নিউ স্টেটসমেন, ১৬ই এপ্রিল, ১৯৭১
বাংলাদেশে রক্তপাত
যদি রক্তকে ধরে নেয়া হয় জনগণের স্বাধীনতার অধিকারের মূল্য হিসেবে, বাংলাদেশ তাহলে স্মরণাতীতকালের সংগ্রামগুলোর মধ্যে সবেচেয়ে চড়া দাম পরিশোধ করেছে শুধুমাত্র সরকারপতন এবং ভৌগোলিক সীমারেখা পরিবর্তনের জন্য। স্বাধীনতার লক্ষ্যে এতো অল্প সময়ের একটি সংঘর্ষে এ পর্যন্ত এতো রক্তপাত এবং ক্ষয়ক্ষতিতে বাঙালিদের দুঃখদূর্দশা একটি রেকর্ড হিসেবে বিবেচিত হবে।যদি তাদের এই আন্দোলন কয়েকদিন বা সপ্তাহের মধ্যেই অবদমিত হয়ে যায় তবে এটি কেবলমাত্র তাদের স্বাধীনতার যুদ্ধে অস্থায়ীভাবে পরাজিত হওয়া হিসেবে গণ্য হবে এধরণের ঘটনাগুলোতে সাধারণত প্রশাসনের স্বপক্ষেই মতামত যায় এবং সে কারণে যে কোনও বিশ্ব শক্তির বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন ঘোষণার সম্ভাবনা কম। সব নিয়মতান্ত্রিক ভাবে চলার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য “বাঙালিদের” এই দাবি একদমই অযৌক্তিক নয়, কিন্তু এটি অন্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য এটি মাথাব্যথার কারণ নয়। তাই এই মুহূর্তে আমরা এবং অন্যান্য রাষ্ট্র গুলোর বিবেচনা করার সময় এসেছে যে জাতিসংঘের সনদে ‘জনগণের আত্মনির্ধারণের অধিকার’ বলতে আসলে আমরা কি বোঝাই, নাকি এই শব্দ গুলো অবাস্তব বা বিষয়ভিত্তিক? ইংরেজি কিংবা চাইনিজে, পুঁজিবাদী বা সমাজতান্ত্রিক শ্রেণীতে যেই দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হোক না কেন পূর্ববাংলার মানুষের এই দাবি কোনোভাবেই ফেলে দেয়া যায় না যেমনটা বরদাস্ত করা যায় না বিশ্বশক্তিগুলোর বাংলাদেশের ব্যাপারে উন্নাসিকতা।
নিয়মতান্ত্রিক ভাবে পশ্চিমের দেশগুলোতে যেটা স্বীকৃত, বাঙালিরা তাই করেছে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো নিজেদের দাবি জানায় ব্যালটবাক্সের মাধ্যমে, নির্বাচনে পুরো পাকিস্তানের এসেম্বলিতে তারা পরম সখাগরিষ্ঠতা পেয়েছে।এটি ছিল দেশটি অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচন এবং ফলাফল একটি উল্লেখযোগ্য ধাক্কা হিসাবে এসেছে, যদিও বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদের দীর্ঘ ইতিহাসকে তুলে ধরলে, যার ব্যাপ্তি পঞ্চাশের দশকের ভাষা এবং সংবিধানবিরোধী আন্দোলন থেকে আজ পর্যন্ত এটি এত বিস্ময়কর হওয়া উচিত নয়। আনুগত্যের চেয়ে মতাদর্শ আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, বাঙালির সংখ্যাগরিষ্ঠতা তারই প্রমান।
এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে , ইয়াহিয়া খান এর ইসলামাবাদ সরকার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরে, যার শক্তি হচ্ছে একটি সেনাবাহিনীর উপর ভিত্তি করে (যেখানে বাঙালিরা অপাঙতেয়)। ইসলামাবাদের অস্থিরতার প্রতিক্রিয়া হয়েছে অত্যন্ত হিংস্র । আমরা টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি পশ্চিম পাকিস্তানিরা ‘ঐক্য পুনঃস্থাপন’ নাম দিয়ে কি করছে, আর পূর্বাঞ্চল এটিকে বলছে গণহত্যা। সত্যটি হয়তো এই দুই দাবির মধ্বর্তী কিছু, কিন্তু নিকটবর্তী ভবিষ্যতে এই পরিস্থিতি সমাধানের কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না।
‘বিয়াফ্রার’ ঘটনার সাথে এই ঘটনার তাল মিলিয়ে পশ্চিমের অনেক আবেগী বামপন্থীরা তাদের চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে এই ভেবে যে অ-সাদা মানুষ একে অপরকে হেয় করতে পারে না , যেটা কিনা স্বভাববিরুদ্ধ, এবং মানবিকতার দিকে নিজেদের মনোযোগ নিবদ্ধ করেছে। কিন্তু কথিত সমস্যাটি শুধুমাত্র প্রতিরক্ষার সীমা অতিক্রম করে আরো জটিল হয়ে ওঠা একটি সমস্যা। একই ছাঁচে ফেলে পূর্ব পাকিস্তানকে সত্যিই ‘বিচ্ছিন্ন’ রাষ্ট্র বলা যাবে না, যেখানে ‘শোষণ’ একটি ভিন্ন অর্থ নিয়েছে। পূর্ববাংলাবাসীরা দাবি করে আসছে যে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের ভর্তুকি দেওয়ার জন্য নিয়মিতভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি অনেক আগে ১৯৪৮ সালের পার্টিশনের মধ্যে দিকে শুরু হয়েছিল। নিজেদের উত্থানের জন্য প্রেসিডেন্ট জিন্নাহ পার্টিশনের পর বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সরকারপেক্ষি পদক্ষেপ নেন, যেখানে প্রদেশগুলোর নিজেদের আয় এবং বিক্রয় কর নেবার অধিকার প্রত্যাহার করা হয়, এবং তাদের আমদানি এবং রপ্তানি আয়ের প্রধান অংশ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য রাখা হয়।
পূর্ব পাকিস্তান এই পদক্ষেপের ফলে বিশেষ বিশেষ ভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, কেননা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে তাদের আয় তদনুসারে বরাদ্ধ কোনওভাবেই বর্ধিত হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, গত দুই দশক ধরে পাকিস্তানের ৭০শতাংশ বিনিয়োগযোগ্য তহবিল পশ্চিমে এবং পূর্ববাংলায় মাত্র ৩০ শতাংশ। পশ্চিমাঞ্চলে রাজস্বের ৭৫শতাংশ এবং পূর্বদিকে মাত্র ২৫ শতাংশ ব্যয় হয়। বৈদেশিক সাহায্য বরাদ্ধ হয় জনসংখ্যার উপর ভিত্তি করে, তবে পূর্ব পাকিস্তানের দুই তৃতীয়াংশ জনগণের মধ্যে নগদ অর্থের মাত্র ২০ শতাংশ বরাদ্ধ পাওয়া যায়। পূর্বপাকিস্তানি অর্থনীতিবিদদের অনুমানে স্বাধীনতার পর থেকে পূর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রকৃত সম্পদ স্থানান্তর প্রায় ৩০০ মিলিয়ন পাউন্ড। এই যুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশ অবশ্যই আরও বেশি হবে আর্থিক ভাবে নিজের উপর নির্ভরযোগ্য এবং রাষ্ট্রগঠনের জন্য আরেকটি মৌলিক যোগ্যতা পূর্ণ করলো বাংলাদেশ।
বৈদেশিক সহায়তার প্রশ্নটি ক্ষমতার রাজনীতির দিকে পরিচালিত করে। পূর্ববাংলা সম্ভবত সুস্পষ্টভাবে ঠান্ডা যুদ্ধের প্যাটার্নের মধ্যে পরে না এবং এর ব্যাপারে পূর্বগৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ এবং অবস্থানগত জটিলতা বিশেষভাবে লক্ষনীয়। ব্রিটিশরা সেন্টোতে (Cento) এবং সিয়াটো-মেরে (Seato-mere) পরিকল্পনা সংগঠনগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের সাথে সংযুক্ত এবং নিশ্চিতভাবেই যার মাধ্যমে অস্ত্র সরবরাহ করা যেতে পারে। তবে ইয়াহিয়া খানের সাথে চীনের সম্পর্ক আরো কাছাকাছি এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ। গুজব ছড়িয়েছে যে পেইকিং ইন্দ-চায়নার সীমান্তে মনোযোগ আকর্ষণকারী কার্যকলাপ তৈরি করবে যদি ভারত (রাশিয়ানদের দ্বারা সমর্থিত) বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করে। চীন পশ্চিম বাংলার কমিউনিস্টদের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, যারা সীমান্তের অপরপাশের বাংলাভাষাভাষী ভাইদের সাহায্যের চেয়ে ভালো কিছু চাইতে পারে না কিন্তু এক তাদের পক্ষে এটা সম্ভবপর হবে না (সম্ভবত এই অবস্থানটি চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করে যে চীনের বৈশ্বিকভাবে বড় ক্ষমতা অবস্থান অর্জন করেছে)। আমাদের সরকার কি অবস্থান নেয় তার উপর ব্রিটেনের অবস্থান নির্ভর করছে, যেখানে সিঙ্গাপুর এর ঘটনার ব্যাপারে সবার অবজ্ঞা ছিল কঠোরভাবে নিন্দনীয়।
যাইহোক, এই ঘটনা চলতে থাকবে এবং রীতি অনুসরণ করে অনুসন্ধান হবে এবং এ থেকে এখনো অনেককিছু জানবার আছে। ঘটনাপ্রবাহ আইজেএনকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ৭৫ মিলিয়ন পূর্ব পাকিস্তানি মনে করেন যে জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে তাদের ততটাই অধিকার আছে যতটা আছে ৪৫মিলিয়ন পশ্চিমা পাকিস্তানির, এবং এই ধরনের পরিস্থিতিতে তারা দাবি করছে যে অস্ত্র সরবরাহ, বৈদেশিক ত্রাণ এবং সাহায্য বন্ধ এবং নিষেধাজ্ঞা প্রণয়ন। এই জরুরি দাবিগুলো কেউ গ্রাহ্য করবে না যেমন কনর ক্রুজ ‘ও’ ব্রিয়েন বলেছেন যে জাতিসংঘ হচ্ছে ডেলফির ওরাকলের মতো, এটি দ্বন্দে সবসময় শক্তিশালীর পক্ষে কথা বলে এবং যথারীতি এখন তারা নিশ্চুপ আছে।
কিন্তু এই অবস্থা চলতে পারেনা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পরবর্তী এটাই সবচেয়ে নবীন ফেডারেশন যেটাকে ভাঙা যাবে। মাউন্টব্যাটেন যখন ভারতীয় উপমহাদেশকে ভাগ করেছিলেন ভৌগোলিকতার চেয়ে তিনি ধর্ম আঁকড়ে ধরাদের প্রতি দুর্বলতা দেখিয়েছিলেন। আমরা অসুখী এবং সমস্যা জর্জরিত আয়ারল্যান্ড এর ঘটনা থেকে অভিজ্ঞতা কাজে লাগাইনি যেটা ভারতবর্ষ ভাগের বিষয়ে ছিল একটা চরম ব্যর্থতা। পাকিস্তানের মূল ভিত্তি যেখান থেকে সৃষ্ট, তেমন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান, মালয়েশিয়া, রোডেশিয়া এবং আরবীয় ফেডারেশন সব ভেঙ্গে গেছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, তাদের প্রত্যেকেই পাকিস্তানের মত ছিল, একটি রাজনৈতিক কারণে ‘রাষ্ট্র’ বানানো হয়। সহজ কথা হচ্ছে যে এরকম রাজনৈতিক কারণে সৃষ্ট কৃত্রিম কাঠামো বেঁচে থাকতে পারে না। এই সত্যটি সবাই গ্রহণ করার আগে আর কত মানুষের প্রাণ যাবে ?