You dont have javascript enabled! Please enable it!

 আব্দুর রাজ্জাক (মুকুল মিয়া)

১৯৭১ সালের অসযোগ আন্দোলনে সাড়া দিয়ে আন্দোলনে সক্রিয় হই। ১০-১৫ ই মার্চ থেকে বকুল সাহেবের নেতৃত্বে গোপালপুর জেলা স্কুল মাঠে ছাত্রজনতাকে নিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয় এবং নিজে প্রায় ২০০ জন ছেলের হাতে বাঁশের লাঠি ও ডামি রাইফেল দিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ দেন।  আমি আরোও ৫/৭ জন ছেলে সহ স্থানীয় পলিটেকনিক ইনিস্টিটিউট এর ওয়ার্কশপ থেকে কাঠের বন্দুক তৈরী করে আমাদের ক্যাম্পে সরবারহ করি। বকুল ও স্থানীয় আওয়ামীলীগ কর্মী ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য জনাব মরহুম বগা মিয়ার (আব্দুর রব) নেতৃত্বে পাবনা শহরে বেশ কয়েকটি জনসভা হয়। হাজার হাজার সরকারি বেসরকারি কর্মচারী ও জনতা উক্ত জনসভায় যোগদান করেন।

 

২০শে মার্চ জনাব বকুলের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের চারটি দলে বিভক্ত করা হয় এবং চারজন ছাত্রনেতার উপর চারটা দলের দায়িত্ব দিয়ে তাদেরকে বকুল সাহেবের নির্দেশে শহরের বিভিন্ন রাস্তায় অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় যাতে পাকবাহিনী পাবনা শহরে প্রবেশ করতে না পারে।

 

একটা দলের ভার শহীদ ছিদ্দিকের উপর অর্পণ করা হয় এবং তার দলকে পাঠানো হয় নগরবাড়ি-পাবনা রোডে। একটি দলের ভার আমি নিজে নিয়ে পাবনা-রাজশাহী রোডে থাকি। একটি দলের ভার ইকবালের উপর দেয়া হয় এবং তার দল পাঠানো হয় শালগাড়িয়া রোডে। আর একটি দলের ভার দেয়া হয় বাবুর উপর এবং তাকে পাঠানো হয় পাকশী-পাবনা রোডে। বকুল সাহেব কিছু যোদ্ধা নিয়ে শহরের কন্ট্রোল রুমে থাকেন।

২৩শে মার্চ আমরা সমগ্র পাবনা শহরে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি। ঐদিন নকশালদের সাথে আমাদের নুরুল খন্দকারের বাড়িতে সংঘর্ষ হয় এবং নকশালেরা পালিয়ে যায়।

 

২৪শে মার্চ পাকবাহিনী নগরবাড়ী হয়ে পাবনা শহরে প্রবেশ করে। তাদের ভারি হাতিয়ারের সামনে টিকতে পারবেনা বলে আমাদের বাহিনী বাঁধা সৃষ্টি করেনি। পাকবাহিনী পাবনা শহরের প্রতিটি অফিস আদালতে বাংলাদেশের পতাকা দেখে শহরে কার্ফু দিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে এবং রাতের বেলা অনেক মহিলার উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। এদিকে আমরা কয়েকটি দল যোগাযোগ করে একত্রিত হই এবং ডিসি ও এসপি সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে পাক সেনাদের আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নেই। আমরা শহরের আশেপাশের গ্রামগুলোতে জানিয়ে দেই যে আগামীকাল আমরা পাকবাহিনীকে আক্রমণ করব এবং তারা যেন তাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে আমাদের সাথে যোগ দেয়। ঘোষনা দেয়ার সাথে সাথে হাজার হাজার জনতা ঢাল, সড়কী, ফলা, তীর, ধনুক, রামদা বর্ষা ইত্যাদি নিয়ে ঢোল থালা পিটিয়ে “জয় বাংলা” স্লোগান দিতে দিতে চর আশুতোষপুর এ এসে জমায়েত হয়।

 

২৫শে মার্চ ভোর চার টার সময় পাকবাহিনী পুলিশ লাইন আক্রমণ করে। পুলিশ বাহিনী পূর্ব হতেই ডিফেন্সে ছিল। পাকনাহিনী আক্রমণ করার সাথে সাথে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

 

 

২৫শে মার্চ সকাল ৭টার সময় আমরা বকুলের নেতৃত্বে হাজার হাজার জনতাকে নিয়ে “জয় বাংলা” স্লোগান দিতে দিতে শহরে ঢুলে পড়ি এবং পাকবাহিনীকে আক্রমণ করি। তুমুল যুদ্ধ চলছে এর মধ্য দিয়ে হাজার হাজার জনতা রুটি, ডাব, ভাত ইত্যাদি দিয়ে আমাদের খাদ্যদ্রব্য যোগান দিচ্ছে। “জয় বাংলা” স্লোগান শোনার সাথে সাথে পাকবাহিনী ৪/৫ টি দলে ভাগ হয়ে যায়। পরে একত্রিত হয়ে সিনেমা হলের নিকতে এসে জমায়েত হয়। এদিকে পুলিশ লাইনে পাক সেনাদের একটি দলের ৮/১০ জন নিহত হয়। “বাণী” সিনেমা হলের কাছে আমরা পাকবাহিনীর সদস্যদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেললে তারা উপায় না দেখে আত্মসমর্পণ করে। সাথে সাথে হাজার হাজার জনতা এসে তাদের পিটিয়ে হত্যা করে।

 

পাকসেনাদের ১০/১৫ জনের একটি দল শিল্প এলাকাতে ছিল। তারা উক্ত সংবাদ শোনার সাথে সাথে হাতিয়ার ফেলে রেখে পাবনা থেকে বের হয়ে আরিফপুর গোরস্থানে গিয়ে আশ্রয় নেয়। জনতা এই সংবাদ শোনার সাথে সাথে উক্ত গোরস্থান গিয়ে ঘেরাও করে। আতারপর অনেক খোজাখুজির পর কয়েকটি কবর থেকে ৫/৭ জন পাকসেনাকে টেনে বের করে তাদেরকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। ৪/৫ জন পাকসেনা গোপালপুর মিলের কাছে গিয়ে জনতার হাতে ধরা পড়লে তাদেরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। অতঃপর পাবনা শহর সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে যায়। এবং আমরা সেখানে আবার বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি। সেখানকার অফিস আদালত আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলতে থাকে।

২৫শে মার্চের পর বাংলাদেশে পাকবাহিনী গণহত্যা শুরু করে। পাবনাতে পাকবাহিনী যাতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য আমরা রাজশাহী-পাবনা রোড, পাবনা-ঈশ্বরদী রোড, পাকশী-পাবনা রোডে ১৫/২০ জনের এক একটি দল প্রতিরোধ করার জন্য পাঠাই। আর আমরা বকুলের নেতৃত্বে নগরবাড়ী ঘাটে গিয়ে অবস্থান নেই। আমরা সেখানে দেখতে পাই বগুড়া থেকে ক্যাপ্টেন হুদা ৫০/৬০ জনের একটি ইপিআর ও আর্মি বাহিনী নিয়ে নগরবাড়ীতে পৌঁছেছেন। আমরা তাঁর বাহিনীর সাথে যোগ দেই।

 

১২ই এপ্রিল পাকবাহিনী বিমান থেকে নগরবাড়ীতে আমাদের উপর বোমা বর্ষণ করে। ঐ দিন ১০টার সময় ২/৩ টি ফেরি ভর্তি পাকসেনা আরিচা থেকে নগরবাড়ী চলে আসে। এসেই তারা শেলিং করে এবং মেশিনগান থেকে আমাদের দিকে এলোপাথারি গোলাবর্ষণ করতে থাকে। ২/৩ ঘন্টা তুমুল যুদ্ধ চলার পর আমরা তাদের ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে ক্যাপ্টেন হুদার নির্দেশে দল তুলে নিয়ে পাবনার দিকে চলে যাই।

 

পাকবাহিনী নগরবাড়ী প্রবেশ করে। তাদের এক কোম্পানী শাহজাদপুরে চলে আসে আর এক কোম্পানী পাবনার দিকে রওয়ানা হয়ে যায়। পথে কাশিনাথপুরে পাকবাহিনী আমাদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। সেখানে ২/৩ ঘন্টা সংঘর্ষের পর আমরা পাবনা হয়ে মুলাডুলি গিয়ে ডিফেন্স গ্রহণ করি। সেখানে ৩/৪ ঘন্টা যুদ্ধের পর ৬/৭ জন ইপিআর ও ১০/১৫ জন লোক নিহত হয়।

 

১৫/১৬ই এপ্রিল আমরা বোনপাড়া যাই। সেখানে পাক সেনাদের সাথে যুদ্ধে আমাদের ৫/৭ জন ইপিআর শহীদ হন। সেখান থেকে আমরা রাজশাহী জেলার সারদাতে পৌঁছি এবং সেখানকার পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধে আমাদের দুই জন মেশিনগান চালক পাকসেনাদের গুলিতে আহত হন। আমি তাদেরকে উদ্ধার করতে গেলে পাকসেনাদের একটি শেলের কণা এসে আমার বুকের বামপাশে লাগলে আমি আহত হই। তারপর তাদেরকে রেখে কোনরকমে আমার বাহিনীর সাথে রাজশাহী জেলার নওগাঁ গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হই। প্রায় দেড় মাস চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে উঠি। তারপর কলকাতা চলে যাই। সেখানে গিয়ে বকুল সহ পাবনা জেলার অনেক মুক্তিযোদ্ধার সাথে দেখা হয়। তাদের কে নিয়ে বকুলের নেতৃত্বে আমরা প্রথমে শিকারপুর ক্যাম্প করি। সেখানে ১০/১৫ দিন থাকার পর আমরা কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্প করি।

 

সেখানে প্রায় ১৫০ জন ছেলে বকুলের নেতৃত্বে প্রাথমিক সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। জুন মাসে ৪৪ জন ছেলেকে নিয়ে মুজিব বাহিনীর সামরিক প্রশিক্ষনের জন্য দেরাদুন যাই। দেরাদুনে সাপ-বিচ্ছুর ব্যাপক প্রকোপ ও নানা অসুবিধা সৃষ্টি হওয়ায় আমরা চাকার্তা চলে যাই। সেখানে আমরা মোট ৪৫ দিন বিভিন্ন প্রকার অশ্ত্রশস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি।

 

 

আগস্ট মাসে ২/৩ তারিখে আমরা জলপাইগুড়ি চলে আসি। সেখানে ৮/১০ দিন থাকার পর জলঙ্গী বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করি এবং পাবনা পাকশী ব্রিজের নিকটে এসে পাকসেনা দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হলে আমরা ভারতে চলে যাই।

 

১৭ই অগাস্ট আমরা কুষ্টিয়ার বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি এবং সাথিয়া থানার সোনাদহ ব্রীজে রাজাকারদের আক্রমণ করি। এতে ৩ জন রাজাকার নিহত হয় এবং একজন রাজাকারকে জীবিত ধরে নিয়ে আসি। অতঃপর আমরা পাবনা জেলার বোনাইনগর, ফরিদপুর থানায় প্রবেশ করি।

সেপ্টেম্বর মাসে আমরা সাথিয়া থানা ও রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ করি। সেখানে ১২ জন রাজাকার নিহত হয়। ১১ জনকে ধরে নিয়ে আসি এবং অনেক গোলাবারুদ উদ্ধার করি।

 

অক্টোবর মাসে পাকসেনারা দিঘলিয়া, রতনপুরে আমাদের ক্যাম্প আক্রমণ করে। ৩/৪ ঘন্টা তুমুল যুদ্ধ চলার পর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে যে আমাদের আরোও দুটি বাহিনী ছিল তাদেরকে খবর দেয়া হয়। সাথে সাথে তারা এসে তিন দিক থেকে ঘিরে পাকবাহিনী কে আক্রমণ করে। এতে ২৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। যুদ্ধ শেষে আমরা ফরিদপুর চলে যাই।

 

নভেম্বর মাসে আমরা গাঙ্গাহাটি ব্রিজে রাজাকারদের আক্রমণ করি। সেখানে আমাদের দু’জন যোদ্ধা আহত হয় এবং ছয়জন রাজাকার নিহত হয়। এরপর আমরা বোনাইনগর ফরিদপুর এলাকাতে পোষ্টার লাগিয়ে দেই। তাতে লেখা থাকে, উক্ত মাসের মধ্যে যদি রাজাকার হাতিয়ার নিয়ে আত্মসমর্পণ করে তাহলে তাদেরকে কিছু বলা হবে না। এবং যারা আত্মসমর্পণ করবেন না তাদের ক্ষমা করা হবে না।

 

এই সংবাদ রাজাকারদের কানে পৌঁছার সাথে সাথে নভেম্বর মাসের মধ্যে ফরিদপুর থানার সমস্ত রাজাকার হাতিয়ার নিয়ে এসে আত্মসমর্পণ করে। তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হয়।

 

১০/১২ ডিসেম্বর আমরা বাঘাবাড়ি ঘাটে পাকসেনাদের আক্রমণ করি এবং আমাদের বিমান বাহিনী বিমান হতে তাদের উপর বোমা বর্ষণ করে। সেখানে পাকসেনাদের সাথে আমাদের ৪/৫ ঘন্টা যুদ্ধ হয়। এতে আমাদের একজন আহত হয়।

 

সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় আমরা গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেই। পার্শ্ববর্তী আরও মুক্তিযোদ্ধারা এসে দেখে যায়। পরদিন সকালে আমরা পাকসেনাদের আক্রমণ করার জন্য বাঘাবাড়ি ঘাটে যাই। কিন্তু সেখানে কাউকে দেখতে পাইনি। জানা গেল তারা রাতে তাদের গাড়ি ও হাতিয়ারে আগুন লাগিয়ে দিয়ে পাবনার দিকে চলে গেছে। আমরা বাঘাবাড়ি ঘাটে গিয়ে দেখতে পাই ১৫/২০ টি গাড়ি পড়ে আছে এবং অস্ত্রশস্ত্রে আগুন জ্বলছে।

আমরা শাজহাদপুরে ফিরে এসে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করি এবং বেসরকারি শাসন ব্যবস্থা চালু করি।

 

স্বাক্ষর/-

মুকুল মিয়া

১৮-১১-৭৩

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!