পূর্ব সাহেবনগরের যুদ্ধ
পরশুরাম থানার মির্জানগর ইউনিয়নে পূর্ব সাহেবনগর খেয়াঘাট। পাকিস্তানিদের মির্জানগর ইউনিয়নে অবস্থিত সেবারবাজার সীমান্ত ফাঁড়ি দখল করার জন্য। নৌকাযােগে নদী পার হবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। কারণ, এ মির্জা নগরী ইউনিয়নে সিএসসি স্পেশাল ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযােদ্ধা জয়নাল আবেদীন হাজারী কয়েক শ মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। উপর্যুপরি কয়েকবার হামলায় পাকিস্তানিদের প্রায় শতাধিক সেনা নিহত হয়।
পশ্চিম ফাজিলপুরের যুদ্ধ
ফেনী সদর থানার ফেনী সদর ইউনিয়নের পশ্চিম ফাজিলপুর গ্রাম অবস্থিত। রাজাকাররা ফাজিলপুর স্টেশনে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে স্থানীয় জনগণের ওপর অত্যাচার শুরু করে। নভেম্বরে মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে প্রায় ১০-১২জন। রাজাকারকে মেরে ফেলে এবং ৬জনকে জীবিত ধরে। পরবর্তী সময় এ ৬জনকেও মেরে ফেলা হয়। এতে ১০-১২জন রাজাকার নিহত হয়।
নােয়াখালী জেলার প্রাথমিক প্রতিরােধ
নোয়াখালী জেলার বেশিরভাগ সামরিক প্রশিক্ষণ বা ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপিত হয়। চর এলাকায়, মহকুমা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে। সর্বদলীয় কমিটি গঠন করে। তাদের কর্মসূচি ভাগ করে দেওয়া হয়। এসব কর্মসূচির মাঝে ছিল গােয়েন্দা সূত্রে খবর সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য রসদ সংগ্রহ ও সরবরাহ ইত্যাদি। এসব কমিটিকে সহযােগিতা করার জন্য বিভিন্ন পেশার মানুষ সকল প্রকার সহযােগিতা নিয়ে এগিয়ে আসে। নােয়াখালী সদরের শহিদ মিনার মাঠ, কচিকাচার মাঠ, স্কুল ও কলেজগুলাের মাঠ, জজকোর্ট প্রাঙ্গণ ও পিটিআই স্কুল প্রাঙ্গণে প্রথম দিকে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খােলা হয়। পরবর্তী সময় । অবশ্য এসব প্রশিক্ষণ ক্যাম্প সরিয়ে বাইরে বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে স্থাপন করা হয়। ছুটিতে থাকা এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনা ও পুলিশ সদস্যরাই ছিলেন এসব ট্রেনিং ক্যাম্পগুলাের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের খবর জেলা প্রশাসক। মঞ্জুর-উল-করিম এবং পুলিশের কর্মকর্তা এস এ খানের মাধ্যমে নােয়াখালীর মানুষ ঐদিন গভীর রাতেই পেয়ে যায়। ২৬ মার্চ সার্কিট হাউস প্রাঙ্গণে হাজার হাজার প্রতিবাদী মানুষের এক বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে যাবতীয় অস্ত্র মুক্তিযােদ্ধাদের মাঝে বণ্টন করে দেওয়া হয়।
জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশের সক্রিয় সহযােগিতা/সাহায্যে মুক্তিযােদ্ধারা সংগঠিত হয়ে ওঠেন। এ ঘােষণা প্রাপ্তির পর নােয়াখালী টাউন হলের পাবলিক লাইব্রেরিতে স্বাধীনতা যুদ্ধের কন্ট্রোল রুম খােলা হয়। নেতাদের প্রধান কাজ ছিল জেলা ও কেন্দ্রের সঙ্গে সার্বক্ষণিক সমন্বয়। বজায় রাখা এবং বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের খোঁজখবর রাখা, তাদের রসদ সংগ্রহ ও তা যথাস্থানে পৌছে দেওয়া। কানকিরহাট ও সােনাইমুড়িতে যুদ্ধের ব্যাপক প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যায়। উত্তর বেগমগঞ্জের সােনাইমুড়ি ও কানকিরহাটে মুক্তিযােদ্ধাদের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি ছিল। ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত নােয়াখালীতে মুক্তিযােদ্ধারা নির্বিঘ্নে তাদের কর্মতৎপরতা চালিয়ে যেতে সক্ষম হন। ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা শহরে প্রবেশ করে এবং মুক্তাঞ্চল, নান্দিয়াপাড়া, শশীপুর ও মুক্তিযােদ্ধাদের অপারেশনস্থল বগাদিয়ার কাছাকাছি তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। কানকির হাট, সােনাইমুড়ির মুক্তিযােদ্ধারা কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে নিয়মিত যাতায়াতকারী পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতিরােধের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এ সময় বেশ কিছু মুক্তিযোেদ্ধা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান এবং কেউ কেউ উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারত গমন করেন। মূলত প্রাথমিক প্রতিরােধ বেশ দৃঢ় ছিল বলেই মুক্তিযােদ্ধারা শেষ পর্যন্ত নােয়াখালীকে শত্রুমুক্ত করতে সক্ষম হন।
কবিরহাটের যুদ্ধ
কবিরহাট নােয়াখালী জেলার সুধারাম থানার একটি উল্লেখযােগ্য ইউনিয়ন এবং এটি পৌরসভাতেই অবস্থিত। সুধারাম থানা একটি বর্ধিষ্ণু অঞ্চল ছিল। এখানে। রাজাকারদের যথেষ্ট আধিপত্য থাকার কারণে এলাকার লােকজন অত্যাচারিত হতাে। কবিরহাটের যুদ্ধ কখন শুরু হয়, এ সম্পর্কে বেশ কিছু মতামত রয়েছে। কারও মতে কবিরহাটের যুদ্ধ ১৮ অথবা ১৯ নভেম্বর সংঘটিত হয়। আবার কারও মতে এটি ২৫ নভেম্বরে সংগঠিত হয়। তবে এ যুদ্ধ ৪-৫ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। এলাকার রাজাকারদের অবস্থান ছিল কবিরহাট হাইস্কুলে। রাজাকারদের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ পরিচালনা করেন মাে. আবুল কাশেম। মাে. আবুল কাশেম ছিলেন যথেষ্ট তীক্ষ বুদ্ধিসম্পন্ন। তিনি একটি সুষ্ঠু ও নিখুঁত পরিকল্পনা করেন। তিনি জানতেন, রাজাকাররা যথেষ্ট সাহসী। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ আসার সাথে সাথে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাজাকাররা সেই স্থান ত্যাগ করবে অথবা পাকিস্তানিদের খবর দেবে এটা মুক্তিবাহিনী জানতাে। আর সে ক্ষেত্রে মুক্তিযােদ্ধারা যদি হাইস্কুলের চতুর্দিক থেকে আক্রমণ পরিচালনা করেন তবে ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, এ পরিকল্পনায় মুক্তিবাহিনীর ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর পেছন থেকে আক্রমণ মুক্তিবাহিনীর জন্য পরাজয়ের কারণ হতে পারে। আবুল কাশেম পরিকল্পনা করেন, এ রাজাকার ক্যাম্প তিনি রাতের বেলা আক্রমণ করবেন।
তার সহকারী হিসেবে সঙ্গে নিলেন মুক্তিযােদ্ধা এ টি এম রফিক, আবু হােসেন ও নিজাম উদ্দীন ফারুক। মাে. আবুল কাশেমের পরিকল্পনামতাে মুক্তিযােদ্ধারা হাইস্কুলে রাতের বেলা আক্রমণ করেন। হঠাৎ আক্রমণে রাজাকাররা হতচকিত হয়ে পড়ে। এ যুদ্ধ চলতে থাকে ৪-৫ ঘণ্টা। একপর্যায়ে সম্ভবত রাজাকারদের গােলাবারুদ ফুরিয়ে যায়। পরাজয় অনিবার্য দেখে কেউ বা পালিয়ে যায় আবার কেউ যুদ্ধের সময় নিহত হয়। মূলত এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর অপারেশন সফল হয়। এ যুদ্ধে রাজাকার বাহিনীর অধিনায়ক জলিলসহ ৩জন নিহত হয়। এ সময় বেশকিছু রাজাকার পালাতে গিয়ে গ্রেফতার হয় এবং কেউ কেউ আত্মসমর্পণ করে। মােট গ্রেপ্তারের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৫৭জন। মুক্তিযােদ্ধারা। মানবতাবিরােধী কাজ করেননি বলেই এ ৫৭জন রাজাকারকে বিভিন্ন ক্যাম্পে রেখে যুদ্ধ শেষে তাদের নােয়াখালী কারাগারে প্রেরণ করেন। কবিরহাট এলাকার যুদ্ধটি ক্ষণস্থায়ী হলেও মুক্তিবাহিনী এখানে যে সাহসিকতা প্রদর্শন, করে তা ছিল সত্যিই অতুলনীয় ও প্রশংসনীয়। সেদিন যুদ্ধে জয়লাভ করার কারণে হাজার হাজার লােক মুক্তিযােদ্ধাদের সংবর্ধনা জানায়। এরপর থেকেই। কবিরহাট ইউনিয়ন রাজাকারমুক্ত হয়।
সােনাইমুড়ি রেল স্টেশনের যুদ্ধ
নােয়াখালী জেলার একটি অন্যতম রেল স্টেশন হলাে সােনাইমুড়ি। মুক্তিযুদ্ধের সময় নােয়াখালী জেলার যে-সব স্থানে যুদ্ধ হয়েছিল, সেগুলাের মাঝে সােনাইমুড়ি অন্যতম। সােনাইমুড়ি বেগমগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত। যাতায়াত ব্যবস্থার ক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য অবদান রেখেছিল এ সােনাইমুড়ি রেল স্টেশন। সম্ভবত সে কারণে নােয়াখালীকে পাকিস্তানি বাহিনী নিজেদের আয়ত্তে আনার জন্য প্রথমে লক্ষ্যস্থির করে সােনাইমুড়ির ওপর। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের রসদ এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি আনা নেওয়ার জন্য সােনাইমুড়ি রেল স্টেশন ব্যবহার করে চলছিল। এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে পাকিস্তানি বাহিনী কুমিল্লার বিভিন্ন অঞ্চল দখল করার পর ধীরে ধীরে। নােয়াখালীর দিকে অগ্রসর হয়। এ অবস্থায় এ এলাকায় পাকিস্তানিদের যেকোনাে মূল্যে প্রতিরােধ করার জন্য ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম, সুবেদার লুৎফর রহমানের ওপর দায়িত্ব আরােপ করেন। কেননা সােনাইমুড়িতে যদি পাকিস্তানি। বাহিনী তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, তাহলে একমাত্র মাধ্যম হিসেবে রেল স্টেশনকে বেছে নেয়ার সম্ভাবনা বেশি।
চন্দ্রগঞ্জের যুদ্ধের পর সুবেদার লুত্যর রহমান নােয়াখালীর বিভিন্ন অঞ্চলের মুক্তিযােদ্ধাদের সুসংগঠিত করেন। পাকিস্তানি সৈন্যের গতিবিধি সম্পর্কে গুপ্তচরেরা নিত্যনতুন সংবাদ নিয়ে আসছিল। আর সেই সূত্র অনুসরণ করে মুক্তিবাহিনী যেখানে সুযােগ পাচ্ছে, সেখানেই তাদের ওপর আঘাত করে। চলেছে। এপ্রিলের শেষে খবর এল যে একদল সৈন্য কুমিল্লার লাকসাম থেকে ট্রেনে। নােয়াখালীর সােনাইমুড়ি স্টেশনে পৌছবে। সুবেদার লুৎফর রহমান এ খবর পাওয়ার সাথে সাথেই তার সহকর্মীদের সঙ্গে আলােচনা ও পরিকল্পনা করতে বসেন। স্থির হলাে ওদের বিনা বাধায় এগােতে দেওয়া হবে না। সােনাইমুড়ি স্টেশনে এ হামলাকারীদের ওপর হামলা করতে হবে। হয়তাে সে জন্য মুক্তিবাহিনীকে বেশ কিছুটা মূল্য দিতে হতে পারে। তবে এবার আর আগের মতাে আড়াল থেকে যুদ্ধ নয়, যুদ্ধ চলবে দিবালােকে, প্রকাশ্যে, মুখােমুখি। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আনুমানিক ৫০জন সশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধাকে সােনাইমুড়িতে একত্রে করা গেলাে। পাকিস্তানি সৈন্যদের সংখ্যা এর চেয়েও অনেক বেশি।
তা হােক, এ শক্তি নিয়েই ওদের সঙ্গে মােকাবিলা করার সিদ্ধান্ত হয়। নির্দিষ্ট সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ট্রেনটি সােনাইমুড়ি স্টেশনে পেীছে। মুক্তিবাহিনী কাছেই কোনাে একটা জায়গায় লুকিয়ে ছিল। ট্রেন আসার সাথে সাথেই রাইফেলধারী মুক্তিযােদ্ধারা বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে এসে ট্রেনটিকে ঘেরাও করে ফেলেন। তারা ট্রেনের আরােহীদের লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকেন। ড্রাইভার ইঞ্জিন থেকে লাফিয়ে প্রাণ নিয়ে পালায়। প্রকাশ্য দিবালােকে এভাবে আক্রান্ত হতে হবে পাকিস্তানি সেনারা সম্ভবত তা কল্পনাও করতে পারেনি। পরমুহূর্তেই তারাও তাদের অস্ত্র নিয়ে কামরা থেকে প্লাটফর্মের ওপর নেমে পড়ে। ওদের মধ্যে কয়েকজন কামরা থেকে নামার আগেই মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিতে প্রাণ হারায়। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে রেল স্টেশনের ওপর এ ধরনের লড়াই আর কোথাও ঘটেছে বলে শােনা যায়নি। এ ব্যাপারে নােয়াখালী সােনাইমুড়ি রেল স্টেশন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রায় ৩ ঘণ্টা এ লড়াই চলে। এ যুদ্ধে প্রায় ৩৫জনের মতাে পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। ইতােমধ্যে খবরটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে ঘণ্টা তিনেক পর আক্রান্ত পাকিস্তানি সৈন্যদের সাহায্য করার জন্য চৌমুহনী থেকে সামরিক ভ্যানে করে একদল পাকিস্তানি সৈন্য ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। এবার পাকিস্তানি সৈন্যদের মােট সংখ্যা দাঁড়ায় আনুমানিক ২৫০জনের ওপরে। হতাহতের সংখ্যা বাদ দিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যা তখন আনুমানিক চল্লিশে এসে দাড়িয়েছে।
এ অবস্থায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না মনে করে মুক্তিযােদ্ধারা যেমন বিদ্যুৎ গতিতে এসে আক্রমণ করেছিলেন, তেমনি আবার ঘটনাস্থল থেকে অদৃশ্য হয়ে যান। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের পেছন পেছন ধাওয়া করে আক্রমণ করতে চেষ্টা করেন কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ঘটনার দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ২৮ এপ্রিল থেকে। সােনাইমুড়ি থেকে আক্রমণ করে এসে সুবেদার লুৎফর রহমান আবির পাড়ায় একটি গােপন বৈঠক ডাকেন। সেদিন তার সাথে নায়েব সুবেদার ওয়ালীউল্লাহ ও আসহাক দেশরক্ষার্থে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হন। সুবেদার লুৎফর রহমান সিপাহি শাহজাহানকে সঙ্গে নিয়ে সােনাইমুড়ি পর্যবেক্ষণ (রেকি) করেন। ২৯ এপ্রিল নায়েক সফি তার সেকশন নিয়ে প্রস্তুত হন। সােনাইমুড়ি আউটার সিগন্যালে পুনরায় অ্যামবুশ সাইটের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর ৩টি গাড়ি আসার পর নায়েক সফি ফায়ার শুরু করেন। ফায়ারে পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রসরমাণ সম্মুখের গাড়িটি অকেজো হয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে শত্রুপক্ষ পাল্টা পজিশন নিয়ে ফায়ার শুরু করে। ২-৩ ঘণ্টা গােলাগুলি বিনিময় হয়। অবশেষে গােলাবারুদ শেষ হয়ে গেলে মুক্তিযােদ্ধারা ফিরে যায়। শত্রুপক্ষের একজন গুরুতর আহত হয়। এখানে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে একজন বৃদ্ধ এবং একটি ছেলে শহিদ হন।
নাথের পেটুয়ার যুদ্ধ
নােয়াখালীর অনেক প্রতিরােধের মাঝে একটি হলাে নাথের পেটুয়ার যুদ্ধ। বিপুলেশ্বরের খুব কাছাকাছিই অবস্থিত এ গ্রাম। এখানে যুদ্ধটি সংঘটিত হয় ১১ এপ্রিল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এ যুদ্ধে মূলত মুক্তিবাহিনীরই জয় হয়। কারণ, পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের চাপে বাধ্য হয়েই নাথের পেটুয়া থেকে অন্যত্র চলে যায়। যুদ্ধটি পরিচালনা করেন সুবেদার লুৎফর রহমান এবং তার সহযােগী হিসেবে সাথে ছিলেন সুবেদার সিরাজ ও সুবেদার জব্বার । ১০ এপ্রিল সারারাত মুক্তিবাহিনী দৌলতগঞ্জ সেতু ধ্বংস করায় ব্যস্ত ছিল। এবং তাদের নেতৃত্ব দেন সুবেদার লুৎফর রহমান। সেতু ধ্বংস করার পর বিপুলের পৌছে লুৎফর রহমান মাইজদী থেকে খবর পান যে লাকসামে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যরা নােয়াখালীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। খবর পাওয়া মাত্রই সুবেদার লুৎফর রহমান যােদ্ধাদের নিয়ে নাথেরপেটুয়ার দিকে অগ্রসর হন। সুবেদার লুত্যর রহমানের নেতৃত্বে ১টি কোম্পানি নাথের পেটুয়ায় গিয়ে স্টেশনের পূর্ব ও পশ্চিম পাশে অবস্থান নেয়। সুবেদার লুৎফর রহমান তাঁর। প্লাটুন নিয়ে রেল স্টেশনের পশ্চিম পাশে অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি তার। প্লাটুনের প্রত্যেককে সেকশনের নিজ নিজ অবস্থান দেখিয়ে দেন এবং প্রতিরক্ষার। জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। প্রতিরক্ষার জন্য যখন খননকার্য চলছিল, তখন হঠাৎ করেই নায়েক সিরাজ সতর্ক সংকেত দ্বারা লুৎফর রহমানকে দেখান। যে পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্রলিং করে মুক্তিযােদ্ধাদের পজিশনের দিকে এগিয়ে আসছে। সুবেদার লুত্যর রহমান দেখলেন, সত্যি সত্যিই শত্রুরা ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে প্রায় এক কোম্পানি এমনভাবে অগ্রসর হচ্ছে, যা অবিশ্বাস্য। লুৎফর রহমান তা দেখামাত্র এসএলআরের সাহায্যে গুলি শুরু করেন।
নায়েক সিরাজও এলএমজির সাহায্যে শক্রর ওপর আক্রমণ করেন। সেদিন ৩ নম্বর প্লাটুনের। সৈন্যরা (স্টেশনের পশ্চিম পাশে) একসাথে আগত শত্রুর প্রত্যেককেই আহত বা নিহত করতে সক্ষম হয়। এ অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনী তাদের পেছনের। কোম্পানি নিয়ে দ্বিগুণ বেগে তাদের সাপাের্টিং বা সাহায্যকারী অস্ত্রের দ্বারা দ্রুত বেগে অগ্রসর হবার চেষ্টা করে কিন্তু এতেও তারা ব্যর্থ হয়। তার কিছুক্ষণ পরই মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর আর্টিলারি ও মর্টারের গােলাবর্ষণ শুরু হয়। পূর্বদিক থেকে যখন শত্রুপক্ষের ওপর এলএমজি ফায়ার শুরু হয়, তখন। শত্রুরাও ২ নম্বর প্লাটুনের ওপর অনবরত শেলিং শুরু করে। এ পরিস্থিতিতে একজন মুক্তিযােদ্ধা তৎক্ষণাৎ শহিদ হন এবং একজন গুরুতরভাবে আহত হন।
সুবেদার লুঙ্কর রহমান সে মুহূর্তে বাধ্য হয়ে তার প্লাটুন নিয়ে ২০০ গজ পেছনে একটি ডােবায় পজিশন নেন। ততক্ষণে শক্রর দুই প্লাটুনের মতাে সৈন্য মুক্তিযােদ্ধাদের প্রথম পজিশনটি দখল করে ফেলে। এর মাঝে দ্বিতীয় প্লাটুনটি প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয় এবং পুনরায় শত্রুর অবস্থান লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। এমন সময় হঠাৎ ৩টি যুদ্ধবিমান মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর পর পর তিনবার আক্রমণ চালায়। যুদ্ধবিমান থেকে প্রচুর পরিমাণে গুলিবর্ষণ করা হয়। অবশ্য তাতে করে মুক্তিবাহিনীর সামনে বা পেছনে কোনাে ক্ষতি হয়নি। এভাবে ভাের থেকে শুরু করে বিকেল ৪টা পর্যন্ত একটানা গােলাগুলি চলতে থাকে। এ অবস্থায় কারও পক্ষে সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার মতাে পরিস্থিতি ছিল না। সুবেদার লুৎফর রহমান পূর্বদিকের মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে সাড়াশব্দ না পেয়ে তার একজন মুক্তিযােদ্ধাকে তাদের খবর আনতে পাঠান। ততক্ষণে পূর্ব দিকের গ্রামগুলােতে আগুন জ্বলতে শুরু করছে। সেই মুক্তিযােদ্ধা ফিরে এসে জানান যে তাদের দুই প্লাটুন স্ব স্ব অবস্থান থেকে সৈন্য তুলে নিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছেন। এ কথা শােনার পর সুবেদার লুৎফর রহমান অলরাউন্ড ডিফেন্স (চতুর্মুখী প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে।
সন্ধ্যার পর পাকিস্তানি বাহিনী রেকি প্যাট্রলিং (অনুসন্ধান) শুরু করে। তারা মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান লক্ষ্য করে প্যাট্রল পাঠায়। এরপর মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে ২ ঘণ্টা যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের যাবতীয় অস্ত্র দিয়ে গােলাগুলি শুরু করে। কিন্তু তাদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। অবশেষে পাকিস্তানি বাহিনী সেখান থেকে অবস্থান পরিবর্তন করে চলে যায়।
তাল মােহাম্মদ হাটের যুদ্ধ
তাল মােহাম্মদ হাট গ্রামটি কোম্পানীগঞ্জ থানার রামপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। ২১ নভেম্বর নােয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ মােহাম্মদের হাটে এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধের মূল পরিকল্পনা করেন জেলা অধিনায়ক মাহমুদুর রহমান বেলায়েত। তাল মােহাম্মদ হাট গােডাউনে প্রায় ৩০-৪০জন মিলিশিয়া ও রাজাকারের একটি ক্যাম্প ছিল। এ ক্যাম্প হতে তারা বিভিন্নভাবে স্বাধীনতাকামী বাঙালি জনগণের ওপর নির্যাতন করতাে। সদর থানা ও কোম্পানীগঞ্জের প্রায় ৩০জনের মুক্তিযোেদ্ধার একটি দল সংগঠিত হয়ে শত্রুর এ ক্যাম্পের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। ২৭ নভেম্বর রাত ৩টা হতে এ যুদ্ধ শুরু হয় এবং পরেরদিন ২৮ নভেম্বর সকাল ১০টা পর্যন্ত চলে। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন অহিদুর রহমান (অদু)। যুদ্ধে আনুমানিক ১০-১২জন মিলিশিয়া ও রাজাকার নিহত হয়। ঐ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের অধিনায়কও শহিদ হন। পরে রাত ২টার দিকে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের লাশ উদ্ধার করে হাটে দাফন করেন। ওই যুদ্ধে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মঈনুদ্দীন জাহাঙ্গীর (সদর থানা) নামক একজন মুক্তিযােদ্ধাকে বীরপ্রতীক পদকে ভূষিত করা হয়।
ফেনার ঘাটার যুদ্ধ
ফেনার ঘাটা বেগমগঞ্জ থানায় অবস্থিত। ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল টেকনিক্যাল থেকে লক্ষ্মীপুরের দিকে রওনা দেয়। পাকিস্তানি বাহিনীর সামনে একটি লাল জিপ ছিল। প্রায় দুই শতাধিক পদাতিক বাহিনী মিলিটারি পুলিশের পেছনে সারিবদ্ধভাবে রওনা হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর রওনা হওয়ার খবর পেয়ে তাদের অবস্থানের উদ্দেশ্যে সুবেদার লুত্যর রহমান গ্রুপ অধিনায়ক। শফিউল্লাহর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযােদ্ধা প্রেরণ করেন। মুক্তিবাহিনীর এ দলটি ফেনা ঘাটার পশ্চিমে জয়নারায়ণপুর সাঁকোর গােড়ায় ওত পেতে থাকে। আনুমানিক বেলা ৩টার সময় পাকিস্তানি বাহিনীর জিপটি সাঁকোর গােড়ায় পৌছলে মুক্তিবাহিনী জিপটির ওপর ব্রাশফায়ার করে। তৎক্ষণাৎ জিপটি অকেজো হয়ে যায়। পদাতিক পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর ওপর এলােপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে। একপর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর গুলির মজুদ শেষ হয়ে যায় এবং পেছনের সরবরাহও বন্ধ হয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর গুলি বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে পাকিস্তানি বাহিনী ত্বরিত গতিতে খাল পার হয়ে ধানক্ষেত ঘিরে ফেলে। পাকিস্তানি বাহিনী ধানক্ষেতে ২জন মুক্তিযােদ্ধাকে ধরে ফেলে এবং সাথে সাথে গুলি করে তাদের হত্যা করে। পাকিস্তানি বাহিনী জয়নারায়ণপুর গ্রামের আবদুল হাই পাটোয়ারী, ডা. সুলতান। আহম্মদ, আনসার আলী, এবাদ উল্লাহ এ ৪জনকে গুলি করে হত্যা করে এবং জয়নারায়ণপুর গ্রামের ১৯টি বাড়ি সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেয়। সিঅ্যান্ডবি পুলের পশ্চিম দিকে আমিনবাজারসহ মিয়াপুরের ৩টি বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। যে-সব মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন, তাদের লাশ স্থানীয় জনসাধারণ জয়নারায়ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে নিয়ে রাখে। রাত ৮টার সময় তাদের দুজনের লাশ নিয়ে যাওয়া হয়।
শহিদ দুজনেরই নাম ছিল মােহাম্মদ ইসমাইল। একজনের বাড়ি বেগমগঞ্জ থানার ১০ নম্বর আমিশাপাড়া ইউনিয়নের কংশনগর গ্রামে। অন্যজন। সম্ভবত কুমিল্লার বাসিন্দা। শহিদ মুক্তিযােদ্ধা ২জনই ছিলেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের। তাদের মিয়ার বাজারের সাথে মিজিবাড়ির কবরস্থানে দাফন করা। হয়। ২৪ এপ্রিল ফেনার ঘাটা অপারেশন শেষে পাকিস্তানি বাহিনী চন্দ্রগঞ্জ পূর্ব বাজার সম্পূর্ণ এবং জগদীশপুর গ্রামের ২টি বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। পাকিস্তানি বাহিনী তেলীবাড়ির ২জন নিরীহ লােককেও গুলি করে হত্যা করে। এঁদের একজনের নাম সুজা মিয়া।
দেওয়ানজী বাজারের যুদ্ধ
দেওয়ানজী বাজার বেগমগঞ্জ থানায় অবস্থিত। ২৬ মে এ জোনের অধিনায়ক সুবেদার লুৎফর রহমানের নির্দেশে সুবেদার অলিউল্লাহ, সুবেদার সামছুল হক ও মমিনুল ইসলাম বাকের সােনাইমুড়ির দক্ষিণে ও দেওয়ানজীর হাট রেলওয়ে পুলের দক্ষিণে মুক্তিবাহিনী নিয়ে ওত পেতে বসে থাকেন। কুমিল্লা থেকে আগত একটি পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়ির বহর সামনে পৌছলে গাড়িকে লক্ষ্য করে তারা গুলিবর্ষণ করেন। এ আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর একজন মেজর, একজন ক্যাপ্টেন ও চারজন সিপাহি নিহত হয়। এদের লাশ নিয়ে মুক্তিবাহিনী বেগমগঞ্জ টেকনিক্যালে আসে। সঙ্গে সঙ্গে প্রায় শতাধিক পাকিস্তানি বাহিনী ওই জায়গায় পেীছে নওতােলা, কাড়ার পাড়, সােনাইমুড়ী ও বাট্রগ্রাম আক্রমণ করে ১২৪জন নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে এবং গ্রামগুলাের প্রায় সব বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়।
নদনার যুদ্ধ
নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানায় প্রতিরােধ যুদ্ধের শুরু থেকেই ভয়াবহতা ছিল বেশি। নদনা এলাকা বেগমগঞ্জ, থানায় অবস্থিত। ১৬ জুন পাকিস্তানি বাহিনী প্রায় দুই শতাধিক পদাতিক বাহিনী নিয়ে মুক্তিবাহিনীর কোম্পানি অধিনায়ক লুত্যর রহমানের এলাকা আক্রমণের জন্য নদনা ব্রিজ থেকে পশ্চিম দিকে রওনা হয়। পাকিস্তানি বাহিনী এ এলাকায় পৌছার সাথে সাথে ব্রিজের অল্প পশ্চিমে সুবেদার অলিউল্লাহ, সুবেদার সামছুল হক এবং হাবিলদার মন্তাজ প্রায় শতাধিক। মুক্তিবাহিনী নিয়ে তাদের ওপর আক্রমণ চালান। লুৎফর রহমান নিজেই এ যুদ্ধ পরিচালনা করেন। পাকিস্তানি বাহিনী বহু চেষ্টা করেও সামনে এগােতে পারেনি। তাদের প্রায় ৭-৮জন সৈন্য নিহত হয়। ব্রাশফায়ারে একজন অফিসারের দাঁতের মাড়ি উড়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। পাকিস্তানি বাহিনীর মূল উদ্দেশ্য ছিল লুত্যর রহমানের বাহিনী শেষ করা। কিন্তু তাদের সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। এ যুদ্ধ দীর্ঘ ৬ ঘণ্টা স্থায়ী হয়।
রাজগঞ্জের যুদ্ধ
রাজগঞ্জ বেগমগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত। ২১ সেপ্টেম্বর মুক্তিযােদ্ধাদের ৬টি দল পাকিস্তানি বাহিনীকে মােকাবিলা করার জন্য রাজগঞ্জ বাজারের চতুর্দিকে অবস্থান গ্রহণ করে। রাজগঞ্জ বাজার থেকে মাইজদীতে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর কন্ট্রোলরুমে বারবার টেলিফোন করে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রস্তুতি সম্পর্কে অবহিত করা হয় এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য আহ্বান জানানাে হয়। . ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী একই অবস্থানে ছিল। কিন্তু ঐ দিনই মুক্তিবাহিনীর ৫টি দলকে প্রত্যাহার করে অন্যান্য জায়গায় অপারেশনের জন্য পাঠানাে হয়। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের গােয়েন্দা মারফত মুক্তিযােদ্ধাদের ৫টি দলের প্রত্যাহারের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সম্ভবত রাজগঞ্জ বাজার আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। রাত সাড়ে ৩টায় রাজগঞ্জ বাজারের ওপর। আক্রমণ চালায়। মুক্তিযােদ্ধাদের কেবল ১টি দল অধিনায়ক হাশেমের নেতৃত্বে রাজগঞ্জ বাজারে আসার চেষ্টা করলেও সম্মুখযুদ্ধের ভয়াবহতার কারণে তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় যুদ্ধের একপর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর গােলাবারুদ শেষ হয়ে যায় এবং অধিনায়ক হাশেম নীরবতার সঙ্গে প্রায় ৩০ মিনিট অবস্থানে টিকে থাকেন। পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের এ নীরবতার কারণ বুঝতে পেরে মুক্তিবাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং অধিনায়ক হাশেমকে গুলি করে হত্যা করে।
মুক্তিযােদ্ধা সবুজ ও রবি পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। মুক্তিযােদ্ধা সবুজের পিতা মৃত সিদ্দিক উল্লাহ এবং তাঁর বাড়ি ছিল লক্ষ্মীপুর থানার মান্দারী গ্রামে। রবির বাড়ি ছিল লক্ষ্মীপুর জেলার ভবানীগঞ্জ গ্রামে এবং তাঁর পিতার নাম ছিল হরিমােহন সাহা। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর যে দল বাবুপুর হয়ে রাজগঞ্জ হয়ে আক্রমণ করেছিল, তাদের হাতে মুক্তিযােদ্ধা গােলাম হায়দার ও শফিকুর রহমান ধরা পড়েন। গােলাম হায়দারকে সাথে সাথে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং শফিকুর রহমানকে মাইজদী ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। পাকিস্তানি বাহিনী একই এলাকা থেকে আরও ৬জন লােককে বন্দি করে মাইজদী ক্যাম্পে নিয়ে আসে। সবুজ, রবি, শফিকুর রহমানের সাথে এ ৬জনকেও মাইজদী জেনারেল হাসপাতালের উত্তর-পূর্ব কোণের বিল্ডিংয়ের কাছে গুলি করে হত্যা করে গণ কবর দেওয়া হয়।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড