You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২রা জানুয়ারী, বুধবার, ১৯৭৪, ১৭ই পৌষ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

চুয়াত্তরে ধনতন্ত্রের নাভিশ্বাস

বিশ্বের ধনবাদী দেশগুলো, বিশেষ করে ধনতন্ত্রী দুনিয়ার মধ্যমণি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে চুয়াত্তর সালটি কি বার্তা বয়ে এনেছে? নতুন বছরের শুভারম্ভেই এই নিয়ে নানা রকম জল্পনা-কল্পনা দানা বেঁধে উঠেছে। প্রাভদার ভাষ্যকার সুস্পষ্টভাবে ভবিষ্যতবাণী উচ্চারণ করেছেন যে, চুয়াত্তর সালে পুঁজিবাদী বিশ্বের দুর্দশার কাল হিসেবেই চিহ্নিত হবে। পক্ষান্তরে, সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ভবিষ্যতের দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে চুয়াত্তর সালে বিরামহীনভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। প্রাভদার ভাষ্যকারের মতে, পুঁজিবাদী দেশগুলো ইতিমধ্যেই যে ব্যাপক শ্রমিক অসন্তোষের মুখোমুখি হয়েছেন, তাতে বর্তমান বছরে বহু শিল্প কারখানা স্বাভাবিক নিয়মেই বন্ধ হয়ে যাবে। প্রবল বেকার সমস্যা দেখা দেবে। এ ছাড়া, মুদ্রাস্ফীতি ইতিমধ্যেই যে করুণ ও মারাত্মক আকারে দেখা দিয়েছে তাতে একদিকে পুঁজিবাদী বিশ্বে জীবনযাত্রার ব্যয়-বাহুল্য অব্যাহত গতিতে বাড়তে থাকবে এবং লাখ লাখ শ্রমিকের ভাগ্যে অনিশ্চয়তার অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে।
সন্দেহ নেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের ধনবাদী দেশগুলোর মধ্যে একটি অন্যতম প্রধান দেশ। এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিচয় সুবিদিত। বিশ্বের সর্বাপেক্ষা ধনী দেশ হয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে এক সীমাহীন অর্থনৈতিক সংকটের যাঁতাকলে নিষ্পিষ্ট হচ্ছে। ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারিত্বের করাল অভিশাপে আজ মার্কিন জনগণের জীবনে ত্রাহি মধুসূদন রব উঠেছে। দ্রব্য মূল্যে ঊর্ধ্বগতি এবং বেকারীর কর্মসংস্থানের দাবীতে মার্কিন মুল্লুকে আজ এক টলটলায়মান অবস্থা। একচেটিয়া পুঁজিবাদের তীব্র শোষণের মুখে এখন সেখানে সংগ্রাম তীব্রতর হয়েছে। এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, তিয়াত্তর সালের প্রথম নয় মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ৪ হাজার ৩শটি ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়েছে—যা বাহাত্তর সালের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য ক্রমশঃ ক্ষুন্ন হচ্ছে। এবং বিশ্ব মুদ্রা বাজারে জগতের অবমূল্যায়ন মার্কিনী কর্তাদের রাতের ঘুম হরণ করে নিয়েছে। ডলারের মূল্যমান স্থিতিশীল তো হচ্ছেই না, বরং ডলারের যে কানাকড়ি মূল্য নেই, তাতে দিন দিন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই করুণ অবস্থার পাঁকে পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আভ্যন্তরীণ উৎপাদন সংকটের কবলে এখন হাবুডুবু খাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের ফলে আরবরা যে তেলাস্ত্রের আঘাত হেনেছে তাতেও ধনবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টনক নড়েছে। মার্কিন নাগরিকের প্রবল চাপের মুখে ভিয়েতনাম থেকে নিক্সন প্রশাসন সৈন্য অপসারণ করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু তবুও সাম্রাজ্যবাদী থাবা বিস্তারের নানা রকম অপকৌশল চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিক্রিয়াশীল চক্রান্তের জটাজাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিরাচরিত নিয়মে যুক্ত থেকে যুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে, শোষণের হাতিয়ারকেও শানাতে এতোটুকু দ্বিধা করছে না। ইন্দোচীনে যুদ্ধ বিরতির পরও সেখানে সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। খোদ মার্কিন মুল্লুকে আভ্যন্তরীণ কলহ তুঙ্গে উঠেছে। মার্কিন জনসাধারণ তাই সংগ্রামের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। মোদ্দা কথায় তিয়াত্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধনতন্ত্রী দুনিয়া হওয়া সত্ত্বেও সমগ্র বিশ্ব জুড়ে নিন্দা ও ধিক্কারই পেয়েছে। এই সব অবস্থার আলোকে ধনবাদী শক্তির মধ্যে যে এ বছর সঙ্গীন অবস্থা দেখা দেবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাগ্যে দুর্দশা দেখা দেবে তা এখন থেকেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধের স্থায়ী ব্যবস্থা

জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা বাংলাদেশের একটা স্থায়ী সমস্যা। শস্য শ্যামলা নদী মেখলা এই বাংলাদেশের যদিও রূপের শেষ নেই এবং যদিও ষড়ঋতুর সহস্র উপচারে এদেশ বারো মাসই রং বদলায়—তবু সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় বৈকি!
এরই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার সামুদ্রিক রক্ষার কবল থেকে দেশের উপকূল ভাগকে রক্ষার জন্যে উপকূল বরাবর দু’শ’ মাইল লম্বা বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে ভাবছেন। এই বাঁধ শুরু হবে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত থেকে এবং সুন্দরবন বরাবর হয়ে বরিশাল জেলার ভোলায় গিয়ে শেষ হবে। এর উচ্চতা হবে ২৫ থেকে ৩০ ফুট। এই বিরাট প্রকল্পে আনুমানিক আটশ’ কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উঁচু মহলে অনুমান করছেন।
প্রতি বছর সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের দরুণ উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে জান ও মালের যে বিপুল ক্ষয়-ক্ষতি হয়, তা জাতীয় অর্থনীতিতে একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রেখে যাচ্ছে। যার ফলে জরুরী অবস্থার ভিত্তিতে সমস্ত সরকারী কর্মতৎপরতাকে যে দিকে সাময়িকভাবে নিয়োজিত করতে হয় এবং স্বাভাবিকভাবে অন্যান্য কর্মসূচীতে বাস্তবায়নের পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।
দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণের দ্বারা শুধু যে এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করা হবে তাই নয়—এর বহুমুখী অন্যান্য সম্ভাবনাও আছে। এই বাঁধে পানি নিষ্কাশন এবং নৌ-চলাচল পথ থাকবে। এর ফলে বিপদসীমার উপরে ১০ কোটি একর ফুট পানি নিষ্কাশন করা যাবে। এর ফলে আগামীতে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের ক্ষতি পরিহার করা সম্ভব হবে এবং জোয়ারে স্থলভাগের পানি বাড়বে না। অর্থাৎ স্থল ভাগের লবণাক্ত পানি প্রতিরোধ করা যাবে যা কৃষিকাজের জন্যে অপরিহার্য।
এছাড়াও. এই বাঁধ সারা বছরের পানি সংরক্ষণের সহায়ক হবে, শীতকালে নৌ-চলাচলের উপযোগী পানি থাকবে এবং চৈত্র-বৈশাখ মাসের প্রচন্ড খরার দিনে কিছু পানি সেচের কাজও হবে।
স্বাধীনতার পূর্বকালে আমরা দেখেছি বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে বিভাষী প্রশাসকদের বিশেষ কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। প্রতিবছর তাই নদীর ভাঙনে, বন্যায়, জলোচ্ছ্বাসে কোটি কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতিতেও তাঁরা গরজ দেখাতেন না। এবং উপকূলীয় জনজীবনের ভোগান্তিতে তাদের কিছু এসে যেতো না। কিন্তু এখন যে আর সে কথা খাটেনা সেই চেতনা জাগ্রত হয়েছে দেখে আমরা আশান্বিত হয়েছি। তবে এই সব পরিকল্পনা কবে এবং কতদূর কার্যকরী হবে সেই প্রশ্নটা এবারও থেকে যাচ্ছে। কারণ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ যাবত যত পরিকল্পনা দেশবাসীর সামনে রেখেছেন এবং বাস্তবায়নের দৃষ্টান্ত রচনার ক্ষেত্রে তাঁরা কতটা সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন সে আলোচনা এখন নিষ্প্রয়োজন।
পরিশেষে, এবার অন্ততঃ আমরা আশা করছি—এ প্রস্তাবিত বাঁধ জাতির জীবনে কল্যাণ ও সমৃদ্ধি বয়ে আনবে। শহরাঞ্চলে সামান্য পানীয় পানি সরবরাহের ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড যত অক্ষমতা ও গাফিলতির পরিচয় দিয়ে থাকুক, দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচী গ্রহণ করে এবার অন্ততঃ তাঁরা সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধের স্থায়ী সম্ভাবনার আশ্বাস দিন।

এদের কথায় বিশ্বাস নেই

আসলে তারা হিসেব মেলাতে পাচ্ছেন না। অনেক চেষ্টা—অনেক কসরৎ সবেই যেন বৃথা যাচ্ছে, ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে তাদের সকল উল্লম্ফন। তাদের প্রতিযোগিতা ছিল কে কত বাড়াবাড়ি করতে পারবেন বা কে কতখানি ফালতু-ফাজিল কথা বলে আসর সরগরম করে হাততালির তোড়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারবেন—তাদের প্রতিযোগিতা ছিল দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করে জাতীয় ক্ষেত্রে কে কত বেশী নৈরাজ্য সৃষ্টি করে আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীদের কাছ থেকে বাহবা কুড়াতে পারবেন, তারই। সেই প্রতিযোগিতায় তাদের মধ্যে স্বদলীয় বা অন্যদলীয়, নবীন বা প্রবীণ কোনো ভেদাভেদ ছিল না। আর এই ভেদাভেদ ছিল না বলেই জাসদের নব্য বিপ্লবীরা যে পাগল-পারা হয়ে নর্তন-কুর্দন শুরু করে দিয়েছিলেন, ভাসানী ন্যাপের নেতারা সেখানটায় সেক্ষেত্রে তাদের কাছে যেন হেরে যাচ্ছিলেন। তাই সেই একই পন্থা অনুসরণ করে স্বীয় দলের যেন মান বাঁচাতে মাঠে নেমে গেলেন খোদ মওলানা সাহেবও। সকল বুদ্ধি-বিবেককে বাদ দিয়ে তিনি একেবারে তথাকথিত সশস্ত্র বিপ্লবের কথা বলে বসলেন। শুধু কি তাই এরশাদ ফরমালেন : বাংলাদেশে আর নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করার পরিবেশ নেই।
কিন্তু, হায় বিধি বাম! মওলানা সাহেব মনে করেছিলেন তিনি খুব মোক্ষম একটা কিছু করে ফেলেছেন—অথচ সেই মোক্ষমটাই শেষটায় বুমেরাং হয়ে গেলো। শেষটায় কিনা ভান্যাপও ডাকাতের দলে। অবস্থা বেগতিক। আর এই বেগতিক অবস্থা দেখেই মওলানা সাহেব গিয়ে উঠলেন সন্তোষের আস্তানায়। যাদু মিয়ার যাদুও যেন লাটে। শেষটায় অগতির গতি ডঃ রাজীকেই এর একটা থোড়বড়ি খাড়া যুক্তি দেখাতে হলো। গত সোমবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি সরাসরি ঘোষণা করলেন : মওলানা সাহেবের ঐ বক্তব্যের সাথে তাঁর দলের কোনো সম্পর্ক নেই—এটা তারা মনে করেন না। আছে। এবং তারা সেটা করবেন।
ডঃ রাজীর কথাটা কিন্তু তাঁর ‘চীফে’র সম্পূর্ণ বিপরীত বক্তব্য। কিন্তু এক্ষণে প্রশ্ন হচ্ছে যদি ডঃ রাজীর কথাই ঠিক হয় যে, মওলানার বক্তব্য দলীয় বক্তব্যের বাইরে তবে কি তারা মওলানার বিরুদ্ধে দলীয় বক্তব্য-বিরোধী বক্তব্য রাখার জন্যে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন—না এ জাতীয় কথাবার্তার দরুণ নিজেরাই তাঁর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করবেন? কিন্তু ডঃ রাজীরা যে ধরনের লোক তাতে করে তার কোনোটাই সম্ভব নয়। কেননা মওলানা সাহেবকে বাদ দিয়ে তাদের রাজনীতি তো শূন্য। কাজেই এদের কথায় বিশ্বাস করার মতো কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ অন্ততঃ জনসাধারণ খুঁজে পাবে না।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!