শিল্প, ব্যবসা, পেশাসমূহ তাদের হাতেই আছে। তাদের তরুনরা ভালভাবে অগ্রসর এবং তাদের অধিকার কী জানে এবং জানে কিভাবে তাদের দাবি করতে হয়। তাদের বর্তমান মনোভাব শুধুমাত্র অস্থিরতা ও হতাশার কারণে সৃষ্ট নয়, শুধুমাত্র অদূরদর্শিতা নয় বরং এটা হল পরাজিত মনোভাবের স্বীকারোক্তি যা বাংলার মহান হিন্দু সম্প্রদায় থেকে কদাচিত আশা করা যায়।

স্বাধীন রাষ্ট্রের কাঠামোতে কী ঘটতে পারে তার উদাহরণ হিসেবে সর্বদা নোয়াখালির কথা উল্লেখ করা হয়। আমি ইতোমধ্যেই বলেছি যে বর্তমান কাঠামো থেকে ভবিষ্যত নির্ণয় করা হাস্যকর কিন্তু আসুন এখানে কিছুক্ষনের বিরতি নেই। নোয়াখালি ও এই এলাকার ঘটনা কি আদর্শ স্বরুপ ও ভবিষ্যতের পূর্বাভাস রুপে ভাবা যেতে পারে, এবং এখানে কি আরও জেলা নেই যেখানে মুসলমানরা বিশ্বাসজনক ও অভাবনীয়ভাবে সংখ্যা গরিষ্ঠ কিন্তু তারপরও সে জেলাগুলোতে শান্তি বিরাজ করছে, পূর্বের মতই কি হিন্দুরা তাদের ক্ষমতা ও সুবিধা ভোগ করছে না?

এবং একটু ক্ষনের জন্য বিরতি নেই বাংলা কী হবে বিবেচনা করতে যদি তা সংযুক্ত থাকে। এটা বিখ্যাত দেশ হবে, প্রকৃতপক্ষে ভারতে সবচেয়ে ধনী ও উন্নয়নশীল যা তার জনগণকে উন্নত জীবন মান প্রদানে সক্ষম হবে, যেখানে অধিকাংশ লোক তাদের যোগ্যতার চুড়ান্ত সীমায় উঠতে পারবে, একটা ভুমি যা সত্যিই প্রাচুর্যে পূর্ণ হবে। এটি কৃষিতে উন্নত হবে, শিল্প ও বাণিজ্যে উন্নত হবে এবং সময়ের পরিক্রমায় বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হবে। যদি বাংলা একত্র থাকে তবে তা স্বপ্ন ও কল্পনা থাকবে না।

 

যে কেউ যে তার পুঁজি ও বর্তমান উন্নয়ন অবস্থা দেখে অবশ্যই একমত হবে যে এটা অবশ্যই পাস হওয়ার অবস্থায় আসা উচিত যদি আমরা নিজেদের হত্যা না করি। অতএব, আমি পুরোটা ঠাহর করতে পারি যে বাংলা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং ভারতীয় কোন জোটের অংশ নয়। যদি এমন রাষ্ট্র গঠিত হয় তবে তাদের ভবিষ্যত তাদের উপরই নির্ভর করবে। আমি কখনোই ভুলতে পারব না ১৯৪৩ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষ অনুধাবন করতে ভারত সরকার কত দীর্ঘ সময় নিয়েছে, বাংলায় প্রবল অভাব থাকতেও কিভাবে প্রতিবেশী প্রদেশ বিহার খাদ্য শস্য দিতে অস্বীকার করেছে, ভারতের তখনকার প্রতিটি প্রদেশ কিভাবে তাদের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল, এবং বাংলাকে তার সাধারণ অপরিহার্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করেছিল, ভারতীয় সম্মেলনে কিভাবে বাংলাকে অমর্যাদার কোনে নিক্ষেপ করেছিল যখন অন্যান্য প্রদেশ অযৌক্তিক কর্তৃত্ব ফলিয়েছিল।

না, যদি বাংলা গুরুত্বপূর্ণ হতে চায়, তবে এটা একমাত্র তখনই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারবে যদি সে নিজের পায়ে দাঁড়ায় এবং একে মহাকরণে সবাই একত্রিত হয়। তাকে অবশ্যই তার সম্পদ, ধন এবং তার ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হতে হবে। তাকে অবশ্যই অন্যদের দ্বারা শুষিত হওয়া বন্ধ করতে হবে এবং ভারতের বাকি অংশের সুবিধার জন্য দুর্ভোগ পোহানো আর অবিরত রাখা যাবে না। অতএব হিন্দুদের মধ্যে যারা বাংলা ভাগ নিয়ে আস্তে কথা বলে তাদের প্রতি আমার অনুরোধ তারা যেন সীমাহীন ভণ্ডামিতে পূর্ণ এই আন্দোলন বাদ দেয়। নিশ্চিতভাবেই, সরকারে কিছু পদ্ধতি আমাদের সকলের একত্র আলোচনার দ্বারা তৈরি হতে পারে যা সব অংশের লোককে সন্তুষ্ট করবে এবং বাংলার যে দ্যুতি ও গৌরব ছিল তা পুনরুজ্জীবিত করবে।

  • (উৎসঃ মর্নিং নিউজ, ২৮ এপ্রিল, ১৯৪৭.)
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!