You dont have javascript enabled! Please enable it! সাঈদ-উর-রহমান সাক্ষাৎকার - সংগ্রামের নোটবুক

সাঈদ-উর-রহমান

 

১৯৭১ সালের ১লা মার্চ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আমার শেষ দিন। ঐ দিন এম, এ শেষ পরীক্ষার মৌখিক পরীক্ষা। পরীক্ষার উত্তর দিতে দিতে বার বার শুনছিলাম করিডোর ও রাস্তায় ছাত্রদের মিছিলের শ্লোগান। পরীক্ষা শেষে হল ছেড়ে দেয়ার কথা ছিল। ভাবলাম আরো সপ্তাহখানেক থেকে পরিস্থিতির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে বাড়ি ফিরব। সাত তারিখে শেখ মুজিবের ইতিহাস সৃষ্টিকারী বক্তৃতা ও নয় তারিখে মওলানা ভাসানীর পল্টন ময়দানের সভায় অংশ নিয়ে দশ তারিখে বাড়ি প্রত্যাবর্তন করলাম। পুনরায় পঁচিশ তারিখে ঢাকায় আসবো ও একেবারে হল ছেড়ে দেব; সে ধরনের চিন্তা মাথায় ছিল।

মে মাসের প্রথম দিকে বুঝলাম; আমাদেরও বাড়ি ছাড়তে হবে। আমাদের বাড়ির মাইলখানেক উত্তরে ফকিরহাট রেল স্টেশন। ওখানে ঘাঁটি পেতেছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। তারা কুমিল্লা শহরে আসা-যাওয়া করে বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে। দেশে থাকা আর নিরাপদ মনে হল না। মে মাসের শেষ দিকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতেই চলে যাই।

দেশত্যাগ করে প্রথমে উঠলাম আত্মীয়ের বাড়িতে। ওখানে ছিলাম সপ্তাহখানেক। নিকটস্থ বক্সনগর যুবশিবির প্রতিদিন যেতাম ও দেখতাম মুক্তিযোদ্ধাদের শারীরিক কসরৎ। ক্যাম্পের পরিচালকমণ্ডলীর সঙ্গে পরিচয় হল। শিবির প্রধান অধ্যাপক আবুর রউফ আমার পুরনো পরিচিত। আমি চিন্তা করলাম আগরতলা যাবার। একদিন যুবশিবির থেকে পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে ভোরবেলা রওয়ানা হলাম আগরতলার উদ্দেশ্যে। পার্বত্য ঘন জঙ্গলের মধ্যে আদিবাসীদের অধ্যুষিত এলাকার ভেতর দিয়ে প্রায় পনের মাইল হেঁটে দুপুরের দিকে শহরে উপনীত হলাম। আগেই জেনেছিলাম যে কলেজের মধ্যে পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধক্ষেত্রের সমন্বয়কারীদের কয়েকজনের অফিস আছে- তাদের একজন ছিলেন আবদুল মান্নান চৌধুরী; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আমার পুরনো বন্ধু। বিকালের দিকে মান্নান ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল এবং তিনি আমাকে পাঠালেন সোনামুড়ায়; রাজনৈতিক যুবকর্মীদের কেন্দ্রস্থল। সেখানকার প্রধান ছিলেন সৈয়দ রেজাউর রহমান- তিনিও ছিলেন আমার পূর্বপরিচিত। তিনি এবারে আমাকে পাঠালেন হাতিমারা যুবশিবির; শিবির প্রধানের কাছে চিঠি দিয়ে। সোনামুড়ায় একরাত কাটিয়ে পরদিন দুপুরবেলা আমি হাজির হলাম শিবিরে। যথারীতি অন্তর্ভুক্ত হলাম শিবির সদস্যরুপে। শুরু হল নতুন জীবন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় রাজনীতির প্রত্যক্ষ কার্যকলাপে আমার কোন যোগ ছিল না; তবে বিশেষভাবে উৎসাহী ছিলাম মিছিলে; মিটিংয়ে। বিভিন্ন সংগঠনের মতপার্থক্য সম্বন্ধে জানলেও টার তীব্রতা আগে বুঝি নি।

হাতিমারা পার্বত্য ত্রিপুরার একটি পরিচিত অঞ্চল। জঙ্গল বেশ ঘন গভীর। উঁচু নিচু টিলা মধ্যে প্রবাহিত ছোট নালা; মাঝে মাঝে টিলায় পার্বত্য উপজাতি টিপরাদের বসতি। নিকটেই একটি বাজার ও প্রাইমারী বিদ্যালয়।

রাস্তার সামান্য দূরে শিবির। প্রথম শিবিরের প্রধান ফটক। ভেতরে সারি সারি ব্যারাকসমূহ। শাল গাছের খুঁটি, বাঁশের বেড়া ও শনের ছাউনি দিয়ে দীর্ঘ ব্যারাকসমূহ তৈরি। চারপাশে ছোট ছোট ঘর। কোনটি শিবির প্রধানের; কোনটি গুদাম। এসবে থাকেন বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত পরিচালকবৃন্দ।

সুপারভাইজার এম, এ হান্নান সাহেব গোড়া থেকে সংশ্লিষ্ট। তিনি প্রথম শিবিরটি চালু করেন। শিবির প্রধান আফজাল খান আসেন আগস্টের মাঝামাঝি। তিনি কুমিল্লার সুপরিচিত ছাত্রনেতা। ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন ইমাম আবু জাহিদ সেলিম। আমি এসে পেলাম আমার এক পুরনো সহপাঠীকে- খায়রুল আলম বাদল। সামরিক প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন হাবিলদার মেজর আইউব।

শিবিরের প্রধান আকর্ষণ তরুন মুক্তিফৌজেরা। প্রতিদিন এরা আসছে। আর নাম লিখাচ্ছে মুক্তিবাহিনীতে। কেউ আসে সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা থেকে কেউ আসে ঢাকা-ফরিদপুরের মতো দূরের এলাকা থেকে। এদের মধ্যে পনের বছরের কিশোর আছে। আবার পঁয়ত্রিশের যুবকও নজরে পড়ে।

হাতিমারা একটি যুবশিবির। দেশত্যাগী তরুণরা প্রথমত এসবে আশ্রয় নেয় ও প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহন করে। রাইফেল, স্টেনগান ও গ্রেনেড ছোড়া সম্পর্কে জ্ঞান দেয়া শরীরকে কষ্টসহিষ্ণু করে সামরিক শিক্ষার জন্য উপযোগী করে তোলাই এসবের লক্ষ্য। ছেলেরা সর্ববিধ কাজ নিজেরা করে। পানি আনা, রান্না করা, জ্বালানী সংগ্রহ, শিবির প্রহরা সবই নিজেদের করতে হয়।

কঠোর পরিশ্রমের সাথে সাথে খাওয়া-দাওয়া ও বিশ্রামের ব্যাপারে যথেষ্ট কঠোরতা পালন করা হয়। সকাল বেলায় নাশতা একটা আটার রুটি; সাথে কোনদিন সবুজ চা, বা অল্প ভাজি। দুপুরে বা সন্ধ্যায় এক বাসন ভাত, সাথে সামান্য ডাল বা তরকারি। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে মাসান্তে অর্ধেক ডিম বা দু’এক টুকরা মাংস বা মাছ পাওয়া যায়।

ছেলেরা থাকে বাঁশের মাচায়। কেউ এর উপর সতরঞ্চি বা চাদর বিছায়। বালিশ অনেকের নেই। বালিশের অভাবে কেউ কেউ মাথার নীচে কাপড়ের পুটুলি রাখে বা খাওয়ার প্লেটটি উপুড় করে দেয়। মশারি অধিকাংশের নেই। পানি খাওয়ার জন্য তারা ব্যাবহার করে মগ, কেটলি বাঁশের চোঙ্গা বা মর্টারের খোল। টিলার নিচে একটি টিউবওয়েল আছে। স্নান করে নালাতে। এতে পানি থাকে কখনো এক বিঘত, কখনো এক হাঁটু। বৃষ্টির দিনে নালার জল কর্দমাক্ত, অন্য সময় নির্মল।

সকাল সাতটায় শিবিরের কাজ শুরু। পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীতের পর ব্যায়াম শিক্ষক ক্লাশ নেন। পুরো এক ঘণ্টা চলে প্যারেড ও দৈহিক অনুশীলন। তারপর সামান্য বিরতি ও নাশতা। নাশতার পর আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর শিক্ষাদানের ক্লাশ। বেলা দশটায় রাজনীতির ক্লাশ, এগারোটার দিকে পূর্ণ বিরতি।

বিকালের দিকে শিবির পুনরায় জেগে ওঠে। বেলা চারটে হতে প্যারেড ও দৈহিক ব্যায়াম করে খেলাধুলা শুরু হয়। শিবিরে আছে দুটো ভলিবল। সন্ধ্যার দিকে ছেলেরা আসর জমায় অফিসের সামনে খোলা যায়গায়। দুটো জারুল গাছকে ঘিরে বাঁশের মাচা তৈরি হয়েছে। তার ওপরে তারা বসে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুরু হয় সন্ধ্যা সাতটা থেকে। অনেকেই অপেক্ষা করে চরমপত্রের জন্য। এরপর ক্যাম্প নির্জন ও নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে।

শিবিরের কাজকর্মে চাঞ্চল্য আসে যেদিন কোন বিখ্যাত অতিথি আসেন বা রিক্রুটের জন্যে সামরিক কর্তার আগমন ঘটে। এমপি বা এমএনএ-রা আসেন, ছেলেদের সঙ্গে কথা বলেন, আশ্বাসের কথা শোনান। রিক্রুটিং অফিসার আসেন, ট্রেনিং-এর জন্য ছেলে নির্বাচন করেন। দল বেঁধে ওরা চলে যায় আসামে বা দিল্লিতে। বাকি ছেলেরা অশ্রুসজল চোখে তাদের বিদায় জানায় আর ভাবে কবে নিজেদের সুযোগ আসবে।

ক’দিন পরে আমি সেলিম ভাইয়ের কাছে বললাম আমার প্রশিক্ষনের কথা। এমনিতেই কর্মহীন জীবনে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলাম। তিনি আমাকে একটি বড় আশা দিলেন। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে আরো বড় একটি প্রশিক্ষণের ব্যাবস্থা আছে বিশেষ কারো ক্ষেত্রে। দেরাদুনে জেনারেল ওভানের নেতৃত্বে তাদের ট্রেনিং দেয়া হয়। এদের নাম বেঙ্গল লিবারেশন আর্মি। যুদ্ধান্তে এদের মধ্য থেকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োগ করা হবে। তিনি ভরসা দিলেন যে আমাকে ঐ দলে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ তিনি এনে দিবেন। আমি আশায় আশায় থাকি।

হাতিমারা এলাকায় যুদ্ধের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন দিদারুল আলম। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হল। প্রায়ই তিনি বাদল ও আমাকে ডেকে পাঠাতেন তাঁর তাবুতে। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের ভক্ত ও মাওলানা ভাসানীর অনুসারী। তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতাম বাংলা সাহিত্যের সাম্প্রতিক অবস্থা সম্পর্কে। রাতটা ওখানে কাটিয়ে ফিরতাম পরদিন।

কিছুদিন পরে ফজলুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও আমার জ্ঞাতি ভাই ফিরে এল দেরাদুন ট্রেনিং নিয়ে। আমাদের ক্যাম্পেই উঠল। সে জানতে চাইল বাড়ির খবরাখবর; আমি জানতে চাইলাম ট্রেনিং এর খবর। আমি ঐ ট্রেনিং-এ যেতে চাই শুনে সে আতংকিত হল। বলল এই ট্রেনিং শুধুমাত্র বিশ্বস্ত বাছাই করা মুজিবভক্তদের জন্য। স্বাধীনতার পর মুজিব-রাজত্ব নিরঙ্কুশ করার কাজে এদের ব্যবহার করা হবে। আপনি যেহেতু ভিন্ন আদর্শে বিশ্বাসী সেজন্য আপনার যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। দেরাদুন যেতে পারলেও; কোনভাবে আপনার মতিগতি জানতে পারলে পরিণতি বিপদজনক হবে। সুতরাং এখানে আছেন ভাল। চুপচাপ থাকেন ও সময় কাটান।

কিন্তু সময় আর কাটেনা। ঠিক করলাম একবার বাড়িতে যাব। ক’দিন ধরে শুনছিলাম; এই শিবির পার্বত্য ত্রিপুরার আরো ভেতরে সরিয়ে নেয়া হবে। তাহলে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। সেজন্য একদিন সকালবেলা রওয়ানা হলাম দেশের দিকে।

বারটার দিকে বাংলাদেশের ভেতর ঢুকলাম। গ্রামের পর গ্রাম নির্জন; পরিত্যাক্ত। উঠোনে ঘাস গজিয়েছে। বাইরের উনুনগুলো ভেঙে পড়েছে। কলাগাছে পাকা কলা, খাবার লোক নেই। একটি বাড়িতে ডাব গাছ দেখে প্রবল তৃষ্ণা পেল। আমার সঙ্গী ছিল আমাদের পাশের বাড়ির রহিম। সে গাছে উঠার উপক্রম করতে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন শীর্ণকায় বৃদ্ধ। তিনি ঘর থেকে ডাব ও বঁটি এনে দিলেন। পরিতৃপ্তি সহকারে তৃষ্ণা নিবারণ করে আমরা যাত্রা করলাম। আছরের নামাজের সময় বাড়িতে পৌঁছলাম। মা তাড়াতাড়ি ভাত বেড়ে দিলেন, আমি গেলাম পুকুরঘাটে গোসল করতে।

হঠাৎ চিৎকার উঠল মিলিটারী আসছে। ফকিরহাট ঘাঁটি থেকে রওনা দিয়ে তারা আমাদের গ্রামে এসে গেছে। দিলাম দৌড় পশ্চিম দিকে-মাঠ পেরিয়ে রেল লাইন অতিক্রম করে যেতে পারলে জানে বাঁচা যাবে। মাঠে পৌঁছে দেখলাম মাঠ ভর্তি লোক। সবাই দিগ্বিদিক ছুটছে। বালক-বালিকা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, নারী পুরুষ সবাই ছুটছে। আমার সাত বছরের ছোট বোন নুরুন্নাহারও কাপড়ের একটি পুটুলি নিয়ে মা ও চাচীদের পেছনে দৌড়ুচ্ছে।

মাইল দুয়েক দৌড়ুনোর পর আপাতত নিরাপদ স্থানে পৌছা গেল। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। ক্ষুধায় ও পরিশ্রমে এত অবসন্ন ছিলাম যে ধান ক্ষেতের আলের উপর শুয়ে পড়লাম। অনেক পরে, রাতের অন্ধকারে সন্তর্পণে ফিরলাম বাড়িতে। তার দুদিন পর আবার হাতিমারা।

সম্ভবত আগস্ট মাসের শেষাশেষি শিবির সরিয়ে নেয়া হয় পদ্মানগরে- আরো পনের বিশ মাইল অভ্যন্তরে। পূর্বোল্লিখিত বক্রনগর ক্যাম্পও একই জায়গায় নিয়ে আসা হয়। ইতিমধ্যে আমি ট্রেনিং এর আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম; সুতরাং কর্তৃপক্ষ আমাকে Political Motivator হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেন। প্রতি সপ্তাহে আমাকে একটি করে বক্তৃতা দেয়ার কথা বলা হল- উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের রাজনৈতিকভাবে দীক্ষিত করা। এ কাজ করার জন্য আমি ছোট একটি গ্রন্থাগার তৈরি করলাম এবং নিজেও পড়াশোনায় মন দিলাম। শিবিরের বাইরে একটি স্থান নির্বাচন করে নিলাম- প্রায় দুপুর কাটতো সেখানে। বক্তৃতায় আমি বললাম মুক্তির কথা – ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’- ঐ কথার উল্লেখ করে। ছেলেরা বেশ আগ্রহের সঙ্গে শুনত। কোনদিন হয়তো বলতাম সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবের কথা- চারু মজুমদার ও চে গুয়েভারার রণকৌশলও আলোচনায় আসত। সমাজতন্ত্র মানে, ইতিহাসের বিকাশ, শোষণ-মুক্ত প্রভৃতি সরল ভাষায় বলার চেষ্টা করতাম।

সেপ্টেম্বর মাসে বাড়ির দুটো দুঃসংবাদ পাই। আমাদের গ্রামের বাড়িটি পুড়িয়ে দিয়েছে মিলিটারিরা, বিশেষ করে পুড়িয়েছে চাচার বছরখানেক আগে নির্মিত সুদৃশ্য বাড়িটি। আমাদের ঘরগুলো অধিকাংশ পুড়ে গেছে- একটি ঘর শুধু রক্ষা পেয়েছে। জ্ঞাতি ভাই ফজলু ও নুরুদের সব ভস্মীভূত হয়ে গেছে (এরা মুক্তিযোদ্ধা ছিল)। দ্বিতীয়টি হল যে আব্বাকে, চাচাকে ও চাচাতো ভাইদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল। প্রচুর নির্যাতন করেছে; তবে কেন জানি প্রাণে মারেনি। আমাদের বাড়ির লোকেরা অন্যত্র কোথাও আশ্রয় নিয়েছে।

 

অক্টোবর মাস থেকে ভাল খবর পেতে লাগলাম। বাড়ি থেকেও সুসংবাদ পেলাম। ফকিরহাটের ঘাঁটি ছেড়ে পাকিস্তানী বাহিনী চলে গেছে। গাঁয়ের সবাই বাড়িতে ফিরেছে। যুদ্ধেরও নাটকীয় মোড় ফেরা লক্ষণীয় হয়ে উঠল। রাজনৈতিক নেতাদের আলাপে সালাপে মনে হল শুভ দিন সন্নিকটে। চট করে মনে পড়ল ক্যাপ্টেন দিদারুল আলমের তাঁবুতে এক ভারতীয় মেজরের কথা। তিনি বলেছিলেন যে আমরা ডিসেম্বরের মধ্যে দেশে ফিরতে পারবো বলে তিনি আশা করেন।

তারপরে শুরু হল চূড়ান্ত যুদ্ধ। ডিসেম্বরের সাত তারিখে আমাদের শিবির বন্ধ বলে ঘোষিত হল। ছেলেরা রওয়ানা হল যার যার দেশে। আমি যাত্রা করলাম নয় তারিখে। সোনামুড়ার চৌকি দিয়ে কুমিল্লা প্রবেশ করলাম। সন্ধ্যায় হাজির হলাম নিজ বাড়িতে। পৌষের প্রসন্ন ভোরবেলায় আবার জমজমাট হয়ে উঠল অগ্নিদগ্ধ বাড়ির ভিটে।

-সাঈদ-উর রহমান
(সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
জানুয়ারি; ১৯৮৪