You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বানী
ঢাকাঃ ২১শে ফেব্রুয়ারী, বৃহস্পতিবার, ৯ই ফাল্গুন, ১৩৮০

একুশে ফেব্রুয়ারি, ইতিহাসের ইতিহাস

দিন যায়, দিন আসে। বর্ষ চক্রের এই চিরন্তন নিয়মেই একুশে ফেব্রুয়ারি বিষাদ মলিন স্মৃতি নিয়ে আজ আবার ফিরে এসেছে আমাদের দুয়ারে। প্রতিবছরই একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জীবনে ফিরে ফিরে আসবে। আমরা শ্রদ্ধাভরে শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের মাজারে পুষ্পাঞ্জলী নিবেদন করব। কন্ঠে তুলে নেবো সেই অবিনাশী সুরঃ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলিতে পারি। এই দিন আমরা ঘুম ভাঙার গান গাইবো, নতুন শপথে উজ্জীবিত হবো, সামনে চলার প্রেরণায় নেবো দৃপ্ত পদক্ষেপ। বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে এই অবিস্মরণীয় লাল তারিখটির স্মৃতি চিরদিন প্রোজ্জ্বল হয়ে থাকবে। কারণ, দিনপঞ্জিকার সব দিনের সব ঘটনা তো ইতিহাস হয়না। একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু একটা ইতিহাস নয়, একুশে ফেব্রুয়ারি ইতিহাসের ইতিহাস। মাতৃভাষার জন্য অকাতরে প্রাণ বিসর্জনের এমন মহিমাদীপ্ত রক্তাক্ত ঘটনা বিশ্বের অন্য কোথাও ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে এদেশের তরুণ সমাজ বিসুভিয়াসের মত গর্জে উঠেছিল। পাকিস্তানি পশ্চিমা প্রভুদের বন্দুকের নলও তারুণ্যের জয়যাত্রাকে নিস্তব্ধ করে দিতে পারেনি। ধর্মের প্রশ্নে ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হয়ে ১৯৪৭ সালে জন্ম নিয়েছিল পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের। আমরা তখন এই পাকিস্তানেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। কিন্তু রাষ্ট্রীয় শাসকচক্র দেশের এই পূর্ব ভূখণ্ডের প্রতি অত্যাচার, অবিচার ও শোষণের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। আমাদের মুখের ভাষার অস্তিত্বকে পশ্চিমা প্রভুরা ধুয়েমুছে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র এঁটেছিল। ফলে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরেই এদেশের বাঙালি ভাষাগত চক্রান্তের আত্ম বলিদানের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিল। সমগ্র বাঙালি জাতির উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করেছিল, ‘আমরা জান দেবো কিন্তু জবাব দেবো না।’ এভাবে ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি কেন্দ্রিক সংগ্রাম বাঙালির অস্তিত্বের সংগ্রামে পরিণত হয় এবং বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি ছাত্র সমাজ রাজপথে বুকের রুধির ছিটিয়ে মুখের ভাষার সম্মান রক্ষা করেছিল। পাকিস্তানের পশ্চিমা প্রভুরা বাঙ্গালীদের ধর্মীয় ঐক্যের বন্ধনে বেঁধে রাখতে প্রয়াসী হয়েছিল। কিন্তু বাঙালিরা সে চক্রান্ত সফল হতে দেয়নি। প্রতিবাদে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাতৃভাষার যোগ্য সম্মান কড়ায়-গণ্ডায় আদায় করে নিয়েছিল। মূলতঃ একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখেই পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম বিস্ফোরণ ঘটেছিল। এ বিস্ফোরণের মূলে ছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, এবং সর্বোপরি বাঙালির নিজস্ব অস্তিত্বের প্রশ্ন। তাই পশ্চিমা প্রভুদের কোন দলন নির্যাতনই বাঙালির অগ্রযাত্রার পথকে অবরুদ্ধ করতে পারেনি। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির দুর্জয় সাহসের প্রতীক হিসেবে তাই চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। একুশে ফেব্রুয়ারির সুমহান ঐতিহ্যকে কেউ কোনদিন ম্লান করতে পারবে না। যতদিন বাঙালি থাকবে ততদিন একুশের জয়গান কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনিত হবে। একুশের মহান শহীদানদের উদ্দেশে আমাদের শ্রদ্ধা নিবেদনের কোন দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে না।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর একুশে ফেব্রুয়ারিকে সরকারিভাবে জাতীয় শোক দিবসের মহিমায় ভূষিত করা হয়েছে। প্রতিবছরের মতো এবারও আমরা একুশের স্মরণে শ্রদ্ধাবনত হব। কালো ব্যাজ পরে, নগ্ন পায়ে রাজপথ প্রদক্ষিণ করতে করতে কন্ঠে তুলে নেবো করুন গানের কলি। কিন্তু বায়ান্নর ভাষা শহীদের আদর্শের জন্য প্রাণাতিপাত করে গেছেন তা কি আমরা বাস্তবায়িত করতে পেরেছি? বড় দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের শিরোপা পাওয়ার পরও, এখনো জীবনের সর্বস্তরে বাংলা প্রবর্তন করা সম্ভব হয়নি। এখানে সরকারি অফিসে আদালতে বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রয়োগ লক্ষিত হয় না। একুশের শহীদরা শুধু ভাষা ও সংস্কৃতির উজ্জীবনের জন্যেই প্রাণ আহুতি দেননি, নানারকম শোষণ বঞ্চনার অবসানও তাদের জীবন উৎসর্গের অন্যতম আদর্শ ছিল। আজ স্বাধীন বাংলাদেশের দৈনন্দিন জীবনে সংকটের’ অন্ত নেই। আমরা আজ রকমারি সংকটের সঙ্গে যুদ্ধ করছি। এ যুদ্ধে যেন বাঙালির জয় অবশ্যম্ভাবী হয়, সেজন্য আজকের মহান একুশের পুণ্য প্রভাতে আমাদের নতুন করে অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হবে। যুগ যুগ ধরে একুশে যেন আমাদের এমনি করে আত্মবিশ্লেষণের সুযোগ এনে দেয়। এবারের একুশেতে এই আমাদের পরম প্রার্থনা।

দৈনিক বাংলার বাণীর তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ

আজ থেকে দুই বৎসর আগে বাহাত্তুরের এই দিনটিতে বাংলার বাণী দৈনিক হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। নানা প্রকার অসুবিধাও প্রতিবন্ধকতার মুখে গত দু’বৎসর বাংলার মেহনতী শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থকে সামনে রেখে দেশপ্রেমিক’ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থেকেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলার সংগ্রামে বাংলার বানী একাত্ম ছিল, সতর্ক ছিল বিগত দু’বৎসরে আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলমন্ত্রের বিরোধী শিবির ও গোষ্ঠী সমূহের নূতন করে শক্তি সঞ্চয়ের বিষয়ে। আমরা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছি প্রশাসনযন্ত্রের একাংশের আমলাতান্ত্রিক মানসিকতার ব্যাপারে, দেশে নূতন পুঁজি ও কালো টাকার অবাধ আগমনের বিষয়টি জনসাধারণের সামনে তুলে ধরেছি এর উদ্ভবের উপাদানগুলো যখন পরিলক্ষিত হচ্ছিল তখনি। বিভিন্ন মহলের ভ্রুকুটি আমাদের সহ্য করতে হয়েছে, আক্রমণ এসেছে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলদের তরফ থেকে।
প্রাথমিকভাবে জাতীয় স্বাধীনতার লক্ষ্যকে সামনে রেখে আজ হচ্ছে থেকে চার বৎসর পূর্বে সাপ্তাহিক বাংলার বাণী প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। বাংলার বাণী আত্মপ্রকাশের পর থেকে তদানীন্তন পাকিস্তানের শাসকচক্রের কুদৃষ্টি পতিত হয় এই পত্রিকাটির উপর। তা প্রকাশিত হতো আওয়ামী লীগের (অস্পষ্ট)কার্যালয় থেকে। পঁচিশে মার্চের সেই কাল রাত্রিতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আওয়ামী লীগ অফিসে যে হামলা চালায় তা থেকে রেহাই পায়নি বাংলার বাণী কার্যালয়ও । মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাকামী মানুষের মনোবলকে অক্ষুন্ন রাখা তথা সার্বিকভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঠিক চিত্র তুলে ধরার মানসে বাংলার বাণী পুনরায় প্রকাশিত হয় মুজিবনগর থেকে। সুদীর্ঘ নয় মাস নিয়মিতভাবে এ কাগজ প্রকাশিত হয়। স্বাধীনতা-উত্তরকালে আর এক সংগ্রামের শুরু। যুদ্ধোত্তর দেশের পুনর্বাসন এবং অর্থনৈতিক সয়ম্ভরতা অর্জনের সংগ্রাম। এই দুই নিকট লক্ষ্য এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলার বাণী বায়াত্তুরের একুশে ফেব্রুয়ারি দৈনিক আকারে আত্মপ্রকাশ করে।
বিগত দুটি বৎসর যে প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে আমাদের অগ্রসর হতে হয়েছে আমরা জানি আরও বেশি প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা আমাদের চলার পথকে দুর্গম করবে। আমরা জানি কোন মহতি আদর্শ প্রতিষ্ঠার পথ কোন দেশে কোন কালেই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। কিন্তু একটা কথা শুধু জানি আর তা হলো সংগ্রামের পথে জনসাধারণের আশীষ, সহযোগিতা ও সহানুভূতিই সকল প্রতিকূলতাকে জয় করবার মূল শক্তি।
বিগত বছরগুলোতে আমরা আমাদের পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের নিকট থেকে যা পেয়েছি তার মূল্য অপরিসীম। তাদের সহযোগিতাই আমাদের প্রেরণার উৎস। আগামীতেও আমাদের পথযাত্রায় তারা সহযোগিতা করবেন, ঐক্যবদ্ধ প্রগতিশীল গণশক্তিই একমাত্র সকল কুপমন্ডুকতা ও ষড়যন্ত্রের নাগপাশ ছিন্ন করতে সক্ষম বলে আমরা দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করি। দৈনিক বাংলার বাণী তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে আমরা তাই সেই গণদেবতার আশীষ কামনা করি।

টিকা নিন কিন্তু কোথায়?

টিকা না নিয়ে থাকলে দেরি না করে টিকা নিয়ে নিন। নিজের পরিবার পরিজন ছাড়াও আশেপাশের মানুষকেও টিকা নিতে বলুন।
ঢাকা শহরের আশেপাশে বিক্ষিপ্তভাবে বসন্তের প্রকোপ দেখা দিয়েছে বলে ঢাকা পৌরসভা একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে গত সোমবার জানিয়েছেন। উল্লেখিত বক্তব্য প্রেস বিজ্ঞপ্তির। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়েছে, পৌরসভা শহরে ৪৫টি টিকাদান কেন্দ্র খুলেছেন। এছাড়া পৌরসভার প্রায় ২ শতাধিক টিকাদার বিভিন্ন মহল্লায় বাড়ি বাড়ি টিকা দেওয়ার কাজে নেমেছেন। ওই টিকাদারদের কাছ থেকে টিকা নেওয়ার জন্য পৌরসভা আহ্বান জানিয়েছেন। বসন্ত রোগ খুবই মারাত্মক। এ সংক্রামক রোগের হাত থেকে নগরবাসীকে বাঁচানোর দায়িত্ব পৌরসভার উপর ন্যস্ত। এজন্য অবশ্য স্বাস্থ্য দফতরের পক্ষ থেকে পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বসন্ত রোগের সংবাদ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানাতে পারলেই পঞ্চাশ টাকা নগদ পুরস্কার।
পৌরসভা কর্তৃপক্ষ যে বসন্ত রোগ নিধনে এগিয়ে আসবেন এটা তো স্বতঃসিদ্ধ কথা। কিন্তু তবুও কথার পর কথা থেকে যায়, আর সে কথাটি হলো অতীতেও আমরা দেখেছি এবং এখনো দেখছি যে, শীতের পর বসন্ত ঋতুর আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই বসন্ত রোগ উচ্ছেদে পৌরসভা তৎপর হয়ে ওঠে। বিজ্ঞপ্তির পর বিজ্ঞপ্তির তুফান ছোটে। বিজ্ঞপ্তির ভাষা একটাই টিকা নিন। টিকা দানের জন্য কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ টিকাদাররা টিকা দানের জন্য মহল্লায় মহল্লায় যাচ্ছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু একটু চোখ কান খোলা রেখে চলে দেখা যায় যে, ভ্রাম্যমাণ টিকাদাররা লা-পাত্তা। টিকাদারদের টিকির সন্ধানও পাওয়া যায় না। এরা যে কোথায়, কাকে, কখন টিকা দেন তা কেউ বলতে পারেন না। কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই- এর মতই অবস্থা। সুতরাং সবকিছু দেখেশুনে বলতে হয় টিকা তো নগরবাসী নেবে কিন্তু কোথায় এবং কখন?

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!