You dont have javascript enabled! Please enable it!
বাগবাড়ি মাদাম পুলের অপারেশন
লক্ষ্মীপুর সদরে লক্ষ্মীপুর-রায়পুর সড়কের ওপর বাগবাড়িতে মাদামপুল অবস্থিত। ১৪ জুন হাবিলদার আব্দুল মতিন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে ৩০জনের একটি মুক্তিযােদ্ধার দল এ অপারেশনে অংশগ্রহণ করে। পাকিস্তানিদের যােগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ৭ জুন মুক্তিযােদ্ধারা লক্ষ্মীপুর-রায়পুর রাস্তার ওপর অবস্থিত মাদাম পুল ভেঙে দেন। এবং লক্ষ্মীপুর-রামগতি রাস্তার অংশবিশেষ কেটে দেন। তার এক সপ্তাহ পর অর্থাৎ ১৪ জুন পাকিস্তানিরা লক্ষ্মীপুর এসে দেখতে পায় যে মাদাম পুল ভাঙা এবং অপর দিকে রামগতি রাস্তার অংশবিশেষ কাটা। তখন তারা সামনে যেতে পেরে পুলের পূর্ব পাশে অবস্থান গ্রহণ করে রামগতি যাওয়ার রাস্তা মেরামত করছিল। সন্ধ্যা নেমে এলে তারা রাতের খাবার তৈরি করে কেউ কেউ খাচ্ছিল। এ সংবাদ পেয়ে মুক্তিযােদ্ধারা হাবিলদার আব্দুল মতিন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে ১টি এলএমজি, ১টি এসএমজি, ৫টি চাইনিজ রাইফেল ও ২১টি .৩০৩ রাইফেল নিয়ে পুলের উত্তর দিক থেকে শত্রুর ওপর আকস্মিক আক্রমণ রচনা করেন। এ আক্রমণ প্রায় আধঘণ্টা স্থায়ী ছিল। অতঃপর তারা দ্রুত পশ্চাদপসরণ করে। এ আকস্মিক আক্রমণের ফলে বেশকিছু পাকিস্তানি সেনা প্রাণ হারায়। পরদিন সকালবেলায় পাকিস্তানিরা প্রতিশােধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ঐ এলাকায় আগুন ধরিয়ে সমস্ত বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়।
রায়পুর থানা আক্রমণ
রায়পুর বাজারের পশ্চিম পাশে রায়পুর থানার অবস্থান। মুক্তিযােদ্ধারা ৬ জুলাই। হাবিলদার আব্দুল মতিন পটোয়ারীর নেতৃত্বে রায়পুর থানা আক্রমণ করেন। এ আক্রমণ ছিল খানার অস্ত্র ও গােলাবারুদ দখল করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযােদ্ধারা থানার ১০০ গজ পূর্ব দিকে রায়পুরলক্ষ্মীপুর সড়কে অবস্থানরত কয়েকটি পরিত্যক্ত গাড়ি এবং ছােট ছােট দোকানের আড়ালে অবস্থান গ্রহণ করেন। যােদ্ধারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে শক্রর ওপর ফায়ার শুরু করেন। সাথে সাথে থানা থেকে পুলিশও পাল্টা গুলি। করে। প্রায় ভাের পর্যন্ত দুই পক্ষে থেমে থেমে গােলাগুলি হয়। এতে থানার ওসি, ৪জন কনস্টেবল ও ১জন চৌকিদার মারা যায়। ভােরের দিকে পুলিশ ৭টি রাইফেল ফেলে প্রাণভয়ে থানা ছেড়ে পলায়ন করে। মুক্তিযােদ্ধাদের নিজস্ব অবস্থানের গােপনীয়তা রক্ষা অধিক জরুরি বলে মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক অবস্থান ত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেই মােতাবেক পুলিশের ফেলে যাওয়া ৭টি রাইফেল সংগ্রহ করে যােদ্ধারা দ্রুতগতিতে অবস্থান ত্যাগ করেন।
রামগতি থানা রেইড
লক্ষ্মীপুর জেলা সদর থেকে লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়ক বরাবর আনুমানিক ৪৭ কিলােমিটার যাওয়ার পর রামগতি মেঘনা নদীর পাশ। বাজারের দক্ষিণ পাশে রামগতি থানা। ৬ জুলাই মুক্তিযােদ্ধারা রামগতি থানা আক্রমণ করে। সুবেদার আব্দুল লতিফের নেতৃত্বে দুই প্লাটুন মুক্তিযােদ্ধা এ অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। থানার পূর্বে ওয়াপদা বিল্ডিংয়ে মিলিশিয়ারা অবস্থান করতাে। মিলিশিয়ারা সংখ্যায় ছিল প্রায় ৪৫জন। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযােদ্ধারা ৩টি দলে বিভক্ত হয়ে নিজ নিজ অবস্থান গ্রহণ করেন। ইতােপূর্বে স্থানীয় জনসাধারণের সহায়তায় অপারেশন এলাকা পর্যবেক্ষণ করা হয়। মুক্তিযােদ্ধারা ২টি এলএমজি ও ১৬-১৭টি .৩০৩ রাইফেল নিয়ে শত্রুকে আক্রমণ করেন। ৬ জুলাই রাত ১১টায় মুক্তিযােদ্ধারা রামগতি থানা আক্রমণ করে অস্ত্রশস্ত্র দখলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি দলকে থানার উত্তরে অবস্থান নিয়ে থানা আক্রমণ এবং আরেকটি দলকে ওয়াপদা বিল্ডিং ও থানার। মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান নিয়ে ওয়াপদা বিল্ডিংয়ে অবস্থানরত মিলিশিয়াদের আক্রমণের নির্দেশ প্রদান করা হয়। অপর দলটি আরও উত্তরে অবস্থান নিয়ে রিজার্ভ পার্টি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। এখানে উল্লেখ্য, থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ১জন বাঙালি ছিলেন। তিনি যদিও পাকিস্তানিদের সাথে ছিলেন, কিন্তু পরােক্ষভাবে তিনি এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের সহায়তা করেন। এদিকে রাত দেড়টায় মুক্তিযােদ্ধারা একযােগে থানা ও মিলিশিয়া ক্যাম্প আক্রমণ করেন। সাঁড়াশি আক্রমণের মাধ্যমে যােদ্ধারা মিলিশিয়াদের পরাস্ত করে থানা দখল করে নেন। শক্র তাদের অবস্থান থেকে পলায়ন করে। স্বাধীনতার পক্ষের ২জন বন্দিকে থানা হাজত থেকে উদ্ধার করা হয়। এ যুদ্ধে ৫জন মিলিশিয়া এবং ৩জন রাজাকার নিহত হয়। এ ছাড়া অন্যরা পালিয়ে। যায়। ৭টি রাইফেল ও গােলাবারুদ মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে আসে।
পানপাড়ার অপারেশন
রামগঞ্জ সদর থেকে প্রায় ১০ কিলােমিটার দক্ষিণে রামগঞ্জ-লক্ষ্মীপুর সড়কে পানপাড়া একটি গ্রাম। পানপাড়া থেকে আরেকটি রাস্তা পশ্চিম দিকে চলে গেছে রায়পুরের দিকে। শত্রুসৈন্যরা অনেক সময় রায়পুর থেকে পানপাড়া হয়ে সড়কপথে রামগঞ্জ কিংবা লক্ষ্মীপুরে যাতায়াত করতাে। মুক্তিযােদ্ধারা ৬ আগস্ট এ পানপাড়া-রায়পুর রাস্তায় শত্রুর ওপর অ্যামবুশ করেন। লক্ষ্মীপুর থেকে রায়পুর আসা যাওয়ার জন্য পাকিস্তানিরা লক্ষ্মীপুর-রায়পুর। সড়কে সরাসরি না গিয়ে অনেক সময় বিকল্প রাস্তা হিসেবে লক্ষ্মীপুর-পানপাড়ারায়পুর রাস্তা ব্যবহার করতাে। শত্রুর একটি গাড়ির বহর রেশন ও গােলাবারুদ সংগ্রহ করার পর লক্ষ্মীপুর থেকে পানপাড়া হয়ে রায়পুর যাবে, এ সংবাদ পেয়ে হাবিলদার তােফাজ্জলের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা অ্যামবুশ অবস্থান গ্রহণ করে। শক্রর জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। এ ছাড়া ২জন যােদ্ধাকে দিয়ে সড়কের ওপর অ্যান্টি ট্যাংক মাইন বিছানাে হয়। পাকিস্তানিরা নিজেদের নিরাপত্তা। নিশ্চিত করতে কনভয়ের সামনে গরুর গাড়ি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলাে। গরুর গাড়িটি মাইনের ফাদে পড়ার সাথে সাথে মাইনটি বিস্ফোরিত হয়। এর পর পরই পাকিস্তানি গাড়ির বহর বিস্ফোরণস্থলের অদূরে এসে থেমে যায়। পাকিস্তানি সেনারা গাড়ি থেকে নেমেই কাউন্টার অ্যামবুশ অবস্থান গ্রহণ করে এবং যােদ্ধাদের ওপর প্রচণ্ড গােলাগুলি শুরু করে। মুক্তিযােদ্ধারাও তাদের অবস্থান থেকে পাকিস্তানিদের ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরােধের মুখে পাকিস্তানি সৈন্যরা পশ্চাদপসরণ করে। এ অপারেশনে পাকিস্তানিদের দুজন সৈন্য নিহত হয়।
কাজীরদিঘির পাড়ের অপারেশন
লক্ষ্মীপুর-রামগঞ্জ সড়ক ধরে রামগঞ্জের দিকে লক্ষ্মীপুর সদর থেকে ১৪ কিলােমিটার উত্তর দিকে কাজীরদিঘির পাড়ের অবস্থান। ২৬ আগস্ট মুক্তিযােদ্ধারা এখানে পাকিস্তানিদের ধ্বংস করার জন্য একটি অ্যামবুশ অপারেশন পরিচালনা করেন। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে শত্রু নিয়মিত এ রাস্তায় টহল দিত। এ টহল দলকে ধ্বংস করাই ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্য সামনে রেখেই ঘটনার দিন হাবিলদার আবদুল মতিন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা। কাফিলাতলী বাজারের দক্ষিণে লক্ষ্মীপুর-রামগঞ্জ সড়কে অ্যামবুশ অবস্থান গ্রহণ। করেন। সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী ঐ দিন শক্রর একটি পায়ে চলা টহল দল ওই রাস্তায় টহল দেওয়ার কথা। আনুমানিক সকাল ১০টার দিকে টহল দলটি টার্গেট এলাকায় প্রবেশ করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযােদ্ধারা ফায়ার শুরু করেন। এতে পাকিস্তানি ও রাজাকাররা উল্টো দিকে দৌড়ে কাজীরদিঘির পাড় মসজিদে অবস্থান নেয়। মুক্তিযােদ্ধারাও পলায়নরত শত্রুদের অনুসরণ করে এবং মসজিদের তিন দিকে অবস্থান নিয়ে পুনরায় আক্রমণ করেন। শত্রুও পাল্টা গুলি শুরু করে। মুক্তিযােদ্ধারা মসজিদের তিন দিক (পূর্ব, পশ্চিম ওউত্তর) থেকে ফায়ার করতে থাকেন। এভাবে প্রায় ৩ ঘণ্টা থেমে থেমে ফায়ার চলার পর লক্ষ্মীপুর থেকে। পাকিস্তানিদের সাহায্য আসে। শক্রর শক্তিবৃদ্ধির ফলে মুক্তিযােদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করেন। অতঃপর পাকিস্তানিরা মসজিদ থেকে তাদের উদ্ধার করে। নিয়ে যায়। শক্রর হতাহতের সংখ্যা নিরূপণ করা যায় নি।
কাজীরদিঘির পাড়ের মসজিদের অপারেশন
কাজীরদিঘির পাড়ে মুক্তিযােদ্ধারা আরেকটি অপারেশন পরিচালনা করেন। এখানে একটি মসজিদ আছে। আগস্টের অপারেশনের পর পাকিস্তানিরা এ এলাকার দায়িত্ব রাজাকারদের ওপর ন্যস্ত করে। রাজাকাররা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে এখান থেকে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করতাে। ১০ সেপ্টেম্বর রাজাকারের একটি দল মীরগঞ্জ থেকে তাড়া খেয়ে এসে মসজিদে আশ্রয় নেয়। ঐ দিনই মুক্তিযােদ্ধারা রাজাকারদের বিরুদ্ধে রেইড অপারেশন পরিচালনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটনার দিন মুক্তিযােদ্ধা হামদে রাব্বির নেতৃত্বে একদল মুক্তিযােদ্ধা মসজিদ ঘেরাও করেন এবং তাদের আত্মসমর্পণ করতে বলেন। কিন্তু রাজাকাররা আত্মসমর্পণ না করে অতর্কিতে গুলিবর্ষণ শুরু করে। ফলে দু’পক্ষের মধ্যে তুমুল গুলিবিনিময় শুরু হয়। ৪জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন এবং রাজাকাররা তাদের ৫টি মৃতদেহ ফেলে দক্ষিণ দিকে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা ৫টি ৩০৩ রাইফেল উদ্ধার করে।
মীরগঞ্জ বাজারের অ্যামবুশ
লক্ষ্মীপুর সদর থেকে লক্ষ্মীপুর-রামগঞ্জ সড়ক ধরে উত্তর দিকে ২০ কিলােমিটার যাওয়ার পরই রামগঞ্জ। লক্ষ্মীপুর থেকে রামগঞ্জের মধ্যে লক্ষ্মীপুর-রামগঞ্জ সড়কের ওপরই কাফিলাতলা, মীরগঞ্জ, পানপাড়া ও ফাতেহপুর অবস্থিত। ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যবর্তী সময়ে এ স্থানগুলােয় মুক্তিযােদ্ধারা কয়েকটি অ্যামবুশ পরিচালনা করে। এ অ্যামবুশগুলােয় হাবিলদার আব্দুল মতিন। তার অধীনের প্রায় ৯০জন সহযােদ্ধা অংশ নেন। যােগাযােগ ব্যবস্থা রক্ষার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানিরা এ সড়কটিতে নিয়মিত টহল পরিচালনা করতাে। মূলত শত্রু ধ্বংস করে তাদের অস্ত্র ও গােলাবারুদ দখল করাই ছিল এ অপারেশনের উদ্দেশ্য। পরিকল্পনা অনুযায়ী হাবিলদার। আব্দুল মতিন পুরাে দলটিকে কয়েকটি ছােট দলে বিভক্ত করেন। ৪ দিনের এ অপারেশনে লক্ষ্মীপুর-রামগঞ্জ সড়কের বিভিন্ন স্থানে পরিচালিত প্রতিটি অ্যামবুশে নেতৃত্ব দেন যথাক্রমে হাবিলদার আলতাফ, হাবিলদার তােফাজ্জল, নায়েক তছলিম উদ্দিন, হামদে রাব্বি, এজাজ, রাজ্জাকুল হাওলাদার ও হাবিলদার আব্দুল মতিন। তবে এ অপারেশনের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন হাবিলদার আবদুল মতিন পাটোয়ারী। ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে মুক্তিযােদ্ধারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে অ্যামবুশ পেতে শক্রর অপেক্ষায় থাকেন। অনেক অপেক্ষার পর ১৯ সেপ্টেম্বর প্রথম শত্রুর সাথে অ্যামবুশ দলটি মুখােমুখি হয়। ঐদিন সকালে পাকিস্তানিদের আনুমানিক ২৫জন সৈন্যের একটি দল ২টি গাড়ি নিয়ে লক্ষ্মীপুর থেকে রামগঞ্জ যাচ্ছিল। শক্র লক্ষ্মীপুর থেকে রামগঞ্জ যাওয়ার পথে প্রথমে চৌধুরী বাজার এবং পরে কাজীরদিঘির পাড়, কাফিলাতলী, মীরগঞ্জ, পানপাড়া ও ফাতেহপুরে খণ্ড খণ্ডভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের অ্যামবুশে পড়ে। মুক্তিযােদ্ধারা সারাদিন খণ্ড খণ্ড অ্যামবুশের মাধ্যমে ছােট দলে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ রচনা করেন এবং তাদের দিশাহারা করে দেন। হাবিলদার আব্দুল মতিন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রতিটি অ্যামবুশের সমন্বয়। করেছিলেন। সারাদিন খণ্ড খণ্ড অপারেশন চলে।
১৯ সেপ্টেম্বর বিকেলবেলা পাকিস্তানিরা দুর্বল হয়ে পড়ে। মীরগঞ্জ যুদ্ধে পাকিস্তানি অধিনায়ক মেজর ইমতিয়াজসহ বেশকিছু পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অবশিষ্ট জীবিত সৈন্যরা ১টি গাড়ি নিয়ে লক্ষ্মীপুরের দিকে পালিয়ে যায়। মেজর ইমতিয়াজের ব্যবহৃত বাইনােকুলারটি পরে উদ্ধার করা হয়। এ অপারেশনের খবর রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা থেকে প্রচার করা হয়। বিভ্রান্তির উদ্দেশ্যে প্রচারিত এ সংবাদে বলা হয় যে এ যুদ্ধে ‘৮০০জন মুক্তিযােদ্ধা মারা গিয়েছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোনাে মুক্তিযােদ্ধাই মারা যায় নি।
কাপিলাতলা ধোঁয়াবাড়ির অ্যামবুশ লক্ষ্মীপুর-রামগঞ্জ সড়ক ধরে লক্ষ্মীপুর সদর থেকে আনুমানিক ১৪ কিলােমিটার উত্তরে একটি গ্রাম। নাম কাফিলাতলা। ২০ সেপ্টেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা এ গ্রামে একটি অ্যামবুশ করেন। শত্ৰু বিভিন্ন সময় লক্ষ্মীপুর-রামগঞ্জ সড়কে টহল দিত এবং রামগঞ্জের সাথে যােগাযােগের জন্য এ সড়কটি ব্যবহার করতাে। যােদ্ধারা এ স্থানে ২টি পাকিস্তানি গাড়ির ওপর অ্যামবুশ করেন। ঘটনার দিন সকাল ৮টায় হাবিলদার তােফাজ্জলের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযােদ্ধা অ্যামবুশ অবস্থান গ্রহণ করেন। ২জন যােদ্ধা লক্ষ্মীপুর-রামগঞ্জ সড়কে অ্যান্টি ট্যাংক মাইন বিছিয়ে পাকিস্তানিদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। দুপুর ১২টার দিকে শক্রর ২টি গাড়ি অ্যামবুশ সাইটে প্রবেশ করে। সামনের গাড়িটি মাইনের ওপর আসার সাথে সাথে প্রচণ্ড শব্দে মাইনটি বিস্ফোরিত হয়। শত্রুর গাড়িটি ধ্বংস হয় এবং গাড়িতে বসা সৈন্যরা হতাহত হয়।
মুক্তিযােদ্ধারাও নিজ নিজ অবস্থান থেকে গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। এ বিস্ফোরণের সাথে সাথেই পেছনের ট্রাক থেকে শত্রুসৈন্যরা নেমে কাউন্টার অ্যামবুশ অবস্থান গ্রহণ করে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ করে। এ আক্রমণের ফলে মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটে যান। এ অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধাদের কেউ হতাহত হন নি। শক্রর ১টি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ৫-৬জন সৈন্য নিহত হয়।
রায়পুর এলএম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও আলিয়া মাদ্রাসা অপারেশন
রায়পুর এলএম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও আলিয়া মাদ্রাসা লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলা সদরে অবস্থিত। ১ অক্টোবর স্থানীয় জনসাধারণের সহায়তায় সর্বমােট ৩০জন মুক্তিযােদ্ধা প্রায় ২০০ মিলিশিয়ার বিরুদ্ধে এ অপারেশন পরিচালনা করেন। | মিলিশিয়ারা উচ্চবিদ্যালয় ও আলীয়া মাদ্রাসার ভেতর অবস্থান নেয়। মুক্তিযােদ্ধারা ৩টি দলে বিভক্ত হয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী ভােরবেলা নিজস্ব অবস্থান গ্রহণ করেন। সেখানে ১জন জেসিওর নেতৃত্বে মিলিশিয়ারা অবস্থান করত। পার্শবর্তী রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল রায়পুর আলীয়া মাদ্রাসায়। মুক্তিযােদ্ধারা হাবিলদার আবদুল মতিন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে আনুমানিক সকাল ৬টায় শত্রুদের পিটি ও প্যারেডের সময় তাদের ক্যাম্প আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। পরিকল্পনা ছিল, নির্দিষ্ট অবস্থান থেকে এলএমজি দ্বারা ফায়ার করে মাঠে। প্যারেডরত সমস্ত সৈনিক ও রাজাকারকে হত্যা করা। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০জন মুক্তিযােদ্ধা প্রতিটি ১০জনের ৩টি দলে ভাগ হন। একটি দল এলএমজি। নিয়ে নায়েক আলতাফের নেতৃত্বে বিদ্যালয়ের ২৫০ গজ পূর্বে খালের পূর্ব। পাশের একটি বাড়ির আড়ালে অবস্থান নেয়। বলাবাহুল্য, এ দ্বীপ সমতুল্য বাড়িটির চতুর্দিকেই খাল ছিল বলে মুক্তিযােদ্ধারা নৌকায় করে এ অবস্থানে আসেন এবং এ সময় ১টি এলএমজি দুর্ঘটনাক্রমে পানিতে পড়ে যায়। এ দলটি ছিল প্রকৃতপক্ষে অ্যাকশন পার্টি-১। অপর দলটি কাট অব পার্টি হিসেবে রাস্তায়। অবস্থান নেয়, যাতে কেউ পেছন দিক থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ করতে না। পারে। তৃতীয় দলটি পীর ফয়েজ উল্লাহ রােড বরাবর আলীয়া মাদ্রাসার দিকে মুখ করে হাবিলদার আব্দুল মতিন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে অবস্থান নেয়। এ দলটি ছিল।
অ্যাকশন পাটি-২
দুর্ভাগ্যবশত অবস্থান নেওয়ার পর ২জন রাজাকার সদস্য। তৃতীয় দলটির অবস্থান দেখে ফেলে এবং সাথে সাথে গুলি করে। এ গুলিতে ১জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। এ ফায়ারের সাথে সাথে অপর ২টি দল ফায়ার। শুরু করে। কিছুক্ষণ গােলাগুলি চলার পর শক্রর কয়েকজন সৈন্য হতাহত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য একপর্যায়ে পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্ত। গ্রহণ করেন। এ অপারেশনে ২জন রাজাকার এবং বিদ্যালয়ের মাঠে অবস্থানরত ৪জন। মিলিশিয়া সদস্য নিহত হয়। রাজাকারদের ২টি অস্ত্র মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে আসে। ১জন যােদ্ধা শহিদ হন।
চরসীতায় অ্যামবুশ
লক্ষ্মীপুর সদর থেকে সড়কপথে রামগতি যাওয়ার রাস্তায় প্রায় ৩০ কিলােমিটার দক্ষিণে জমিদারহাট বাজার অবস্থিত। পাকিস্তানি ও রাজাকাররা লক্ষ্মীপুর থেকে রামগতি পর্যন্ত যােগাযােগ ব্যবস্থা রক্ষা করা এবং এ সড়কটি নিরাপদ রাখার জন্য বিভিন্ন সময় এ সড়কটিতে টহল পরিচালনা করতাে। ১১ অক্টোবর হাবিলদার সােলায়মান গাজীর নেতৃত্বে ৪০জন যােদ্ধা রাজাকারদের একটি দলকে এ রাস্তায় অ্যামবুশ করার পরিকল্পনা করেন। লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়কের পূর্ব পাশে জমিদারহাট বাজার ঘেঁষেই কাজী মেম্বরের বাড়ি অবস্থিত। মুক্তিযােদ্ধারা এ বাড়ি থেকে উত্তর দিকে বিস্তৃত হয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। ১১ অক্টোবর সােমবার সকালে রাজাকারের দলটি হাজীরহাট ও বড়খেরী ক্যাম্প থেকে জমিদারহাট যাচ্ছে, এ সংবাদ পেয়ে মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক হাবিলদার মাে. সােলায়মান গাজী ও আবু তাহেরের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা বেলা ২টার দিকে লক্ষ্মীপুর-রামগঞ্জ সড়কের পূর্ব পাশে অ্যামবুশ অবস্থান গ্রহণ করেন। | অ্যামবুশ দলটি শক্রর আগমনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজাকারের দলটি অ্যামবুশ এলাকায় প্রবেশ করে। প্রথমেই মুক্তিযােদ্ধা আবু তাহেরের দল ফায়ার শুরু করে এবং পরে হাবিলদার সােলায়মান গাজীর দল ফায়ার শুরু করে। উভয় দিকের আক্রমণের মুখে রাজাকাররা দিশেহারা হয়ে রাস্তার উভয় পাশের পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে। এ অপারেশনে ঘটনাস্থলেই ২২জন রাজাকার নিহত হয় এবং ৩জন বন্দি হয়। মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক হাবিলদার সােলায়মান গাজী গুরুতর আহত হন। যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা ২৫টি রাইফেল ও গােলাবারুদ উদ্ধার করেন।
চৌধুরীহাটের রেইড
লক্ষ্মীপুর জেলার সদর থানার উত্তর হামছাদী ইউনিয়নে লক্ষ্মীপুর সদর থেকে আনুমানিক ১০ কিলােমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে চৌধুরী হাট অবস্থিত। ২৬ অক্টোবর বিকেলে মুক্তিযােদ্ধারা চৌধুরী হাট মাদ্রাসায় অবস্থিত পাকিস্তানিদের অস্ত্র ও গােলাবারুদ দখলের উদ্দেশ্যে আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ইতােমধ্যে স্থানীয় জনসাধারণের মাধ্যমে ঘটনাস্থলের তথ্য সংগৃহীত হয়েছিল। এ যুদ্ধে হাবিলদার আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে ২৫জন মুক্তিযােদ্ধা আনুমানিক ৩০-৩৫জন পাকিস্তানি ও রাজাকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৭ অক্টোবর সকালে মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুর অবস্থানের উদ্দেশ্যে রওনা হন। টার্গেট এলাকায় আনুমানিক সাড়ে ১২টায় পৌছনাের পর  চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং পুরাে দলকে ৩টি ভাগে বিভক্ত করা হয় । আক্রমণের সময় ছিল বেলা ১টা। প্রথমে ৩জন মুক্তিযােদ্ধা শত্রুর অবস্থান। সম্বন্ধে নিখুঁতভাবে জানার জন্য তিন দিক থেকে মাদ্রাসার উদ্দেশ্যে ক্রলিং করে অগ্রসর হতে থাকেন।
মুক্তিযােদ্ধারা সুপ্রশিক্ষিত ছিল না। ফলে যুদ্ধের কৌশল সম্বন্ধে ধারণাও ছিল সীমিত। তারা নিজেদের গােপনীয়তা বজায় রাখতে ব্যর্থ হন এবং শত্রু  তাদের দেখে ফেলে। সাথে সাথেই শক্র মাদ্রাসার জানালা দিয়ে তাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে এবং তৎক্ষণাৎ ৩জনই শাহাদতবরণ করেন। এ ঘটনার পর পরই মুক্তিযােদ্ধারা তিনদিক হতে শত্রুর ওপর ফায়ার শুরু করেন। একপর্যায়ে কয়েকজন শত্রুসৈন্য নিহত হয়। এ সময় পাকিস্তানিদের সহায়তা করার জন্য লক্ষ্মীপুর সদর হতে অতিরিক্ত সৈন্য পাঠানাে হয়। তারা দালালবাজার হতে মর্টার দ্বারা কভারিং ফায়ারের মাধ্যমে অতিরিক্ত সৈন্য চৌধুরী হাটে প্রেরণ করে। পাকিস্তানিদের জনবল ও শক্তি বৃদ্ধি হওয়ায় মুক্তিযােদ্ধারা তাদের অপারেশন সংক্ষিপ্ত করে এবং পশ্চাদপসরণ করে নিজস্ব অবস্থানে ফেরত চলে আসেন। এ অপারেশনে পাকিস্তানিদের কয়েকজন হতাহত হয়। ৩জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। মুক্তিযােদ্ধারা পশ্চাদপসরণের পর পাকিস্তানি বাহিনী নিহত সৈনিকদের মৃতদেহ নিয়ে লক্ষ্মীপুরে ফেরত চলে যায়।
কাজীরদিঘির পাড় রাজাকার ক্যাম্প রেইড
কাজীরদিঘির পাড় এলাকায় মুক্তিযােদ্ধারা পরবর্তী সময় ১টি রাজাকার ক্যাম্পও ধ্বংস করেছিলেন। লক্ষ্মীপুর-রামগঞ্জ সড়কের পশ্চিম পাশে ১টি মসজিদ এবং মসজিদসংলগ্ন ১টি বড় দিঘি আছে। এ দিঘির পাড়েই রাজাকারদের অবস্থান ছিল। ২৪ নভেম্বর আনুমানিক সন্ধ্যা ৭টায় এখানে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্পটি রেইড করা হয়।  হাবিলদার আব্দুল মতিন পাটোয়ারী ও হামদে রাব্বির নেতৃত্বে মুক্তিযোেদ্ধারা কাজীরদিঘির পাড় মাদ্রাসায় অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্প রেইড করেন। মুক্তিযােদ্ধারা অবস্থান গ্রহণ করে পরিকল্পনা অনুযায়ী শত্রুর ওপর গুলিবর্ষণ করেন। প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে রাজাকার বাহিনী আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। এ রেইডে ৫৪জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযােদ্ধারা তাদের কাছ থেকে ২টি এলএমজি, ৪৮টি রাইফেল এবং প্রচুর গােলাবারুদ উদ্ধার করেন।
লক্ষ্মীপুর ক্যাম্প অপারেশন
বেগমগঞ্জ-লক্ষ্মীপুর সড়কের ওপর লক্ষ্মীপুর সদরে ট্রাফিক মােড় (বর্তমানে ঢাকা বাসস্ট্যান্ড) থেকে আনুমানিক ১.৫ কিলােমিটার দক্ষিণে লক্ষ্মীপুর থানা। থানার নিকটস্থ হারিছ চেয়ারম্যানের ও বটু চৌধুরীর বাড়ি প্রায় কাছাকাছি অবস্থিত। থানা থেকে হারিছ চেয়ারম্যান বাড়ির দূরত্ব ২০০ গজ এবং বটু চৌধুরীর বাড়ির দূরত্ব ৩০০ গজ। থানা এবং এ দুই বাড়িতে শত্রু অবস্থান করতাে। ৩০ নভেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা লক্ষ্মীপুরে শত্রুর ক্যাম্পে অপারেশন পরিচালনা করেন। হাবিলদার মতিনের নেতৃত্বে ৫০জন মুক্তিযােদ্ধা এ যুদ্ধে অংশ নেন। শক্ররা ৩টি স্থানে আনুমানিক ৪০-৪৫জন অবস্থান করছিল। পাকিস্তানিরা এখানে ক্যাম্প স্থাপনের মাধ্যমে লক্ষ্মীপুর থেকে রামগঞ্জ, রায়পুর ও রামগতি পর্যন্ত যােগাযােগ ব্যবস্থা অক্ষুন্ন রাখতাে। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযােদ্ধারা ছােট ছােট দলে বিভক্ত হয়ে কাবলাতলা হাইস্কুলে অবস্থান গ্রহণ করেন। সর্বমােট ৩টি দলে বিভক্ত হয়ে অপারেশন পরিচালনা করা হয়। ৩০ নভেম্বর আনুমানিক সকাল ১০টায় মুক্তিযােদ্ধারা কাবলাতলী হাইস্কুল থেকে শত্রুর অবস্থানের উদ্দেশ্যে রওনা হন। ইতােপূর্বে স্থানীয় জনগণের মাধ্যমে ঘটনাস্থলের তথ্য সংগৃহীত হয়েছিল।
অপারেশন এলাকায় আনুমানিক বেলা ২টায় পৌছানাের পর চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং সে অনুযায়ী দলকে ৩ ভাগে বিভক্ত করা হয়। অপারেশনের সময় ছিল বিকেল ৪টা। প্রথমে অ্যাকশন পার্টি চেয়ারম্যানের বাড়ির উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে মুখ করে অবস্থান নেয়। আরেকটি দল লক্ষ্মীপুর থানা এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করে। তৃতীয় দলটি ছিল স্পেশাল টাস্ক গ্রুপ। এ দলে ৪জন মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন। কমান্ডারের নির্দেশে এ যােদ্ধারা যথাসময়ে শত্রুর ওপর হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। একইসাথে প্রথম দলটি চেয়ারম্যানের বাড়িতে অবস্থিত শত্রুর ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। ঘটনাস্থলেই শক্রর ৪-৫জন সৈন্য নিহত হয়। বাকিরা পাল্টা আক্রমণ করে অনবরত ফায়ারের মাধ্যমে পশ্চাদপসরণ করে এবং তাদের মূল ক্যাম্প লক্ষ্মীপুর থানায়। একত্র হয়। এখানে সৈনিক নজরুল শক্রর হাতে ধরা পড়েন এবং পরবর্তী সময় শত্রুরা তাকে হত্যা করে।  শক্র যখন লক্ষ্মীপুর থানায় একত্র হয়, তখন মুক্তিযােদ্ধাদের আরেকটি দল। লক্ষ্মীপুর থানায় গুলিবর্ষণ শুরু করে। এ সময় ১০-১৫ মিনিট গুলি বিনিময় হয়। এতে শক্রর ৬-৭জন সৈন্য নিহত হয় এবং বাকিরা পশ্চাদপসরণ করে বটু চৌধুরীর বাড়ির ক্যাম্পে একত্র হয়। এ পর্যায়ে সকল যােদ্ধারা একত্র হয়ে বটু চৌধুরীর বাড়িতে অবস্থানরত শত্রুদের একযােগে আক্রমণ করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের অনবরত ফায়ারের কারণে পাকিস্তানিরা বটু চৌধুরীর বাড়ির। ক্যাম্পও ছাড়তে বাধ্য হয়। এ অপারেশনে অনেক শত্রু হতাহত হয়। মিলিশিয়াদের আনুমানিক ২৫জন সদস্য অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযােদ্ধারা প্রচুর অস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার করেন।
চর জাঙ্গালিয়ার অপারেশন (হাজীরহাট)
রামগতি থানা এলাকায় মুক্তিযােদ্ধারা যে কয়টি অপারেশন পরিচালনা করেছিলেন, চর জাঙ্গালিয়ার অপারেশন এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য। লক্ষ্মীপুর সদর থেকে ২০ কিলােমিটার দক্ষিণে লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়কের ওপরই চর জাঙ্গালিয়া। ৯ ডিসেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা এখানকার রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে দখল করে নেন। চর জাঙ্গালিয়া ক্যাম্পে মিলিশিয়া ও রাজাকাররা একত্রে অবস্থান করতাে। পাকিস্তানিদের শক্তি যখন ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছিল, এ পরিস্থিতিতে মিলিশিয়ারা ক্যাম্প পরিত্যাগ করে চলে যায়। মিলিশিয়া বাহিনী চলে যাওয়ার পর এলাকার সব রাজাকার হাজীরহাট চর জাঙ্গালিয়া ক্যাম্পে সমবেত হয়। ঘটনার দিন বেলা ১১টায় স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক আবু তাহের ৪০-৪৫জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে রাজাকারদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেন এবং শত্রুর অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। যােদ্ধারা ক্যাম্পের কাছাকাছি এসে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং রাজাকারদের আত্মসমর্পণ করতে বলেন। এতে রাজাকাররা হতাশ হয়ে পড়ে। অতঃপর মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক আবু তাহের মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে রাজাকার ক্যাম্পে প্রবেশ করেন এবং রাজাকারদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন।
রামগঞ্জ এমইউ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের যুদ্ধ
রামগঞ্জ এমইউ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় রামগঞ্জ সদরে অবস্থিত। ওই স্থানে শক্রর একটি ক্যাম্প ছিল। পাকিস্তানিদের প্রায় ১ কোম্পানি সৈন্য এ ক্যাম্পে থেকে বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করতাে। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হলেও রামগঞ্জ উপজেলা তখনাে শত্রুমুক্ত হয়নি। কারণ, পাকিস্তানিরা ১৭ ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত পশ্চাদপসরণের জন্য নিরাপদ কোনাে পথ নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে নিজস্ব অবস্থান থেকেই বাধ্য হয়ে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে হয়। এ পরিস্থিতিতে শত্রু রামগঞ্জ এলাকার কর্তৃত্ব ১৬ ডিসেম্বরের পরও বহাল রাখে। ১৬ ডিসেম্বরের ২-৩ দিন পূর্ব থেকে নােয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর অঞ্চলের বিপুলসংখ্যক রাজাকার এ বিদ্যালয়ে জড়াে হতে থাকে। একইসাথে মুক্তিযােদ্ধারা আরও সংগঠিত হয়ে পাকিস্তানি এবং তাদের দোসরদের ওপর আক্রমণের তীব্রতা ক্রমেই বৃদ্ধি করছিল। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করলে ঐ দিন দিবাগত রাতে চুপিসারে সকল পাকিস্তানি সৈনিক নিরাপদ স্থানে সটকে পড়ে। ক্যাম্পে থাকে শুধু ২০০জনের মতাে রাজাকার। ১৭ ডিসেম্বর সকাল থেকেই মুক্তিযােদ্ধারা সুসংগঠিত হয়ে এ স্কুলে আক্রমণ শুরু করে। মুক্তিযােদ্ধারা প্রাথমিকভাবে খণ্ড খণ্ড আক্রমণ পরিচালনা করেন। প্রাথমিক খণ্ড আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযােদ্ধারা যখন বুঝতে পারেন, পাকিস্তানিরা বিদ্যালয় এলাকায় উপস্থিত নেই। তখন প্রায় ১০০জনের মতাে মুক্তিযােদ্ধা পুরাে এলাকা ঘিরে ফেলেন। সংঘর্ষ আর গুলিবিনিময়ে অনেক রাজাকার ও মুক্তিযােদ্ধা হতাহত হন। এভাবে ১৭ ডিসেম্বর সারাদিন ও সারারাত সংঘর্ষ চলে। ১৮ ডিসেম্বর ভােরে অসংখ্য আহত রাজাকার পেছনে ফেলে অন্য রাজাকাররা ঐ ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যায়। এ সংঘর্ষে প্রায় ৩০জন রাজাকার নিহত এবং ৭জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। এ ছাড়া ২৫টি ৩০৩ রাইফেল উদ্ধার করা হয়।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!