সিরাজুর রহমান
১৯৭১ সালে বিবিসিতে কতকগুলি সমস্যা ছিল। আমাদের শ্রোতাদের সঠিক তথ্য পরিবেশন করতে হবে, সর্বশেষ এবং সঠিক খবর তাদের জানাতে হবে কিন্তু সেই খবরগুলো আমরা পাই কোথায়। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সংবাদপত্রের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ থাকার ফলে সংবাদ সংগ্রহ করা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর ছিল। এই অসুবিধার ভেতর দিয়ে যথাসাধ্য আমাদের সংবাদ সংগ্রহ করার চেষ্টা করতে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এরূপক্ষেত্রে যা হয়, যেখানে সত্যিকারের সংবাদ পাওয়া কঠিন হয়ে যায় সেখানে মিথ্যা সংবাদ অজস্র আসতে থাকে, গুজবগুলো সংবাদের আকার নেয়। আমাদের পক্ষে আরো বড় সমস্যা ছিল যে, বাংলাদেশ-ভারতের বাংলাভাষী শ্রোতারা, যাদের নিয়ে আমাদের কাজ কারবার, বরাবরই তাদের জন্য আমাদের সংবাদ পরিবেশন করতে হবে। কিন্তু যদি কখনো অজান্তে গুজবের বেসাতি করে আমরা এমন একটি ধারণা সৃষ্টি করে ফেলি যে আমরা দুনিয়ার অন্যান্য অঞ্চল সম্বন্ধে মিথ্যা সংবাদ দিয়ে থাকি তাহলে ভবিষ্যতে কখনো শ্রোতারা আমাদের বিশ্বাস করবেন না। এক দিকে যাতে কেউ বলতে না পারে যে আমরা খবর অন্যান্যদের পরে দিচ্ছি, দ্বিতীয়ত আবার কেউ যাতে অভিযোগ করতে না পারে আমরা মিথ্যা খবর দিচ্ছি। আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হয়েছে দু’কূল বজায় রেখেই সর্বশেষ ও সঠিক সংবাদ পরিবেশন করতে। এই ছিল আমাদের মূল সমস্যা। এছাড়া আমাদের অনুষ্ঠানের সময় ছিল খুব কম, বেশি খবর দেয়ার খুব একটা সুযোগ ছিল না। অবশ্য পরবর্তীকালে আমাদের অনুষ্ঠানের সময় বাড়ানো হয়েছিলো।
আমরা বাংলা বিভাগে যারা ছিলাম সংখ্যায় অত্যন্ত কম ছিলাম। আমাদের পক্ষে সবকিছু সামলানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছিলো। সৌভাগ্যবশত তখন আশেপাশে কিছু ছাত্র ছিলেন তাঁরা এদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য এসেছিলেন। তাঁরা আমাদের যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন। আমার মনে আছে আমার সহকর্মী শ্যামল লোধ, কমল বোসসহ কোনো কোনো সময়ে দিনের পর দিন আমরা সকাল ৯টার সময় এসেছি আবার রাত ২/৩টার সময় ট্রান্সমিশানগুলোর কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরেছি।
এর মধ্যে আবেগেরও বহু ব্যাপার ছিল। দেশ থেকে অবিরাম খবর আসছে। দেশের জনসাধারণের দুঃখ দুর্দশা বৃহত্তর ভোগান্তি ইত্যাদি নানা কাহিনী শুনে আমাদের মন আবেগে আপ্লুত হয়ে যেত। সে দিকটি তো ছিলই। তার ওপর আর একটা বড় সমস্যা ছিল – আমাদের হাজার হাজার বাঙালি যারা পাকিস্তানে আটকা পড়েছিলো। দেশের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করার কোনো উপায় ছিল না তাদের। দুই তরফ থেকে তারা আমাদের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। তখনই আমরা বুঝতে পারলাম বিবিসি বাংলা বিভাগের প্রতি তাদের ভালোবাসা কতোটুকু। কারণ বেপরোয়া হয়ে তারা আমাদের সাহায্য কামনা করেছিলেন। প্রথমত আমরা বাংলাদেশ থেকে পাওয়া কিছু চিঠি পাকিস্তানের আত্মীয়স্বজনের অথবা পাকিস্তানে আটকে পড়াদের চিঠি বাংলাদেশে তাদের আত্মীয়স্বজনদের পাঠানোর চেষ্টা করেছি। বেশ কয়েক হাজার চিঠিপত্র এভাবে এদিক-ওদিক গিয়েছিলো। আমাদের পর্যাপ্ত জনবল ছিল না এগুলো দেখাশোনা করার জন্য। শেষ পর্যন্ত আমরা ‘সেতুবন্ধন, সাগর পাড়ের বাণী’ অনুষ্ঠানে তাদের খবরাখবর বিনিময় শুরু করলাম। অজস্র চিঠি আমরা সে সময় পেয়েছি। এর ভেতর দিয়ে আমাদের শ্রোতারা কতো একাত্মবোধ করেছেন সেই প্রমাণ আমরা সেই সময়ে পেয়েছি।
আরো মনে পড়ে, যখন ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে আমরা টের পেয়ে গেলাম যে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তান বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করবে তখন আমরা নতুন একটা বিশেষ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিলাম। আমার মনে আছে যখন আমরা সেই অনুষ্ঠানটি প্রচার করি ঠিক সেই সময়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণ দিচ্ছিলেন। আমি কানে ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণ শুনছিলাম এবং মুখে আমাদের শ্রোতাদের খবর দিয়ে যাচ্ছিলাম যে ইয়াহিয়া খান তখন কি করছেন – একই টেইপে। অর্থাৎ ইয়াহিয়া খান যে মুহূর্তে বেতার ভাষণ দিয়ে যাচ্ছিলেন ইংরেজিতে সেই মুহূর্তে ভারত-বাংলাদেশে আমাদের বাংলা অনুষ্ঠানের শ্রোতারা এই বিষয়ে অনুষ্ঠানটি মারফতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরটা শুনতে পেরেছিলেন। আবেগে মনটা এ রকম হয়ে পড়েছিলো যে কান্না চাপাটাই খুব অসুবিধাজনক হয়ে গিয়েছিলো। অথচ আমি জানি বেতার সাংবাদিকদের পক্ষে আবেগ-অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেওয়া অত্যন্ত অযোগ্যতার পরিচয়। কিন্তু তবুও সেদিন কান্না চেপে রাখা কষ্টকর ছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এ দেশের প্রবাসী বাঙালিরা বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন এটা বলতে হবে। এখানে আমার কিছু বাঙালি বন্ধু ছিলেন, তারা একটা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুললেন এবং আমার সাহায্য চাইলেন। সাব্যস্ত হলো আমি তাদের সাহায্য করবো জনসংযোগ ও তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে। তাদের মধ্যে ছিলেন ওয়ালী আশরাফ, মাহমুদ হোসেন মঞ্জুর, মোশারফ হোসেন, বুলবুল মাহমুদ, মানিক চৌধুরী, শামসুদ্দীন প্রমুখ। সুরাইয়া খানমও ছিলেন তাঁদের সঙ্গে। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের তাৎপর্য ও যৌক্তিকতা সম্বন্ধে বিশ্বের জনসাধারণকে তাঁরা অবহিত করবেন। আরো সিদ্ধান্ত নেয়া হলো সাংবাদিক, বেতার-সাংবাদিক, শিক্ষাব্রতী এবং বিশেষ করে দেশের বাইরে যারা আছেন তাঁরা বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্ট সদস্য ও অন্যান্যদের বুঝাবেন। একটা উপায় স্থির করা হলো যে, তথ্য বুলেটিন বের করা হবে। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি তাদের সে ব্যাপারে সাহায্য করতে। আমরা নিজেরা প্রচুর তথ্য বুলেটিন লিখেছি। আমার পুরো মনে নেই মনে হয় হাজার পাঁচেক প্রতিনিধির বাড়িতে, বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অধ্যাপক, সংবাদপত্র সম্পাদক, বেতার-টেলিভিশন, বিভিন্ন দেশের সংসদ সদস্য, রাষ্ট্রপ্রধান – এঁদের কাছে এবং লন্ডনে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের প্রত্যেকের কাছে পাঠানো হতো। আমরা নিজেরা যা লিখতাম তা তো বটেই অন্যান্যরা বাংলাদেশের সপক্ষে লিখতেন সেগুলোও আমরা তাঁদের কাছে তুলে ধরতাম। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলতে পারি, একদিন এক বন্ধু আমাকে আমেরিকা থেকে টেলিফোন করে জানালেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন অধ্যাপক বাংলাদেশের দাবীকে সমর্থন করে ৩২ পৃষ্ঠাব্যাপী একটি তথ্য দলিল বের করেছেন। আমি বললাম সেটিই চাই। ডাঃ শামসুল হক স্বয়ং নিয়ে এসেছিলেন সেই দলিলটি। আমার মনে আছে সে দিনের মধ্যেই ৩২ পৃষ্ঠার দলিল আমরা ৫ হাজার কপি বিতরণ করেছি। পরবর্তীকালে কলকাতা থেকে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার যে তথ্য পুস্তকটি বের করেছিলেন তাতে এটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো। এভাবে এই অবস্থা হয়েছিলো যে, পত্রপত্রিকাগুলো প্রায়ই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে কোনো খবর পেলে তার বিশ্লেষণের জন্য আমাদের কাছে ফোন করতেন রাতে-বিরাতে। বহুবার তাঁরা ফোন করেছেন। এ ব্যাপারে অনেক কিছু করা হয়েছিলো।
আমার ব্যক্তিগত দিক থেকে একটা বিশেষ সন্তুষ্টি ব্যাপার ছিল। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তখন বাংলাদেশ আন্দোলন পক্ষে এখানে কাজ করছিলেন। তবে তাঁর কাজের ধারা ছিল স্বতন্ত্র। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরদের সঙ্গে এবং আন্তর্জাতিক আইনজীবী সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলেন। কারণ, তিনি বিচারপতি ছিলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরও ছিলেন। টেলিফোনে কয়েকদিন ধরে কথাবার্তা হলো। আমি তাঁকে বুঝাতে চেষ্টা করছিলাম যে তাঁর প্রকাশ্যে কাজ করা উচিত। তিনি তখন ভাবছিলেন, তাঁর আত্মপরিচয় না দিয়ে যদি তিনি শিক্ষাব্রতী এবং বিচারকমণ্ডলীদের মধ্যে কাজ করেন ভালো কাজ হবে। এ সময়ে তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট-এর সদস্যদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বাংলাদেশ প্রশ্ন তুলে ধরেন।
ইতিমধ্যে দেখা গেল যে, ব্রিটেনে বাংলাদেশ আন্দোলনের সপক্ষে কাজ করার জন্য, বিশেষ করে ২৫শে মার্চ তারিখের পর থেকে আমাদের কর্মীর অভাব নেই, কিন্তু তাদের নেতৃত্ব দেয়ার লোকের অভাব আছে। যা হোক বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে আমি এ বিষয়ে অনেক কথাবার্তা বলেছি। শেষ পর্যন্ত তিনি স্থির করলেন যে, তাঁর আত্মপ্রকাশ করার প্রয়োজন আছে। বোধ হয় এই স্বাধীনতা আন্দোলনের সপক্ষে আমার সবচাইতে আত্মতুষ্টির কারণ, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আমার যুক্তির সাথে একমত হয়েছিলেন। আমার মনে আছে, তারপরে তিনি আত্মপ্রকাশ করে যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, আমার সাংবাদিক বন্ধু পিটার গিল (পরবর্তীকালে যিনি উপমহাদেশের ‘ডেলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার সংবাদদাতা হয়েছিলেন), আমার এখানে বসে বিচারপতি চৌধুরীর সাথে কথাবার্তা বলেছিলেন এবং তাঁর একটি আধ ঘণ্টাব্যাপী সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম আমি।
আমার ব্যক্তিগত দিক থেকে আর একটা সন্তুষ্টির কারণ এই যে; টেলিফোনে তৎকালীন পাকিস্তানের বাংলাদেশী কূটনীতিকরা, যাঁরা বিভিন্ন দূতাবাসে ছিলেন, আমি তাঁদের নাম বলতে চাই না। তাঁদের অনেকের সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছিলো। আমার মনে হয় তাঁরা সেই সময় বাংলাদেশের পক্ষে চাকরি ছাড়তে রাজি ছিলেন এবং পরে ছেড়েছিলেন।
আমার মনে আছে, বিভিন্ন সময়ে লন্ডনে যখন র্যালি করা হতো, পার্লামেন্ট লবী করা হতো, টেলিফোন করলে আমাদের বাংলাদেশীরা জিজ্ঞেস করতেন কতো লোক দরকার। কখনো কোথাও পাঁচ হাজার, কোথাও তিন হাজার – আগে থেকেই আমরা ঠিক করে নিতাম কোথায় কতো লোক পাঠানো হবে এবং সেই পরিমাণ লোক তাঁরা সংগ্রহ করে পাঠাতেন দু’একদিনের নোটিশে। সেই সময় বাংলাদেশের মহিলা সমিতি এখানে খুব কাজ করছিলো। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং মহিলা সমিতির সদস্যরা পার্লামেন্টের অধিবেশনের সময় নিয়মিত গিয়ে পার্লামেন্ট ভবনে বসে থাকতেন। সদস্যদের কাছ থেকে অবশেষে তারা শতাধিক পার্লামেন্ট সদস্যদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিলেন বাংলাদেশের দাবি সমর্থন করে পার্লামেন্টে একটা প্রস্তাব আনার ব্যাপারে। সেখানে আবার আর একটা সংশ্লেষ আছে, তখন মহিলা সমিতির সাধারণ ছিলেন আমার স্ত্রী সুফিয়া রহমান।
-সিরাজুর রহমান
বিবিসি, বাংলা বিভাগ
১৯৮০