You dont have javascript enabled! Please enable it! 1967 | পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করার অপচেষ্টায় বুদ্ধিজীবীরা | রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান কী? - সংগ্রামের নোটবুক
রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করার অপচেষ্টা
১৯৬৭ সালের জুন মাসে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গীত নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ইতিপূর্বে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পাকিস্তান রেডিও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ থাকে। বাজেট অধিবেশনে রাজশাহী থেকে নির্বাচিত বিরােধীদলীয় সদস্য মজিবর রহমান চৌধুরীর এক প্রশ্নের উত্তরে তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন মন্তব্য করেন যে, পাকিস্তানী আদর্শের সঙ্গে না মিললে রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ করে দেয়া হবে। খান এসবুর পহেলা বৈশাখ উদযাপন এবং রবীন্দ্র-সংগীতকে হিন্দু-সংস্কৃতির অংশ বলে মন্তব্য করেন। জাতীয় পরিষদের এই বিতর্কের সংবাদ ঢাকার সংবাদপত্রে (দৈনিক পাকিস্তান ও অবজারভার, ২৩-২৮ জুন ১৯৬৭ দ্রষ্টব্য) প্রকাশিত হলে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরাও বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। ২৫ জুন ১৯৬৭ আঠারাে জন বুদ্ধিজীবী সরকারি বক্তব্যের সমালােচনা করে এক বিবৃতি দেন: সরকারি মাধ্যম হতে রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার হ্রাস ও বর্জনের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হইয়াছে। এই সিদ্ধান্ত আমরা অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মনে করি।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বাংলাভাষাকে যে ঐশ্বর্য দান করেছে, তার সংগীত আমাদের অনুভূতিকে যে গভীরতা ও ভিন্নতা দান করেছে তা রবীন্দ্রনাথকে বাংলাভাষী পাকিস্তানীদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে। সরকারি নীতি নির্ধারণের সময় এই সত্যের গুরুত্বকে মর্যাদা দান করা অপরিহার্য। এই বিবৃতির পাল্টা আরেকটি বিবৃতি দৈনিক পাকিস্তানে ২৯ জুন ছাপা হয়। এতে স্বাক্ষর করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ জন শিক্ষক। তারা বলেন : .(১৮ জন বুদ্ধিজীবীর) বিবৃতির ভাষায় এই ধারণা জন্মে যে স্বাক্ষরকারীরা বাংলাভাষী পাকিস্তানী ও বাংলাভাষী সংস্কৃতির মধ্যে সত্যিকারের কোনাে পার্থক্য রয়েছে বলে স্বীকার করেন না। বাংলাভাষী পাকিস্তানীদের সংস্কৃতির সম্পর্কে এই ধারণার সঙ্গে আমরা একমত নই বলে এই বিবৃতি দিচ্ছি। একই দিন (২৯-৬-৬৭) দ্বিতীয় আরেকটি বিবৃতি দৈনিক পাকিস্তানে ছাপা হয়। এতে স্বাক্ষরদাতা ছিলেন ৪০ জন। বিবৃতিতে তারা মন্তব্য করেন : রবীন্দ্রসংগীত সম্পর্কে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি মারাত্মক। যে তমুদ্দনিক স্বাতন্ত্রের ভিত্তিতে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা, উপরােক্ত বিবৃতি মেনে নিলে সে ভিত্তিই অস্বীকৃত হয়। এই কারণে উপরােক্ত বিবৃতিকে আমরা শুধু বিভ্রান্তিকর নয়, অত্যন্ত মারাত্মক এবং পাকিস্তানের মূলনীতি বিরােধী বলেও মনে করি। শেষােক্ত বিবৃতিদাতারা ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্সে এক সভা করে নজরুল একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেন। তারা একটা বিবৃতিও প্রচার করেন। বিবৃতিতে তারা বলেন রবীন্দ্র সংগীতের ভাব, ভাষা ও সুরের কোনােটার সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের তৌহিদবাদী জনসাধারণের তিলমাত্র যােগ নাই। রবীন্দ্রনাথের ঐশ্বর্য ও কৃষ্টি পূর্ব পাকিস্তানী, তমদ্দনের সম্পূর্ণ বিপরীত। এইভাবে কিছু বুদ্ধিজীবীর সমর্থন পেয়ে সরকার ১৩৭৪ সালের ২২ শ্রাবণের পূর্ব মুহূর্তে (আগস্ট ১৯৬৭) বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ করে দেয়। এর দুবছর পর উনসত্তরের গণআন্দোলনের জোয়ারে উক্ত নিষেধাজ্ঞা ভেসে যায়।
রেডিও টিভিতে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ হয়ে গেলে ঢাকার বিভিন্ন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংস্থা বিশেষত ‘ছায়ানট’, বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’ ও ‘ঐক্যতান’ রবীন্দ্রসংগীতের বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়ােজন করে সাহসিকতার পরিচয় দেয়। এ সময় বদরুদ্দীন উমর লিখিত সংস্কৃতি ও সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কিত দুটো বই ‘সংস্কৃতির সংকট’ ও ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ সাংস্কৃতিক প্রতিরােধ আন্দোলনকে খুবই অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত করেছিল।
বাংলা ভাষা সংস্কারের প্রয়াস
আইয়ুব-মােনেম চক্র কেবল রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা বাংলাভাষা সংস্কার করে একটি জাতীয় ভাষা প্রচারের চেষ্টা শুরু করে। ১৯৬৭ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ড. ওসমান গণি বাংলা বিভাগের ড. কাজী দীন মুহাম্মদের নেতৃত্বে ভাষা ও বানান সংস্কারের জন্য একটি কমিটি নিয়ােগ করেন। ঐ কমিটির সুপারিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলে গৃহীত হয়। ড. মুহম্মদ এনামুল হক, অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই এবং অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী উক্ত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গােষ্ঠীও এর বিরােধিতা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। উনসত্তরের গণআন্দোলনে তা চাপা পড়ে যায়। [1]
বঙ্গবন্ধু ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালের এক ভাষণে বলেন,

“জ্ঞ্যান আহরণের পথে এই সরকার যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিয়াছেন যার নজির বিশ্বে বিরল। আমরা মীর্জা গালিব, সক্রেটিস, সেক্সপিয়ার, এরিস্টটল, ডানতে, লেনিন, মাওসেতুং পড়ি জ্ঞ্যান আহরণের জন্য আর দেউলিয়া সরকার আমাদের পাঠ নিষিদ্ধ করিয়া দিয়াছেন রবীন্দ্রনাথের লেখা, যিনি একজন বাঙ্গালী কবি এবং বাংলায় কবিতা লিখিয়া যিনি বিশ্বকবি হইয়াছেন। আমরা এই ব্যবস্থা মানি না – আমরা রবীন্দ্রনাথ পড়িবই, আমরা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাহিবই এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত এই দেশে গাওয়া হইবেই। আমি রেডিও এবং টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপর হইতে সর্বপ্রকার বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করিয়া অবিলম্বে পর্যাপ্ত পরিমাণে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারের দাবী জানাই।” [2]

১ জানুয়ারি ১৯৭১ তারিখের আরেকটি ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন,
“বাংলা ভাষা ও বঙ্গ সংহতিকে ধ্বংস করার জন্যে জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরো স্থাপন করা হয়েছে। পাকিস্তান বেতার এবং টেলিভিশনও এই ষড়যন্ত্রের দোসর। তারা রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিল এবং আজও এ ব্যাপারে উঁচু মহলে জোর আপত্তি রয়েছে। জনগণ তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এই চক্রান্ত সহ্য করবে না। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যেসব বাঙালি সরকারি সমর্থন পেয়েছেন,  তাঁদের দিন আজ শেষ।” [2]
৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু বলেছেন,
“অতীতে বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাসকে বিকৃত করার সুপরিকল্পিত চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলা ভাষা,  সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমার মুখের ভাষাকে কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে,  আরবি হরফে বাংলা লেখার চেষ্টা করা হয়েছে,  হরফ-সংস্কার,  ভাষা-সংস্কার,  বানানসংস্কারের চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা আন্দোলন করে তা রুখেছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুলকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের কথা ভাবা যায় না। কিন্তু এর উপর বারবার হামলা এসেছে। ভেবে অবাক হতে হয়,  কাজী নজরুলের কবিতার শব্দ পরিবর্তন কম হয়েছে? গানের শব্দ বদল করে রেডিওতে গাওয়া হয়েছে। তারা মুসলমান করিয়েছেন। এ অধিকার তাদের কে দিল?” [2]
২৪ জানুয়ারি ১৯৭১ তারিখে ইঞ্জিনিয়ারস ইন্সটিটিউটে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,
“কোন ৪০ জন ব্যক্তি রবীন্দ্রসংগীতের বিরুদ্ধে বিবৃতি প্রদান করেছিলেন? কোন বিশেষ মহল তথাকথিত ইসলামের নামে নজরুলের গান ও কবিতার শব্দ বদলেছে? রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে বাদ দিলে বাংলা সাহিত্যের অস্তিত্বটা থাকে কোথায়? যে মৌলিক গণতন্ত্র ও ডিক্টেটরি শাসনের পতন ঘটাবার জন্যে বাংলার বীর ছাত্র-জনতা-শ্রমিক বুকের রক্ত দিয়েছে,  তাদেরই গুণকীর্তন করে,  প্রবন্ধ লিখে,  বেতার কথিকা প্রচার করে এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদ পয়সা রোজগার করেছেন। বিএনআর-এর অর্থানুকূল্যে বই প্রকাশ করেছেন। ৪৭ সাল থেকে বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হতো কিন্তু এখন অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন যে কেউ স্বাধীনভাবে বাংলাভাষায় কথা বলতে এবং নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চা করতে পারেন।” [2]
References:   
[1] স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস – মুনতাসীর মামুন, মো. মাহবুবুর রহমান
[2] বঙ্গবন্ধুর ভাষণসমগ্র ১৯৪৮-১৯৭৫, সংগ্রামের নোটবুক