খন্দকার আসাদুজ্জামান
যদিও সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, তবুও অনেকের মতো আমার মনেও দ্বিধা ছিল যে আসলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ আদৌ ক্ষমতা লাভ করবে কিনা। বিশেষ নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হবার পরেও যখন ক্ষমতা হস্তান্তর করা নিয়ে পাকিস্তানিরা বিভিন্ন অজুহাতে গড়িমসি করতে লাগলো, তখন এই ধারণা আমার মনে আরো দৃঢ়বদ্ধ হয়। সবই মনে হচ্ছিলো একটা সাজানো ব্যাপার, একটা সুদৃশ্য চালবাজি, যার মাধ্যমে গভীর কিছু ঢেকে রাখার প্রচেষ্টা চলছে।
আমি সে সময় রাজশাহীর জেলা প্রশাসক ছিলাম। ৫ ই জানুয়ারীর পরে আমাকে প্রাদেশিক সরকারের অর্থ- বিভাগের যুগ্ম-সচিব হিসেবে নিয়োগ করা হয়। আমি ঢাকায় এসে সার্কিট হাউসে উঠি এবং চারিদিকে খোঁজ খবর রাখতে থাকি। বাইশে ফেব্রুয়ারী যখন মন্ত্রিসভা ভেংগে দেয়া হয় তখন আমার আশংকা আরো ঘনীভূত হয় যে অবস্থা হয়তো বা খুব খারাপ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে এবং সবই হচ্ছে তারই পূর্বপ্রস্তুতি। যখন সংসদ অধিবেশন স্থগিত করা হয়, তখন বলা যায় আমরা এক প্রকার নিশ্চিত যে দূর্যোগ সামনেই রয়েছে। এই সময় যে গণআন্দোলনের জোয়ার বয়ে যাচ্ছিলো, তাতে প্রায় সকলেই শামিল হয়। সবাই চাইছিল কোন না কোন ভূমিকা পালন করতে। আমরা যারা সরকারি চাকুরি করতাম এবং একই সাথে দেশ-সচেতন নাগরিক ছিলাম, তাঁরা বিশেষভাবে আলোচনা করতে থাকি বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের কী ভূমিকা হওয়া উচিৎ।
একটা সভায় আমরা একসাথে মিলিত হই এবং আলোচনার পর কয়েকটি সিদ্ধান্ত এবং ঐকমত্যে উপনীত হই। আসন্ন দূর্যোগ যে অভাবনীয় কিছু সেটা সবাই ধারণা করে এবং বুঝতে পারে এই চক্রান্তের পিছনে একটা উদ্দেশ্য কাজ করছে-সেটি হচ্ছে বাঙালিদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে শেষ করে দেয়া। যেভাবেই হোক অসহযোগিতা বা প্রতিরোধ করতেই হবে। দেশ ও জাতির সংকট এমনই তীব্র যে সরকারী-বেসরকারী ছাপ প্রয়োগের কোন অবকাশ নেই। সমস্যা এবং বিপদ গোটা জাতির। আমাদের এই সভা অনুষ্ঠিত হয় জনাব সানাউল হকের বাসায়। জনাব সালাউদ্দিন, জনাব মুজিবুল হক এবং আরো কয়েকজন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমরা ঘটনার গতিধারা পর্যালোচনা করতে থাকি। খুব সহজেই অনুমিত হয় যে প্রস্তুতি পর্ব চরমে উঠেছে। এম ভি সোয়াতে অস্ত্র এসে গেছে। আমার মনে হচ্ছিল যে ভয়াবন কিছু ঘটার শুধু বাকি। যখন জয়দেবপুর, চাটগাঁ এবং আরো কয়েকটি জায়গায় সেনাবাহিনী মানুষ হত্যা করেছে তখন ঘটনা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে তা পরিষ্কার হতে থাকে।
এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমি ২৩ তারিখে আমার গ্রামের বাড়ি টাংগাইলের উদ্দেশে রওয়ানা হই। সেখানে গিয়ে বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সাথে আলাপ হয়। ২৪ তারিখে আমার শ্যালিকা ঢাকা ছেঁড়ে আসে এবং আমাদের জানায় যে, ঢাকা এখন একটা ভয়ের শহরে পরিণত হয়েছে। ২৫ তারিখে আলোচনা ভেংগে যায়। ২৬ তারিখে ঢাকার ঘটনা আমরা জানতে পাই। এই ঘটনা শোনার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা একত্রিত হন এবং সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন আগামী কর্মসূচীর। আমাকেও এই সভায় যোগদান করতে আহ্বান করা হয় এবং সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। আমি উক্ত পরিষদের পরামর্শদাতা হিসেবে যোগদান করি। জনাব বদিউজ্জামান এই সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি হন। ঘোষণা করা হয় বাংলাদেশ স্বাধীন এবং এই স্বাধীনতা রক্ষার্থে আমরা সর্বাত্মকভাবে লড়বো।
আমি আমার বক্তব্য রাখি এবং বলি, যে সব মানুষ এলাকায় আছে তাদের দু’টি ভাগে বিভক্ত করতে হবে। যথা- ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং ট্রেনিংবিহীন। এছাড়া আমরা পুলিশ ও আনসারদেরও যোগদান করতে অনুরোধ জানাই। এইভাবে বিভিন্ন কর্মীশিবির খোলা হয়। মূল সমস্যা অবশ্য একটাই, সেটা হচ্ছে অস্ত্র। খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে, ডি সি এবং পুলিশ অফিসার উভয়ই অনুপস্থিত। তাদেরকে সংবাদ দেয়া হয় এবং তাঁরা এসে এই আন্দোলনে যোগদান করেন। এদিকে ট্রেজারীর দায়িত্বে যিনি ছিলেন তিনি বলেন যে তাঁর নিজের অবস্থা বাঁচানোর জন্য একটা কিছু লিখিত দেয়া উতিচ। ওই এলাকার সর্বোচ্চ সরকারী কর্মচারী হিসেবে আমি তাঁকে লিখিতভাবে আদেশ দেই। চারদিকে সাড়া পড়ে যায় এবং সবাই আন্দোলনে অংশগ্রহণের ইচ্ছে পোষণ করে। এক কথায় সবাই জড়িয়ে পড়ে কোন না কোন কাজে। এই অত্যন্ত আনন্দজনক এবং অনুপ্রেরণাদায়ক হলেও নিয়মশৃংখলার সমস্যা সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা দেখা যায়। আমরা যতদূর সম্ভব সুসংগঠিত এই আন্দোলন গড়ে তুলতে চেষ্টা করি। আমি বুঝেছিলাম যে সরাসরি ট্রেনিং এর ব্যবস্থা না করলে অথবা অস্ত্রের সঠিক ব্যবহার না হলে অবস্থা অসুবিধাজনক হতে পারে। এই সময় টাংগাইলের ছাত্রনেতা কাদের সিদ্দিকী আমার সাথে দেখা করেন এবং বলেন যে তিনিও কিছু ছেলেকে ট্রেনিং দিচ্ছেন এবং আমাকেও এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন। খবর নিয়ে জানা যায় যে জেলা সদর দপ্তরে বি ডি আর ক্যাম্প আছে এবং সেখানে প্রচুর অস্ত্র আছে। আমরা তাঁদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করি।
তারা জানান, কোনভাবে তাঁদের কাছ থেকে অস্ত্র নেয়ার চেষ্টা করলে তাঁরা শুধুই দেবেনই না বরং সংগ্রামেও যোগদান করবেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তাদের উপর একটা ভুয়া আক্রমণের ব্যবস্থা করি। প্রায় সাথে সাথেই বিডিআর সৈন্যরা পাকিস্তানীদের বন্দি করে এবং আমাদের সাথে যোগদান করে। এই ঘটনাটি ঘটে ২৮শে মার্চ তারিখে। আমরা সে সময় শুনতে পাই যে মেজর শফিউল্লাহ জয়দেবপুর থেকে বাঙালী সৈন্যদের নিয়ে বের হয়ে গেছেন এবং ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। সিরাজগঞ্জ থেকে উক্ত এলাকার কর্মকর্তা জনাব শামসুদ্দীন আসেন। তিনি জানান যে সাঙ্গগঠনিক দিন থেকে তাঁরা অনেক এগিয়েছেন কিন্তু তাঁদের কোন অস্ত্র নেই। আমরা জানাই যে আমরা ৫০ টা রাইফেল তাদের দিতে পারি।
আমাদের নিজেদের এলাকায় আমরা আমাদের সীমিত সংখ্যক অস্ত্র বিলি করি। যতদূর সম্ভব সেইভাবে আর যেখানে যেখানে ট্রেনিং হচ্ছে সেখানে একটা দুটো করে অস্ত্র দেয়া হয়। এই সময়ে ময়মনসিংহের অবস্থা জানার চেষ্টা করি। আমরা জানতে পারি যে, সেখানকার ইপিআর বাহিনীও বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। শহর প্রায় জনশূন্য। অবশ্য সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জেলা প্রশাসকের বাসায় পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। হাসান আহমদ এবং সিরাজুল্লাহ ছিলেন এই এলাকার সরকারী কর্মকর্তা। উক্ত সভায় রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া এবং সৈয়দ আব্দুস সুলতান উপস্থিত ছিলেন আমাদের সাথে। আমরা তাদেরকে জানাই টাংগাইলে কি ধরণের কর্মতৎপরতা চালানো হচ্ছে। আলোচনার পর ঠিক হয় যে যদি প্রতিরোধের প্রশ্ন আসে তবে আমরা মধুপুরেই প্রতিরোধ করবো যেহেতু রণকৌশলের দিক থেকে এই জায়গা আমাদের সবচেয়ে সুবিধাজনক মনে হয়। সমস্যা অবশ্য তখনও একটাই ছিল অস্ত্র কোথায় পাওয়া যাবে।
টাংগাইল এসে খবর পাই যে পাক সেনারা টাংগাইল অভিমুখে আসছে। পরে আবার খবর আসে যে মির্জাপুর পর্যন্ত এসে তারা ফিরে চলে গেছে।
ই পি আর –এর কিছু সৈন্য নিয়ে আমি মির্জাপুরের উদ্দেশ্যে রওয়না হই। আমরা কালিহাতিতে এসে থামি এবং মির্জাপুর গিয়ে সংসদ সদস্য শওকত আলী খানের সাথে দেখা করি। তিনি আমাদের বক্তব্য শোনেন এবং একমত হন যে প্রতিরোধ করলে মির্জাপুরের আগেই করতে হবে। এরপর মেয়েদেরকে কুমুদিনী কলেজ এবং হোস্টেল থেকে চলে যেতে বলা হয়। কালিয়াকৈর পর্যন্ত গিয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়। ঠিক হয় পাক-সেনাদের গতিবিধির ওপর চোখ রাখা হবে। ৩ রা এপ্রিল গোলাগুলির আওয়াজ পাই। নাটিয়াপাড়া নামে একটা জায়গায় পাকিস্তানীরা আক্রমণ চালিয়েছে। কয়েক ঘন্টা যুদ্ধ হয় এবং আমাদের সৈন্যরা পিছু হটে গেলে শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ এবং গ্রাম পোড়ানো। আমি টাংগাইল-এর আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম আক্রমণ হলে কোথায় যেতে হবে।
আমাদের প্রধান কাজ ছিল অস্ত্র হেফাজতে রাখা। কাদের সিদ্দিকী এই কাজের দায়িত্বে ছিলেন। গিয়ে দেখি তিনি দুটো ট্রাকে অস্ত্র বোঝাই করেছেন। নতুন সদর দপ্তরের উদ্দেশ্যে রওনা হই। আমি সিদ্ধান্ত নেই যে, আমার পরিবারকে গ্রামের বাড়িতে রেখে আসবো, এক সাথে থাকবো না। এখানো বলা যেতে পারে যে, এক এলাকা থেকে আর এক এলাকায় আমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। খবর পেলাম টাঙ্গগাইল পাকিস্তানীরা দখল করে নিয়েছে। তখন ঠিক করি যে জামালপুর যাবো। সেখানে এম পি নিজামউদ্দীনের সাথে দেখা হয়। অস্ত্রের অভাব পুনর্বার প্রকটভাবে জানতে পারি। এরপর আমি নিজ পৈতৃক নিবাসে যাই। গিয়ে দেখি ডাইনামাইট দিয়ে সেটা উড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং জানতে পারি যে আমাকে ধরিয়ে দেবার জন্য ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এমতাবস্থায় সিদ্ধান্ত নেই সিরাজগঞ্জ যাওয়াটাই শ্রেয় হবে। সিরাজগঞ্জ আমাদের গ্রামের ঠিক উল্টো দিকেই অবস্থিত। আমরা হেঁটেই পার হয়ে যাই। এর মধ্যে একটি ঘটনা ঘটে যায়। ডি, সি-র স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন এবং তিনি শারীরিক অসুস্থতার কারণে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। বাবার ধারণা ছিল সেটাই ভালো হবে। পথিমধ্যে তাঁরা গোপালপুরে এসে জানতে পারেন যে কারফিউ জারি করা হয়েছে। রাত্রে ওখানকার ও সি এসে জানায় যে আমার নামে গ্রেপ্তারী পরওয়ানা রয়েছে এবং আমাকে পেলে পাকসেনারা হয়ত সবাইকেই হত্যা করবে। আমরা আবার সাংগঠনিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকি। জানতে পারি পাকিস্তানীরা আরিচা পর্যন্ত এসে গেছে। তখন আমরা বগুড়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। এর মধ্যে নগরবাড়ীর পতন ঘটে ১১ই এপ্রিল।
উল্লাপাড়ায় গিয়ে দেখি বি ডি আর – এর সৈন্যরা ঢাকা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি বগুড়াত চলে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি শহর প্রায় জনশূন্য। হঠাৎ রিক্সায় জনাব গাজিউল হককে দেখি। আরো কিছু অফিসারের সঙ্গে দেখা হয়। বগুড়া তখনও মুক্ত। এরই মধ্যে পাকিস্তানীদের সাথে দুটো সংঘর্ষ হয়েছে। এখনে সংগ্রাম পরিষদ সব দায়িত্ব পালন করছিল। তবে কতদিন এই প্রতিরোধ টিকিয়ে রাখা যাবে তা নিয়ে সবাই বিচলিত ছিল। এম আর আখতার মুকুলের সাথে দেখা হয় সেখানে। তিনি ঢাকার খবর দিলেন। তিনিও আমাদের সাথে জয়পুহাটের দিকে রওয়ানা হন। সেখানে আমাদের পরিবারের লোকজনকে রেখে আমরা কয়েকজন ১৬ই এপ্রিল হিলি উপস্থিত হই ভারতীয় সীমান্তে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোকজনদের সাথেও সেখানে দেখা হয়। অস্ত্রের প্রকট অভাব সহজেই পরিলিক্ষিত হয়।
আমরা সীমান্ত পার হয়ে ভারতীয়দের সাথে যোগাযোগ করি এবং অস্ত্রের সাহায্য কামনা করি কিন্তু সে সময় কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। তাঁদের কাছে নাকি কোন আদেশ ছিল না আমাদের সাহায্যের ব্যাপারে। অবশ্য আমরা নিজেরাও জানতাম না যে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছে।
এমন সময় খবর এলো যে জয়পুরহাট দিয়ে পাকিস্তানীরা আসছে হিলির দিকে। সেখানে মুকুল সাহেব ছিলেন, খবর পাঠালাম আমার এবং তাঁর নিজের পরিবারসহ্ন হিলি চলে আসতে। কিন্তু খবর পাঠানোর বহুক্ষণ পরও কাউকে না আসতে দেখে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ি। তখন কিছু লোক এবং অস্ত্র নিয়ে জয়পুরহাটের দিকে যেতে থাকি। পথিমধ্যে পাঁচবিবির কাছে হঠাৎ জীপ গাড়ির আলো দেখি এবং তারপরই সবার সাথে দেখা হয়। জানতে পারি যে মুকুল সাহেবকে যে কোন কারণেই হোক পাঞ্জাবী বলে সন্দেহ করা হয় এবং অন্যদেরকে বিহারী মনে করা হয়। তাদেরকে থানাও নিয়ে যাওয়া হয় এবং শেষ পর্যন্ত ও সি-র কথায় জনতা তাদেরকে মুক্তি দেয়। রাত ১২ কি ১ টার দিকে আমরা সীমান্ত পার হই। আমার মানসিক অবস্থা যে কি ছিল তা বলার নয়। ভীষণ মন খারাপ। এভাবে যে দেশ ছাড়তে হবে তা কোনদিন ভাবিনি। তাছাড়া মুজিবনগর সরকারের কোন সংবাদ আমি তখনও জানতাম না।
মালদাহ পৌঁছে ডি সি-র সাথে দেখা করি। শুনলাম অন্য কয়েকজনও এসেছেন এই পথ দিয়ে। তাঁর কাছে কোন নির্দেশ আসেনি তবে তিনি আমাকে মুজিবনগর সরকারের সংবাদ দিলেন। পরের দিন মুকুল সাহেবের সাথে কোলকাতায় উপস্থিত হই এবং জনাব নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন ও কামরুজ্জামানের সাথে দেখা করি। তাঁদের সাথে সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা হয়। জনাব নুরল কাদের খানের সাথে কথা হয় এবং আমাদের দুজনকে একটি সরকারের কাঠামো তৈরি করার দায়িত্ব দেয়া হয়। কিছুদিন পর আমাদেরকে সচিব হিসেবে নিয়োগ করা হয়।
এর কয়েকদিন পরই জনাব হোসেন আলী মুজিবনগর সরকারের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করেন। আমি অর্থ সচিব হিসেবে নিয়োজিত হই এবং দূতাবাসের একটি কক্ষে আমার দপ্তর স্থাপন করি।
আমদের অর্থের মূল উৎস ছিল বিভিন্ন ট্রাজারি থেকে লব্ধ টাকা। এর সঙ্গে যোগ হয় হোসেন আলী সাহেবের নিয়ন্ত্রণাধীন দূতাবাসের টাকাগুলো। একাউন্ট রক্ষা করার এবং সরকারী অর্থের অডিট করা আমার বিভাগের প্রধান কাজ ছিল।
মুজিবগর সরকারের কাজ ছিল প্রধানত দুটি- এক. যুদ্ধ করা দুই. শরণার্থীদের দেখাশোনা করা। আমাদের দায়িত্ব ছিল ভারতীয় সরকারের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে শরণার্থীদের জন্য সাহায্যের ব্যবস্থা করা। এই সাহায্য ছিল প্রধানত ভারতীয়। কিন্তু রিলিফ ক্যাম্পগুলো ছিলো আওয়ামীলীগ নেতাদের হাতে।
আমরা মাঝে মাঝেই এই শরণার্থী শিবিরগুলোতে যেতাম। সেখানকার অবস্থা ছিল অবর্ণনীয়। তবে ভারতীয় এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা এই দুরবস্থা কিছুটা লাঘব করার জন্য বহু কাজ করেছে।
সংগ্রামের দ্বিতীয় পর্যায়ে ছিল ‘মুক্তিফৌজ’ গড়ে তোলা। ছেলেদের প্রশিক্ষণ দান ছিল এই কর্মসূচীর প্রধান অংশ। এই লক্ষ্যে “যুব নিয়ন্ত্রণ বোর্ড’ গঠিত হয়। উইং কমান্ডার মীর্জা এর প্রধান ছিলেন। ফ্লাইট লেঃ রেজা তাঁকে সহায়তা করতেন। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। লাখ লাখ তরুণ ও যুবক এসে তাতে যোগদান করে। এই যুবশিবিরগুলোকে মুজিবনগর সরকারের অর্থে চালানো হতো। শিবির এলাকা থেকেও চাঁদা সংগ্রহ করা হলো কিন্তু সব খরচ ‘ফাইনানসিয়াল রুল’ অনুযায়ী হতো। একটি প্রতিষ্ঠিত সরকার যে নিয়মে তাঁর টাকা বরাদ্দ ও খরচ করে, আমরা যতদূর সম্ভব, সেইভাবেই করতাম। এখানে উল্লেখ্য যে, সরকারী কর্মচারীদের সর্বোচ্চ বেতন ছিল পাঁচশত টাকা। যুদ্ধের খরচের ব্যাপারে সরাসরি সিদ্ধান্ত নিতেন মন্ত্রী পরিষদ। এটি আমাদের বিষয় ছিল না।
জোনাল এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল গঠন ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই আঞ্চলিক প্রশাসনিক এলাকাগুলো যেমন সেই এলাকার সব দায়িত্ব বহন করতো তেমনি এদের প্রায় সামগ্রিক অর্থ যোগানোর দায়িত্ব ছিল আমাদের বিভাগের। তবে আমরা খুব টেনে খরচ করতাম যেহেতু আমাদের অর্থ ছিল কম এবং কেউ বলতে পারতো না যুদ্ধ কতদিন চলবে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার আমাদের সব হিসাবের সঠিক হিসাব গ্রহণ করে।
কিছু কিছু মুক্ত এলাকায় সীমিতভাবে ব্যবসা বাণিজ্য চালু করা হয়েছিল। এর একটি কারণ ছিল শত্রুকে জানানো যে আমরা ক্রমে প্রশাসন দখল করে নিচ্ছি। এছাড়া বেসরকারী কোন সংগঠন বা কোন দলের হাতে ক্ষমতা যাতে না যায় সে জন্যও। এই সব কাজেও আমাদের দপ্তর সাহায্য করতো ও নিয়ন্ত্রণ রাখতো।
মুজিবনগর সরকার একটি প্লানিং বোর্ড স্থাপন করেছিল। এই প্রতিষ্ঠানকে বলা যেতে পারে আগামী বাংলাদেশের একটি প্রতিবিম্ব স্বরূপ। যে সব পরিকল্পনা এখানে তৈরী হয় তা ছিল সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলক। বিভিন্ন ধরণের পরিকল্পনা তৈরী হয় বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। এই পরিকল্পনাগুলো ছিল স্বাধীন দেশের জন্য সেই স্বাধীনতা যত দ্রুতই আসুক কিংবা দীর্ঘকাল পরেই আসুক।
অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে একটা পরিষ্কার করা যেতে পারে। জোনাল এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলগুলোকে কিছুটা স্বাধীনতা দেয়া হতো অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে। একই সাথে এটাও লক্ষ্য করা তাঁদের দায়িত্ব ছিল যে অন্য কোন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান যেন চাঁদা সংগ্রহ অভিযান না চালায়। কেবলমাত্র তাদের চাঁদা সংগ্রহই বৈধ ছিল এবং তারাই সেই অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার করবেন।
