You dont have javascript enabled! Please enable it! এ, কে খন্দকার এর সাক্ষাৎকার - সংগ্রামের নোটবুক

এ, কে খন্দকার

 

১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন বিজয়ী আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে জেনারেল ইয়াহিয়া এক পর্যায়ে ভাবী প্রধানমন্ত্রী বলেও অবিহিত করেন। সেই পরিস্থিতিতে ২৩শে মার্চ মহাসমারোহে ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ পালনের কর্মসূচী গৃহীত হয়। তখন আমি ঢাকায় কর্মরত পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে কর্মরত বাঙালি অফিসারদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র। সুতরাং সম্মিলিত সশস্ত্র বাহিনীর প্যারেড অধিনায়কত্ব করার দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত হয়।

 

ফেব্রুয়ারী মাসের তৃতীয় সপ্তাহে একদিন জোনাল আর্মী হেডকোয়ার্টারস (বর্তমান এয়ার হেডকোয়ার্টার) থেকে জনৈক কর্নেল আমাকে ফোন করে জানালেন যে, ২৩শে মার্চের পরিকল্পিত প্যারেড বাতিল করা হয়েছে। প্যারেড বাতিলের সিদ্ধান্তের আকস্মিকতায় বিস্মিত হলাম। প্রায় সাথে সাথেই বিগ্রেড হেডকোয়ার্টার অফিস কক্ষে প্রবেশ করে দেখি ডজনখানেক পদস্থ পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার আলোচনারত। আমার আকস্মিক ও অনভিপ্রেত উপস্থিতি তাঁদের মধ্যে একটা অপ্রস্তুত ও কিছুটা বিরুপ ভাবের সঞ্চার করলো। তাঁদের এ মনোভাব বুঝতে আমার অসুবিধা হল না। আমি বিশেষ আর কোন আলোচনা না করে ফিরে এলাম।

 

১লা মার্চ। শাহীন স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে পূর্ব পাকিস্তানের এয়ার অফিসার কমান্ডিং এয়ার কমডোর মাসুদের সভাপতিত্ব করার কথা। আগে দেখেছি এ ধরনের অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতি সবসময় ছিলো সাগ্রহ। কিন্তু সেদিন দেখলাম ব্যাতিক্রম। এয়ার কমোডোর আমাকে বললেন, আমি যেন তাঁর পরিবর্তে অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করি। দুপুর একটায় জেনারেল ইয়াহিয়া পূর্ব ঘোষনা অনুযায়ী ৩রা মার্চে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল ঘোষণা করলেন। বিদ্যুৎ গতিতে ঢাকার চেহারা পাল্টে গেলো। চারিদিকে বিক্ষোভ। শাহীন স্কুল প্রাঙ্গন থেকেই দেখলাম বিক্ষব্ধ জনতার এক বিশাল মিছিল অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে শ্লোগান দিতে দিতে মহাখালী থেকে শহরাভিমুখে ধাবমান।

 

ঘটনা দুটো উল্লেখ করলাম এজন্য যে এগুলো থেকে আমার দৃঢ়বিশ্বাস জন্মেছে যে, ১লা মার্চে জেনারেল ইয়াহিয়ার পরিষদ অধিবেশন স্থগিত কোন আকস্মিক ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ঘোষণার প্রস্তুতি আগে থেকেই চলছিল এবং একারনেই এয়ার কমডোর মাসুদ আমাকে পুরস্কার বিতরণী সভার দায়িত্ব দিয়ে নিজে ইয়াহিয়ার ঘোষনা পরবর্তী সম্ভাব্য পরিস্থিতি সম্পর্কিত কাজে ব্যাপৃত ছিলেন।

 

ফেব্রুয়ারীর তৃতীয় সপ্তাহ থেকেই লক্ষ্য করলাম যে, পশ্চিম পাকিস্তান বোয়িং ভর্তি সৈন্য ঢাকায় আনা হচ্ছে। তাদের সাথে আর্মীর স্পেশাল কমান্ডো সেনারাও আসছে এবং তাঁদের ব্যাগ ব্যাগেজ নামছে। আমি বুঝতে পারছিলাম যে এটা দেশের দু’অংশের মধ্যে সৈণ্য বদলী ও যাতায়াতের একটা সাধারণ ঘটনা না।

 

মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহের পর থেকেই পরিস্কারভাবে অনুভব করলাম যে আমাকে গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত ও অন্যান্য কার্যকলাপ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। উপরমহল থেকে এ ধরনের আচরণ অপ্রত্যাশিত হলেও এর কারন আমার নিকট অবোধগম্য ছিল না।

 

সারা পূর্ব পাকিস্তান তখন প্রতিবাদমূখর। মানুষ তাঁদের নিজ নিজ পন্থায় এ অন্যায়ের মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেখলাম ইকবাল হলের ছাত্ররা কয়েকটি মাত্র ৩০৩ রাইফেল নিয়ে নিজেদের তৈরি করছে শত্রুর মোকাবেলার জন্য। এঘটনায় আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তাঁদের প্রস্তুতির ধরন দেখে মনে হলো, কত বড় শত্রুর মোকাবেলা তাঁরা করতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারনা পর্যন্ত তাঁদের নেই। অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত একটা নিয়মিত বাহিনীর মোকাবেলায় ৩০৩ রাইফেল নিয়ে বেসামরিক লোকেদের পক্ষে কতটুকু সম্ভব! কিন্তু তবু সেদিন আমি ওদের প্রানের আবেগ আর চিত্তের দৃঢ়তায় মুগ্ধ হয়েছিলাম।

 

পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত পাকিস্তান বিমান বাহিনীর টেকনিশিয়ানদের অধিকাংশই ছিলেন বাঙালি। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহনের কথা সে সময় আমি ভেবেছি। কিন্তু এ ধরনের পদক্ষেপ নেবার আগে রাজনৈতিক অনুমোদন সমীচীন মনে হওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের একটা কার্যকর যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করি। এই সূত্রে দু’জন আওয়ামী লীগ এমপি আমার বাসায় আসেন। আমি তাদেরকে বললাম যে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈণ্যদের তৎপরতা ও প্রস্তুতি দেখে আমার ধারনা হচ্ছে, তাঁরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। এ অবস্থায় কি করনীয় জানতে চাইলাম এবং তাঁদের মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীতে বাঙালিদের ভূমিকা সম্পর্কে পার্টির নেতাদের মনোভাব জানবার ইচ্ছাও তাঁদের নিকট ব্যক্ত করলাম। সে মূহুর্তে তাঁরা আমাকে সুনির্দিষ্ট কিছুই বলতে পারেননি।

 

২৫শে মার্চ সন্ধ্যার দিকে এয়ারপোর্টে যাই। দেখলাম অতিগোপনে সতর্ক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় একটি বিমানে মাত্র একজন কিংবা দুজন যাত্রীসহ জেনারেল ইয়াহিয়া করাচীর উদ্দ্যেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করলেন। আমি এই সংবাদ টেলিফোনে আওয়ামী লীগ অফিসে জানিয়ে দেই। আমার মনে আছে,এয়ারপোর্ট থেকেই আমি ক্যান্টনমেন্ট এয়ারফোর্সের সব বাঙালি অফিসারদের খবর দেয়ার চেষ্টা করেছি। পরে বাড়ী বাড়ী গিয়ে তাঁদের আবার খবরটা বিস্তারিত দিই। বলেছি, পরিস্থিত গুরুতর, একটা ভয়ংকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আমি তাঁদের সবাইকে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে বলি এবং আমার পরিবারকে ক্যান্টনমেন্টে বাহিরে পাঠিয়ে দিই।

 

রাত এগারোটার দিকে কানে আসে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণের আওয়াজ । পায়ের আওয়াজের পরপরই ট্যাঙ্ক চোলাড় শব্দ । বুঝতে পারলাম যা একদিন আশঙ্কা করেছিলাম তা বাস্তবে পরিণত হতে শুরু করেছে । রাতভর সারা শহরজুরে যে তান্ডব চলছিল, আগুনের আলোতে এবং গুলির আওয়াজে ক্যান্টনমেন্ট থেকেই ঘটনার ভয়াবহতা সম্পর্কে একটা মোটামোটি ধারণা হচ্ছিল । কিন্তু তাণ্ডবের ভয়ঙ্কর রূপটা যে কল্পনার সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গেছে , না দেখা পর্যন্ত সেটা সঠিক বোঝা যায় নি। ২৫ শে মার্চ সন্ধ্যা থেকে মাঝ রাতের ভেতরেই জনসাধারণ জায়গায় জায়গায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে এসব ব্যারিকেড কোন বাধাই ছিল না।

 

২৭শে মার্চ সন্ধ্যায় এয়ারফোর্স মেসে গেলাম। মেসের যে পাশে পুকুরপাড় তা পূর্ব দিক থেকেই নাখালপাড়া এলাকা শুরু।এটা অত্যন্ত গরীব ও নিম্নবিত্তদের এলাকা। কিছুক্ষনের মধ্যেই দেখলাম পাক-বাহিনীর লোকেরা অগ্নিসংযোগকারী যন্ত্র দিয়ে পুরো এলাকাটি ঘিরে ফেলছে এবং তাঁদের সাথে মেশিনধারী সৈন্যরা পজিশন নিয়েছে।

 

অল্পক্ষণ পরেই দেখলাম সারা এলাকায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। আতঙ্কগ্রস্থ অসহায় মানুষ প্রানের ভয়ে আর্তচিৎকার করে বেরিয়ে আসছে বাইরে। সারা শহরে তখন কার্ফু। এরা কার্ফু ভঙ্গ করেছে এই অজুহাতে সঙ্গে সঙ্গে মেশিনধারী সৈন্যরা নির্বিচারে গুলি চালাল।

 

পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের মাঝে একটা ধারনা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিলো যে এই সব গরীব ও নিম্নবিত্ত লোকেরাই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভিত্তি- সুতরাং এদেরকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে হবে। মেসে জনৈক পাকিস্তানী লেফটেন্যান্ট যিনি আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং জানতেন যে, আমি একজন বাঙালি গ্রুপ ক্যাপ্টেন, আমার সামনে মন্তব্য করলেন, “এটাই জারজদের সাথে সঠিক ব্যবহার”

 

এরই মধ্যে মুক্তিবাহিনীতে কিভাবে যোগদান করা যায় সে কথা ভাবতে শুরু করি। কিন্তু কিভাবে যাবো? আমার বাসায় কয়েকজন গার্ড নিয়োগ করা হয়েছিলো নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য ছিল আমার গতিবিধির উপর নজর রাখা।

 

কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশ ত্যাগের ব্যাপারে আমি অন্যান্য বাঙালি অফিসার, বিশেষ করে বৈমানিকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করি। তখনকার উইং কমান্ডার বাশারের সাথেও আমি যোগাযোগ স্থাপন করি এবং তাঁর মাধ্যমে অন্য অফিসারদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করি।

 

আলাপ-আলোচনার পর আমরা এয়ারফোর্সের কতিপয় অফিসার চুড়ান্ত স্বিদ্ধান্ত নিই যে যেমন করেই হোক পাক বাহিনীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতেই হবে। আমাদের এই স্বিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আমরা মাঝে মাঝে বিভিন্ন চাইনিজ রেষ্টুরেন্টে আলোচনায় বসতাম। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো যে একদিন একযোগে সবাই পাক বাহিনী ত্যাগ করবো না। করলে তাতে ধরা পড়লে সবারই একসাথে ধরা পড়ার সম্ভবনা। সিদ্ধান্ত হল ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নুরুল কাদের প্রথমে সীমান্ত অতিক্রমের বিভিন্ন পথ আগে সরেজমিনে জরিপ করে আসবেন এবং তাঁর রিপোর্ট অনুযায়ী  আমরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে ভিন্ন ভিন্ন পথে সীমান্ত অতিক্রম করবো । কথামতো নুরুল কাদের খবর নিতে যান। কিন্তু কাজ শেষে ফিরে আসার সময় তিনি পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। পরে অবশ্য নানা অজুহাত দেখিয়ে তিনি মুক্তি পেয়ে আসতে পেরেছিলেন এবং আমাদের সাথে যোগ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

 

অন্যান্য অফিসারদের সাথে মিলে দেশ ত্যাগের এই চুড়ান্ত স্বিদ্ধান্ত নেবার আগে ২৮শে মার্চ আমি এ ব্যাপারে প্রথম পদক্ষেপ নেই। বেড়াতে যাবার কথা বলে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েসহ নিজের গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। ডেমরা ঘাট পর্যন্ত গিয়ে গাড়িটি চাবিসহ ফেলে রেখে অনির্দিষ্ট নিরাপদ স্থানের উদ্দেশ্যে বের হই। ফ্লাইট লেফট্যান্যান্ট মারগুব পরে (বাংলাদেশ বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান) আমাদের সঙ্গে ছিলেন এবং তিনিই পথ দেখিয়ে আমাদের গ্রামের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন ।

 

কিন্তু আমাদের প্রথম প্রচেষ্টাই সফল হয়নি। ভাড়া করা লঞ্চ নিয়ে কিছুদূর যাবার পর নদীতে অল্প পানিতে আটকে পড়ি এবং শেষ পর্যন্ত ভৈরব বাজারের কাছ থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হই।

 

এপ্রিল মাসের ১০ কি ১১ তারিখে রাজশাহী সীমান্ত অতিক্রমে লক্ষ্যে আমরা কয়েকজন মিলে আবার ঢাকা ত্যাগ করি কিন্তু আরিচা এসে পাক বাহিনীর সমাবেশ দেখে আবার ঢাকা ফিরে আসি।

 

সীমান্ত অতিক্রমের পরবর্তী চেষ্টা চালাই ১০ই মে। এবার লক্ষ্য ছিলো কুমিল্লার পথে সীমান্ত অতিক্রম করা। নবীনগর পর্যন্ত গিয়ে পাক বাহিনীর সমাবেশ দেখে ফিরে আসি এবং নরসিংদীর কাছে এক জুট মিলের রেস্ট হাউজে আশ্রয় নেই। মিলের ম্যানেজার ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রেজা এবং তিনিও আমাদের সাথে সীমান্ত অতিক্রমকারীদের একজন ছিলেন।

 

১২ই মে রাতে কুমিল্লার কালির বাজারে জনৈক কৃষকের বাড়ীতে রাত কাটানোর স্মৃতি আমার স্মরণে এখনো অম্লান। কৃষকটির বাড়িতে আমরা বেশ কয়েকটি পরিবার আশ্রয় নিয়েছিলাম। রাত ২/৩ টার দিকে হঠাৎ দরজায় করাঘাত। পাক সেনা হবে ভেবে কেউ কেউ দরজা খুলতে দ্বিধা করছিলেন। বললাম, পাক সেনারা এসে থাকলে দরজা না খুললেও তারা ভেঙ্গে ঢুকবে। যারা দ্বিধা করছিলেন তারাও একমত হলেন যে, দরজা খোলাই সংগত। দরজা খুলে দেখি বাইরে দাঁড়িয়ে গৃহস্বামী স্বয়ং। তিনি আমাদের জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করেছেন এবং বিনয় ও আন্তরিকতার সাথে আমাদের খাবারের দাওয়াত দিতে এসেছেন। দরিদ্র কৃষকের বাড়ী। এতো রাতে এতো গুলো লোকের জন্য এত ভাল ভাল খাবারের ব্যবস্থা দেখে আমরা সবাই বিস্মিত। একদিকে আমরা যেমন বিব্রতবোধ করছিলাম অন্যদিকে তেমনি এই গ্রাম্য কৃষকের আন্তরিকতায় অভিভূত হই। পরে জেনেছিলাম যে আমাদের আশ্রয়দানের অপরাধে আমরা চলে যাবার পর পাকসেনারা উক্ত কৃষকের বাড়ী জ্বালিয়ে দেয়।

আমাদের আশ্রয়দাতা উক্ত কৃষক ও স্থানীয় অন্যান্য কতিপয় লোকের সহায়তায় পরদিন আমরা সীমান্ত অতিক্রম করে মতিনগর বিএসঅএফ ক্যাম্পে উপস্থিত হই। এখানে ক্যাপ্টেন আবুর সাথে আমার প্রথম দেখা । তিনি পরে মুক্তি যুদ্ধে শহীদ হন ।

 

আমাদের প্রায় সাথে সাথে বিমান বাহিনীর প্রায় তিনশত জুনিয়র টেকনিশিয়ান ভারতে যায়। এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, বিমান বাহিনীর যারা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়েছিলো তাঁরা স্বেচ্ছায় স্বতঃপ্রনোদিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য তা করেছিলেন। তাঁদের বেশীরভাগের সামনেই দেশে তেমন কোন বিপদ ছিল না। বিমান বাহিনীর যারা ভারতে গিয়েছিলেন একাত্তরে তাঁদের সামনে অন্যান্য পথ খোলা ছিল। তাঁদের ভারতে যাবার উদ্দেশ্য ছিল একটাই, তাহলো দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা।

 

আগরতলা পৌছেই আমি মেজর খালেদ মোশররফ, মেজর শওকত আলী প্রমূখের সঙ্গে যোগাযোগ করি। পরদিন জেনারেল কলকাত সিং এবং আমি মেজর শাফায়েত জামিলসহ কোলকাতায় যাই। ওখানে পৌঁছে আমি কর্নেল ওসমানীর (পরে জেনারেল) সঙ্গে সাক্ষাত করি। কোলকাতায় তাঁর সঙ্গে দুইদিন থাকার পর তিনি আমাকে উর্ধ্বতন ভারতীয় সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ আলোচনার জন্য দিল্লি যাওয়ার নির্দেশ দেন। আমি তখন ভারতীয় বিমান বাহিনীর জনৈক পদস্থ কর্মকর্তার সাথে দিল্লি যাই। ইতিমধ্যে আমার সাথে যেসব অফিসার সীমান্ত অতিক্রম করেছিলেন তাঁরাও দিল্লী এসে পৌঁছান।

 

দিল্লী থেকে কোলকাতা ফেরার পর কর্নেল ওসমানী আমাকে জানালেন যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আমাকে সরকারের সম্মিলিত সশস্ত্র বাহিনীর ডেপুটি চীফ অব স্টাফ নিযুক্ত করেছেন। সংসদ সদস্য কর্নেল(অবসরপ্রাপ্ত) রবকে রাজনৈতিক কারনে চীফ অব স্টাফ নিয়োগ করা হয়েছে। একজন এমপি হিসেবে কর্নেল রব আগরতলায় মুজিবনগর সরকারের রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিয়েই বেশী ব্যস্ত থাকতেন। ফলে যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়গুলোর বেশীরভাগ দায়িত্ব আমার উপরই ন্যস্ত ছিলো।

 

মুক্তিযুদ্ধের সামরিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সমগ্র এলাকাকে বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ করে সেক্টর কমান্ডার নির্ধারণ করা হয়। হেড কোয়ার্টারের সাথে যোগাযোগের ব্যাপারে আমাদের নিজস্ব কোণ শক্তিশালী মাধ্যম না থাকায় আমরা ভারতীয় সেক্টরগুলোর সহায়তায় যোগাযোগ রক্ষা করতাম। কমান্ডার ইন চীফ এর তরফ থেকে সেক্টর কমান্ডার দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়। পরে বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে সেক্টর কমান্ডারই নির্ধারণ করতেন কোন দায়িত্ব তিনি কেমন করে সম্পন্ন করবেন। সমগ্র এলাকাকে বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ করার ফলে যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা অধিকতর সমন্বয় সাধনে সক্ষম হই।

 

ডেপুটি চীফ অব স্টাফ হিসেবে ট্রেনিং ও অপারেশনের দায়িত্ব ছিল আমার। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য যে সব যুবক সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করতো তাঁদের জন্য বর্ডার এলাকাতেই ক্যাম্প খোলা হয়েছিলো। এইসব যুবক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করা হত। এই রিক্রুটমেন্টের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সাংসদদের ভূমিকাই ছিলো অগ্রণী এবং মূলত তারাই নতুন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়োগ করতেন।

 

আমি বিশ্বাস করতাম যে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণে সকলের সমান অধিকার আছে এবং এ ব্যাপারটিকে সকল প্রকার দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে রাখা প্রয়োজন। এ জন্যই দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেনীর মানুষের মধ্য থেকে আমি মুক্তিযোদ্ধা নিয়োগের চেষ্টা করেছি।

 

মুক্তিযোদ্ধা নিয়োগের ব্যাপারে পেশাদারী মনোভাবের প্রয়োজন ছিল। যুবকদের মানসিক ও শারীরিক যোগ্যতা, মনোবল, দৃঢ়তা ইত্যাদি গুণাবলী নিয়োগ লাভের মানদন্ড হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু নিয়োগের ক্ষেত্রে ভিন্নতর নীতি অনুসৃত হওয়ায় কিছু কিছু অনভিপ্রেত ফল পরিলক্ষিত হয়। আমি ছাত্রলীগ, যুবলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টি প্রভৃতি জনমতের সদস্যদের সাথে বহুবার আলোচনায় মিলিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সকল প্রকার কোন্দলের উর্ধ্বে রেখে সবাইকে মিলেমিশে একাত্ব হয়ে কাজ করার আহবান জানিয়েছি। রিক্রুটমেন্টের ব্যাপারে আমি কর্নেল ওসমানীর সাথে আলোচনা করতাম এসব বিষয় নিয়ে।

 

মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার বেশ কিছুদিন পর ‘মুজিব বাহিনী’’ নামে একটা আলাদা সশস্ত্র গ্রুপ গঠনের কথা আমি জানতে পারি। কর্নেল ওসমানি আলাদা নাম ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে এই বাহিনী গঠনের ঘোর বিরোধী ছিলেন। আর আমিও এ ব্যাপারে তাঁর সাথে সম্পূর্ণ একমত ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধে সকল শক্তি ও সম্পদ একই লক্ষ্যে এবং একই কমান্ডে সমন্বিত হওয়া উচিৎ এবং এটাই আমরা চেয়েছিলাম। একজন রাজনীতি নিরেপক্ষ ব্যাক্তি হিসেবে আমি অনুভব করতাম যে মুক্তিযুদ্ধ কোন একটা বিশেষ রাজনৈতিক দলের সংগ্রাম নয়- এটা একটা জাতীয় জনযুদ্ধ।

 

একাত্তরের আগষ্ট মাসের শেষ দিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তিনটি ব্যাটালিয়ন গঠন করা হয়- এগুলোকে ‘জেড ফোর্স, এস ফোর্স’ এবং ‘কে ফোর্স’ নামে অভিহিত করা হয়। এগুলো গঠন করার মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল যে, ক্রমাগত গেরিলা আক্রমণের ফলে পাক বাহিনী যখন দুর্বল ও হতোদ্যম হয়ে পড়বে তখন এই ব্যাটালিয়নগুলোর দ্বারা চূড়ান্ত আঘাত হেনে বাংলাদেশের একটা উল্ল্যেখযোগ্য পরিমান এলাকা সম্পূর্নরূপে শত্রুমুক্ত করা হবে এবং পরবর্তী পর্যায়ে ঐ এলাকা থেকে রাজনৈতিক কর্মকান্ড ও যুদ্ধ দুই-ই চালিয়ে যাওয়া হবে।

 

এই ব্যাটালিয়নগুলো সেনাবাহিনী, বিডিয়ার এবং পুলিশ বাহিনীর যে সব নিয়মিত সৈনিক মুক্তিবাহিনীতে ছিলো তাঁদের ভেতর থেকে গুণাগুণ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বাছাই করা যুবকদের নিয়ে গঠন করা হয়। তিনটি ব্যাটালিয়নে নেয়ার পর নিয়মিত বাহিনীর বাদবাকী সদস্যদের নিয়ে সেক্টর ট্রুপস গঠন করা হয়। ব্যাটালিয়ন ও সেক্টর ট্রুপসের সদস্যরাই সাধারণভাবে ‘ ‘মুক্তিফৌজ’ নামে অভিহিত হত। বাকী সকল নিয়মিত ও অনিয়মিত গেরিলা যোদ্ধাদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বা ‘ফ্রিডম ফাইটার’ নামে অভিহিত করা হয়।

 

ব্যাটালিয়ন ও সেক্টর ট্রুপস গঠন করার ফলে এই বাহিনীর বাইরে একান্তভাবে গেরিলা তৎপরতা চালিয়ে যাবার জন্য যারা রয়ে গেলেন তাদের বেশীরভাগই ছিলেন অপেশাদার, অনভিজ্ঞ ও অতি সামান্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ফলে গেরিলাদের ছোট ছোট গ্রুপগুলিকে সঠিকভাবে নেতৃত্ব প্রদানের অসুবিধা হয়ে পড়ে। এছাড়া ভারতীয় বাহিনী যে পরিমান অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করতো, প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিল একান্তই অপ্রতুল। ফলে সাময়িকভাবে গেরিলা বাহিনীর কার্যকারিতা বেশ কিছুটা হ্রাস পায়।

 

গেরিলা যুদ্ধের ব্যাপারে আমাদের সুস্পষ্ট ধারণার অভাব এবং পরে উদ্ভুত এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য একটা কার্যকর পরিকল্পনা তৈরি অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে কর্নেল ওসমানীর অনুমতি নিয়ে আমি যে প্লান তৈরী করি তাতে যুদ্ধ পরিচালনায় একটা দক্ষ কমান্ড গঠন, মুক্তিযোদ্ধা নিয়োগের ক্ষেত্রে সুষ্ঠ নীতি অবলম্বন প্রশিক্ষণ ও পরিবেশের উন্নতি এবং সমন্বয় ও যোগাযোগের ব্যপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহনের ব্যপারে সুপারিশ করা হয়েছিল।

 

এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ সরকারে এক কেবিনেট মিটিং এ জেনারেল অরোরা ও ডিপি ধরসহ বহু শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং যুদ্ধোপকরণ সরবরাহের দাবী জানানো হয়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সার্বিক সহযোগীতা দানের পূর্বশর্ত হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় চরিত্র আরোপ এবং অর্থনৈতিক দিকগুলো তুলে ধরার পরামর্শ দেন।

 

বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিণীর তিনটি ব্যাটালিয়ন গঠন করার কথা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। একটা স্বাধীন দেশের পূর্ণাঙ্গ সশস্ত্র বাহিনী গঠনের প্রশ্নটিকে সামনে রেখে আমরা তখন বাংলাদেশের বিমান বাহিনী গড়ে তোলার কথাও চিন্তা করি। বিমান বাহিনীর প্রয়োজনীয়তাও অনুভূত হচ্ছিল। আমি বিমানবাহিনী গঠনের ব্যাপার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন ও কর্নেল ওসমানীর সাথে আলোচনা করি। এই আলোচনার ফলশ্রুতি হিসেবে পরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের উপস্থিতিতে ভারতীয় প্রতিরক্ষা সচিব মি কে বি লাল এবং বিমান বাহিনীর এয়ার মার্শাল দেওয়ানের সাথে আমার আলোচনা হয়। তাঁরা বললেন যে, আমাদের বৈমানিকদের ভারতীয় স্কোয়াড্রনের সাথেই অপারেট করতে হবে এবং স্বভাবতই ভারতীয় নিয়মকানুন আমাদের ওপর প্রযোজ্য হবে। আমি এই প্রস্তাবে অসম্মতি জ্ঞাপন করে বিকল্প হিসেবে আমাদেরকে বিমান এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি প্রদানে অনুরোধ জানাই যাতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, তাঁর নিজস্ব পৃথক সত্ত্বা নিয়ে অপারেট করতে পারে কারন আমাদের প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত বৈমানিক ও টেকনিশিয়ানের কোন অভাব ছিল না।

 

এর কিছুদিন পর ভারতীয় বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল পি সি লালের সাথে আবার আমার এ ব্যাপারে আলোচনা হয়। এ আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা ভারতীয় বিমান থেকে অটার এয়ারক্রাফট , হেলিকপ্টার এবং ডাকোটা বিমান পাই। এই বিমানগুলো নিয়েই সম্পূর্নভাবে আমাদের নিজস্ব পাইলট ও টেকনিশিয়ানদের নিয়ে ১৯৭১ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুর বিমান ঘাঁটিতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠিত হয়। সে সময় উইং কমান্ডার ৬ নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নুরুল কাদের ৪ এবং ৫ নং সেক্টরে সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছিলেন। এরা ছাড়া বাকি সকল বৈমানিক বিমান বাহিনীর সাথে যুক্ত থাকে।

 

স্কোয়াড্রন লীডার সুলতান মাহমুদ (বর্তমান বিমান বাহিনীর প্রধান) তখন ১ নং সেক্টরের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। আমি তাঁকে সেখান থেকে ডিমাপুর নিয়ে আসি এবং বিমান বাহিনীর প্রশাসনিক ও ‘অপারেশন’ এর দায়িত্ব তাঁর ওপর দিই।

 

-এখানে বর্তমান বলতে ১৯৮৪ সালের কথা বুঝানো হচ্ছে। এ, কে খোন্দকার সে সময়েই সাক্ষাৎকারটা দিয়েছিলেন।

 

৬) যেহেতু আমাদের সম্পদ ও জনবল খুবই সীমিত ছিল সেহেতু বিমান যুদ্ধের কৌশল হিসেবে আমরা দুটো পন্থা অবলম্বন । প্রথমত কেবলমাত্র রাতের বেলায় অপারেশন পরিচালন করা এবং দ্বিতীয়ত আমরা যাতে পাকবাহিনীর রাডারে ধরা না পড়ি, সেজন্য খুব নীচু দিয়ে উড্ডয়ন করা।

 

নাগাল্যান্ড এক বিস্তীর্ন জংগলাকীর্ণ পার্বত্য এলাকা। সুতরাং লক্ষ্যবস্তু ঠিক করে আমাদের নিয়মিত অনুশীলন করা খুবই অসুবিধাজনক ছিলো। তাই একটা পাহাড়ের উপর সাদা প্যারাসুট ফেলে সেটাকে লক্ষ্যবস্তু ধরে আমরা অনুশীলনের ব্যবস্থা করি যাতে রাতের বেলায়ও দেখা যায়।

 

৩রা ডিসেম্বর সর্বাত্বক যুদ্ধ শুরু হলে আমাদের এই ক্ষুদ্র বিমান বাহিনী চট্টগ্রামো গোদানাইলে প্রথম আঘাত হানে এবং পাক বাহিনীর মারাত্বক ক্ষতি সাধনে সক্ষম হয়।

 

মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ডেপুটই চিফ অব স্টাফ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক প্রত্যক্ষ করার দুর্লভ সৌভাগ্য আমার হয়েছিল । আমরা তরুণেরা প্রায় বিনা অস্ত্রে অথবা অতি সাধারন অস্ত্র নিয়ে কেমন করে অতি আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত একটা বাহিনীর সাথে অসীম সাহস নিয়ে মোকাবেলা করেছিল এবং কেমন করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল তার বহু ছোট ছোট ঘটনা আজো আমার স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে এখানে আমি বহু ঘটনা থেকে একটা মাত্র ঘটনার উল্লেখ করছি ।

যুদ্ধ চলাকালে পাক বাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় বস্ত্রসামগ্রী বিশেষ করে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার লক্ষ্যে আমরা চট্রগ্রাম ও চালনা বন্দরকে অকেজো করে দেয়ার একটা পরিকল্পনা নিই । আমরা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলাম যে , যদি নৌ-কমান্ডো পাঠিয়ে পাকিস্তানী বা তাদের মিত্রদের কিছুসংখ্যক জাহাজ ডুবিয়ে দিতে পারি তবে এতে চমৎকার ফল পাওয়া যাবে । ডুবে যাওয়া জাহাজ একদিকে বন্দরের প্রবেশপথকে বন্ধ করে দেবে এবং মানসিক দিক থেকেও অন্য কোন জাহাজ সে পথে যেতে সাহসী হবে না ।

একই লক্ষ্যকে সামনে রেখে জুন মাস থেকে প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে মুর্শিদাবাদের পলাশীতে নৌ-কমাণ্ডোর প্রশিক্ষণ দেয়া হয় । এই পরিকল্পনার আওতায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১৩/১৪ বছর বয়সের একটি কিশোর ডুব-সাঁতার দিয়ে চালনা বন্দরের একটি পাকিস্তানী জাহাজে মাইন ফিট করতে যায় কিন্তু ভ্রান্তিবশত সে একটি চায়নিজ জাহাজের কাছে চলে যায় এবং ওদের হাতে ধরা পড়ে । পরে বহু জিজ্ঞাসাবাদের পর তারা তাকে মুক্তি দেয় । ফিরে এসে অবলীলায় সে তার মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসার বর্ণ্না দিয়েছিল সবার কাছে । মুক্তিপাগল এই কিশোরের সাহস, দৃঢ়তা ও দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত সেদিন আমরা সবাই বিস্মিত হয়েছিলাম ।এই ঘটনা একটা একক বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়-এ রকম হাজার হাজার নজীর সেদিন আমাদের ছেলেরা স্থাপন করেছে ।

 

মে মাসে পরিস্থিতি বিশ্লেষণের পর আমার একটা পরিষ্কার ধারনা হয়েছিলো যে, ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ দেশ পুরোপুরি শত্রু মুক্ত হবে। আমার এই ধারনার পেছনে  প্রধানতঃ তিনটি কারন ছিল।

 

প্রথমতঃ যে বিপুল পরিমান শরনার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলো তাঁরা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে ভারতের পক্ষে একটা বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং যত শীঘ্র এর একটা সমাধানের পথ বের করার জন্য ভারত উদগ্রীব হবে।

 

দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তানের দুই অংশকে আলাদা করে দেয়ার যে কামনা ভারতের ছিলো তাঁকে সফল করে তোলার এটাই ছিলো সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। সুতরাং ভারত এ সুযোগের পূর্ণ ব্যবহার করবে।

 

তৃতীয়তঃ ভারত এটা বুঝতে পেরেছিল যে, বাইরের বিশেষ করে চীনের তরফ থেকে হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। সুতরাং যুদ্ধে যদি ভারতকে নামতেই হয় তাহলে এমন একটা সময় বেছে নিতে হবে যাতে চীনের পক্ষে যুদ্ধে অসম্ভব হয়ে পড়ে। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ভারত-চীন এলাকায় প্রচন্ড শীত ও তুষারপাতের ফলে চীনা সৈন্যদের ব্যাপারে চূড়ান্ত ফয়সালা করে নেয়ার ব্যাপারে ভারতের চেষ্টা করাই স্বাভাবিক।

 

কেবল ভারতীয় সাহায্যের কথা চিন্তা করেই আমি এ ধারনা পোষন করিনি। ইতিমধ্যে দেশের জনসাধারণের অকুন্ঠ সমর্থন ও সহযোগীতা পেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল একদিকে যেমন বৃদ্ধি পেয়েছিল তেমনি শত্রুকে চরম আঘাত হানার শক্তিও তাঁদের দিন দিন বৃদ

 

অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রমাগত গেরিলা আক্রমণে এবং দেশের ভেতরে কোটি কোটি বৈরীভাবাপন্ন মানুষের সহযোগিতা ও প্রতিরোধ পাকবাহিনীকে সম্পূর্নরূপে হতোদ্যম ও পরিশ্রান্ত করে তুলেছিল । অবশেষে আমাদের সেই বহু কাঙ্ক্ষিত সময়, শত্রুর পূর্ন আত্নসমর্পণের সময় ঘনিয়ে এল । ১৬ ই ডিসেম্বরের সকাল বেলা । পাক-বাহিনীর আত্নসমর্পণের সিদ্ধান্তের কথা ইতিমধ্যে এসে গেছে । এমন সময় খবর পেলাম বাংলাদেশ সরকারের পূর্ণ কেবিনেটের বসেছে এবং আমাকে ওখানে জরুরী কোন বিষয়ে আলোচনার জন্য খোঁজ করা হচ্ছে । কর্নেল ওসমানী তখন সীমান্তের অগ্রবর্তী এলাকা পরিদর্শনের জন্য সিলেটে ছিলেন । সুতরাং সেই অল্প সময়ে তার সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি ।

আমাকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন জানালেন , যে বিকেলে ঢাকায় পাকবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্নসমর্পণ করবে এবং কর্নেল ওসমানীর অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সবচেয়ে সিনিয়র অফিসার হওয়ায় উক্ত অনুষ্ঠানে আমাকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে হবে । তদনুসারে জেনারেল অরোরার সঙ্গে বিমানে আগরতলা , এবং ওখান থেকে হেলিকাপ্টারে ঢাকা এসে পৌঁছালাম । জেনারেল অরোরা ছিলেন সম্মিলিত বাহিনীর কমাণ্ডার।

আত্নসমর্পণের দলিলে কেবলমাত্র দুই জনের স্বাক্ষর দানের ব্যবস্থা ছিল- একজন পাক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার প্রধান এবং অন্যজন ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর অধিনায়ক।

অনুষ্ঠানে পাক-বাহিনী প্রধান বিষন্ন, ভগ্নপ্রায় ও অশ্রুসিক্ত জেনারেল নিয়াজীকে দেখলাম। যথাসময়ে উভয় পক্ষের স্বাক্ষর হয়ে গেল । চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের।

 

আব্দুল করিম খন্দকার (এয়ার ভাইস মার্শাল, অবসরপ্রাপ্ত ) আগষ্ট, ১৯৮৪