মুক্তিযুদ্ধের পূর্বপ্রস্তুতিতে ভূমিকা পালন
১.
প্রাক-মক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম আর সিদ্দিকী তার এক আত্মজবানিতে (মার্চ ১৯৮৪) চট্টগ্রাম জেলায় ও সন্নিহিত অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধপূর্বপ্রস্তুতি- যাতে সিভিল সার্ভিস অফিসারদেরও বিশেষ ভূমিকা ছিল, সেসম্বন্ধে বলেন: “..In Chittagong Major Rafique then Capt. of the EPR contacted us and conveyed that the entire EPR Officers and Jawans will be with us. He undertook to contact his counterparts in Rangamati, Kaptai, Cox’s Bazar and arrange for their joining the fight as soon as the signal is given to them. In the Cantonment Brigadier Mazumdar was in charge. He sent Captain Amin Ahmed Chowdhury to be in touch us every night and pledged their support. The then D. C. Mustafizur Rahman and SP….of Chittagong also pledged their support.”৮৩
এইচ. টি. ইমাম লিখেছেন: “১৬ মার্চ রাতে চট্টগ্রাম থেকে সহকর্মী ডেপুটি কমিশনার মুস্তাফিজুর রহমান টেলিফোনে জানালেন যে, পরদিন (১৭ মার্চ) সকালে যেন তার বাংলােয় উপস্থিত হই। জরুরি বার্তা আছে, টেলিফোনে বলা যাবে না। ১৭ মার্চ সকালে হাজির হলাম ডি.সি, মুস্তাফিজুর রহমানের বাংলােয় । সেখানে বসে আছে সহকর্মী মহিউদ্দীন খান আলমগীর। ঢাকা থেকে তাকে ব্যক্তিগত বার্তা দিয়ে পাঠিয়েছেন তৎকালীন সি.এস.পি, সমিতি (CSP-Civil Service of Pakistan), পূর্বপাকিস্তান শাখা ।.. বিষয়বস্তু হলো এই যে, আমাদের সমিতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা অসহযােগ আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘােষণা করছি এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে তাজউদ্দীন আহমদ সাহেবের নির্দেশাবলি মেনে চলব। পরবর্তী বার্তা হলাে ঢাকা থেকে দুই কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতা ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী এবং খন্দকার মােশতাক আহমদ চট্টগ্রামে গিয়েছেন, ২ ও ৩ মার্চের ঘটনাবলি তদন্তের জন্য। তাদের সাথে ঐদিন সকালে (১৭ মার্চ) এম.আর. সিদ্দিকী সাহেবের বাটালিহিলের বাংলােতে সাক্ষাৎ করতে হবে। ডি.সি. মুস্তাফিজ, আমি এবং মহিউদ্দীন খান আলমগীর পাহাড়ের ওপর সুদৃশ্য বাংলােতে ঢােকার পথেই লে. কর্নেল চৌধুরীর সাথে দেখা, শাদা পােশাকে।..”৮৪
যাই হােক, যে কোনাে কারণেই হােক পরবর্তীকালে শেষােক্ত দুই সিভিল সার্ভিস অফিসারের পক্ষে আর প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ বা মুজিবনগর সরকারে যােগদান করা সম্ভব হয়নি। অবরুদ্ধ পূর্বপাকিস্তানেই তারা মাঠপ্রশাসনে নিয়ােজিত ছিলেন।
২.
১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা বা ভবেরপাড়া (পরে ‘মুজিবনগর’ নামে পরিচিত) গ্রামের আম্রকুঞ্জে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠাকালে স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠকারী অধ্যাপক মােহাম্মদ ইউসুফ আলী তাঁর আত্মকথনে উল্লেখ করেছেন (নভেম্বর ১৯৮৪): “২৪শে মার্চ সকাল ৬টা। বাসার টেলিফোন বেজে উঠলাে। দিনাজপুর সদর এস, ডি, ও আব্দুল লতিফ।সাহেব অত্যন্ত উত্তেজিত কণ্ঠে জানালেন সৈয়দপুরে দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে। বাঙ্গালীদের মেরে শেষ করে দিচ্ছে। আমি ফোন করলাম জিলা আনসার কমাণ্ডার শরীফুল ইসলাম সাহেবকে। তাকে বললাম রাইফেল ক্লাবে কি কি অস্ত্র এবং গুলি আছে খুব তাড়াতাড়ি বের করে আনুন। বেশ কয়েকটি রাইফেল এবং কয়েক কার্টন গুলি নিয়ে এস, ডি, ও সাহেবের জিপে এগিয়ে চললাম সৈয়দপুরের দিকে।” তিনি আরও উল্লেখ করেন: “বড় অস্বস্তির মধ্যে ঘুমহীন রাত (২৫শে মার্চের রাত) কেটে গেলাে। ভাের হতে আজানের পর পরই মাইকে প্রচার শুনলাম বেলা ১১টা থেকে কারফিউ। দিনটি ছিল শুক্রবার।/ সকাল সাড়ে সাতটার সময় বারান্দায় বসে আছি। এমন সময় ডি সি-র একজন পিয়ন সালাম জানিয়ে আমার হাতে একটা স্লিপ দিল। তাতে ডি, সি (ফয়েজউদ্দিন সাহেব) লিখেছেন আমার বাসায় আমার সংগে চা খেলে আমি খুব খুশী হব। আমি ৮টার দিকে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম ।../ ডি. সি-র বাংলাের গেট বন্ধ, পাশের সার্কিট হাউসের গেট খােলা। গাড়ী থেকে নামার সংগে সংগেই গেটের পাহারাদার সৈনিক এমন অভদ্র এবং কর্কশ ভাবে আমাকে অভ্যর্থনা করে ভিতরে নিয়ে গেল যাতে আমরা মনটাই খারাপ হয়ে গেল। গাড়ী বারান্দায় বেশ কয়েকজন মিলিটারী অফিসার। এক পাশে ডি. সি। তিনি এগিয়ে এসে আমার সাথে হাত মেলাতেই শান্ত স্বরে বললেন আপনি কেন এলেন? বলেই মুখ ফিরিয়ে আরেকদিকে চলে গেলেন। আশ্চৰ্য্য ব্যাপার! (পরে ডি,সি আমাকে বলেছিলেন যে অস্ত্রের মুখে তিনি সেই শ্লিপ লিখে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন)। একটু পরে আরাে ২/১ জন আওয়ামী লীগ নেতা এলে লেঃ কঃ তারেক রসুল কোরেশী আমাদের নিয়ে বসলেন।”৮৬
উল্লেখ্য, বর্ণিত ‘ডি, সি ফয়েজউদ্দিন’-এর পুরাে নাম ফয়েজ উদ্দীন আহমেদ, পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকারের সংস্থাপন সচিব হন (স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব) ও বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন; মুক্তিযুদ্ধে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিস্তারিত জানতে দেখা যেতে পারে তাঁর পাঁচ দশকের স্মৃতি কথা, বিশেষত গ্রন্থটির মুক্তিযুদ্ধের সূচনা এবং আমার অংশগ্রহণ’ অধ্যায়টি।৮৭
৩.
মুক্তিযুদ্ধ কালের অন্যতম পত্রিকা জয় বাংলার ৮ই এপ্রিল ১৯৭১ সালে প্রকাশিত ৮ম সংখ্যায় বগুড়ায় মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক পর্যায়ের প্রথমদিকে স্থানীয় জনসাধারণের হানাদারদের প্রতিরোধ সম্পর্কিত কিছু দুঃসাহসিক ঘটনা তুলে ধরেছে। এতে দেখা যায়, বগুড়ার তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক আব্দুল হাই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে স্থানীয় তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করছেন। পত্রিকাটিতে পাচ্ছি: “প্রথম দিনেই হানাদারদের বাধা দিতে রওয়ানা হইবার পূর্বে বগুড়ার মহকুমা প্রশাসক জনাব আব্দুল হাই সাহেব তাহাদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক উদ্দীপনাময়ী ভাষণ দিয়া তরুণ মুক্তি সেনাদিগকে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিলেন। শ্রদ্ধেয় হাই সাহেব বয়োঃবদ্ধ হইলে কি হইবে- বগুড়ার বীর তরুণেরা তাহাকেও তরুণ বলিয়া স্বীকার কবিয়া নিয়াছেন। জেলা প্রশাসকসহ অন্যান্য সরকারী কর্মচারীবৃন্দও তাহাদের সহিত সর্বপ্রকার সহযােগিতা করিয়াছেন।”৮৮
৪.
ভূতপূর্ব এম.এন.এ. ও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পীকার আব্দুল মালেক উকিল তদীয় আত্মজবানিতে লিখেছেন (১/৭/১৯৮৪): ২৬ মার্চ সকালেও আমরা বিভিন্ন সূত্রে স্বাধীনতা ঘােষণার কথা এবং হানাদার বাহিনীর গণহত্যার কথা অবহিত হই। এসময় নােয়াখালী জেলার ডেপুটি কমিশনার ছিলেন জনাব মনযুর উল করীম (বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব)। আমি তার মারফতে জেলা ও দায়রা জজ গাজী শামসুর রহমান (বর্তমানে প্রেস কাউন্সিলের সভাপতি) এবং পুলিশ সুপার শহীদ আব্দুল হাকিম সহ মহকুমা প্রশাসক ও সকল সরকারী কর্মচারী, ম্যাজিস্ট্রেট, ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারকে নােয়াখালী সার্কিট হাউসে ২৬ তারিখে ১০টার মধ্যে সমবেত হওয়ার জন্য আহ্বান জানাই। আওয়ামী লীগের সমস্ত এম পি এ, এম এন এ ও বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকেও ঐ সমাবেশে উপস্থিত থাকতে অনুরােধ করি। নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই সমস্ত সার্কিট হাউজ এবং সম্মুখের ময়দান জনসমদ্রে পরিণত হয়। উক্ত সমাবেশে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি হিসেবে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম করার জন্য দলমত জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে আহ্বান জানাই। উপস্থিত সর্বস্তরের জনগণ এবং জিলা ও দায়রা জজ সহ সকল স্তরের কর্মচারী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে স্বাধীন বাংলার পক্ষে সংগ্রাম করার শপথ গ্রহণ করে। ইতিমধ্যে আকস্মিকভাবে ডেপুটি কমিশনার জনাব মনযুর উল করিম বঙ্গবন্ধু মুজিব কর্তৃক ঘােষিত একটি ইংরেজীতে টাইপ করা স্বাধীনতার ঘােষণা পত্র আমার হাতে দেন। সেটি ছিল ? To the people of Bangladesh and also the World:-/ Pakistan Armed Forces suddenly attacked..for freedom./
“Joy Bangla”./ Sk. Mujibur Rahman.”? এটি হুবহু বঙ্গবন্ধু ২৫শে মার্চের রাতে অয়ারলেস মাধ্যমে ঘােষণা করেছিলেন।”৮৯
উল্লেখ্য যে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যে কোনো কারণেই হােক উপরে বর্ণিত ‘জনাব মনযুর উল করীম (প্রকৃত নাম মঞ্জুর-উল-করিম; ১৯৬২ সাল ব্যাচের সিএসপি) মুক্তিযুদ্ধে বা মুজিবনগর সরকারে যােগদান করেননি বা করতে পারেননি। তখন তিনি দুটি জেলায় জেলা প্রশাসক পদে নিয়ােজিত ছিলেন।
৫.
আগেই বলেছি, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর একেবারে প্রথমপর্বেই কয়েকজন সিএসপি জেলা প্রশাসক বা ডেপুটি কমিশনার (কোথাও কোথাও মহকুমা প্রশাসকও)- যাদের মধ্যে অন্যতম এইচ, টি, ইমাম, এম, এন, কাদের খান ওরফে মােহাম্মদ নুরুল কাদের, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী প্রমুখ স্ব স্ব নিয়ন্ত্রণাধীন জেলা ট্রেজারি বা ব্যাঙ্কের ভল্ট ভেঙ্গে প্রচুর নগদ অর্থ (তখনকার পাকিস্তানি মুদ্রায় কয়েক কোটি টাকা), স্বর্ণালঙ্কার প্রভৃতি মূল্যবান সম্পদ, কেউ কেউ সরকারি যানবাহন পর্যন্ত (যেমন, পাবনার জেলা প্রশাসক এম. এন. কাদের খান ওরফে মােহাম্মদ নুরুল কাদের) সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে তথা সীমান্ত পেরিয়ে মুজিবনগর সরকারে যােগ দিয়েছিলেন।
এপ্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদীর ভাষ্য উদ্ধারযােগ্য। তিনি লিখেছেন: “৩০ শ্রাবণ, ১৩৭৮ সােমবার, ১৬ আগষ্ট ১৯৭১/ ..স্বরাষ্ট্র সচিব জনাব আব্দুল খালেক (প্রাক্তন আইজি) স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেন যে, একটা সর্বগ্রাসী মুক্তিযুদ্ধ চালাতে যে অর্থ সম্পদের কথা ভাবা যেতে পারে তা আমাদের ছিল না। পাবনার ডেপুটি কমিশনার নুরুল কাদের খান (পরে সংস্থাপন সচিব) পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে একদফা সম্মুখ যুদ্ধের পর তার ট্রেজারির টাকা নিয়ে ভারতে এসে সেই টাকা প্রবাসী সরকারের (বাংলাদেশ সরকার, মুজিব নগর) হাতে তুলে দেন। তেমনি ট্রেজারির টাকা প্রবাসী সরকার পেয়েছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার হােসেন তৌফিক ইমাম ও সাংসদ মুস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকীর কাছ থেকে।..সর্বসাকুল্যে সতেরাে-আঠারাে কোটি টাকায় চালাতে হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশাসনিক ও সামরিক ব্যয়।”৯০
অন্যদিকে যারা সেজাতীয় পদে ছিলেন না বা তেমন সুযােগ পাননি, তাদেরও কেউ কেউ সংশ্লিষ্টদের সহায়তা করেছেন বলে জানা যায়। সুকুমার বিশ্বাসের মুক্তিযুদ্ধে রাইফেলস ও অন্যান্য বাহিনী গ্রন্থে লিখেছেন৯১ (নিম্নরেখাঙ্কিত নামগুলাে লক্ষণীয়): কুড়িগ্রামে পাক সেনাবাহিনীর আক্রমণ মােকাবিলার বা প্রতিরােধের প্রস্তুতিস্বরূপ- “২৮শে মার্চ ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন বাঙালি কোম্পানি কমান্ডার এবং অন্যান্যদের ডেকে টসরাইহাটে এক সভায় মিলিত হন। সেই সভাতে
সুবেদার আরব আলী, হাবিলদার আবুল হােসেন ভূইয়া, মহকুমা প্রশাসক মামুনুর রহমান এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গ উপস্থিত ছিলেন।../ ১৪ই এপ্রিল পাক বাহিনীর দুটি কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান রাজারহাট এবং কুলারঘাটে ব্যাপক আক্রমণ চালায়। পাক সেনাদের সর্বাত্মক আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা স্থান দুটি ছেড়ে পিছনে সরে আসে এবং ১৫ই এপ্রিল মুক্তিবাহিনীর ‘এ’ কোম্পানি কাকিনা নামক স্থানে, ‘বি’ কোম্পানি পাটেশ্বরী ঘাটে, ‘সি’ কোম্পানি পাটেরঘাটের বামদিকে রৌমারী সড়কে এবং ‘ডি’ কোম্পানি ফুলবাড়ি থানায় পুনরায় ডিফেন্স নেয়। ইতিমধ্যে ‘রিয়ার হেডকোয়ার্টার’ কুড়িগ্রাম থেকে সরিয়ে ভুরুঙ্গামারীতে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৬ই এপ্রিল নিম্নোক্ত ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে কুড়িগ্রাম ব্যাঙ্কের যাবতীয় অর্থ ভুরুঙ্গামারীতে নিয়ে যাওয়া হয়।
১. ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন।
২. মহকুমা প্রশাসক মামুনুর রহমান।
৩. রংপুর সদরের জনৈক ম্যাজিস্ট্রেট
৪. এম. সি. এ. রিয়াজউদ্দিন আহমদ
৫. এম. সি, এ. শামসুল হক চৌধুরী এবং
৬. এম. সি. এ. আবদুল হাকিম
১৮ই এপ্রিল সমুদয় অর্থ কুচবিহারের এক নিরাপদ স্থানে রাখা হয়।”
এখানে মনে রাখতে হবে, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দেশে, অচেনা নতুন পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত ও মুক্তিযুদ্ধের ন্যায় সুকঠিন ও জটিল দায়িত্ব-কর্তব্য নির্বাহকারী প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের হাতে শুরুতে তাে বটেই, এমনকি পরেও পর্যাপ্ত অর্থ-সম্পদ ছিল না এবং না-থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। ফলে সিএসপি প্রভৃতির মাতৃভূমি থেকে নিয়ে যাওয়া এসব অর্থ-সম্পদ কিছুটা হলেও সেদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তথা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে কাজে লেগেছিল। প্রসঙ্গত মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের রিলিফ কমিশনার জয় গােবিন্দ ভৌমিকের আত্মকথনের (জুন ১৯৮৪) অংশবিশেষ জানা যেতে পারে, যা এরকম: “..এখানে বলা প্রয়ােজন যে, মুজিবনগর সরকারের হাতে অনেক পাকিস্তানী মুদ্রা জমা পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য। অনেক অফিসার ও সংগ্রামী জনতা পূর্ব পাকিস্তানের অনেক ব্যাংক, ট্রেজারী থেকে বেশ কিছু টাকা নিয়ে গিয়ে ঐ সরকারের হাতে জমা দেয় । সেই জমাকৃত টাকা থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে কিছুদিন অফিসারদেরকে এলাউন্স হিসেবে দেয়া হতাে।”৯৩
যাই হােক, এপর্যায়ে মুজিবনগর সরকারের স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বসান বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জনসংযােগ অফিসার রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদীর ৭১এর দশমাস শীর্ষকগ্রন্থে নানাসূত্রে উদ্ধৃত এজাতীয় আরও কিছু ঘটনা তুলে ধরা হলাে।
৬.
“বরিশালে নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের (এম, এন, এ) নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এখানে স্থানীয় এম এন, এ ও এম, পি, এ সহ মেজর এম, এ জলীল ও ছাত্র নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।.. জেলা প্রশাসক আইয়ুবুর রহমান প্রতিরােধ সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।”৯৪
৭.
“…২৬শে মার্চ সকালে ফরিদপুরে পুলিশ কন্ট্রোল ওয়ারলেস থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণা বার্তা আমরা পাই। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সে বার্তা শহরে প্রচার করেছে মাইক নিয়ে।”৯৫
৮.
“সীমান্ত জেলা ও মহকুমা প্রশাসনের বহু সি এস পি, ই পি সি এস, পুলিশ কর্মকর্তা ভারতে আশ্রয় লাভ ও স্বাধীনতা যুদ্ধ (যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।”৯৬
৯.
“৩১ চৈত্র ১৩৭৭ বুধবার ১৪ এপ্রিল ১৯৭১/..পাকবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বিমান থেকে গুলী করে(।) ফলে সাধারণ জনসাধারণসহ কিছু বাঙ্গালী সৈন্য নিহত হয়। উল্লেখ্য সেদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার(য়) স্বাধীনবাংলা পতাকা উড্ডীন থাকে। এস ডি ও জনাব রফিকউদ্দিন আহমদ তৎপর ছিলেন।”৯৭ এই ‘এস ডি ও জনাব রফিকউদ্দিন আহমদ’ আসলে হলেন কাজী রকিবউদ্দীন, যিনি ছিলেন ১৯৬৭ সাল ব্যাচের সিএসপি (পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন সচিব ও বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার)। প্রসঙ্গত এর এবং অন্যদের সম্বন্ধে এইচ. টি. ইমাম। লিখেছেন: “আগরতলায়/.. এইরকম একটা অবস্থায় বিদেশে, ভিন্ন সরকারের আশ্রয়ে আমাদের একটা অফিস চালানাে যে কী কঠিন আর দুরূহ কাজ, তা আজ কেউ অনুমানও করতে পারবেন না। অবশ্য রামগড়ে (২ মে পর্যন্ত) এবং সাব্রুমে। রাজনৈতিক বড় মাপের কোনাে নেতা থাকতেন না। মাঝে মাঝে আসতেন।/ এমন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কাজ শুরু হয়। এই অঞ্চলে প্রথমে আমাদের বেসামরিক প্রশাসক হলেন মাহবুব আলম চাষী। তার সাথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এস.ডি.ওকাজী রবিউদ্দীন, হবিগঞ্জের এস.ডি.ও. আকবর আলী খান। আমি (পার্বত্য চট্টগ্রামের ডি.সি.) রামগড়ে, ঠিক ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তে (কয়েকশ গজের মধ্যেই ফেনী নদীর অপরপাড়ে সাব্রুম শহর)।”৯৮
১০.
২ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮ সােমবার ১৭ মে ১৯৭১/.. সিরাজগঞ্জের বিপ্লবী এসডিও একে শামসদ্দিন সি এস পি (জনগণ তাকে কর্ণেল শামছুদ্দিন বলতাে) সশস্ত্র প্রতিরােধ গড়ে বলিষ্ঠ সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছিলেন। উল্লেখ্য পরে স্ত্রীর সাথে দেখা করতে এসে ধরা পরে (পড়েন) পাকসেনাদের হাতে। ক্যান্টনমেন্টের একাটি (একটি) ছােট সেলে নারকীয় অত্যাচারে শহীদ হন ২৯ মে।../ ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮ মঙ্গলবার ২৫ মে ১৯৭১..পাক বাহিনী উল্লাপাড়া আক্রমণ করে। সিরাজগঞ্জের এস ডি ও বীরমুক্তিযােদ্ধা সামসুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন মুক্তিফৌজ তীব্র লড়াই পরিচালনা করেন। এই লড়াই তিনদিন অব্যাহত থাকে। তরুণ সি এস পি অফিসার বীর মুক্তিযােদ্ধা সামসুদ্দিন আহমেদের দেশপ্রেম ও যুদ্ধ পরিচালনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।”৯৯
এসময় মাঠপ্রশাসনের যেসমস্ত সিএসপি-ইপিসিএস, পুলিশ অফিসার প্রমুখ অকাল মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তাদের কারাে কারাে বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে এবং শােকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে পূর্বপাকিস্তান সরকার গভীর শোকও প্রকাশ করেছিল; তবে তা কৃত্রিম লােক-দেখানাে, নাকি গতানুগতিক রীতির অনুবর্তন, তা অবশ্য জানা যায় না।
নমুনা স্বরূপ পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক বীর মুক্তিযােদ্ধা পূর্বোক্ত জনাব এ. কে. সামসুদ্দিনের মৃত্যুপ্রসঙ্গে তৎকালীন সরকারের শােকপ্রকাশ নিচে হুবহু (verbatim) দেখা যেতে পারে;১০০
Registered No. DA-1.
The
Dacca (Monogram) Gazette
Extraordinary
Published by Authority
WEDNESDAY, NOVEMBER, 3, 1971
PART I-Orders and Notifications by the Governor of East
Pakistan, The High Court, Government Treasury, etc.
GOVERNMENT OF EAST PAKISTAN
SERVICES AND GENERAL ADMINISTRATION
DEPARTMENT
General Administration Branch
Section 1
RESOLUTION
No. GAI-351/71-2038-20d November 1971—The Government of East Pakistan announce with profound regret the sad news of the death of Mr A. K. Shamsuddin, C.S.P., formerly Subdivisional Officer, Serajganj, Pabna on the 20″ May 1971.
পৃষ্ঠা: ৯৮
- Mr A. K. Samsuddin was born on 2nd August 1943 and joined the Civil Service of Pakistan in the year 1967. He was serving under the Government of East Pakistan since October 1968.
- The Government of East Pakistan convey their sincere condolence and heart-felt sympathies to the widow of late Mr A. K. Shamsuddin and other members of the bereaved family and wish that his soul may rest in peace.
By order of the Governor
- N. ISLAM
Additional Chief Secretary to the
Government of East Pakistan.
যাই হােক, এভাবে সিভিল অফিসার তথা সিএসপি-ইপিসিএস অফিসারদের আরও অনেককে মুক্তিযুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় । যেমন, রাঙ্গামাটির তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক আবদুল আলী সম্পর্কে এইচ. টি. ইমাম তাঁর বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ গ্রন্থে লিখেছেন: “রাঙামাটি সদরের এস.ডি.ও. আবদুল আলি ছিলেন আরেক মহৎপ্রাণ, বাংলাদেশের জন্য নিবেদিত। আবদুল আলি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ। এপ্রিলে পাকিস্তানি সেনারা রাঙামাটি দখলের সাথে সাথে তাকে গ্রেপ্তার করে। সে-সময় তিনি রামগড়ের পথে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা অমানুষিক অত্যাচার করে আলির ওপর, আমার গতিবিধি এবং কার্যকলাপ জানার জন্য। শহীদ আবদুল আলি নিজে প্রাণ দিয়ে আমাদের নিরাপত্তা রক্ষা করেছেন। তিনি শত অত্যাচারেও মুখ খােলেননি কিংবা আমাদের গতিবিধি ও কাজ সম্বন্ধে শক্রদের কাছে কিছু ফাঁস করেননি।”১০১
এরকম অনেক সিভিল অফিসার ছিলেন যারা মুখ বুজে পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্মম অত্যাচার সহ্য করেছেন এবং শেষপর্যন্ত জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন, তবু হানাদারদের জেরার মুখে জবান খােলেননি বা মাথা নত করেননি। এইচ. টি. ইমাম তদীয় বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-৭৫ গ্রন্থে লিখেছেন: “পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে সমস্ত বাঙালি অফিসারকে শেরেবাংলা নগরস্থিত তথাকথিত বন্দিশিবিরে (POw camp) আটক করে রেখেছিল, তাদেরকে মুক্ত করে (দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে) যথাযথ সম্মানের সাথে সরকারি বিভিন্ন পদে নিয়ােগ দেয়া হয়। এদের মধ্যে ছিলেন আইয়বুর রহমান (সি,এস,পি, ১৯৫৯), আ. ন. ম. ইউসুফ (সি.এস.পি, ১৯৬১), সৈয়দ রেজাউল হায়াত (সি.এস.পি, ১৯৬৭),
নুরুল মােমেন খান (পি.এস.পি, ১৯৬১), লােকমান হােসেন (ডিরেক্টর, ডাক ও তার বিভাগ), শাহ মােহাম্মদ ফরিদ (সি,এস,পি, ১৯৬৮) এবং আরাে অনেকে। এদের যােগদানের ফলে সরকারি কর্মকাণ্ডে গতি সঞ্চারিত হয়।”১০২
এপর্যায়ে মুজিবনগর তথা যুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারে যােগদান এবং সামগ্রিক অর্থে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে পূর্বপাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ বা সরকার যারপরনাই ক্ষুব্ধ, উদ্বিগ্ন ও খড়গহস্ত হয়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কী কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল, তা একনজর দেখতে চেষ্টা করব। প্রথমেই এসংক্রান্ত যে-নােটিশ কর্তৃপক্ষ জারি করেছিল (ঢাকা গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত), স্বব্যাখ্যাত সেই ৩-প্রস্থ নােটিশ (১টি সিএসপি এবং ১টি ইপিসিএস অফিসারদের বিরুদ্ধে) নিচে হুবহু (verbatim) উদ্ধার করা হলাে।
১৩-জন সিএসপি অফিসারের বিরুদ্ধে ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে জারিকত, ‘জোন বি’র তৎকালীন সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান স্বাক্ষরিত নােটিশ:
Registered No. DA-1.
The
Dacca Gazette
Extraordinary
Published by Authority
THURSDAY, SEPTEMBER 2, 1971
PART 1-Orders and Notifications by the Governor of East Pakistan, the High Court, Government Treasury, etc.
GOVERNMENT OF EAST PAKISTAN
MARTIAL LAW HEADQUARTERS ZONE ‘B’ DACCA
NOTIFICATION
No. MLA Zone ‘B’ 286/R/A dated 1 Sep 1971
- In exercise of the powers conferred on me under MLR-40, 1, Lieutenant General Tikka Khan, HQA, S.Pk, Administrator Martial Law Zone ‘B’, order you:
(1) Kh. Asaduzzaman, CSP, Joint Secy, Finance Department, Dacca,
(2) T. Imam, CSP, D. C. Chittagong Hill Tracts,
(3) Abdus Samed, CSP, D. C., Sylhet,
(4) Mr. Md. N. Q. Khan, CSP, D. C. Pabna,
(5) Syed Abdus Samad, CSP, Rehab. Officer, Chittagong Hill Tracts,
(6) Quadrat-e-Ilahi Choudhury, CSP, Addl D. C. Rajshahi,
(7) Md Khoshruzzaman Chowdhury, CSP, S. D. 0., Kishoreganj.
(8) Kazi Rakubuddin Ahmed, CSP, S. D. O., Brahmanbari,
(9) Waliul Islam, CSP, S. D.O., Magura,
(10) Akbar Ali Khan, CSP, S. D.O., Habigonj,
(11) Kamaluddin Siddique, CSP, S.D.O., Narail,
(12) Md Tawfique-e-Ilahi Choudhury, CSP, S. D. O., Meherpur,
(13) Saadat Hossain, CSP, Asstt. Commissioner, Jessore,
to appear before SMLA Sector-6 MPA Hostel Dacca at 0800 hrs on 8 Sep 71 to answer to the charge under MLR-25 read with Martial Law Zone ‘B’ Order No. 120 levelled against all of you.
- If you fail to appear as aforesaid, you will be tried in absentia in accordance with the provisions of MLR-40.
TIKKA KHAN
LIEUTENANT GENERAL
Martial Law Administrator
Zone ‘B’.
Place: DACCA
Date: 1 Sep 71.
Source: মুক্তিযুদ্ধে সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসারদের ভূমিকা কাবেদুল ইসলাম