তবে আমরা এটাও জানতাম যে বিচ্ছিন্ন যেসব মুক্তি এলাকা ছিল বা যেখানে যোদ্ধারা ছিল সেখানে চাঁদা ওঠানো হবে। আমরা খবর পেতাম যে চাঁদা সংগ্রহ হতো খুবই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে। সাধারণ মানুষরা এই সব ক্ষেত্রে নিজেরাই এগিয়ে এসেছে সব ধরণের সাহায্য নিয়ে। জোনাল এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল- এর ব্যাপারে আর একটা বলা যায়। সেটা হচ্ছে এই বিভাগকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হতো তাঁদের কাজকর্ম পরিচালনা করার জন্য। কেননা এই ব্যবস্থা ছাড়া তাদের পক্ষে এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বহন করা সম্ভব ছিল না। প্রায় সব ধরনের সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার তাদের ছিল। আমরা মুজিবনগর সরকার পরিচালনা করতাম সম্পূর্ণ নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্যের ওপর। আমাদের সঙ্গে ভারতীয় সরকারের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত আনুষ্ঠানিক এবং প্রয়োজনভিত্তিক।
সরাসরি কোন যোগাযোগ খুব কমই হতো। লিয়াজোঁ অফিসারের মাধ্যমে আমাদের কাজ সমাধা হতো এবং প্রয়োজনীয় তথ্য আদান প্রদান করা হতো।
আমরা জানতাম মুক্তিযুদ্ধে সৈন্যবাহিনীই প্রধান ভূমিকা পালন করবে তবে আমরা একই সাথে সচেষ্ট ছিলাম একটি সক্রিয় সরকার প্রতিষ্ঠা করতে। যাতে প্রয়োজনের সময় আমরা একটি কার্যকরী সরকার তৎক্ষণাৎ চালু করতে পারি। প্রায় সব টাকা-পয়সা প্রদান করা হতো চেকের মাধ্যমে। এখানে বলা যায় যে সমগ্র মুজিবনগর সরকারের অধীনে এক হাজারেরও বেশী কর্মচারী ছিল। আমাদের টাকা-পয়সা বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যাংকেও রাখা হতো- যদিও সরকার হিসেবে আমাদের কোন আনুষ্ঠানিক অস্তিত্ব ছিল না। যুদ্ধ সম্পর্কিত গোপনীয়তা চরমভাবে রক্ষা করা হতো। খুব কম লোকেই জানতো যুদ্ধ কখন শুরু হতে পারে যদিও সবার কম-বেশী ধারণা ছিল যে যুদ্ধ বাধবেই। যেমন আমরা ১৯৭২ সালের বাজেটও প্রস্তুত করি যা পরে প্রয়োজন হয়নি। এখানে উল্লেখ্য যে, আমাদের কাছে যে অর্থ ছিল তা আমাদের হিসাবে দু’বছর পর্যন্ত সরকার পরিচালনার জন্য যথেষ্ট ছিল। এরপর অবশ্য নতুন অর্থ সংগ্রহের প্রশ্ন আসতো। আমরা অবশ্যই চাইছিলাম সমস্যার দ্রুত সমাধান। আমাদের মনে হতো যে, মুক্তিবাহিনী একা যুদ্ধ করলে কয়েক বছর লাগবে এবং এ যুদ্ধ ভারতীয় সাহায্য নিয়েই করতে হবে। যদি যৌথ কমাণ্ডের অধীনে যুদ্ধ হয় তবে তা হবে ক্ষণস্থায়ী এবং কম ক্ষয়ক্ষতিপূর্ণ। এটা ছিল যুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের ধারণা।
উপসংহারে বলা যায় সময়টা ছিল একেবারেই বিশেষ ধরনের। নিজেদের শুধুমাত্র সরকারী চাকুরে বলে কখনই মনে হয়নি। আমরা ছিলাম মুক্তিযুদ্ধের একটি অংশ। কোন কষ্টই বড় কষ্ট ছিল না। কোন ত্যাগের প্রশ্নে ছিল না দ্বিধা। কখনও ভাবিনি আমাদের কি হবে। একটা কথাই কেবল মনে হতো-কাজটা যে করেই হোক সমাধা করতে হবে। তাঁর জন্য যা করার দরকার সবই করতে আমরা প্রস্তুত ছিলাম অন্য সবার মত।
-খন্দকার আসাদুজ্জামান
মার্চ ১৯৮৪