You dont have javascript enabled! Please enable it!

একাত্তরের সংক্ষিপ্ত জবানবন্দি | সৈয়দ মইনুর রহমান

আমি মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মইনুর রহমান, পিতা মরহুম মুক্তিযোদ্ধা ডা. সৈয়দ ওবায়েদুর রহমান, সৈয়দ মঞ্জিল-১১০, শায়েস্তানগর পৈলরোড হবিগঞ্জ, বর্তমান- ১৭/১ নূরানী, বনকলাপাড়া, সুবিদ বাজার, সিলেট। আমি স্বাধীনতাযুদ্ধে একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা, তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র, সিলেট রণাঙ্গনে ৪নং সেক্টরের জালালপুর সাব সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করি। সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মাহবুবুর বর সাদী (পরবর্তীতে বীর প্রতীক)। বৃহত্তর সিলেটে একমাত্র আমরাই বাবা-ছেলে একত্রে একই ক্যাম্পে থেকে যুদ্ধ করছি। পিতা সন্তানদেরকে সব সময় নিরাপদে রাখেন। আমার বাবা দেশের স্বার্থে আমাকে হাতে ধরে যুদ্ধে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমার বাবা মরহুম ডা. সৈয়দ ওবায়েদুর রহমান ১৯৪৭ এর আগে কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। দেশ ভাগ হওয়ার পর নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ময়মনসিংহের সরকারি হসপিটালে চাকরিরত অবস্থায় বাবার সিলেটের বিশ্বনাথ থানার এক বন্ধুর অনুরোধে চাকরি ছেড়ে বিশ্বনাথে চলে আসেন। বিশ্বনাথে তখন কোনো ভালো ডাক্তার ছিলো না, কবিরাজদের উপরই সবাই নির্ভর ছিল। বাবা বিশ্বনাথের ফাউন্ডার আওয়ামীলীগার। কর্ণেল আতাউল গনি ওসমানীর সঙ্গে বিশ্বনাথের বালাগঞ্জে আওয়ামী লীগের কর্মকান্ড শুরু করেন। ঊনসত্তরের গণ আন্দোলন সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাত্রি পর্যন্ত রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। পাক সেনা একাত্তরের বর্বর অত্যাচারের সময় বাবা তাদের ওয়ানটেড ছিলেন, ধরতে পারলে মেরে ফেলত অবশ্যই। কিছুদিন আত্মগোপনে থেকে পরে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। জালালপুর সাব সেক্টরের মোডিক্যাল অফিসার হিসাবে নিয়োগ পান। সিলেট শহরে আমাদের বাসা ছিল। চার ভাই এক বোনের বড় আমি, আমরা সিলেটেই লেখাপড়া করতাম। ২৫ মার্চ আক্রমণের ৩/৪ দিন পর শহর ছেড়ে বিশ্বনাথের পশ্চিম দিকে গ্রামে চলে যাই। এপ্রিলের মাঝামাঝি বাসার অবস্থা দেখার জন্য সিলেট আসি। সিলেট শহরের প্রবেশমুখ চভিরপুল নামক স্থানে পাক বাহিনীর চেকপোস্টে গাড়ি থেকে নামিয়ে সবাইকে চেক করত। গাড়ি থেকে নামতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল, এক সেনা আমার পিঠে রাইফেলের বাট দিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করে। এতে আমি রাস্তায় পড়ে যাই। মনে হয়েছিল মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছে। ব্যথায় চোখে পানি এসে যায়। সবাইকে লাইনে দাঁড় করায়, আমিও কোনোক্রমে উঠে লাইনে দাঁড়ালাম। কলেমা বলতে হবে। সবাই কলেমা শুনালো, আমার নিকট যখন এল রাগে, ব্যথায় ও ভয়ে মুখে কলেমা শুদ্ধ করে বলতে পারলাম না, কী মনে করে আর মারধর করে নাই। মার খেয়ে মনে জেদ আসল, এর প্রতিশোধ নিতে হবে। বাবার প্রেরণা মনের জেদ টুকুই মুক্তিযুদ্ধে শক্তি যুগিয়েছে। বাসায় গিয়ে দেখি সব কিছু লুটপাট হয়ে গেছে। বাসা খালি পড়ে আছে। ভারতে চলে যাব ঠিক করেছি। এরই মধ্যে খবর পেলাম সিলেটের জগন্নাথপুর থানার শ্রীরামসি বাজার ও পাশ্ববর্তী এলাকা নিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে কিছু মুক্তিযোদ্ধা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। আমি তাদের সঙ্গে যোগ দেই। কমান্ডিংয়ে ছিলেন আনছার কমান্ডার তুরণ মিয়া জায়গীরদার। অস্ত্র বলতে কয়েকটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল, কিছু একনলা, দুনলা বন্দুক। বাজারের ও আশপাশের গ্রামের লোকজনকে ট্রেনিং দিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে। গ্রামের লোকজনকে বেসিক ট্রেনিং করাননা এবং অস্ত্র চালনা শেখাননা। কয়েক গ্রাম দূরে এক ডাকাতের খবর পাওয়া গেল। কমান্ডার বললেন ডাকাতের নিকট নিশ্চয় অস্ত্র পাওয়া যাবে, তাকে আক্রমণ করার দিন ঠিক করা হলো। খবর নিয়ে জানা গেল বাড়িতে আছে, তার নাম ছিল ময়না ডাকাত। তার বাড়ি রেইড করা হলো। সে বাড়িতেই ছিল। বিপদ দেখে গুলি না করে পালিয়ে যেতে চাইল। হাতের অস্ত্রসহ সারেন্ডার করার জন্য বলা হলো। সারেন্ডার না করে হাতের রাইফেল উচিয়ে ধরল, আমরা ভেবেছি গুলি করবে। সুযোগ না দিয়ে আমরা গুলি চালালাম, সে মারা পড়ল। তার বাড়ি থেকে দুইটি রাইফেল, দুইটি একনলা বন্দুক, কিছু গুলি জব্দ করা হলো। এক মাস ছিলাম শ্রীরামসিতে আমার নিকট এসব সুবিধা মনে হলো না, তাই বিদায় নিয়ে চলে গেলাম। এক লোক টাকার বিনিময়ে ভারতের করিমগঞ্জে পৌছে দেবে। সে এপার ওপার লোক আনা নেওয়া করে, ঐ লোকের সঙ্গে আল্লাহর নাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার জন্য। মা, ছোট ভাই বোনদের প্রয়োজনীয় রসদ কিনে দিয়ে যাই। শহর বাজার এড়িয়ে অনেক কষ্টে সুতারকান্দি সীমান্তের ছোট একটা হাওরের জলাশয় নৌকায় করে পাড়ি দিচ্ছি। অনেক দূর থেকে রাজাকার টহলদল দেখে ফেলে, নৌকা দিয়ে দ্রুত আমাদের দিকে আসতে থাকে। বিপদ দেখে পানিতে ঝাপ দেই। প্রাণপণে সাঁতরাতে থাকি। আমাদেরকে পালাতে দেখে দুই রাউন্ড গুলি ছুড়ে। ততক্ষণে স্থল ভাগে পৌছে যাই। তারপরও দৌড়াতে থাকি অনেকক্ষণ ধরে। কিছু লোক জমিনে চাষাবাদ করছে, তারা বলল আর দৌড়াতে হবে না। সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের অনেক ভিতরে এসে গেছ, এখন তোমরা নিরাপদ। গ্রামের একটি পুকুরে শরীরের কাদামাটি ধুয়ে পরিষ্কার করি। আরও বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর পাকা রাস্তা গেলাম। ঐখান থেকে রিক্সাযোগে করিমগঞ্জে এসে পৌছাই। করিমগঞ্জ শহরে এসে পৌছানোর পর অনেক বাংলাদেশি পেলাম, অনেক পরিচিতও পেলাম। একটা রেস্টুরেন্টে বসিয়ে চাটনি দিয়ে সিঙ্গারা ও চা খাওয়ালেন পরিচিত একজন। সবাই দেশের খবর জানতে চাইলেন। বাবার রাজনৈতিক বন্ধু সাবেক এমপি এডভোকেট নুরুল ইসলাম চাচার সঙ্গে দেখা করি। সব নেতারাই হােটেলে অথবা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন। নুরুল ইসলাম চাচা ইয়ুথ ক্যাম্পের একটি রুমের মেঝেতে বিছানা করে থাকতেন। আমাকে বললেন আপাতত কিছুদিন এখানে থাক, তারপর দেখা যাবে কী করবে। করিমগঞ্জের গৌরি হোটেল একটা অভিজাত হোটেল। সব বড় নেতাগণ উক্ত হোটেলেই আড্ডা জমিয়েছেন। ইয়ুথ ক্যাম্পে ৪/৫ দিন থাকার পর জানতে পারলাম করিমগঞ্জ সরকারি হাসপাতালে বেশ কিছু যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সেবার অভাবে কষ্ট পাচ্ছেন। নুরুল ইসলাম চাচাকে বলে হাসপাতালের কাজে লেগে গেলাম। নুরুল ইসলাম চাচা মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক হিসাবে কাজ করতেন। বাবা ডাক্তার। বংশগত ভাবেই নার্সিংটা শেখা ছিল। হাসপাতালে একটা ওয়ার্ডে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মারাত্মকভাবে আহত হয়ে বিছানায় পড়ে কষ্ট পাচ্ছেন। মাইন বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন, দুইজনের দুটো হাতই কনুইর নিচ পর্যন্ত উড়ে গেছে। একজনের বুকের পাজরের বেশ কয়েকটা হাড় ভেঙে ক্ষত বিক্ষত হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্সের অভাব। চিকিৎসার মানও ভালো নয়। ওয়ার্ডের ভিতরে রক্ত, মাংশের পচা দুর্গন্ধ। কাজ করতে ডাক্তার নার্সদের সহযোগিতা পেয়েছি। ফেনাইল দিয়ে ওয়ার্ড পরিষ্কার করলাম। ডিডিটি পাউডার ছিটালাম। ফেনাইলের জন্য গন্ধ কিছুটা সহনীয় হয়ে এসেছে। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের যন্ত্রণা কাতরানি এখনও কানে বাজে। আমি রাতের ডিউটি করতাম, নার্স ব্রাদারদের সঙ্গে। ২০/২৫ দিন হাসপাতালে ডিউটি করেছি। আমি থাকতেই গুরুতর আহত তিনজনকে সোভিয়েত ইউনিয়নে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। হাসপাতালেও মন টিকলনা। যুদ্ধে যাওয়ার বাসনাই ছিল বেশি, এর ভিতরে বাবা এসে আমাকে নিয়ে গেলেন জালালপুর সাব-সেক্টরে। ঐখান থেকে ট্রেনিং সেন্টারে ২৮ দিন ট্রেনিং দিলাম নিয়মিত এবং জেএলডাবলিউ। আধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত বিশ্বের সেরা বাহিনীদের কাতারের ঐ পাকবাহিনীর সঙ্গে আমাদের এই ট্রেনিং বলতে গেলে খেলার মতো। তারপরও এই ট্রেনিং এবং দেশপ্রেম নিয়ে শত্রু বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়লাম। বাবার দেশপ্রেম যে কত বিশাল ছিল তার প্রমাণ। সব বাবাই চায় সন্তানরা নিরাপদে থাকুক। আমি নিজেও এখন বাবা, সন্তানের স্নেহ কী বুঝতে পারছি। আমার বাবা আমাকে হাতে ধরে এনে মৃত্যুর মুখামুখি দাঁড় করিয়েছিলেন দেশের জন্য। বাবা, আমি একই ক্যাম্পে একই সঙ্গে যুদ্ধ করেছি। ধন্য আমি এমন বাবার সন্তান হতে পেরে। বাংলাদেশের ভিতরে দখলকৃত দুটি এডভান্স ক্যাম্প ছিল। একটি রঘুরচর আরেকটি কারবালা। কারবালায় ইপিআর ক্যাম্প ছিল। এসবে নিয়মিত ডিউটি দিতে হতো। একবার বের হলে বাংলাদেশের ভিতর ৪/৫ দিনও থাকা পড়ত। জঙ্গল বুটের ভিতর ভেজা অবস্থায় থাকতে থাকতে পায়ের আঙ্গুলে পচন ধরে যেত। ফুট পাওডার সব সময় পায়ে দিতে হত। মশার জন্য মশকুইটো ক্রীম হাতে পায়ে মেখে মেখে শরীরের লােম পড়ে যেত। সিলেট অঞ্চলে জোকের উৎপাত খুব বেশি ছিল। জোকে খেয়ে শরীরে রক্ত অনেক ঝরিয়েছে। যারা যুদ্ধে ছিল একমাত্র তারাই বলতে পারবেন যুদ্ধের ভয়াবহতা কী কঠিন ছিল। দিনে রেকী করে সব খবরাখবর সংগ্রহ করতে হতো, রাতে এমবুস পাতা হত। এমবুসের ফাঁদে পড়েছে শত্রু বাহিনী অনেকবার। শত্রু বাহিনীর চলার পথে মাইন পাততে হতো। যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করার জন্য ব্রিজ কালভার্ট, বিস্ফোরক দিয়ে ধ্বংস করতে হতো। হাই কমান্ডের আদেশে লােবা চা বাগানে বাংলাদেশের অংশের চা বাগানের মেশিন বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। যুদ্ধের ছোট বড় অনেক ঘটনা লিখে শেষ করার নয়। এমবুস, ফ্রন্ট ফাইট, ব্রিজ কালভার্ট ধ্বংস করতে গিয়ে আমাদের অনেক সাথী শহীদ হয়েছে। আমাদের হিট এন্ড রান পলিসি শত্রুকে খুব ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল। ফ্রন্ট ফাইটে বিএসএফ আমাদেরকে কভারিং ফায়ার দিত। মাঝে মাঝে ফায়ার করার সময় সেলগুলো ভুল করে আমাদের উপরই এসে পড়ত। ট ইঞ্চি মর্টার আমরা বহন করে নিতাম। থ্রি ইঞ্চি মর্টার দিয়ে বিএসএফ কাভার ফায়ার দিত। খবর পেলাম আমি পূর্বে যেখানে ছিলাম শ্রীরামসি এলাকায় পাকবাহিনী বাইদ্দাদের নৌকায় করে লুকিয়ে পুরো এলাকা দখল করে নেয়। তারপর গ্রামের লোকজনদেরকে ডেকে আনে শান্তি কমিটি করার নামে। ভয়ে সবাই এসে জমায়েত হয়। বর্বর বাহিনী ১৯৭১ সনের ৩১ আগস্ট গুলি করে অনেক গ্রামবাসিকে হত্যা করে। শ্রীরামসীতে অযতনে অবহেলায় বধ্যভূমি আজও কালের সাক্ষী হয়ে আছে। ঐ আনছার কমান্ডার পালিয়ে বাঁচতে পেরেছেন। যদি আমি ঐখানে থেকে যেতাম তাহলে আমাকেও হয়তো মরতে হতো। বর্তমান প্রজন্ম হয়তো উপলব্ধি করতে পারবে না, দেশ কীভাবে স্বাধীন হয়েছে। নয় মাসের যুদ্ধ খুব কম সময় কিন্তু এত সহজ ছিল না । অনেক রক্ত ঝড়েছে। অনেক মা বোনের ইজ্জত লুষ্ঠিত হয়েছে। আমরা যারা জীবিত আছি (মুক্তিযোদ্ধা) বর্তমান প্রজন্মের নিকট সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা আমাদের দায়িত্ব। দিন যেতে লাগলো আর যুদ্ধের তীব্রতাও বাড়তে লাগলো। জালালপুর সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মাহবুবুর রব সাদী, অতিরিক্ত তদারকির দায়িত্ব দিয়ে হেড কোয়ার্টার থেকে ইন্ডিয়ান আর্মির ক্যাপটেন কুমারকে পাঠাল। যুদ্ধে লোকবলের দরকার হওয়ায় শরণার্থী ক্যাম্প থেকে যুবকদের ট্রেনিং দিয়ে যুদ্ধে পাঠাতে লাগলো। এমনি একজন সদ্য ট্রেনিং দিয়ে আসা এক মুক্তিযোদ্ধা, হিন্দু, শরণার্থী ক্যাম্পে কিছুদিন আগে বিয়ে করেছে। যুদ্ধে যেতে খুবই ভয় পেত। তাকে আর যুদ্ধে যেতে হল না। একদিন ভোরে সে প্রস্রাব করতে বের হয়েছে। কোত (অস্ত্রাগার) এর পিছনে প্রস্রাবে বসেছে। কোতের ভেতর একদল মুক্তিযোদ্ধা যারা সকালেই রণাঙ্গনে যাবে তাহারা অস্ত্রগুলো পরীক্ষা করে নিচ্ছিল। হঠাৎ একজনের রাইফেল থেকে ফায়ার হয়ে যায়, আর গুলি গিয়ে লাগে প্রস্রাব করা রত তার উপর। পিঠের পিছন দিকে ঢুকে পেট দিয়ে গুলি বের হয়ে যায়। নাড়িভূড়ি বের হয়ে যায়। শব্দ শুনে সবাই দৌড়ে বের হলাম। আমার বাবা তার নাড়ি ভুড়িগুলো ভিতরে ঢুকিয়ে বেন্ডেজ করে মরফিন ইনজেকশন দিয়ে দ্রুত হেডকোয়ার্টারে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। আমার হাত ধরে কেঁদে কেঁদে বলেছিল, আমি বাচঁবোত? তার বেদনাকাতর চোখের চাহনী এখনও মনে দাগ কাটে। বিকেলে সে লাশ হয়ে ফেরত এলো ক্যাম্পে। লাশ দেখে খুবই কষ্ট লেগেছিল। যুদ্ধে শহীদ হলে এতটা খারাপ লাগতো না। যার রাইফেল থেকে গুলি বের হয়েছিল আগে থেকেই সেটার চেম্বারে গুলি ঢোকানো (লোড) ছিল। অস্ত্র পরীক্ষা করার সময় ম্যাগজিন খালি অবস্থায় থাকে। রাজাকারদের ধরে আনলে শাস্তির বিধান ছিল গাছের সঙ্গে বেধে রাখা। একদিন পাহাড়ী মশার কামর খেলেই রাজাকারি ছেরে মুক্তিযুদ্ধের কাতারে এসে যেত। যুদ্ধ বন্দিদেরকে আমাদের ক্যাম্পে লঙ্গরখানার কাজে লাগানো হতো। এবমুসে ফেলে যেসব মিলিশিয়া পাকসৈন্য ধরা পড়ত তাদেরকে বাধ্যতামূলক ইন্ডিয়ান আর্মির নিকট হস্তান্তর করতে হতো। দেখতে দেখতে ডিসেম্বর মাস এসে গেল। ঈদের আগেরদিন ১৯ নভেম্বর ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বড় একটা দল আমাদের ক্যাম্পে এলো ৪নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তের নেতৃত্বে। পরের দিন ঈদ, ঈদের জামাতের জন্য ইমাম দরকার। লাখাইর নিজাম ভাইর উপর দায়িত্ব পড়ল ইমাম যোগাড় করার। নিজাম ভাই আমাকে সঙ্গে করে আমাদের বাহন ট্রাক্টর নিয়ে বদরপুরে মৌলভী খুঁজতে যত জায়গায় গেলাম। কোনো মৌলভী মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নামাজ পড়াবে না। ইন্ডিয়ান মুসলমানরা আমাদেরকে ভালো চোখে দেখত না। অথচ গত দুর্গাপূজার সময় করিমগঞ্জে গিয়েছিলাম। নদীর পারে সবচেয়ে বড় যে মন্ডপ তার দুই পাশে দুই বড় প্রতিকৃতি টাঙিয়ে রেখেছিল একজন নেতাজি সুভাস বসুর অন্যজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আসার পথে এক জেলে পাড়ার ছোট একটি ছনের বাসের মসজিদে খোজ নিয়ে বৃদ্ধ একজন ইমাম সাহেব পেলাম। ওনাকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করালাম। প্রায় ১২/১৩ শত মুক্তিযোদ্ধা ১ রুপি করে দিলেও ১২/১৩ শত রুপি হবে। ইমাম সাহেবকে কেউ ১ রুপি দেবেন না। ৫/১০ রুপি করেই দেবে। কথা হলো সকালে গিয়ে আনতে হবে। জামাতের পরে পৌছে দিতে হবে। উল্লেখ থাকে যে, MF যারা ১৫০ রুপি FF যারা ৭৫ রুপি বেতন ঠিক নয় হাত খরচ বলা চলে, পেতাম ক্যাম্প পাহাড়ের উপর। নিচে সমতল ভূমি গ্রাউন্ড। পরের দিন সকালে ঈদের নামাজ পড়তে সবাই প্যারেড গ্রাউন্ডে জমায়েত হয়েছি। কোন শব্দ নেই, যাকে বলে একেবারে সাইলেন্ট। সন্ধ্যা নামলেই সবাইকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে হবে। শত্রুকে মোকাবেলার জন্য, কেমন যেন সবার ভিতরে উত্তজেনা বিরাজ করছে। একে অন্যের সঙ্গে কুশল বিনিময় পর্যন্ত নেই। ঈদের জামাত শেষ হলে খুতবা ও দোয়ার পর ইমাম সাহেবের কাঁধের রুমাল রুপি দিয়ে সবাইকে ভরে দিল, ইমাম সাহেব খুশি মনে বিদায় নিলেন। জামাতের পরে বেশ কিছু আদেশ নির্দেশ দিলেন কমান্ডারগণ, দিনে কয়েকবার কিছু মহড়াও হলো। সন্ধ্যার পর পর রাতের খাবার খেয়ে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে সবাই একযোগে আক্রমণ করার জন্য বর্ডার পেরিয়ে দেশের ভিতরে ঢুকে পড়লাম। বর্ডারেই মিত্র বাহিনীর ৫/৫ গুরখা রেজিমেন্ট আমাদের সঙ্গে মিলিত হলো। রাতেই প্রচণ্ড বেগে আক্রমণ শুরু হলো। পাক বাহিনী পিছাতে থাকলো, আর আমরা মাতৃভূমি দখল করে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলাম। শত্রু বাহিনী পিছানোর সময় ব্রিজ, কালভার্ট বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা নষ্ট করে দিয়ে যাচ্ছিল যাহাতে করা সহজে এগোতে না পারি। আটগ্রাম ডাকবাংলা থেকে মাইল খানিক দূরে থাকতে আক্রমণের ধরন পরিবর্তন করা হলো। কারণ জকিগঞ্জ আক্রমণ করা যাবেনা। জকিগঞ্জ আক্রান্ত হলে পাকবাহিনী করিমগঞ্জে গোলাবর্ষণ করবে। আটগ্রাম ডাকাবাংলায় শত্রুবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ছিল। ডাক বাংলার সম্মুখ যুদ্ধে একদল অবতীর্ণ হলো। মিত্র বাহিনী সহ বাকী সবাই কিছুটা ঘুরে পিছন দিক থেকে একযোগে বাঙ্কারে ঢুকে ঝটিকা আক্রমণ শুরু করবে। শুধু বেনেট চার্জ, এই পরিকল্পনা অনুযায়ী সামনের দিকের দলে আমি পড়লাম। পিছন দিকের আক্রমণে মিত্র বাহিনী গুরখা ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং গণযোদ্ধাদের বড় দলটি কুল করে বাঙ্কারে ঢুকে বেনেট চার্জ শুরু করে। আমরা সামনের দিক থেকে বৃষ্টির মতো গোলাগুলি শুরু করে দিলাম। ভোরের আগেই যুদ্ধ শেষ। সকালে দেখা গেল শুধু লাশ আর লাশ। একটা পাকিস্তানি সৈনিকও বাঁচতে পারে নাই। বেশ কিছু গুরখা সৈন্য এবং কিছু মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন, গুরখা লাশ সকালেই ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ডাকবাংলার কাছেই গণকবর দেয়া হয়। শত্রু বাহিনীকে ডাকবাংলা থেকে একটু দূরে সরকারি গুদামের কাছে গণকবর দেয়া হয়। শত্রু বাহিনীর আহত হয়ে যারা পালিয়ে ছিল তাদের সবাইকে উদ্ধার করা হয় আশ-পাশের গ্রামগুলো থেকে। কানাইঘাট পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার পর, সর্ব কনিষ্ঠ তাই হয়তো আমাকেই বাছাই করা হলো, ভারতে ফেরত গিয়ে কোতের (অস্ত্রাগার) অস্ত্র এবং ক্যাম্প গুটিয়ে নিয়ে আসার জন্য। ক্যাম্পে কোত ইনজাৰ্চ, এক বাবুর্চি ও সহকারী ছিল। ক্যাম্পে পৌছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল, রাত কাটিয়ে সকালেই সব গুছিয়ে বাংলাদেশের দিকে যাত্রা করব। কোতের ভিতরেই ঘুমালাম, শেষ রাতের দিকে ঘুম ভেঙে যায় লোকজনের মৃদু কথাবার্তা শুকনো পাতায় পায়ের শব্দে। তাবুর ফাক দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম ক্যাম্পের কাছ দিয়ে বেশ কিছু লোক যাচ্ছে। কেউ কেউ সিগারেটও ফুকছে। অস্ত্র নিয়ে তৈয়ার থাকলাম ইনচার্য সহ আত্মরক্ষার জন্য। ওরা চলে গেল, আর ঘুম হলোনা, সকালে জায়গাটা পর্যবেক্ষণে গেলাম। যে দিকে লোকজন গিয়েছিল। সিগারেটের খালি প্যাকেট, খাকি পোষাকের ছেড়া অংশ, বুট জুতা জায়গায় জায়গায় ফেলে গিয়েছে। কোত ইনচার্জ ইপিআর ছিলেন, নিদর্শনগুলো দেখে বললেন পাকবাহিনী গত রাতে এদিকে গিয়েছে এবং সংখ্যায় অনেক। পরে আরও জানতে পারলাম ভারতের ধনী মুসলমানগণ পাক আমীকে সাহায্য করে ভারতের ভিতর দিয়ে ছদ্মবেশে পাকিস্তান পার করে। লেবার্টি গার্ডেন থেকে সংগ্রহ করা ট্রাকটরটি আমাদের অস্ত্রাগারের সব অস্ত্র, অফিসের মূল্যবান কাগজপত্র এবং রসদ অল্প যা ছিল লোড করে বাংলাদেশের দিকে রওয়ানা দিলাম। আমরা যখন আমাদের দলের সঙ্গে মিলিত হলাম, তখন সবাই সিলেট শহরের নিকটে এসে গেছেন। পাক বাহিনী রাস্তার ব্রীজ কালভার্ট ধ্বংস করে পিছু হটেছিল। আমাদের আসতে খুবই কষ্ট হয়েছে। শহরতলিতে সবাই অবস্থান নিয়েছি। ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনী ঢাকায় সারেন্ডার করেছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে। সিলেট কিন্তু স্বাধীন হয় নাই। ১৭ ডিসেম্বর শর্ত দিল শুধু মিত্র বাহিনীর নিকট সারেন্ডার করবে। শর্ত মেনে সারেন্ডার করল ১৭ ডিসেম্বর। সিলেট সহ সমস্ত বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হলো। মেডিকেল কলেজ হোস্টেল গুলোকে অস্থায়ী ক্যাম্প করা হলো। আমরা সেখানেই উঠলাম। কয়েকদিন রুটিন ডিউটি সেরে হাতের অস্ত্র জমা দিয়ে, ইংরেজি টাইপ করা ডিসচার্জ সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে বাবাসহ চলে গেলাম মা ভাই বােনদের দেখার জন্য। সিলেট শহরে কী পরিমাণ অস্ত্র মজুদ ছিল তা কল্পনার বাহিরে। দুই মাস | যাবত ফেরী করে মিত্র বাহিনী অস্ত্রগুলো ভারতে নিয়ে গেল, আমরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম। ১২০ টাকা সোনার ভরি ছিল। মিত্র বাহিনী সব সোনা ক্রয় করে ভারতে নিয়ে গেল। দেশ স্বাধীন হয়েছে অনেক দিন হয়ে গেল, তাই অনেক ঘটনার তারিখ সঠিক মনে নেই। মিত্রবাহিনী এমসি কলেজের সাইন্স লেবরেটরীর সব সরঞ্জাম নিয়ে গেল। সিলেটের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ল্যাবরেটরী ছিল। মা ভাই বোন আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে মিলিত হলাম কী আনন্দ। পরে সনদপত্র দেওয়া হয়। বাবা নতুন করে আবার সব গুছাতে সগ্রামে লিপ্ত হলেন। আমি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সামনে এসএসসি পরীক্ষা, আর কিছু দেখার সময় নেই। ১৯৭৭ সনে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে পশ্চিম জার্মানীতে চলে যাই। ফ্রাংকফুর্টে দুই বৎসর লেখাপড়া করি। তারপর কর্মজীবন, তারপর ১৯৮৫ সনে দেশে চলে আসি। দেশে এসে ঠিকমতো পুনর্বাসিত হতে পারিনি, তাই ১৯৯৬ সনে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে চলে যাই। দীর্ঘ দিন থাকার পর ২০০৫ সনে আবার দেশে চলে আসি। বাবা ১ আগস্ট ২০০৬ সনে ইন্তেকাল করেন। বাবা জীবদ্দশায় কোনো সরকারি সাহায্য বা মুক্তিযোদ্ধা ভাতা নেন নি। এই পর্যন্ত আমিও নেইনি। বাবা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডে অনেক দিন নেতৃত্ব দেন। কোনো কিছু পাবার আশায় যুদ্ধ করিনি। বাবা দেশের জন্য শ্রম দিয়ে গেছেন। আমিও আমার ক্ষুদ্র পরিসরে যা পারি করে যাচ্ছি, যত দিন বেঁচে আছি দেশের সেবা করে যাব। কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম, আমার বয়স এখন ৫৭ বছর হয়ে গেছে। সাথী মুক্তিযোদ্ধা নিজাম ভাই, আলাউদ্দিন ভাই, আমার বাবাসহ অনেকেই পরপারে চলে গেছেন, আমিও যাব। এমন একদিন আসবে যখন একজন মুক্তিযোদ্ধাও পাওয়া যাবে না। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে সম্বর্ধনা দেওয়ার জন্য বা প্রজন্মকে দেখানোর জন্য। মুক্তিযোদ্ধা আর সৃষ্টি হবে না। পরে যাহারা জন্মগ্রহণ করেছে তাদের অনেকেই আজ মুক্তিযোদ্ধা। এ রকম মুক্তিযোদ্ধা যেন সৃষ্টি করা না হয়। জীবিত অবস্থায় যদি সম্মান না পাই মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় সম্মান দিয়ে কী হবে? করুণা নয় উপযুক্ত সম্মান যেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা পায় এই আবেদনটুকু সবার কাছে রইল। স্বাধীনতা যুদ্ধে ও পরবর্তীতে যত মুক্তিযোদ্ধা পরলোক গমন করেছেন তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে শেষ করছি।

তারিখ ১০ অক্টোবর ২০১০ সৈয়দ মইনুর রহমান জন্ম :১ জুলাই ১৯৫৫, হবিগঞ্জ। শিক্ষা: রাজা গিরিশচন্দ্র হাই স্কুল, সিলেট। মদনমোহন কলেজ, সিলেট। কিশোর মইনুর বাবা ডা. সৈয়দ ওবায়দুর রহমানের হাত ধরে যুদ্ধে যান। বাবা ও ছেলে পাশাপাশি যুদ্ধ করছেন- কী আনন্দের, কী বিরল ঘটনা। তারা যুদ্ধ করেন ৪ নম্বর সেক্টরের জালালপুর সাব-সেক্টরের অধীনে। রোটারিয়ান সৈয়দ মইনুর রহমান মুক্তিযোদ্ধা অন্তপ্রাণ একজন মানুষ।

Reference: স্বাধীনতা মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!