বাংলার বাণী
ঢাকা: ৩১শে ডিসেম্বর, শনিবার, ১৫ই পৌষ, ১৩৮০
বিদায়, ১৯৭৩
দিন যায়, দিন আসে- পূর্বাকাশে নতুন সূর্য হেসে ওঠে, মাসের পর মাস যায়- এমনি করে মহাকালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায় একটি বছর- যাত্রা শুরু হয় নতুন বছরের। দিনপঞ্জীর হিসেবে এটাই চিরন্তন নিয়ম। দিনপঞ্জীর হিসেবে আজ ৩১শে ডিসেম্বর- বছরের সর্বশেষ দিন। আজকের সূর্য অস্তমিত হবে একটি বছরের সাফল্য- ব্যর্থতা এবং আশা-নিরাশার ছন্দময় অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে। আমাদের জাতীয় জীবনে আমরা ১৯৭৩ সালে কতোটা সাফল্য অর্জন করেছি, আর কতোটুকু সাফল্য অর্জন করতে পারিনি, তা এ বছরের পূর্ণায়তন হিসেবে নিলেই সুস্পষ্টভাবে আমাদের চোখের সামনে দেদীপ্যমান হয়ে উঠবে। তেয়াত্তরের সবশেষ দিনটিতে যদি আমরা পেছনের দিকে ফিরে তাকাই তাহলে অনেক স্মৃতি, অনেক অভিজ্ঞতা আমাদের চোখের সামনে জ্বল জ্বল করে উঠবে। আজকের দিনে যে বছরটির পরিসমাপ্তি ঘটছে, সেই বছরটিকে আমরা ধরে ডাকতে পারবো না৷ কালের ঘূর্ণায়মান নিয়মে তা আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। কিন্তু তেয়াত্তর সালের স্মৃতিময় অভিজ্ঞতা তো আমাদের মন থেকে, জাতীয় জীবনের ইতিহাসের পাতা থেকে ধুয়ে মুছে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে না, বরং তেয়াত্তর সালের চিহ্ন, তেয়াত্তরের যাবতীয় স্মৃতি আমাদের মনোলোকে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। তেয়াত্তর সাল আমাদের জাতীয় জীবনের একটি ঘটনা-বহুল বছর। তেয়াত্তরে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর তাৎপর্যও খুবই তাৎপর্যমণ্ডিত এবং সুদূর প্রসারিত বলে আমরা মনে করি। সাফল্য এবং ব্যর্থতাকে বাদ দিয়ে জীবন কখনো প্রবাহিত হতে পারে না। আমাদের জাতীয় জীবনে তাই তেয়াত্তর সালে নানাবিধ সাফল্যকে যেমন আমরা অর্জন করতে পেরেছি, তেমনি ব্যর্থতার হাত থেকেও নিতান্ত মুক্তি পাইনি। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য দেশবাসীর যে প্রত্যাশা ছিল, তা তেয়াত্তর সালে পুরোপুরি সাফল্য লাভ করেছে, তা আমরা বলবো না। তবে, আমাদের জাতীয় জীবনে তেয়াত্তর সাল ব্যর্থতার চেয়ে সাফল্যের সোপানেই উন্নীত হয়েছে বেশির ভাগ।
একটি বছর একটি স্বাধীন দেশের জন্য এক মূল্যবান সঞ্চয়। সেই দিক থেকে যদি বিবেচনা করি, তাহলে দেখতে পাবো যে, তেয়াত্তর সালে আমাদের জাতীয় জীবনে সমস্যা ছিল অনেক। সমস্ত সমস্যার পাহাড়কে ডিঙিয়ে এ বছরই আমরা নতুন শাসনতন্ত্র পেয়েছি এবং এই সংবিধানের আলোকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বুকে অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রথম সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় দেশবাসীর সংগ্রামী ঐক্যের চিত্রটিকেই সমগ্র বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছে। প্রতিক্রিয়াশীল দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীদের ষড়যন্ত্র এই বছরটিতে সমানে অব্যাহত ছিল, কিন্তু প্রগতিশীল শান্তিকামী শক্তির কাছে সেই সব ষড়যন্ত্রকারীরা মার খেয়েছে সাম্প্রদায়িকতার উস্কানিদাতারা শত চেষ্টা করেও রাষ্ট্রীয় মৌলাদর্শ ধর্ম নিরপেক্ষতার উজ্জ্বল পতাকাকে ভূলুন্ঠিত করতে পারেনি। বারংবার সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে, ধর্মীয় জিগির তুলে মুসলিম বাংলার ঘৃণ্য৷ স্লোগান উচ্চকিত হয়েছে এবং এশীয় শান্তি সম্মেলনকে বানচাল করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতিক্রিয়ার দুর্গ ভেঙ্গে দিয়েছে এদেশের সদা জাগ্রত মানুষ। প্রগতিশীল ছাত্র সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেছে। দেশ পুনর্গঠনের কাজে সম্মিলিতভাবে নিজেদের নিয়োগ করেছে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও গণ ঐক্যজোট গঠন করে ষড়যন্ত্রকারীদের দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিয়েছে। জাতীয় জীবনে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্যে চালিয়েছে সংগ্রাম। তেয়াত্তর সালে শান্তির অতন্দ্র প্রহরী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জুলিও কুরি শান্তি পদক পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে এবং বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে এশীয় শান্তি সম্মেলন।
ভারত ও সোভিয়েতের সঙ্গে আমাদের মৈত্রীবন্ধনে ফাটল ধরানোর কারসাজিও করা হয়েছে বহুবার, কিন্তু জনসাধারনের প্রবল প্রতিরোধ এবং সংগ্রামী ঐক্যের কাছে সেই সব অশুভ শক্তি পদানত স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। তেয়াত্তর সালে নিন্দুকেরা দেশে যে দুর্ভিক্ষাবস্থা দেখা দেবে, সেই রটনা মিথ্যে প্রতিপন্ন হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অবশ্য রোধ করা যায়নি। একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মহলের তৎপরতায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার ততোটা সাফল্যের পরিচয় দিতে না পারলেও, দ্রব্য মূল্য নিয়ন্ত্রণের নিয়ত প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তেয়াত্তর সালে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে দেশের মানুষের মনে ত্রাসের সঞ্চার হয়েছিল। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এ বছর এতো ব্যাপক অবনতির কবলে পতিত হয়েছিল যে, সরকারকে নাগরিক জীবনে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য বিরামহীন প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হয়েছে। এইভাবে যদি আমরা পুরো তেয়াত্তর সালের খতিয়ান নিই তাহলে দেখতে পাবো যে, সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের কি অপরিসীম জটিলাবস্থার মোকাবেলা করতে হয়েছে। একটি রক্তাক্ত যুদ্ধের পর, দেশের স্থিতিশীলতার খুব স্বাভাবিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় না। নানা দুর্যোগময় পথ অতিক্রম করে এগোতে হয়। সেদিক থেকে যে আমরা ব্যর্থতার চেয়ে সাফল্যই অর্জন করেছি আশাতীতভাবে তা অবশ্যই স্বীকার না করে উপায় নেই।
ষোলই ডিসেম্বর জাতীয় দিবসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশে নতুন সংগ্রামের ডাক দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের বিতাড়নের সংগ্রামে আমরা জয়ী হয়েছি- এবার দেশ গড়ার সংগ্রাম শুরু হয়েছে। অভাব, দারিদ্র, ক্ষুধা, রোগ, অশিক্ষা, বেকারত্ব এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে নতুন সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু উৎপাদন বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন, চোরাচালানী, কালোবাজারি, অসৎ ব্যবসায়ী, ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে নতুন সংগ্রাম ঘোষণা করেছেন। জাতীয় দিবসে স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণ চাঞ্চল্যে দেশবাসী তাদের ঐক্যবদ্ধতার প্রমাণ দিয়েছেন। আনরবের বিদায়ী প্রধান ফ্রান্সিস লাকোষ্টে তার সমাপনী ভাষণে আশাবাদ প্রকাশ করে বলেছেন যে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল। তিনি অভিমত দিয়েছেন যে, বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠেছে এবং এখন বাংলাদেশে নিজ পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম। কৃষিকাজ এবং ফসল ফলানোর ব্যাপারেও বাংলাদেশ পূর্বতম রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। ফলে, দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়নি, মহামারী ঘটেনি।
এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন, গত ১৪ই নভেম্বর থেকে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। সারা দেশে এ অভিযান চালিয়ে ৪লক্ষ টন ধান-চাল সংগ্রহ করা হবে। এ অভিযানে এ পর্যন্ত ১৭ হাজার ৭১২ টন ধান সংগ্রহ হয়েছে বলে খাদ্য মন্ত্রী জানিয়েছেন। যে গতিতে এবং যে ভাবে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান এগিয়ে চলেছে তাতে অনেকের এ প্রশ্ন উত্থাপিত হবে যে, শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট লক্ষ্য মাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব হবে কি? অথচ একথা কে না জানে যে এ ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান যদি ব্যর্থ হয় তাহলে আমাদের দূর্ভোগ আর দুর্দশার অন্ত থাকবে না। ‘ভিক্ষার ঝুলি’ নিয়ে দ্বারে দ্বারে আর খাদ্যশস্য সংগ্রহ সম্ভব নয়। একদিকে তৈল সংকট অন্যদিকে খরা ও অন্যান্য কারণে খাদ্যশস্যের উৎপাদন হ্রাসের ফলে টাকা থাকলেও খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। সরকার এমনিতেই চালের মণ ৭২ টাকায় কিনে রেশন দিতে হবে ৪০ টাকায়। তার মধ্যে যদি বিদেশ থেকে চড়া দামে খাদ্যশস্য কিনতে হয় তাহলে অবস্থাটা কি দাঁড়াবে তা একবার ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করা প্রয়োজন। এখন আর ‘আনরব’ নেই যে সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসবে। এমতাবস্থায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবশ্য করণীয় কর্তব্য হলো ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানকে যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থার ভিত্তিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
স্বাভাবিকভাবে তেয়াত্তর সাল বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে একটি তাৎপর্যময় বছর হিসেবেই চিহ্নিত থাকবে। বঙ্গবন্ধুর যোগ্য নেতৃত্বে সমগ্র দেশবাসী যে ঐক্য, সংহতির পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন, তাতে একদিন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে উঠবেই এবং শান্তি, প্রগতি, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র সাফল্যমন্ডিত হবেই। উনিশ শ’ তেয়াত্তর সাল আমাদের এই প্রত্যাশায় উজ্জীবিত করেছে। তেয়াত্তরে যেই সব সমস্যার সমাধান হয়নি, আগামী দিনে সেই সব সমস্যার পাহাড় যে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া যাবে না, তেয়াত্তরের সর্বশেষ দিনটিতে দাঁড়িয়ে সেই প্রত্যাশা করতে আমাদের দোষটা কি?
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক