পাকিস্তানী আর্মি কর্তৃক সিএসপি অফিসারদের নির্যাতনের চিত্র
মাতৃভূমি ত্যাগ না করে চাকুরির কারণে স্বদেশে অবস্থান করলেও অনেক প্রশাসক পাক সেনাকর্তপক্ষের হাতে বন্দি হয়ে দিনকে দিন তাদের নির্মিত অস্থায়ী কনডেমড সেলে বা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আটক থেকে নির্যাতন-নিপীড়ন ভােগ করেছেন, শহিদ হয়েছেন। এজাতীয় বেশ কিছু বর্ণনা বিভিন্নসূত্রে নিচে তুলে ধরা হলো। ১৯৫৬ সালের কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সার্ভিস (সিএসএস) পরীক্ষায় পাকিস্তানের উভয় অংশ মিলিয়ে মেধাতালিকায় প্রথম স্থানাধিকারী বাঙালি সিএসপি চট্টগ্রামের কাজী ফজলুর রহমান তার ডায়েরি-টাইপ রচনা দিনলিপি একাত্তরে এরকম বেশ কিছু বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন (যুদ্ধকালে লেখা বলে স্বাভাবিকভাবে অনেক কিছু শােনা কথার উপর নির্ভর করে রচিত হওয়ায় এতে কিছু ভুল তথ্যও বর্তমান):
“২০/ এপ্রিল সােমবার ১৯৭১, ঢাকা.. জেলায় বা বিভাগে যারা ছিল তারা পড়েছে সব চাইতে বিপদে। তাদের অবস্থা ছিল হয় রামে মারে, নইলে রাবণে । পাবনায় ছিল নুরুল কাদের খান। সে মুক্তিফৌজের নেতাই হয়ে গিয়েছিল। স্টেনগান কাঁধে নিয়ে। রাঙ্গামাটির২৫ তৌফিকও বােধ হয় তাই করেছে।
টাঙ্গাইলের জালাল সম্বন্ধে একই কথা শােনা গিয়েছিল, তবে আজ তার ভাইয়ের কাছে শুনলাম কাল সে আবার টাঙ্গাইল এসেছে।../ রাজশাহীর ডিসি’র কোন খবর নেই। খুলনার ২৬ ডি.সি, নুরুল ইসলাম ও এস.পি.কে নাকি গুলি করে মারা হয়েছে। / কুমিল্লার ডি সি, সামছুল হককে নাকি বন্দি করে আনা হয়েছে। তার উপর নাকি করা হয়েছে অকথ্য শারীরিক নির্যাতন। এখনও বেচে আছে কিনা তার খবর কেউ জানেনা। তার অপরাধ ছিল মার্চ মাসে সে সেনাবাহিনির সঙ্গে সহযােগিতা করেনি। স্থানীয় সেনা প্রধানদের সাথে মতানৈক্য হয়েছে। আর যখন গােলাগুলি শুরু হয়েছিল তখন সে আত্নরক্ষার জন্য বাড়ীতে ট্রেনচ করছিল”।২৭
এ, আর, মল্লিক তার পূর্বোক্ত স্মৃতিচারণায় (এপ্রিল, ১৯৮৪) উল্লেখ করেছেন, ২৫শে মার্চের রাত দশটা নাগাদ তারা যখন জানতে পারেন যে, বাঙালির গণহত্যায় ঢাকার রাজপথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নেমে পড়েছে, সেই সংবাদ পেয়ে তিনি তাঁর সহকর্মী শিক্ষকদের কয়েকজনকে নিয়ে পরবর্তী করণীয় সম্পরকে শলা-পরামর্শে বসেছিলেন। এরই একপর্যায়ে তিনি তার আত্নিয় কমিল্লার তৎকালীন জেলা প্রশাসকের কাছে টেলিফোনে ঘটনার বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন। উত্তরে জেলা প্রশাসক তাকে জানান, তিনি নিজেই পাক শাসকচক্রবিরােধী ভূমিকার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চক্ষুশূল হয়ে আছেন, স্বয়ং তখন বিপদাপন্ন। ইতিহাসবিদ মল্লিকের জবানিতে জানা যাক ঘটনাটি: “আমরা প্রথমে চট্টগ্রামের সাংবাদিকদের কাছে পরিস্থিতি সম্পর্কে খােজ নিই। তারা কিছুই বলতে পারলেন না। এই সময় আমার আত্মীয় কুমিল্লার ডি, সি, শামসুল হক খান এর সঙ্গে ফোনে কথা হয়। তিনি জানান, যেকোন মুহূর্তে তার জীবন বিপন্ন হতে পারে। কারণ তিনি বঙ্গবন্ধুর ডাকে ক্যান্টনমেন্টে গাড়ীর জ্বালানি সরবরাহ আগেই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আমি তাকে অবিলম্বে কুমিল্লা সার্কিট হাউস থেকে সরে গিয়ে গ্রামের দিকে আশ্রয় নিতে বলি। এর পর তার সঙ্গে আমার আর কোন যােগাযােগ হয়নি। তাকে সামরিক বাহিনী ধরে নিয়ে হত্যা করেছিল সে খবর অনেক দিন পরে পাই।”২৮
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্রঃ অষ্টম খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত জনৈক মােঃ মাজেদুল ইসলাম, যিনি মুক্তিযুদ্ধকালে কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের অফিসে কর্মরত ছিলেন, তিনি আত্মকথনে জানান: ‘সংবাদ পাইলাম জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে পাক বাহিনী ধরিয়া লইয়া গিয়াছে। পরের দিন জেলা প্রশাসকেরব্যক্তিগত ড্রাইভার আমার বাসায় আসিয়া জেলা প্রশাসককে ও পুলিশ সুপারিনটেণ্ডেণ্ট কবির উদ্দিন সাহেবের মর্মান্তিক সংবাদ জানাইল। পরে পরস্পর জানিতে পারিলাম উভয়কে পাক সৈন্যরা গুলি করিয়া নির্মম ভাবে হত্যা করে।”
প্রসঙ্গত পূর্বপাকিস্তানে বাঙালির গণহত্যার নীলনক্সা প্রণেতাদের অন্যতম মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খানও তৎপ্রণীত How Pakistan got Divided (‘বাংলাদেশের জন্ম’ শিরােনামে শাহ আহমদ রেজা কর্তৃক অনূদি) গ্রন্থে স্বীকার করেছেন এসব বিষয়। এই কুম্ভীরাশ্রুবর্ষণকারী জেনারেল লিখেছিলেন (পরবর্তী পৃষ্ঠায় দেখুন)৩০:
“আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। গভর্নর হাউসে বসে আমি পশ্চিম পাকিস্তানী, বিহারী ও বাংগালীদের কাছ থেকে হৃদয়বিদারক কাহিনী শুনছিলাম। আমার কাছে সকলেই ছিল পাকিস্তানী। এই তিন শ্রেণীর পাকিস্তানীই কারাে না কারাে হাতে নির্যাতিত হয়েছিল। আমি এখানে একটি মাত্র দিনের ঘটনার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করব। আমার অফিসে কুমিল্লার ডিসি-র স্ত্রীর সঙ্গে কথা হল। তার স্বামী পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাতে নিহত হয়েছিলেন।”../টাঙ্গাইলের ডিসি এলেন। ভীতসন্ত্রস্ত, হাত ভঁজ করা এবং ছেড়া কাপড় গায়ে। তিনি জনতাকে সাহায্য করেছিলেন, যারা শেষ পর্যন্ত একজন পাকিস্তানী এ সি-কে হত্যা করেছিল। কারো তখন করার কিছুই ছিল না, একমাত্র এই আশা নিয়ে ভুলে যাওয়া ও ক্ষমা করা ছাড়া যে, এমন সদিচ্ছার ফলে পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন জয় করা যাবে। আমি তাকে পুনর্বহাল করলাম এবং জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য ফেরত পাঠালাম। তিনি আমাদের সঙ্গে সহযােগিতা করেছিলেন এবং সন্তোষজনকভাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আমি অবশ্য অন্য অসামরিক প্রশাসকদের বেলায় তেমন সফল হইনি, যারা পাকিস্তান আর্মির হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। নিয়াজী একটি কঠোরতর মনােভাব নিয়েছিলেন এবং তার প্রথম বক্তৃতায় ঘােষণা করেছিলেন যে, বাঙালীদের শত্রু হিসেবে গণ্য করতে হবে। এটা ছিল এক জঘন্য মনােভাব, অন্তত বলার ক্ষেত্রে। যখন ফরিদপুর ও পটুয়াখালীর দুই ডিসিকে পাকিস্তান আর্মি গ্রেফতার করল, আমি তাদের মুক্তি দেয়ার জন্য অনুরােধ করেছিলাম। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর আমি জেনারেল টিক্কা খানকে হস্তক্ষেপ করতে ও তাদের মুক্তির আদেশ জারি করতে বলি। আমি এ কথা লক্ষ্য করে আতংকিত হয়ে গেলাম যে, নিয়াজী টিক্কার অধীনস্থতা থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করছিলেন। প্রকৃতপক্ষে পূর্ব পাকিস্তানে, এমন কি মার্শাল ল-ও ব্যর্থ হয়েছিল এবং নগ্ন মিলিটারি রুল ক্ষমতা দখল করেছিল।”
Reference: মুক্তিযুদ্ধে সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসারদের ভূমিকা