You dont have javascript enabled! Please enable it! বগাদিয়ার যুদ্ধ-২,সাহেবজাদা পুল ধ্বংস,ছাতুরার অ্যামবুশ,দালালবাজার রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ,চণ্ডীপুরের অ্যামবুশ - সংগ্রামের নোটবুক
বগাদিয়ার যুদ্ধ-২
বেগমগঞ্জ থানায় বগাদিয়া অবস্থিত। নায়েক সিরাজ এক প্লাটুন যােদ্ধা নিয়ে বগাদিয়া সেতুর কাছে অ্যামবুশ করেন। এ জায়গা দিয়ে ১টি জিপসহ ৩টি ৩ টন লরি কিছু দূরত্ব বজায় রেখে অগ্রসর হবার সময় নায়েক সিরাজ তাঁর দল নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর চরম আক্রমণ চালান এবং প্রথম ও শেষের গাড়িটির ওপর অনবরত গুলি চালালে ৩ টন একটি গাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়।
এখানে প্রায় ১৫-২০জন পাকিস্তানি সেনা সঙ্গে সঙ্গে নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। পরক্ষণে পাকিস্তানি সেনারা ৩ ইঞ্চি মর্টার ও মেশিনগান হতে অবিরাম গুলিবর্ষণ করতে থাকে। দীর্ঘ সময় যুদ্ধের পর নায়েক সিরাজ তার প্লাটুন নিয়ে উইথড্র করেন। পাকিস্তানি সেনারা এখানে কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং একজন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এ যুদ্ধে হাবিলদার নুরুল আমিন ও অপর একজন মুক্তিযােদ্ধা গুরুতরভাবে আহত হন। নায়েক সিরাজ অসীম সাহস ও বীরত্বের সাথে এ যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
সাহেবজাদা পুল ধ্বংস
বেগমগঞ্জ থানাধীন সাহেবজাদা পুলটি মুক্তিযােদ্ধারা ২৩ জুলাই ধ্বংস করে। সােনাইমুড়িতে সংঘটিত অপারেশনগুলাের মধ্যে সাহেবজাদা পুল ধ্বংস একটি অন্যতম বিশেষ ঘটনা। পাকিস্তানি বাহিনী সাহেবজাদা পুল (রেলব্রিজ) দিয়েই নােয়াখালীর সাথে রেল যােগাযােগ স্থাপন করেছিল। মিলিশিয়া ও রাজাকাররা এ পুলে পাহারা দিত। সুবেদার লুত্যর রহমানের তত্ত্বাবধানে ২জনের ১টি মুক্তিযােদ্ধার দল ৭০ পাউন্ড বিস্ফোরক স্থাপন করে ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়। এতে ১জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। এরপর নােয়াখালীর সাথে পাকিস্তানি। বাহিনীর রেল যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
ছাতুরার অ্যামবুশ
ছাতুরা নােয়াখালী সদরে অবস্থিত। জুলাই মাসে পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি শক্তিশালী দল এ এলাকাকে মুক্তিযােদ্ধাদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য লঞ্চযােগে চাদপুর থেকে ডাকাতিয়া নদী দিয়ে অগ্রসর হয়। সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারী আগে থেকেই এ ব্যাপারে গােপন খবর পান। তিনি ছাতুরার। কাছে একটি সুপারি বাগানে শত্রুসেনাকে অ্যামবুশ করার জন্য অবস্থান নেন। তার দলটি নদীর দু’পাশে হালকা মেশিনগান স্থাপন করে শক্রদলের অপেক্ষায় থাকে। বেলা ১১টায় শক্ররা লঞ্চযােগে অ্যামবুশ অবস্থানের মধ্যে পৌছায়। নদীর দুই তীর থেকে নায়েব সুবেদার ওয়ালীউল্লাহকে বগাদিয়ায় অ্যামবুশ করার নির্দেশ দিয়ে নায়েব সুবেদার জাবেদকে সঙ্গে নিয়ে সুবেদার লুৎফর রহমান শত্রু বাহিনীর কর্মতৎপরতা ও অবস্থান লক্ষ্য করে চৌমুহনী রওনা হন।
চৌমুহনীতে পাকিস্তানি বাহিনীর গতিবিধি লক্ষ্য করে বগাদিয়ায় ফেরার পূর্বেই নায়েব সুবেদার ওয়ালীউল্লাহ পাকিস্তানি বাহিনীর একখানা পিকআপ ভ্যানের ১জন জেসিওসহ ৬জন সৈন্যের ওপর আক্রমণ করেন। সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর ২জন সৈন্য নিহত হয়। গাড়িটি রাস্তায় পড়ে যায়। ইতােমধ্যে মুক্তিযােদ্ধারাও পৌছে যান সেখানে। ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তানি বাহিনীর আরও ২টি গাড়ি এসে পড়ে সেখানে। শুরু হয় উভয় পক্ষের আক্রমণ আর। পাল্টা আক্রমণ। প্রায় ৪-৫ ঘণ্টা গুলিবিনিময় হয়। অবশেষে পাকিস্তানি বাহিনী হতাহত সৈন্যদের নিয়ে চৌমুহনীর দিকে চলে যায়। এখানে পাকিস্তানি বাহিনীর যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ যুদ্ধে নায়েব সুবেদার ওয়ালীউল্লাহর কপালে গুলি লাগে এবং তিনি সামান্য আহত হন। তিনি এ যুদ্ধে অসামান্য সাহস ও বীরত্বের উজ্জ্বল। দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর অকেজো গাড়িটি স্বাধীনতার পরও দীর্ঘ কয়েক মাস রাস্তার পাশে উল্টে পড়ে ছিল।
দালালবাজার রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ
জেলা সদরে অবস্থিত দালালবাজার এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর রাজাকাররা ক্যাম্প স্থাপন করে। তারা সাধারণ জনগণের ওপর নানাবিধ অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছিল। রাজাকারদের দুষ্কর্মের বিস্তারিত ঘটনা জেনে। মুক্তিবাহিনী তাদের ওপর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ২৬ মে সুবেদার ওয়ালীউল্লাহর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযােদ্ধা দালালবাজার রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে প্রায় ৩০জন রাজাকারকে হত্যা করেন এবং সেখান থেকে ৬টি রাইফেল উদ্ধার করেন। ২৯ মে মীরহাট থেকে আনুমানিক ১৫জনের একটি রাজাকারের দল নােয়াখালীর দিকে অগ্রসর হলে হাবিলদার আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের ফাদে ধরা পড়ে এবং ঘটনাস্থলেই রাজাকাররা সবাই নিহত হয়।
গােপালপুরের যুদ্ধ
বেগমগঞ্জ থানা সদর থেকে আনুমানিক ৯ কিলােমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত গােপালপুর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রায় মুক্তই ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী কয়েকবারই এ অঞ্চল দখলের প্রচেষ্টা নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এ এলাকার চিকিৎসক আনিসুজ্জামান, ছাত্রনেতা | নিমচন্দ্র ভৌমিক, সাহাব উদ্দিন মিন্টু ও স্থানীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সমন্বয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সংঘটিত করার কাজ শুরু হয়। এখানে গড়ে ওঠে মুক্তিযােদ্ধা রিক্রুটিং সেন্টার। মুক্তিযােদ্ধাদের এ দুর্জয় ঘাঁটির খবর স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে পৌছে যায়। আগস্ট থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক প্রস্তুতি নেয় গােপালপুর দখলের। ১০ আগস্ট পাকিস্তানি বাহিনীর শতাধিক সৈন্য গােপালপুর দখল করার উদ্দেশ্যে তাদের অভিযান শুরু করলে তিতা হাজরা নামক স্থানে হাবিলদার জাবেদ আলীর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযােদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরােধ করেন। এ প্রতিরােধে পাকিস্তানি বাহিনীর ২জন নিহত ও ৭জন আহত হয়। এ ঘটনায় হাবিলদার জাবেদ আলী, নায়েক হাসমত উল্লাহ, হাবিলদার মমতাজ, নজির আহমেদ মােক্তার, সিপাহি সিরাজ ও নায়েব সিরাজ প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধে কোনাে মুক্তিযোেদ্ধা হতাহত হন নি। 
পাকিস্তানি বাহিনী ১০ আগস্টের বিপর্যয়ের প্রতিশােধ নেয় ১৯ আগস্ট। ভােররাতে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ৩০০ সৈন্য, রাজাকার, আলবদরসহ  বেগমগঞ্জ-লক্ষ্মীপুর সড়কের কাছে শামসুন নাহার হাইস্কুলে অবস্থান নেয়। দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে রাজাকারদের একটি দল গােপালপুর বাজারের পশ্চিম দিক  দিয়ে এবং বাদবাকিরা মূল রাস্তা দিয়ে চারদিক থেকে বাজার ঘিরে ফেলে। তখন সকাল ৮টা, মুক্তিযােদ্ধারা বিভিন্ন অপারেশনে চলে যাওয়ায় এ  অঞ্চলে তখন মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম। তা সত্ত্বেও স্বল্পসংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু স্থানীয় সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হায়দার চৌধুরী নসা মিয়া (মুসলিম লীগের নেতা, কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের সহায়তাকারী) গণহত্যা ও অগ্নিসংযােগ ইত্যাদি এড়ানাের জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরােধ না করার পরামর্শ দেন। তিনি পাকিস্তানিদের কাছে নিজেকে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা বলে পরিচয় দিয়ে গণহত্যা ঠেকানাের প্রয়াস নেন। পাকিস্তানি বাহিনী তাকে সে সুযােগ  দেয়নি। চৌধুরী নসা মিয়াসহ বাজারের ব্যবসায়ী মিলিয়ে মােট ৪৫জনকে তারা গুলি করে হত্যা করে।
সেনবাগে অপারেশন
জেলা সদর থেকে উত্তর-পশ্চিম ফেনী সীমান্ত ঘেঁষে সেনবাগ থানা অবস্থিত। ১৪ আগস্ট আটবাড়িয়ায় গনি মিয়ার বাড়িতে মুক্তিযােদ্ধারা পরবর্তী। অপারেশনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। মুক্তিযােদ্ধারা উত্তরে কাদরা থানার পূর্বদক্ষিণ সেনবাগ ডাকবাংলাের সন্নিকটে এবং পশ্চিমে অর্জুনতলার বিভিন্ন। বাড়িঘরের আনাচকানাচে যথাসম্ভব অবস্থান নেন। রাত ১টার সময় উভয়। পক্ষের মধ্যে গােলাগুলি শুরু হয়। যখন মুক্তিযােদ্ধারা ফায়ার শুরু করেন, প্রায়। ১০ মিনিট পরই ‘ইয়া আলী’ শব্দ উচ্চারণ করে পাকিস্তানি বাহিনী পাল্টা। আক্রমণ শুরু করে। এ যুদ্ধে ৩জন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। এ আক্রমণ রচনার । অন্যতম কারণ ছিল পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস পালনে মুসলিম লীগকে নিরুৎসাহিত করা এবং সেদিনের আয়ােজিত সব অনুষ্ঠান বানচাল করে দেওয়া। ঐদিন সেনবাগ থানা অপারেশনের পর পাকিস্তানি বাহিনী ও শান্তি বাহিনীর দালালেরা স্থানীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
সােনাপুরের যুদ্ধ
জেলা সদরের সবচেয়ে নিকটবর্তী (দক্ষিণে) থানা সুধারামে সােনাপুর অবস্থিত। মুক্তাঞ্চল নান্দিয়াপাড়া দখলের জন্য পাকিস্তানি বাহিনী গজারিয়ায় পরাজিত হয়ে সম্ভবত ভিন্ন পথে অগ্রসর হবার পরিকল্পনা নেয়। ৮ সেপ্টেম্বর নােরাপুর দিয়ে। শতাধিক পাকিস্তানি সৈন্য রাজাকারসহ প্রবেশের চেষ্টা করে। সিপাহি অলিউল্লাহর নেতৃত্বে ১০জন মুক্তিযােদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ  গড়ে তােলেন।  অলিউল্লাহ ১টি এলএমজি দিয়ে দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধ চালিয়ে যাবার পর একপর্যায়ে। তার সব গুলি শেষ হয়ে যায়। এমতাবস্থায় অলিউল্লাহ তার সহকর্মীর রাইফেল নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে থাকেন। সহকর্মীদের পিছু হটে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে। এ যােদ্ধা এগােতে থাকেন। সহকর্মীরা গুলি সংগ্রহ করে পুনরায় প্রতিরােধযুদ্ধে অংশ নিলেও অলিউল্লাহ এ যুদ্ধে শহিদ হন। উল্লেখ্য যে প্রায় ২৬জন পাকিস্তানি । সৈন্য এ অঞ্চলে অভিযান ও দখলের চেষ্টা চালায়। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর সব। প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
সিলােনিয়ার যুদ্ধ
১০ সেপ্টেম্বর সেনবাগ থানাধীন সিলােনিয়া আক্রমণ করা হয়। এদিন সিলােনিয়া শেল্টারে থাকা অবস্থায় মন্টু মিয়ার কমান্ডের অধীন গ্রুপকে হঠাৎ করেই ভােরবেলায় পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকার বাহিনী আক্রমণ করে। মুক্তিযােদ্ধা শহিদ আব্দুল ওয়াদুদ, খিজির হায়াত, ফারুক ভূঁইয়া, মান্নান ও আব্দুর রহমানের বাড়িতে অবস্থিত শেল্টারে থাকার সময় পাকিস্তানি বাহিনীর আগমনের শব্দ শুনে মুক্তিযােদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করেন। দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। ঐ যুদ্ধে আব্দুর রহিম আহত হন। তাঁকে হেকিম রুহুল আমিন অতি গােপনে ডা. নূরুজ্জামান চৌধুরীর বাড়িতে নিয়ে চিকিৎসা করান। পাকিস্তানি বাহিনী এ অপারেশনে মুক্তিবাহিনীর উল্লেখযােগ্য ক্ষতি করতে না পেরে সাধারণ জনগণকে হত্যা করে। ঐ এলাকার বহু বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলে। এবং জনসাধারণের ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালায়।
বাংলাবাজারের যুদ্ধ
বেগমগঞ্জ থানা সদর থেকে ৬ কিলােমিটার পশ্চিমে লক্ষ্মীপুর সড়কের পার্শ্বস্থ বাংলা বাজার নামক স্থানে হাবিলদার জাবেদ আলীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে। প্রায় ৭ ঘণ্টা যুদ্ধের পর রাজাকাররা রাতের অন্ধকারে অন্যত্র পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে রাজাকার বাহিনীর ২জন নিহত হয়। এবং আনুমানিক ৭জন আহত হয়।
বেগমগঞ্জের অপারেশন
বেগমগঞ্জ থানায় স্থানীয় পাকিস্তান বাজার (বর্তমানে বাংলাবাজার), জয়াগবাজার, সােনাইমুড়ি বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে স্বাধীনতার পক্ষে লােকজনদের সাথে যােগাযােগ রক্ষা এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণে পালিয়ে আসা ইপিআর, আনসার, পুলিশসহ অন্যদের কাছ থেকে পাওয়া হাতিয়ার দিয়ে সুবেদার লুত্যর রহমান পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানাের ব্যবস্থা নেন। ইতােমধ্যে এসব এলাকায় সংগ্রাম কমিটি গড়ে উঠেছিল। সুবেদার লুৎফর কিছুসংখ্যক সৈন্য, ইপিআর, পুলিশ, ছাত্র নিয়ে মাইজদিতে যােগাযােগ করেন। তকালীন জেলা প্রশাসক মুনজুরুল করিমের সাথে সাক্ষাৎ করলে তিনি মাইজদি পিটিআই স্কুলের ট্রেনিং মাঠে এক কুচকাওয়াজের মাধ্যমে সুবেদার লুঙ্কর রহমানের হাতে ১টি ৩০৩ রাইফেল হস্তান্তর করেন পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রযাত্রা রােধ করা এবং নােয়াখালী প্রবেশে বাধাদানসহ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করে সুবেদার লুত্যর রহমানের ওপর। সেই দায়িত্ব পাওয়ার পর সুবেদার লুত্যর রহমান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য জড়াে হওয়া সামরিক বাহিনীর সদস্য, ইপিআর, পুলিশ আনসার, ছাত্র, শ্রমিক, সুবেদার সামছুল হক, সুবেদার অলিউল্লাহ, হাবিলদার শামছুল হক, সুবেদার ফখরুল, হাবিলদার বেলায়েতসহ আরও কয়েকজন সামরিক বাহিনীর সদস্যের কমান্ডের অধীনে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। তিনি নােয়াখালী এলাকাকে যুদ্ধের সুবিধার্থে চার ভাগে ভাগ করে।
সুবেদার লুৎফর রহমান চৌমুহনীতে গিয়ে এম এন এ নূরুল হককে সাথে । নিয়ে ফেনী যান। সেদিনই এম এন এ খাজা আহমেদের সাথে দেখা করে এবং তাদের নিয়ে বেলােনিয়া ডাকবাংলােয় যান। তিনি পাকিস্তানিদের প্রতিরােধ। করার জন্য অস্ত্র, গােলাবারুদ, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক, ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন নিয়ে নােয়াখালী ফিরে আসেন। কয়েকজনকে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের নােয়াখালী আসার পথ লাকসামের খিলা রেলওয়ে ব্রিজ উড়িয়ে দেন। নােয়াখালী আসার পথে পাকিস্তানি বাহিনীকে আর বাধা না দিয়ে সর্বক্ষেত্রে পাকিস্তানি সৈন্য এবং তাদের এ দেশের দোসরদের গেরিলা পদ্ধতিতে আঘাত করতে থাকেন এবং ক্রমান্বয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্রের মজুদ বাড়াতে থাকেন। লাকসামের বাঘমারায় মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে মুখােমুখি যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও তারা আরও দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে লাকসামে শক্তিশালী। ঘাটি করার প্রস্তুতি নেন।
সুবেদার লুত্যর রহমান তার বাহিনীকে নাথের পেটুয়ার সন্নিকটে কয়েক ভাগে ভাগ করে নােয়াখালী আগমণে বাধাদানের জন্য লাকসাম সােনাইমুড়ি রাস্তার নাথের পেটুয়ার উত্তরে বিনয়ঘর নামক গ্রামের পাশ দিয়ে নিজের পজিশন নেন। বিভিন্ন সময়ে খণ্ড খণ্ড অপারেশনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি। বাহিনীকে নাজেহাল করার চেষ্টা করা হয়। বেগমগঞ্জের মুক্তাঞ্চল নান্দিয়াপাড়াকে মুক্ত রাখাসহ সুবেদার লুত্যর রহমান প্রায় ৫৪টি যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। নান্দিয়াপাড় দখলের জন্য পাকিস্তানি। বাহিনী ২০ বার চেষ্টা চালালেও তার সতর্ক তৎপরতা ও প্রতিরােধের মুখে তাদের সব চেষ্টা নস্যাৎ হয়ে যায়। এ সাহসী যােদ্ধা বার্ধক্যজনিত কারণে স্বাধীনতা লাভের কিছুদিন পর মৃত্যুবরণ করেন।
ওদারহাটের যুদ্ধ
সুধারাম থানায় ওদারহাটের অবস্থান। ৩০ অক্টোবর শনিবার রমজান মাসের ৯ তারিখ দুপুর ১২টায় ওদারহাটে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে মতিন ও হাবিলদার খালেকের ট্রপসসহ প্রায় ৪০জন মুক্তিযােদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। দীর্ঘ ৪ ঘণ্টা স্থায়ী এ যুদ্ধে উভয় পক্ষের কয়েক হাজার রাউন্ড গুলিবিনিময় হয়। বিকেল ৪টায় মুক্তিযােদ্ধাদের একটি দল কৌশলে ক্যাম্পের বিল্ডিংয়ের দেওয়ালের কাছে পৌছে চিল্কার করে গ্রেনেড নিক্ষেপের কথা বললে ২৬জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। যুদ্ধের এ অবস্থায় ক্যাম্পের চতুর্দিকের প্রায় ৫-৬ হাজার জনতা জড়াে হয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তােলে। বন্দি ২৬জন রাজাকারকে আব্দুল্লাহ মিয়ার বাড়ির সামনে এনে তিন রাস্তার মােড়ে গুলি করে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়। এ খবর মাইজদিতে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে পৌছলে পরদিন সকালে প্রায় ১০টি গাড়ি নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বহর সেখানে পৌছায়। পাকিস্তানি বাহিনীর ১জন মেজর (সম্ভবত) গাড়ি থেকে নেমে রাজাকারদের লাশ দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে কোনাে অপারেশন না চালিয়ে দ্রুত মাইজদিতে ফিরে যায়।
বামনি অপারেশন
কোম্পানীগঞ্জ থানায় বামনির অবস্থান। ২০ নভেম্বর রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের জন্য মুজিব বাহিনীর অধিনায়ক মাহমুদুর রহমান বেলায়েতসহ যুদ্ধের তারিখ ঠিক করা হয়। এ যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে মাে. আবু তাহের মির্জার ওপর। রাত ১১টার সময় কোম্পানীগঞ্জ থানার ১২ নং পার্বতী ইউনিয়নের দিঘিরপাড়ে ঘাটলাই কাচারিবাড়িতে অহিদুর রহমান অদুদকে যুদ্ধের ব্রিফিং দিয়ে রাত ১২টায় পাঠানাে হয়। বামনি যুদ্ধের সময় শত্রুবাহিনীর গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অহিদুর রহমান অদুদ শহিদ হন। যুদ্ধের বিস্তারিত জানা সম্ভব হয় নি।
দালালবাজারের যুদ্ধ
লক্ষ্মীপুর সদর থেকে আনুমানিক ৮ কিলােমিটার উত্তর-পশ্চিমে দালালবাজার ইউনিয়ন। এ বাজারের ভেতরই দালালবাজার স্কুল। স্কুলটিতে রাজাকাররা ক্যাম্প স্থাপন করে। ২৬ মে মুক্তিযােদ্ধারা দালালবাজার স্কুলের রাজাকার ক্যাম্প। রেইড করেন। রাজাকারদের ১টি দল দালালবাজার স্কুলে অবস্থান করছে, এ তথ্য জানার পর মুক্তিযােদ্ধারা ওই ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী যােদ্ধারা ক্যাম্পটি উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক থেকে ঘিরে ফেলেন। আনুমানিক বিকেল ৪টায় মুক্তিযােদ্ধারা নিজ অবস্থান থেকে শত্রুর ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করেন। উভয় পক্ষে প্রচণ্ড গুলিবিনিময় হয়। গােলাগুলির একপর্যায়ে রাজাকাররা তাদের অবস্থান থেকে অস্ত্র ফেলে। পশ্চাদপসরণ করে নিকটবর্তী বাগবাড়ি ক্যাম্পে জড়াে হয়। এ যুদ্ধে বেশ কিছু রাজাকার হতাহত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা ৬টি রাইফেল উদ্ধার করেন।
চণ্ডীপুরের অ্যামবুশ
রামগঞ্জ সদর থেকে রামগঞ্জ-লক্ষ্মীপুর সড়ক ধরে আনুমানিক ১৫ কিলােমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে গেলে শ্রীপুর হয়ে চণ্ডীপুর। চণ্ডীপুর বাজারের ভেতর চণ্ডীপুর উচ্চবিদ্যালয়ের অবস্থান। রামগঞ্জ থেকে মধুপুর, শিবপুর হয়ে চণ্ডীপুরে যাওয়ার আরেকটি বিকল্প রাস্তা আছে। এ রাস্তাটি দৈর্ঘ্যে ছােট। এ বিকল্প রাস্তা ধরে রামগঞ্জ থেকে আনুমানিক ৭ কিলােমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে গেলেই চণ্ডীপুর।  পাকিস্তানিরা সম্ভবত নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টির প্রতি প্রাধান্য দিতে গিয়ে এ বিকল্প রাস্তাটি অধিকাংশ সময় ব্যবহার করতাে। ৬ জুন মুক্তিযােদ্ধারা জনৈক এন আই চৌধুরীর কাছে থেকে শক্রর চলাচল সম্পর্কিত একটি চিঠি পান। এ চিঠির বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করেই মুক্তিযােদ্ধারা লক্ষ্মীপুর ও চণ্ডীপুরের মাঝে অবস্থিত বিকল্প রাস্তায় চলাচলরত পাকিস্তানি গাড়ির বহরের ওপর অ্যামবুশ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, চিঠির বক্তব্য অনুযায়ী ঐ দিন। রাত ৮টার সময় মুক্তিযােদ্ধাদের রামগঞ্জ সদরে চণ্ডীপুর উচ্চবিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকতে বলা হয়।
পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযােদ্ধারা যথাসময়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। যােদ্ধারা। মীরগঞ্জ রাস্তার ওপর একটা মাইন বিছিয়ে রাখেন। যে জায়গায় মাইন বিছানাে হয়েছিল, তার ৫০ গজ দূরে একটি বাঁশঝাড়ের কাছে উঁচু মাটির আড়ালে ৭জন যােদ্ধা রাইফেল হাতে ওত পেতে বসে থাকেন। ৩জন মুক্তিযােদ্ধাকে হ্যান্ড গ্রেনেড দিয়ে রাস্তার পাশে শত্রুর কনভয়ের ওপর আক্রমণের জন্য অধিনায়ক। নির্দেশ দেন।  ৭ জুন ভােররাত। দূর থেকে গাড়ির শব্দ কানে ভেসে আসে। যােদ্ধারা সতর্ক হয়ে রাইফেলের ট্রিগারে হাত রেখে গাড়ি আসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। শত্রু মুক্তিযােদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণের ভয়ে ১টি গরুর গাড়ি সামনে রেখে অগ্রসর হতে থাকে। গরুর গাড়িটি মাইন পাতা স্থানটিতে আসার সাথে সাথে হঠাৎ প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মাইনটি বিস্ফোরিত হয়ে যায়। গাড়ােয়ান ও গরু ২টির মৃত্যু হয় তৎক্ষণাৎ গরুর গাড়ির পেছনে আসা শত্রুর গাড়ির বহরটিও সাথে সাথে থেমে যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুক্তিযােদ্ধাদের রাইফেল গর্জে ওঠে। আচমকা এ আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিরা কিছুটা হকচকিয়ে যায় এবং নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য রকেট লঞ্চার থেকে রকেট নিক্ষেপ এবং বৃষ্টির মতাে গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। ২জন যােদ্ধা হামাগুড়ি দিয়ে রাস্তার পশ্চিম পাশে। শত্রুর পেছনে অবস্থান নেন এবং শত্রুর ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের দ্বারা দুদিক থেকে আক্রান্ত হয়ে পাকিস্তানি অধিনায়ক চিৎকার করে সব সৈনিককে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলে। যােদ্ধাদের আক্রমণের মুখে কয়েকজন পাকিস্তানি তাদের অবস্থান ছেড়ে প্রাণভয়ে বিভিন্ন দিকে পালাতে আরম্ভ করে তাদের পালাতে দেখে মুক্তিযােদ্ধারাও অ্যামবুশ অবস্থান ছেড়ে দ্রুত পাকিস্তানিদের অনুসরণ করেন। নিরুপায় হয়ে পাকিস্তানিরা তাদের অস্ত্রগুলাে রাস্তার পাশে কচুরিপানায় পরিপূর্ণ এক ডােবায় ফেলে দিয়ে দৌড়াতে থাকে। পরবর্তী সময় মুক্তিযােদ্ধারা পলায়নরত ৬জন পাকিস্তানি । সেনাকে ধরে ফেলেন এবং তাদের হত্যা করেন। এ অভিযানে মুক্তিযােদ্ধারা ১টি ওয়্যারলেস সেট, ৩টি চাইনিজ অটোমেটিক। রাইফেল, ১টি এলএমজি ও ১টি এসএমজি উদ্ধার করেন।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড