মোহাম্মদ হুমায়ূন খালিদ
মেঘালয়ের তুরাতে এফ জে সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং সেন্টারে দীর্ঘ আট মাস মোটিভেশনের দায়িত্বে ছিলাম । এই কয় মাসে প্রায় ১৬ হাজার মুক্তিবাহিনীর সদস্য আমার হাত দিয়ে শপথ নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ঢোকে । আমি নিজেও দীর্ঘ ৪ মাস গেরিলা ট্রেনিং গ্রহণ করি।
টাঙাইলের গেরিলা নেতা কাদের সিদ্দিকির সঙ্গে সর্বপ্রথম আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হয় । মুক্তি বাহিনীর ছেলেদের ট্রেনিং গ্রহণ করার পর টাঙ্গাইল ময়মনসিংহের ভাল ভাল ছেলেদের সরাসরি কাদের সিদ্দিকির নিকট পাঠিয়ে দিই ।
কাদের সিদ্দিকির জন্য কিছু ( উচ্চ মানের ) অস্ত্রশস্ত্র পাঠানোর ব্যাপারে আমি ভারতীয় উক্ত সেক্টরের বিগ্রেডিয়ার সাচ্ছু সিংহের সঙ্গে দেনদরবার করি । এই খবর পাক বাহিনী পায় । ফোলে আমার স্ত্রী পুত্র – পরিবারকে বন্দি করে তাদেরকে কঠোর ইন্টারগেশন করে । অবশ্য অন্য কোন অত্যাচার না করে তাদের ছেড়ে দেয়া হয় । আমি এই খবর ভারতে থেকে পাই । আরও জানতে পারি যে পাক সেনারা আমার পালক পুত্র (কলেজের ছাত্র ) সোহরাব হোসেনকে বন্দি করে টাঙ্গাইল জেলে রেখেছে ।
মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৮ মাসে মাইঙ্কার চর , মহেন্দ্র-গঞ্জ ও ডালুতে ঘুরে ঘুরে বেঙ্গল রেজিমেন্ট , ইপি আর ও মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের সামনে বক্তৃতা করে উদ্বুদ্ধ করতাম । তারা বজ্রশপথে মাতৃভূমি উদ্ধার কল্পে বাংলাদেশে ঢুকতো । নটিয়াপাড়া , বাঐখোলা, পাটখাগুড়ি , বাসাইল হাতিবান্দা ও মিরিকপুরে ১২ জন নিহত হয় । এদের সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হয় । গণহত্যার স্থান ছিল মিরিকপুর বাসাইল। আমার পালিত পুত্রের বাবা খন্দকার শামসুর রহমানকে শুধু আমারই পালক পুত্রের বাবা হওয়ার অপরাধে ধরে এনে টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসের সামনে নৃশংসভাবে জবাই করে হত্যা করা হয় ।
৩রা এপ্রিল ( যেদিন পাকবাহিনী টাঙাইলে প্রথম ঢুকে ) নাটিয়াপাড়াতে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর কাদের সিদ্দিকির নেতৃত্বে তুমুল যুদ্ধ হয় । নটিয়া পাড়া বাজার ও আশেপাশের বাড়িঘর পাক বাহিনী পুড়িয়ে দেয়।
আমার স্ত্রী রিজিয়া খালিদ পাক বাহিনীর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পর লজ্জায় অপমানে অসুস্থ হয়ে পড়েন । পরে চিকিৎসার জন্য ছদ্মনামে তিনি ঢাকা হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি হন । আমার প্রাক্তন ছাত্র ( ডাঃ আব্দুর রহমান ) উক্ত হাসপাতালের ডাক্তার আমার স্ত্রীকে বাঁচানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেও রক্ষা করতে পারেন নি । ৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল শুক্রবার সকাল ৯টায় তিনি প্রাণত্যাগ করেন । মারা যাওয়ার প্রাক্কালে প্রকাশ পেয়ে যায় যে তিনি আমারই স্ত্রী এবং যখন তার লাশ টাঙাইলে নেয়ার জন্য অনুমতি চাওয়া হয় , পাক বাহিনীর কাছে তা অগ্রাহ্য হয় । ফলে একদিন পর ৪ঠা ডিসেম্বর আজিমপুর গোরস্থানে তাকে দাফন করা হয় । সে সময় ঢাকায় ভীষণভাবে বোমাবর্ষিত হচ্ছিল । আমার স্ত্রীর এই অকাল মৃত্যুর খবর আমি ঘাঁটাইলে পাই ১৩ ডিসেম্বর , সর্বপ্রথম আমি যখন ভারত থেকে টাঙাইলের দিকে আসছিলাম।
কাদের সিদ্দিকির উপস্থিতিতে ১৮ই ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে যে জনসভা হয়, সেই সভায় আমি কোরআন তেলাওয়াত করি এবং মর্মস্পর্শী বক্তৃতা দিই । এটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম জনসভা । এই সভায় বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আমি মোনাজাত পরিচালনা করি তাতে সমস্ত জনসভা যেন কান্নার রোলে ফেটে পরে।
-অধ্যক্ষ হূমায়ুন খালিদ
এমসিএ (সাবেক এম এন এ)
টাঙ্গাইল