বাংলার বাণী
৯ই জানুয়ারী, ১৯৭৩, মঙ্গলবার, ২৫শে পৌষ, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ
গণতান্ত্রিক নির্বাচন ও সংশ্লিষ্ট সব্বার দায়িত্ব
বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের কর্মসূচী ঘোষণা করে প্রধান নির্বাচনী কমিশনার বিচারপতি মোহাম্মদ ইদ্রিস গত ৭ই জানুয়ারী এক বেতার ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের মানুষ যে অপূর্ব ত্যাগ ও সাধনার পরিচয় দিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে সাড়ে সাত কোটি মানুষ সেই সুনাম অক্ষুন্ন রাখবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন। নির্বাচনী কর্মসূচী অনুযায়ী আগামী ৩১শে জানুয়ারী জাতীয় সংসদে নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র আহ্বান, ৫ই ফেব্রুয়ারী মনোনয়নপত্র দাখিলের তারিখ, ৬ই ফেব্রুয়ারী মনোনয়নপত্র বাছাই এবং ৮ই ফেব্রুয়ারী মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ তারিখ হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে। কিছু ব্যক্তি এবং গোষ্ঠী বিশেষের সকল অপপ্রচারকে মিথ্যে করে দিয়ে বিচারপতি জনাব ইদ্রিস বলেন, ‘আমাদের দিক থেকে আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিয়োজিত সকল কর্মচারী সততা ও সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতার সাথে নির্বাচন কার্য পরিচালনা করবেন। আজ পর্যন্ত আমাদের কোন কাজে কেউ বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেন নি। এবং আমরা কোনরূপ হস্তক্ষেপ করতে দিতাম না।’
প্রধান নির্বাচনী কমিশনারের উক্তি স্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন। সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচন গণতন্ত্রেরই পূর্বশর্ত। গণতান্ত্রিক বিকাশেই এই মূলনীতিকে সামনে রেখেই নির্বাচন কমিশন তাদের কাজে এগিয়ে চলেছেন। আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক অবস্থা এবং পরিবেশ কোনদিনই বিকাশ লাভ করেনি। পূর্বতন ঔপনিবেশিক শাসকচক্র স্বীয় প্রয়োজনেই মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে স্বীকার করে নেয়নি। স্বাধীনতা উত্তরকালে বঙ্গবন্ধু তথা আওয়ামী লীগ সরকার তাদের পূর্ব ওয়াদাকে সামনে রেখেই নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। প্রশাসনকে নির্বাচনী কমিশনের কাছ থেকে সম্পূর্ণ দূরে রেখে তারা সুষ্ঠু এবং অবাধ গণতান্ত্রিক নির্বাচন গ্রহণের নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন। এরপর যা থাকে তা হলো সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের দায়িত্ব এবং কর্তব্যবোধ।
সংসদীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব এবং কর্তব্য সমধিক। গণতন্ত্রের সাধারণ নীতিমালা মেনে রাজনৈতিক সংগঠনগুলো নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করবেন এটাই স্বাভাবিকভাবে আশা করা যেতে পারে। কিন্তু নির্বাচনকে সামনে রেখে কিছু কিছু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের গণতন্ত্র বিরোধী কার্যকলাপ জনগণকে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত সম্পর্কেই আশঙ্কিত করে তুলতে সহায়তা করছে। সুস্থ মনন এবং মানসিকতা নিয়ে রাজনৈতিক দলসমূহকে আজ এগিয়ে আসতে হবে। বিরোধী দলসমূহকে সুস্পষ্ট প্রস্তাব নিয়ে জনগণের সামনে তা পেশ করতে হবে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোধা আওয়ামী লীগ নির্বাচনে তাদের কর্মসূচী প্রণয়নের জন্য আগামী ১১ই জানুয়ারী এক বৈঠকে মিলিত হবে। আওয়ামী লীগের এই কর্মসূচীর প্রতি জনগণের সমর্থন রয়েছে কি না তা জানা যাবে ৭ই মার্চ অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনে। অন্যান্য রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছেও আমাদের অনুরোধ, নিজ নিজ দলের কর্মসূচী প্রণয়ন এবং তা সাধারণ নির্বাচনে জনগণের অনুমোদন লাভের গণতান্ত্রিক মানসিকতা প্রদর্শন করুন। অপপ্রচারে ধুম্রজাল সৃষ্টি করে অথবা নোংরামীর আশ্রয় নিয়ে আর যাই হোক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনে সহায়তা করা যায় না। দেশী বিদেশী নানা চক্রান্তের বেদীমূলে নিজেদের অর্পণ না করে সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখার জন্য আমরা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সব্বার কাছে আর একবার আকুল আহ্বান জানাই। এভাবেই বাংলাদেশের স্থায়িত্ব শান্তি, এবং অগ্রযাত্রাকে নিশ্চিত করা সম্ভব।
০০০
একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ
বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা খাতে ব্যয়ের জন্যে তিনশত কোটি টাকার একটি বৃহৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন বলে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি সংবাদে জানা গেছে। দেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ পৌঁছে দেবার জন্যে প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনায় এই কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হবে বলেও জানানো হয়েছে। দেশের জনগণের স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্যে প্রতিটি পরিবারকে এই পরিকল্পনার কর্মসূচীর আওতায় গ্রহণ করা হবে। ইতিমধ্যেই সরকার জনগণের স্বাস্থ্যের উন্নয়নের উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। দেশের আধুনিক চিকিৎসা ও পরিকল্পিত পরিবার গঠনের মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এ সিদ্ধান্ত সরকার গ্রহণ করেছেন বলেও সংবাদে বলা হয়েছে। পাকিস্তান আমলে জনস্বাস্থ্যের খাতে মাত্র তিন ভাগ টাকা ব্যয় করা হতো। সে ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার বহু টাকা ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বস্তুতঃ বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে উন্নত করার প্রয়োজন অত্যাবশ্যক। একটি পরিকল্পিত চিকিৎসা ব্যবস্থার মাধ্যমে এদেশের জনগণের স্বাস্থ্যের উন্নয়ন করতে হবে। বর্তমানে মানুষের নানাবিধ অসুবিধার মধ্যে চিকিৎসার অভাব অন্যতম। সুচিকিৎসা ছাড়া যেমন স্বাস্থ্যের নিয়শ্চতা ছাড়া একটি সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশ গঠনও সম্ভব নয়। বর্তমান বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোতে যে সকল সকল সমস্যা আজ সবচেয়ে প্রকট তার অন্যতম হলো চিকিৎসা ব্যবস্থা। মানুষের চিকিৎসার নিশ্চয়তার অধিকার একটি মৌলিক অধিকার বলে গণতান্ত্রিক বিশ্বে স্বীকৃত। জীবন ধারণের অধিকার যেমন জন্মগত, চিকিৎসার অধিকারও তেমনি জন্মসূত্রেই স্বীকৃত। অনুন্নত দেশসমূহ আজ এই চিকিৎসা ব্যবস্থাকে দ্রুত উন্নত করার জন্যে তৎপর হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশও এমনি একটি চিকিৎসার অব্যবস্থার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। স্বাধীনতা পূর্বকালে পাকিস্তান সরকার এদেশের চিকিৎসার উন্নয়নের জন্যে তেমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এদেশের অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসার কষ্টে যে অসংখ্য মানুষ বহু যুগ ধরে দুঃসহ জীবন যাপন করে আসছে তার থেকে মুক্তি দেবার জন্যে আজ সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। সরকার একটি মহান বিপ্লবের পর ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। চিকিৎসার অধিকার যেহেতু এটাকে নিশ্চিত করার জন্যেও প্রয়োজনীয় কার্যক্রমের উদ্ভাবন করতে হবে সরকারকে। অন্যথায় দেশের মৌল উন্নয়ন ব্যাহত হতে বাধ্য। মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতি ছাড়া একটি সজীব জাতি বা সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। আমাদের দেশ সমাজতন্ত্রের মহান আদর্শ বাস্তবায়নের জন্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকার ও তাঁর দল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। সমাজতান্ত্রিক আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে যদি আমরা চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা চিন্তা করি তাহলে অবশ্যই প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারের মতই চিকিৎসা ব্যবস্থারও নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। প্রতিটি মানুষ যাতে করে চিকিৎসার সুযোগ পায় তার বিধান করতে হবে। দেশের মানুষের স্বাস্থ্যকে রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিবেচনা করে কার্যক্রম প্রণয়ন করতে হবে। বর্তমান সরকার তিনশত কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নয়নের যে বৃহৎ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন তা অত্যন্ত কার্যকরী পদক্ষেপ। একটি পরিকল্পিত স্বাস্থ্য উন্নয়নের নীতির মাধ্যমে দেশের প্রতিটি মানুষের জীবনে চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হেকা এটাই আমাদের কামনা।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক