বিরলী ব্রিজের যুদ্ধ
বিরলী ব্রিজ ফেনীর দাগনভূঞা থানার রাজাপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। বিরলী ব্রিজ যেহেতু ভারী যানবাহনসহ সব ধরনের যানবাহন চলাচলের উপযােগী ছিল, কাজেই যােগাযােগ রক্ষার জন্য এর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্রিজের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের রসদসহ অন্য সবধরনের প্রশাসনিক সুবিধাগুলাে উপভােগ করত। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর জন্য এ ব্রিজের গুরুত্ব ছিল যথেষ্ট। কেননা শত্রুর রসদ সরবরাহে আঘাত করার মাধ্যমে মনােবল ধ্বংস করার জন্য অন্যতম। উপায় ছিল এ ব্রিজ ধ্বংস করা। এ ব্রিজ ধ্বংস করতে পারলে পাকিস্তানি বাহিনীর সদসহ সবধরনের সরবরাহের ওপর সরাসরি আঘাত হানা সম্ভব। হতাে। বিরলী ব্রিজ ধ্বংসের জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। ভারতের উত্তর প্রদেশের অন্তর্গত দেরাদুন জেলার দেরাদুন সেনাছাউনিতে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে দীর্ঘ ৪৫ দিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। প্রশিক্ষণ শেষে মাে. আব্দুল মােতালেব নামক একজন সাহসী মুক্তিযােদ্ধার তত্ত্বাবধানে এ যুদ্ধ পরিচালনার পরিকল্পনা করা হয়। এ যুদ্ধ। পরিচালনার জন্য মুক্তিবাহিনীর প্রস্তুতিতে সবচেয়ে সহায়ক বস্তু হিসেবে কাজ করেছে ভূমিজ্ঞান ও মনােবল।
উচু মনােবলের কারণে তারা স্বল্প প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামাদির মাধ্যমে নিজেদের এ অপারেশনের জন্য প্রস্তুত করতে পেরেছে। অপর পক্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে এ ব্রিজের গুরুত্ব অপরিসীম হওয়ায় তারাও তাদের পর্যবেক্ষক টহল ও চৌকির মাধ্যমে এ ব্রিজ দেখাশােনা করত। ১৩ নভেম্বর পরিকল্পনা করা হয়, শত্রুর অগােচরে এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে ব্রিজটি ধ্বংস করা হবে। আনুমানিক রাত ১০টার দিকে শত্রু যখন ব্রিজের ওপর তাদের দৃষ্টিপাত কিছুটা শিথিল করে তখনই মুক্তিবাহিনী তাদের অপারেশন পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি নেয়। পরিকল্পনা ছিল এক্সপ্লোসিভ দিয়ে ব্রিজটি ধ্বংস করা। কাজেই রাত ১০টার দিকে মুক্তিবাহিনী ব্রিজের পিলার ও স্লাবের ওপর বস্তা দিয়ে এক্সপ্লোসিভ লাগায়। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানি বাহিনী সামান্যতমও মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি জানতে সক্ষম হয়নি। মুক্তিবাহিনী এ আকস্মিকতা অর্জনের ফলে ব্রিজটি ধ্বংস করে। তবে ব্রিজটি এমনভাবে ধ্বংস হয়, যাতে মানুষ পায়ে হেঁটে ব্রিজটি পার হতে পারে।
এর পাশাপাশি শুধু ব্রিজ ধ্বংস করেই মুক্তিবাহিনী ক্ষান্ত হয়নি, বরং ব্রিজের পাশেই রাজাপুর ইউনিয়ন পরিষদের রাজাকার ক্যাম্পের ওপর আক্রমণ করে। ব্রিজ ধ্বংসের কারণে পাকিস্তানি বাহিনী গাড়িতে করে রাজাকার ক্যাম্পে আসতে সক্ষম হয়নি। ফলে ওই রাজাকার ক্যাম্পে আকস্মিক আক্রমণের কারণে। রাজাকার বাহিনী কোনাে প্রকার প্রতিরােধ ছাড়াই গােলাবারুদ, অস্ত্র ও সরঞ্জামাদিসহ সব ফেলে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে প্রায় ২০-২৫জন রাজাকার আহত হয়। সরঞ্জামাদির মধ্যে মুক্তিবাহিনী ১০টি রাইফেল পায়। এ অপারেশন সফলতার কারণেই ওই এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী এবং রাজাকার ক্যাম্প সংগঠিত হয়নি। সম্পূর্ণ অপারেশনে নেতৃত্ব দেন জয়নাল আবেদীন। এ মুক্তিযােদ্ধাদের তত্ত্বালীন নাম ছিল (বিএলএফ) বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা মুজিব বাহিনী।
বেলােনিয়ার চূড়ান্ত যুদ্ধ
৮৩ মাউন্টিং ব্রিগেড কুমিল্লা এলাকায় চূড়ান্ত আক্রমণে অংশগ্রহণের জন্য বেলােনিয়া থেকে চৌদ্দগ্রামে গমন করে। অপরদিকে সদর দপ্তর কিলাে ফোর্স দ্বিতীয় পর্যায়ে আক্রমণে অংশ নেওয়ার জন্য বেলােনিয়ায় চলে আসে। এ কিলাে ফোর্স ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩১ জাট রেজিমেন্ট ও ৩২ মাহার রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত হয়।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ২১-২২ নভেম্বর রাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২ ব্যাটালিয়ন সৈন্য ট্যাংকের সাহায্য নিয়ে সীমান্তের উভয় দিক থেকে বন্দুয়াদৌলতপুর-পাঠাননগরে প্রবেশ করে এবং বেলােনিয়ার দক্ষিণপ্রান্ত বন্ধ করে দেয়। অবরুদ্ধ করার প্রাথমিক পর্যায়ে গােপনীয়তা বজায় রাখা সম্ভব হয়নি বলে পাকিস্তানি বাহিনী মিত্রবাহিনীর পরিকল্পনা জেনে যায়। ফলে পাকিস্তানি বাহিনীকে আটকানাের পূর্বেই তারা তাড়াতাড়ি করে বেলােনিয়া উপদ্বীপে তাদের সব অবস্থান পরিত্যাগ করে ফেনীতে চলে আসে। | ২২ নভেম্বর সূর্যোদয়ের মধ্যে মিত্রবাহিনী অবরােধ স্থাপন করে। কিন্তু তার পূর্বেই পাকিস্তানি বাহিনী বেলােনিয়ার উত্তরাংশ থেকে পালিয়ে যায়। ভারতীয় ট্যাংক ও পদাতিক বাহিনী উত্তর দিকে ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পূর্বের প্রতিরক্ষা অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। সেখানে তারা কোনাে শত্রু খুঁজে পায়নি। পাকিস্তানি বাহিনী পালিয়ে যাওয়ার সময় প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র ও গােলাবারুদ ফেলে যায়। এরপর মিত্রবাহিনী বেলােনিয়ার দক্ষিণ প্রান্ত বরাবর একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তােলার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে, যাতে পাকিস্তানি বাহিনী পরবর্তী সময় ফেনী থেকে কোনাে প্রকার পাল্টা আক্রমণ করতে না পারে। এ অবস্থায় ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান ত্যাগ করে পাঠাননগরে নুতন অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। | শালদা নদী থেকে আগত ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে কিলাে ফোর্সের অধীনে ন্যস্ত করা হয় এবং নতুন প্রতিরক্ষা অবস্থানে এসে এর শক্তি বৃদ্ধি করার। দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এভাবে মুক্তিবাহিনীর ২টি ব্যাটালিয়ন এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২টি পদাতিক ব্যাটালিয়ন বেলােনিয়ার মুখ বন্ধ করে বন্দুয়াদৌলতপুর-পাঠাননগর বরাবর একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা লাইন গড়ে তােলে। প্রতিরক্ষা লাইনের সর্ব পশ্চিমে বন্দুয়া-দৌলতপুর এলাকায় ৩১ জাট রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল। গন্দারবাপুর-পাঠাননগর এলাকায় ছিল ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, দক্ষিণ সাতারায় ছিল ৩২ মাহার এবং সবচেয়ে পূর্ব প্রান্তে। ছিল ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। | ফেনীতে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনী এ প্রতিরক্ষা লাইন বরাবর আর আক্রমণ করার চেষ্টা করেনি। মিত্রবাহিনী তাদের প্রতিরক্ষা লাইন থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে এবং ফেনী-ছাগলনাইয়া রােডে চলাচলরত পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ির ওপর হয়রানিমূলক ফায়ার করতে থাকে। ৩ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়মিত যুদ্ধ ঘােষিত হলে কিলাে ফোর্স ফেনীর ওপর চূড়ান্ত আক্রমণ পরিচালনা করে ৪ ডিসেম্বর ফেনী দখল করে নেয়।
সােনাগাজী হাসপাতাল ও থানা দখলের যুদ্ধ
ফেনী জেলার সােনাগাজী একটি থানা। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর পর পরই পাকিস্তানিরা সােনাগাজী থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে এবং হাসপাতাল ও থানার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। পাকিস্তানি সেনাদের সােনাগাজী হতে উচ্ছেদের পরিকল্পনায় সংঘটিত যুদ্ধগুলাের মধ্যে হাসপাতাল দখলের যুদ্ধ ছিল অন্যতম। | ১৫ অক্টোবর সকালবেলা মৃত এক রাজাকারের লাশ নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকার সদস্যরা হাসপাতাল থেকে ১ কিলােমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে চর খােয়াজ গ্রামের জমিদারবাড়ির দরজায় উপস্থিত হয় এবং ২-৩ রাউন্ড ফাকা গুলি করে। এ স্থানের পূর্ব পাশে ৩০০-৪০০ গজ পূর্বদিকে মুক্তিবাহিনী অবস্থান করছিল। সাথে সাথে মুক্তিবাহিনীও ফায়ার করে পাল্টা জবাব দেয়। ফলে পাকিস্তানিরা বুঝতে পারে মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি। ফলে উভয় পক্ষে যুদ্ধ লেগে যায়। সারাদিন পাকিস্তানিদের সাথে মুক্তিবাহিনী পরস্পর আক্রমণ, ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে। একপর্যায়ে এ যুদ্ধ বিরাট আকার ধারণ করে। এ যুদ্ধে ৩জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। এরমধ্যে একজনের নাম শহিদ মুক্তিযােদ্ধা। অধিনায়ক আফছার আর বাকি ২জনের নাম জানা যায়নি। এ যুদ্ধ পরিচালনা করেন মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক মােশাররফ হােসেন। এ যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। বাকি পাকিস্তানি ও রাজাকার পালিয়ে গেলেও তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রকার অস্ত্র পাওয়া যায়। কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা আহত হন এর মধ্যে মুক্তিযােদ্ধা সামছুল হুদা অন্যতম। আহতদের চিকিৎসা দেন মুক্তিযােদ্ধা ডা. মাে. ওয়ালিউল্লাহ ভূঁইয়া। শহিদদের তাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। অবশেষে এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী সােনাগাজী হাসপাতাল ও থানা দখল করে নেয় পাকিস্তানিদের হাত থেকে এবং এ দখল ১৮ তারিখ পর্যন্ত বজায় থাকে। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর সােনাগাজী থানায় মূল পাকিস্তানি ক্যাম্প দখল করে।
সাতবাড়িয়ার যুদ্ধ
সাতবাড়িয়া সােনাগাজী থানার সাতবাড়িয়া ইউনিয়নে অবস্থিত। এখানে পাকিস্তানি সেনাদের স্থায়ী কোনাে ক্যাম্প ছিল না, তবে এ সাতবাড়িয়া এলাকার ভেতর দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী সবসময় চলাচল করতাে। এ সুযােগে প্রায় সময় মুক্তিবাহিনী তাদের ওপর চড়াও হতাে। এতে তাদের ব্যাপক ক্ষতি না হলেও প্রায় সময় তাদের অস্ত্র ও রসদ লুটপাট হতাে। যুদ্ধের প্রায় শেষের দিকে একদিন খবর পাওয়া গেলাে, পাকিস্তানি বাহিনীর ১জন মেজর তার ৫৫জন। সৈন্য নিয়ে স্থানীয় এক রাজাকার কমান্ডারের বাড়িতে দাওয়াত খেতে আসে। সে খবর পাওয়ার পর মুক্তিবাহিনী পরিকল্পনা করে পাকিস্তানি বাহিনীকে এ গ্রাম থেকে আর ফিরে যেতে দিবে না। তারা সাতবাড়িয়া রাস্তায় মাইন স্থাপন করে। এ মাইন স্থাপনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক নূরুল আফসারের। পাকিস্তানি বাহিনী যখন রাস্তা অতিক্রম করছিল, সে সময় প্রচণ্ড শব্দে মাইনগুলাে ফেটে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে পুরাে পাকিস্তানি বাহিনীর দলটি তুলাের মতাে উড়তে লাগলাে। এ আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর সবাই অর্থাৎ ১জন মেজরসহ ৫৫জন সৈনিক নিহত হয়। এটি ছিল অত্র এলাকায় সংঘটিত সবচেয়ে বড় যুদ্ধ, যেখানে মুক্তিবাহিনী তাদের কোনােরূপ ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই পাকিস্তানি বাহিনীর সর্বোচ্চ পরিমাণ ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম হয়।
নােয়াপুরের যুদ্ধ
নােয়াপুর ফুলগাজী থানার মুন্সীর হাট ইউনিয়নে অবস্থিত। ফেনী দখল করার পর পাকিস্তানি বাহিনী নােয়াপুরেও তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। ওই গ্রামে ইপিআর-এর একটি ক্যাম্প ছিল। এ ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে মুক্তিবাহিনী সেখানে প্রতিরক্ষাব্যুহ গঠন করে। এখান হতে তারা পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর ছােট ছােট গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করতাে। এভাবে মুক্তিবাহিনীর এসব আক্রমণে অতিষ্ঠ হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর ওপর চূড়ান্ত আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। তবে তাদের আক্রমণের তারিখ জানা যায়নি। রাত প্রায় ১০-১১টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীকে ঘিরে ফেলে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল গভীর রাতে তারা মুক্তিবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু মুক্তিবাহিনী তাদের ঘিরে ফেলার পর পরই টের পেয়ে যায়। রাত সাড়ে ১২টার দিকে মুক্তিযােদ্ধারা ফায়ার শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনী এ আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। প্রায় ৩ ঘণ্টা দুই পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গােলাগুলি হয় এবং ঘটনাস্থলে ৩জন পাকিস্তানি নিহত হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধা সাহাবউদ্দিন শহিদ হন। এরপর মুক্তিবাহিনী যখন বুঝতে পারলাে, পাকিস্তানি বাহিনী পুরােপুরি প্রস্তুত হয়ে তাদের আক্রমণ করতে এসেছে, তখন ভারী পিস্তলের সংকেতের আলােয় মুক্তিযােদ্ধারা তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান ত্যাগ করে ভারতের গামতলী ক্যাম্পে চলে যান।
বেলােনিয়া চেকপােস্ট যুদ্ধ
পশুরাম থানার শুভপুর ইউনিয়নে বেলানিয়া গ্রাম অবস্থিত। বিভিন্ন সীমান্ত ফঁাড়িতে কর্মরত পাকিস্তানিরা মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরােধ করার জন্য বেলােনিয়ার চেকপােস্টে একত্র হয়। ৪ এপ্রিল দু’পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যায়। প্রায় দুঘণ্টা স্থায়ী এ সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানিরা পরাজিত হয় এবং অস্ত্র ও গােলাবারুদ ফেলে পালায়। অধিকাংশ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। পক্ষান্তরে মুক্তিবাহিনীর দুজন শহিদ হন।
হাজীপুর জামে মসজিদের সামনের যুদ্ধ
সােনাগাজী থানার নবাবপুর ইউনিয়নে নবাবপুর গ্রাম অবস্থিত। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযােদ্ধারা মতিগঞ্জে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যায়। এ যুদ্ধে ৩জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। আব্দুল মুন্সি বাজারের যুদ্ধ আব্দুল মুন্সি বাজার ফেনী সদর থানায় অবস্থিত। মে মাসের আনুমানিক ২০ তারিখের দিকে একদল রাজাকার বাজারের নিরীহ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাছ মাংস কেড়ে নেয়ার খবর শুনে মুক্তিবাহিনী তাদের আক্রমণ করে এবং অধিকাংশ রাজাকার মেরে ফেলে। সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও অধিকাংশ রাজাকার নিহত হয়।
ইটলীর যুদ্ধ
ইটলী ছাগলনাইয়া থানায় গােপাল ইউনিয়নে দুর্গাপুর সিংহনগর গ্রামে অবস্থিত। ২৯ মে এ স্থানে আনুমানিক দুপুর ২টার সময় মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানিদের মধ্যে যুদ্ধ বাধে। যুদ্ধে ৩জন পাকিস্তানি নিহত এবং বেশকিছু আহত হয়। এ | ছাড়া মুক্তিবাহিনীর ২জন আহত হন। মুন্সিরহাটের যুদ্ধ ফেনী জেলার ফুলগাজী থানার দরবারপুর ইউনিয়নে মুন্সিরহাট অবস্থিত। পাকিস্তানি বাহিনী যখন মুন্সিরহাটের মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর প্রবল আক্রমণ চালানাের জন্য বন্দুয়া সেতু অতিক্রম করতে থাকে, সেসময় মুক্তিবাহিনীর অগ্রবর্তী দলের গুলিতে প্রায় ৪০-৫০জন পাকিস্তানি সেনা গুলি। খেয়ে সেতু থেকে পানিতে পড়ে যায়। এরফলে ১০ জুন তারা পিছু হটতে বাধ্য। হয়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ৪০-৫০জন নিহত হয়।
রাজাকারের ক্যাম্প আক্রমণ
ফেনী সদরের ৯ নম্বর লেমুয়া ইউনিয়নে লেমুয়া বাজার অবস্থিত। ১৭ জুন মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক মাহবুবুল আলম মফিজের নেতৃত্বে ৬০জন মুক্তিযােদ্ধা রাত ২টার সময় লেমুয়া বাজার কমিউনিটি সেন্টারে স্থাপিত রাজাকারদের ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এতে একজন রাজাকার নিহত এবং পাকিস্তানিদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। কসকা গ্রামের যুদ্ধ ফেনী সদরের ৯ নম্বর লেমুয়া ইউনিয়নে কসকা গ্রাম অবস্থিত। কসকা গ্রামের জমাদারবাড়িতে নূরুল হুদা নামে একজন মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন। তার খোঁজে প্রায় ৫০-৬০জন রাজাকার তার বাড়িতে এসে ব্রাশফায়ার করে। এতে ১জন বৃদ্ধ ও ১জন ছেলে মারা যায় এবং আরও ২জন চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়। বাড়িটিও সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়।
চিথলিয়া-পরশুরাম পাকিস্তানি ঘাঁটি আক্রমণ
পরশুরাম থানায় চিথলিয়া রেল স্টেশন অবস্থিত। অক্টোবর মাসে মুক্তিযােদ্ধারা পরশুরামের লিচুবাগান ও গুথুমা পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প ঘেরাও করেন। এ সময় একটি ট্রলি ফুলগাজীর দিক থেকে রওনা হয়ে চিথলিয়া স্টেশন পার হবার সময় হাবিলদার ইয়ার আহম্মেদ ট্রলির ওপর ২ ইঞ্চি মর্টার ফায়ার করেন এবং নিজেই এলএমজি ব্রাশফায়ার করে ট্রলিটি ধ্বংস করে ১১জন পাকিস্তানিকে মেরে ফেলেন। ট্রলির গােলাবারুদ ও অস্ত্র মুক্তিযােদ্ধারা নিয়ে যান।
দৌলতপুরের যুদ্ধ-২
ফেনী সদরের ৯ নম্বর লেমুয়া ইউনিয়নের লেমুয়াবাজার অবস্থিত। লেমুয়া বাজার কমিউনিটি সেন্টারে পাকিস্তানি ও রাজাকাররা ক্যাম্প স্থাপন করে। ইতােপূর্বে সে ক্যাম্প থেকে তাদেরকে উৎখাত করা হলেও পরবর্তী সময় তারা আবার সেখানে ঘাঁটি স্থাপন করে। তাদের শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক মাহবুবুল আলম মফিজ তার বাহিনী নিয়ে ক্যাম্পের ওপর আক্রমণ চালায়। তিনি প্রতি একজন রাজাকারকে জীবিত ধরার জন্য ২জন করে মুক্তিযােদ্ধা নিয়ােগ করেন। ১৯ অক্টোবর রাজাকাররা আগেই মুক্তিযােদ্ধাদের। গতিবিধি বুঝতে পেরে বাজারের উত্তর পাশে মুদি দোকানের সামনে জড়াে হয়। এবং গুলি চালানাে শুরু করে। এতে ২জন রাজাকার নিহত এবং একজন পাবলিক ইঞ্জিনিয়ার ও একজন সাধারণ মানুষ শহিদ হন।
পরব্রাম থানা আক্রমণ
পরশুরাম থানার পরশুরাম ইউনিয়নের পরশুরাম গ্রাম অবস্থিত। নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি সম্মিলিতভাবে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে বেলােনিয়া ও পরশুরামের পাকিস্তানিদের অবস্থানের ওপর প্রবল আক্রমণ চালায় এবং ৯ নভেম্বর পরশুরাম মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। পাকিস্তানিদের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ সেনা নিহত হয় এবং পরশুরাম মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসে।
মন্দারহাট যুদ্ধ
ফেনী সদরের ৯ নম্বর লেমুয়া ইউনিয়নে রামপুর গ্রাম অবস্থিত। ৫ নভেম্বর পাকিস্তানি রাজাকার নূরুল ইসলামসহ ১০০জন সৈন্য নিয়ে মুক্তিযােদ্ধা। অধিনায়ক মাহবুবুল আলম মফিজের বাড়ি আক্রমণ করে। তারা তাঁর বাড়িসহ । গ্রামের প্রায় ৩০টি বাড়ি ও মজুমদারহাট নামক বাজারটি সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেয় । তারা মফিজ কমান্ডারের পিতাকে ধরে নিয়ে যায় এবং ফেনী পলিটেকনিক্যাল ক্যাম্পে অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে। পাকিস্তানি বাহিনী সাধারণ জনগণের ৩০টি ঘর পুড়িয়ে দেয়।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড