You dont have javascript enabled! Please enable it!
চন্দ্রগঞ্জের যুদ্ধ
জেলার ফেনী সদর থানায় চন্দ্রগঞ্জের অবস্থান। পাকিস্তানি বাহিনী ফেনীর প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলােয় তাদের কালাে থাবা প্রসারিত করে। এমনি একটি এলাকা। হলাে চন্দ্রগঞ্জ। অবাধে লুটপাট করা যাবে, এ আশা নিয়ে জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে তারা চন্দ্রগঞ্জে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের আগমনের খবর মুক্তিবাহিনী আগেই পেয়ে যায়। সুবেদার লুৎফর রহমান ৬জনের একটি ছােট দল নিয়ে তাদের বাধা। দেওয়ার জন্য অগ্রসর হন। তাঁর লক্ষ্য ছিল, যতটা সম্ভব পাকিস্তানি বাহিনীর। ক্ষতি করা। কেননা মুক্তিবাহিনী বুঝতে পেরেছিল, হানাদার বাহিনী চন্দ্রগঞ্জে আস্তানা করতে পারলে পুরাে গ্রাম তারা শেষ করে দেবে। সুবেদার লুত্যর রহমান ও তার দল প্রতিজ্ঞা করে, তাদের শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত তারা শত্রুকে তাদের গ্রামে আসতে দেবে না। মুক্তিবাহিনীর ঘােট এ দলটি রাস্তার পাশে একটি ইটের স্কুপের আড়ালে অবস্থান নেয়। বিকেলের দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর ভ্যানের শব্দ পাওয়া গেল। শব্দটি ক্রমেই নিকটবর্তী হচ্ছিলাে। তাদের কাছাকাছি এসে হঠাৎ করে সেটি থামতে বাধ্য হলাে। কেননা ভ্যানের সামনের সব চাকাই অদৃশ্য কারাে গুলিতে ছিদ্র হয়ে বসে গেছে। তারা বুঝতেও পারেনি, এ গুলি কোথা হতে এলাে।
কিছুক্ষণ নীরবতার পর আবার একঝাক গুলি বেশ কয়েকজন পাকিস্তানির জীবন কেড়ে নিলাে। এ আকস্মিক আক্রমণে পাকিস্তানিদের মাঝে প্রচণ্ড ভীতির সঞ্চার হলাে। তারা সবাই ভ্যান হতে নেমে কোথা হতে গুলি আসছে, তা বের করার চেষ্টা করতে লাগলাে। আবার কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আরও একঝাক গুলি তাদের দিকে ছুটে এলাে। এবারে পুরােপুরি ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল পাকিস্তানি বাহিনী। যে রাজাকারটি তাদের পথপ্রদর্শক ছিল, হঠাৎ করে তার নজর গিয়ে পড়ল ইটের স্কুপের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে সে তাদের অধিনায়ককে জানালাে, সে নিশ্চিত এ গুলিগুলাে আসছে ইটের স্কুপের পেছন থেকে। পাকিস্তানি বাহিনীও এতক্ষণে সংবিত ফিরে পেল তারা ৩টি দলে ভাগ হয়ে ধীরে ধীরে তিন দিক থেকে ইটের স্তুপ ঘেরাও করার জন্য অগ্রসর হতে লাগলাে। এদিকে মুক্তিবাহিনী বুঝতে পারলাে, শত্রু তাদের অবস্থান বুঝতে পেরেছে। এখন এখানে থাকা মানে নিজের জীবন বিসর্জন দেওয়া তারা তাদের লক্ষ্যের।
চেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছে। সুতরাং এখন তারা এখান হতে সরে গিয়ে। পরবতী আক্রমণের পরিকল্পনা করতে পারে। তাই সুবেদার লুৎফর রহমান তার ছােট্ট এ গেরিলা দল নিয়ে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় তাদের অবস্থানে ফিরে এলেন। পাকিস্তানি বাহিনী ইটের স্থূপ ঘেরাও করে দেখে সেখানে কিছু গুলির খােসা ছাড়া অন্য কিছু তাদের জন্য অপেক্ষা করছে না। এ ছােট গেরিলা দলটি ২৩জন পাকিস্তানি হতাহত করে। এত বড় ধরনের ক্ষতিসাধনের পর পাকিস্তান বাহিনী আর সাহস করেনি সামনে অগ্রসর হতে। এর কয়েকদিন পর তারা পুনরায় দ্বিগুণ শক্তিতে আবার সেই গ্রামের দিকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এ সময় সুবেদার লুত্যর রহমান অন্য একটি অপারেশনে ছিলেন। তাই গ্রামবাসী আতঙ্কিত হয়ে পড়লাে, এবার মনে হয় তাদের আর নিস্তার নেই। এ সময় এক অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ সৈনিক, যার নাম জানা যায়নি, তার রাইফেলটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন শত্রুর মােকাবিলায়। বাবাকে যেতে দেখে তার পুত্রও সঙ্গী হলেন। দুজনে মিলে আবার সেই ইটের স্কুপের পেছনে অবস্থান নিলেন।
পাকিস্তানি বাহিনী গাড়িতে করে সামনে আসামাত্রই একঝাক গুলি তাদের ৩জনের প্রাণ কেড়ে নিল। এবার সহজেই তারা বুঝতে পারলাে, গুলি কোথা হতে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে তাদের সবার অস্ত্র হতে গুলি ছুটে গেল ইটের স্থূপ। লক্ষ্য করে। এরপর অনেকক্ষণ অপর প্রান্ত হতে কোনাে উত্তর এলাে না। এরপর ধীরে ধীরে ইটের স্কুপের কাছে গিয়ে তারা দেখে, সেখানে এক বৃদ্ধের লাশ পড়ে আছে। তাঁর সঙ্গীরা সবাই উধাও হয়েছেন। তারা বুঝতে পারলাে, তাদের জন্য এমনি অনেক বিপদ সামনে হয়তাে অপেক্ষা করছে। তাই তারা আর অগ্রসর না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। এভাবে এক বৃদ্ধ তাঁর নিজের জীবনের বিনিময়ে রক্ষা করলেন পুরাে চন্দ্রগঞ্জ গ্রাম।
চাঁদগাজী দিঘিরপাড়ের যুদ্ধ
চাঁদগাজী গ্রামটি ছাগলনাইয়া থানার শুভপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। ৬ জুন সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর ২টি কোম্পানি মুক্তিবাহিনীর অবস্থান চাদগাজীতে আক্রমণ করে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী সেদিন পিছু হটতে বাধ্য হয়। ১৬ জুন তারা আবার চাঁদগাজী আক্রমণ করে। এ দিনও দুই পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয় এবং পাকিস্তানি বাহিনী আবারাে পিছু হটতে বাধ্য হয়। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে এ স্থানটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই এটি দখল করা তাদের জন্য ছিল অপরিহার্য। সে জন্য ১৭ জুন ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী আবারাে আক্রমণ করে এবং ১৮ জুন ভাের ৫টা পর্যন্ত যুদ্ধ করে আবারাে পিছু হটে যায়। ১৯ জুন তারা আবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে চাদগাজী আক্রমণ করে। এ সময় তারা তাদের রিয়ার সদর দপ্তর থেকে ব্যাপক আর্টিলারি মটার এবং স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। ১৯ জুন ভাের ৪টা পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীকে আটকে রাখতে সক্ষম হয় কিন্তু এরপর তারা ব্যর্থ হয় তাদের অবস্থান ধরে রাখতে। ফলে চাঁদগাজী পাকিস্তানি বাহিনীর। দখলে চলে যায়।
তবে পাকিস্তানি বাহিনীকে এ অবস্থান দখল করার জন্য চরম মূল্য দিতে হয়। তাদের প্রায় ১৫০জন সৈন্য এ যুদ্ধে প্রাণ হারায়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি খুব কম হয়। মুক্তিবাহিনী অস্ত্রের স্বল্পতা সত্ত্বেও পাকিস্তানি বাহিনীর ভারী অস্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বেশ কয়েকবার তাদের যেভাবে পরাজিত করে, তা ছিল এক অসাধারণ। ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা এবং ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান তাদের নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর এ হামলা মােকাবিলা করেন।
পরশুরাম বাজারের গণহত্যা
পরশুরাম বাজার ফেনী জেলার অন্তর্গত পরশুরাম থানায় পরশুরাম ইউনিয়নে। অবস্থিত। জুলাই মাসের দিকে পাকিস্তানি বাহিনী মেজর ইফতেখারের নেতৃত্বে এলাকার রাজাকার-আলবদরের সহযােগিতায় পরশুরাম হাইস্কুলে তাদের। বন্দিশিবির স্থাপন করে। এ বন্দিশিবিরে ১৩ জুলাই উত্তর গােথুমা চৌধুরীবাড়ির মুক্তিযােদ্ধা মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর (মিহির) পিতা মাে. আমিনুল ইসলাম চৌধুরী ও তাদের বর্গাচাষি শুকুরকে ধরে এনে আটকে রাখে এবং পরবর্তী সময় নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। একইভাবে ১২ আগস্ট মুক্তিযােদ্ধা মেজর মীর হােসেন ও এসপি শফিকুল হােসেন চৌধুরীর ভাই রফিকুল হােসেন চৌধুরী ও সিরাজুল হােসেন চৌধুরীকে বাজার থেকে ধরে এনে বন্দিশিবিরে আটকে রাখে এবং পরবর্তী সময় একইভাবে হত্যা করে। এ ছাড়া এ বন্দিশিবিরে পূর্ব অনন্তপুরের পণ্ডিত অধন, সামছু মিয়া ও নাম না জানা অনেক দিনমজুরকে হত্যা করা হয়।
পরশুরাম থানা আক্রমণের যুদ্ধ (প্রথমবার)
১৯ জুলাই পরশুরামে বিভিন্ন সীমান্ত ফাঁড়ির ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের বাঙালি সৈনিকেরা বিদ্রোহ করে এবং অবাঙালি সৈন্যদের সরিয়ে দেন। এরপর তারা ফেনীতে সংঘবদ্ধ হয়ে একটি ফাইটিং কোম্পানি গঠন করে। এরই মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী চট্টগ্রামে মেজর জিয়াউর রহমানের সৈন্যবাহিনীকে দমন করতে রওনা হয় এবং একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে একটি কমান্ডাে প্লাটুনকে রণকৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ পরশুরামের ছাগলনাইয়া থানার শুভপুর ব্রিজ পাহারায় রেখে যায়। এ ছাগলনাইয়া সংকীর্ণ ভূখণ্ডের মাধ্যমে চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের। মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত করেছে। ফেনীতে সংঘটিত ওই ইপিআর কোম্পানি ১৯। জুলাই শুভপুর ব্রিজে আক্রমণ করে এবং ক্যাপ্টেন এনামুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে। আনসার, মুজাহিদ, অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক, বেসামরিক সেচ্ছাসেবক এবং ছুটিতে থাকা সৈনিকদের নিয়ে একটি যৌথ বাহিনী গড়ে তােলা হয়। জুলাইয়ের ৩য় সপ্তাহ পর্যন্ত এ দুই বাহিনীর সম্মিলিত শক্তি ফেনীকে শত্রুমুক্ত রাখে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা বিভিন্ন ভবনের ওপর শােভাবর্ধন করতে থাকে। এরপর
পাকিস্তান বাহিনী তাদের প্রধান সাপ্লাই পথকে হস্তক্ষেপমুক্ত এবং কুমিল্লাচট্টগ্রামের মধ্যে যােগাযােগ রক্ষার্থে জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে ফেনী দখল করে। জুলাইয়ের শেষ থেকেই পরশুরামের দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম অত্যন্ত সফলতার সাথে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র বাহিনী দিয়েও শত্রুকে প্রতিহত করেন। পরশুরাম প্রথম যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধারা যথেষ্ট সফলতা অর্জন করে। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় দেড় শতাধিক সৈন্য মৃত্যুবরণ করে। ১৯ জুলাইয়ের পরবর্তী সময়ে পশ্চাদপসরণকালে মুক্তিযােদ্ধাদের অল্প কিছুসংখ্যক সৈন্য হতাহত হয় এবং উল্লেখযােগ্য পরিমাণে গােলাবারুদ প্রতিরক্ষা অবস্থানে এবং আশপাশের পুকুর ডােবায় ফেলে আসতে বাধ্য হয়।
নবাবপুরের যুদ্ধ
ফেনী বাংলাদেশের দক্ষিণের একটি অন্যতম জেলা। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এটি বৃহত্তর নােয়াখালী জেলার মধ্যে ছিল। এর উত্তরে ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা এবং পশ্চিমে লক্ষ্মীপুর। সােনাগাজী ফেনী জেলার অন্তর্গত একটি ইউনিয়ন। মুক্তিবাহিনী ২৮ জুলাই রাতে একটি গেরিলা অপারেশনে যাবার পূর্বে বিশ্রাম নিচ্ছিল সােনাগাজী ইউনিয়ন পরিষদে। হঠাৎ করে গােপন সূত্রে খবর পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর মেজর গুল মােহাম্মদ তার ৯০জন সৈন্য এবং প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে বিশ্রামরত মুক্তিবাহিনীর ওপর। তাদের এ অতর্কিত হামলায় ১জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন এবং কয়েকজন আহত হন। অতি মুক্তিবাহিনী নিজেদের গুছিয়ে নেয় এবং আক্রমণের জবাব না দিয়ে গুপ্ত পথ দিয়ে বের হয়ে উল্টো পাকিস্তানি বাহিনীকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে। এদিকে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে সাড়াশব্দ না পেয়ে ধীরে ধীরে ইউনিয়ন পরিষদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাে। হঠাৎ মুক্তিযােদ্ধারা একযােগে চারপাশ হতে তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পুরােপুরি বিভ্রান্ত। হয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। তারা তাদের অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ছুটে পালাতে শুরু করে। উপায়ান্তর না দেখে তাদের দলনেতাও একসময় পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। যুদ্ধে একজন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। পক্ষান্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর কমপক্ষে ১০-১২জন মারা যায় এবং আহত হয় আরও বেশি।
দরবেশহাটের অপারেশন
দরবেশহাট ফেনী জেলার দাগনভূঞা উপজেলার রাজারপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী প্রায় প্রতিদিন নােয়াখালী জেলার সেনবাগ থানা থেকে দরবেশহাট ও কোরেশমুন্সি এলাকায় এসে গ্রাম ও হাটবাজার লুটপাট করতাে। এ কাজে তাদের সহযােগিতা করত স্থানীয় রাজাকাররা। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মুক্তিবাহিনী তাদের আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে। সম্ভবত আগস্ট মাসের দিকে মুক্তিযােদ্ধা কাজী নূরনবীর নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা দরবেশহাট রাস্তায় অ্যামবুশ করেন। দুপুর ১২টার দিকে ৫জন পাকিস্তানি সেনা ও ৩জন রাজাকার যখন দরবেশহাট কোরেশমুন্সি এলাকায় আসছিল, তখন মুক্তিযোেদ্ধাদের পাতানাে অ্যামবুশ এলাকা অতিক্রমের সাথে সাথেই মুক্তিবাহিনী তাদের ওপর ব্রাশফায়ার আরম্ভ করে। এতে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের সবাই ঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণ করে।
ভাদাদিয়া মাদ্রাসা দখলের যুদ্ধ
ফেনী জেলার সােনাগাজী থানার একটি ইউনিয়ন হলাে মতিগঞ্জ। এ মতিগঞ্জেই অবস্থিত ভাদাদিয়া মাদ্রাসা। মতিগঞ্জ গ্রামের সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ভাদাদিয়া মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি ছিল অত্র গ্রামের শিক্ষালাভের অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান। সেখানকার রাজাকারদের অধিনায়ক মৌলানা আবদুল মান্নানের নির্দেশে এ ভাদাদিয়া মাদ্রাসায় রাজাকাররা ক্যাম্প স্থাপন করে। রাজাকারদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী ১ প্লাটুন সৈন্য। ভাদাদিয়া মাদ্রাসায় প্রেরণ করে। তারা এসে গ্রামের মানুষের ওপর অবর্ণনীয়। নির্যাতন শুরু করে। ১৩ আগস্ট গভীর রাতে গ্রামবাসীসহ মুক্তিবাহিনী ভাদাদিয়া মাদ্রাসা ঘিরে ফেলে এবং একযােগে আক্রমণ চালায়। রাজাকাররা এ আক্রমণে প্রথমে হতবিহ্বল হয়ে পড়লেও তারা পাল্টা আক্রমণ চালায়। কিন্তু গ্রামবাসীরা তাদের গ্রাম হতে রাজাকারদের উত্থাত করে জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেছিল তাই।
শত্রুরা বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। বেশ কিছু পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার আহত ও নিহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়।  পরবর্তী সময় রাজাকাররা এ মাদ্রাসা পুনরায় দখলের চেষ্টা চালায় কিন্তু সে চেষ্টা গ্রামবাসী ব্যর্থ করে দেয়। যুদ্ধে ১০জন রাজাকার নিহত হয় এবং বহুসংখ্যক আহত হয়। পক্ষান্তরে রাজাকার অধিনায়ক আবদুল মান্নান যখন পালিয়ে যাচ্ছিল, তখন তাকে ধরতে গিয়ে তার গুলিতে শহিদ হন মুক্তিযােদ্ধা বেলায়েত। এ ছাড়া হাবিলদার মফিজুল গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন।
বাদামতলীর যুদ্ধ
বাদামতলী এলাকাটি ফেনী শহর হতে দক্ষিণে সােনাগাজী থানায় অবস্থিত। আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। গভীর রাতে মুন্সি ডাকবাংলাে থেকে মােহাম্মদপুর বাজার দিয়ে আনুমানিক রাত ১২টার দিকে পূর্ব দিক থেকে বেড়িবাঁধের ওপর এসে পাকিস্তানি বাহিনী গাড়ি থামিয়ে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ঘিরে ফেলে। মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ পরিকল্পনা বেশ কিছু সময় আগেই অবগত হন। তাই মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পের চারদিকে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। এরপর ক্যাম্প হতে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশ্যে ফাঁকা গুলি ছুড়ে। তখন পাকিস্তানি সেনারা তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে ক্যাম্প হতে ভারী অস্ত্র দ্বারা ফায়ার শুরু করে। এমতাবস্থায় পাকিস্তানি সেনাদের ফায়ারের মুখে টিকতে না পারায় মুক্তিযােদ্ধারা পেছনে সরে যেতে বাধ্য হন। পেছনে গিয়েও মুক্তিবাহিনী দমে যায়নি। তাদের অক্লান্ত চেষ্টার মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছে। প্রায় সারাদিনরাত এ যুদ্ধ পরিচালনা করে পাকিস্তানি সেনারা কিন্তু এলাকার দখল অর্জন করতে পারেনি। এ যুদ্ধে অনেক পাকিস্তানি সেনা আহত হয় এবং বেশ কয়েকজন নিহত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের ভেতরে মুক্তিযােদ্ধা রুহুল আমিন শহিদ হন। ঐ ক্যাম্প প্রহরীর ২জনকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে যায়। ঐ সময় পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযােদ্ধাদের না পেয়ে ২৮জন সাধারণ গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। পরবর্তী সময় মুক্তিযােদ্ধারা দল ভারী করে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ রচনা করে এবং তাদের বাদামতলী এলাকা ছাড়তে বাধ্য করে।
ফেনী-চৌদ্দগ্রামের যুদ্ধ
ফেনী-চৌদ্দগ্রাম সড়কটি মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ছিল। কারণ, এ সড়ক দিয়েই ঢাকা-চট্টগ্রাম যােগাযােগ স্থাপিত হতাে। ২৯ আগস্ট খবর পাওয়া যায়, মুক্তিযােদ্ধাদের দলে সম্পৃক্ত থাকার কারণে গ্রেপ্তার করা হয় গায়ক আলতাফ মাহমুদ, রেডিও’র হাফিজ উদ্দিন এবং আরও কয়েকজন গেরিলাকে। এ খবর পাওয়ার পর ফেনী-চৌদ্দগ্রাম এলাকায় মুক্তিযােদ্ধারা প্রতিশােধ নেবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। একটি গেরিলা দল ফেনী-চৌদ্দগ্রাম ব্রিজে মাইন স্থাপন করে। রাত ৮টার দিকে ১টি জিপে করে ১জন অফিসারসহ ৫জন পাকিস্তানি সেনা ফেনীর দিকে আসে। তারা ব্রিজের ওপর ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মাইনটি বিস্ফোরিত হয়। ফলে অফিসারটিসহ ৩জন পাকিস্তানি সেনা তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করে এবং বাকি ২জন গুরুতর আহত হয় ও ব্রিজটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। ঐদিনই সন্ধ্যায় ৩জন গেরিলাকে হ্যান্ড গ্রেনেডসহ চৌদ্দগ্রামে পাঠানাে হয়। চৌদ্দগ্রাম থানার পাশেই পাকিস্তানি বাহিনীর একটি পরিখা ছিল। গেরিলা দলটি শক্রর একেবারে নিকটবর্তী হয়ে গ্রেনেড ছুড়ে পরিখাটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে। ফলে ৩জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অন্যদিকে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানির ১টি প্লাটুন ২টি। ৩ ইঞ্চি মর্টারসহ সন্ধ্যায় পাকিস্তানি নিয়মিত বাহিনী চৌদ্দগ্রাম থানার পাশে অবস্থান নেয়, রাত একটু গভীর হলে মর্টারের সাহায্যে অতর্কিতভাবে থানার ওপর আক্রমণ চালায়। মটারের গােলার আঘাতে এবং মেশিনগানের গুলিতে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক সৈন্য হতাহত হয়।  একই দিন রাতে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানির আরেকটি প্লাটুন চৌদ্দগ্রামের আধা মাইল উত্তরে চৌদ্দগ্রাম-মিয়াবাজার রাস্তার ওপর অ্যামবুশ পাতে। পাকিস্তানি বাহিনীর ২৭জনের একটি দল রাস্তা ধরে যাওয়ার সময় এ অ্যামবুশ দলের মুখােমুখি হয়। হঠাৎ আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী প্রথমে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও পরক্ষণে তারা পাল্টা আক্রমণ চালায়। ফলে মুক্তিবাহিনী তৎক্ষণাৎ সে স্থান পরিত্যাগ করে তাদের অবস্থানে ফিরে যায়। এ আক্রমণে ৩জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। পক্ষান্তরে মুক্তিবাহিনীর কোনােরূপ ক্ষতিসাধন হয়নি।
মতিগঞ্জ সিও (উন্নয়ন) অফিস দখলের যুদ্ধ
সােনাগাজী ফেনী জেলার একটি থানা। আর এ সােনাগাজী থানার একটি ইউনিয়ন হলাে মতিগঞ্জ। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হবার পর পরই পাকিস্তানি বাহিনী ফেনী দখল করে স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় সাবেক সিও (উন্নয়ন) অফিসে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে মতিগঞ্জে, গ্রামবাসীরা মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় রাজাকারদের ক্যাম্প উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা করে। এ ক্ষেত্রে তাদের নেতৃত্ব দেন অধিনায়ক গােলাম রসুল, অধিনায়ক কাইয়ুম ও অধিনায়ক শাহজাহান। তাদের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালায়। তাদের আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী প্রথমে সরে গেলেও কিছুক্ষণ পর তারাও পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। এভাবে সারারাত চলে এ যুদ্ধ। দু’পক্ষেই নিহত ও আহত হতে থাকে। সকালের দিকে পাকিস্তানি বাহিনী বুঝতে পারে, তারা এ যুদ্ধে পেরে উঠবে না। কারণ, মুক্তিবাহিনী ক্রমেই সংগঠিত হচ্ছিলাে এবং আরও গ্রামবাসী তাদের সাথে যােগদান করছিল। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীও ছিল মরিয়া, কারণ তারা জানত, মতিগঞ্জ ও সােনাগাজী এলাকায় যতগুলাে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, সবই পরিচালিত হয়েছে এখান থেকে। এ ছাড়া ফেনী থেকে এখানে এনে রাখা হতাে খাদ্য, গোলাবারুদ, অস্ত্রশস্ত্র । যার কারণে এসব সংবাদ পেয়ে মুক্তিবাহিনী এ পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্প আক্রমণ করে। আর এ সময় ক্যাম্পে পাকিস্তানিদের সাথে অনেক রাজাকারও ছিল। পাকিস্তানিদের সাথে বেশকিছু রাজাকার মারা যেতে থাকে এবং অবশেষে মুক্তিযােদ্ধাদের চাপে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা পালিয়ে যায়। পালানাের সময় তারা প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র, ২টি মােটর সাইকেল, ৩টি রেডিও এবং ৩ বক্স ওষুধ ফেলে যায়। এ যুদ্ধে ১জন অফিসারসহ ১১জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং ২০জন আহত হয়। অপরপক্ষে মুক্তিবাহিনীরও ২জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। তাঁরা হলেন মুক্তিযােদ্ধা নূর ইসলাম ও মুক্তিযােদ্ধা নূর করিম।
কল্যাণদীর অপারেশন
কল্যাণদী ছিল নােয়াখালী জেলার সেনবাগ থানার দক্ষিণে ফেনী-লক্ষ্মীপুর সড়কের সংযােগস্থলে। এটি ছিল সমগ্র সেনবাগ ও সােনাইমুড়ির বৃহত্তর জনগােষ্ঠীর চলাচলের অন্যতম সংযােগস্থান। এখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী স্থানীয় রাজাকার আলবদরের সহযােগিতায় প্রায় ১৫০-২০০ জনের একটি সুরক্ষিত ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ক্যাম্প হতে নির্যাতন, হত্যা, লুণ্ঠনের মাধ্যমে তারা চারদিকে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছিল। রমজান মাসের শেষের দিকে মুক্তিযােদ্ধারা খবর পান, এলাকার যে-সব সাধারণ মানুষ ঈদ উপলক্ষে নিজ বাসস্থানে ফিরে আসছিল রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনী বাসস্ট্যান্ড হতেই তাদের সবকিছু লুট করছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা করে এবং তারিখ ঠিক করা হয় ঈদের আগের রাত। এ আক্রমণকে সফল করার জন্য মুক্তিবাহিনী বিভিন্ন প্রকার পরিকল্পনা নেয়। তারা একটি কাট অফ পার্টিকে হাট এলাকায় প্রেরণ করে, যাতে পূর্বদিক অর্থাৎ ফেনী হতে পাকিস্তানি বাহিনী সহায়তা করতে আসতে না পারে। এ দলের নেতৃত্ব দেন বিএলএফ অধিনায়ক শৈলেন্দ্র কুমার অধিকারী। আরেকটি কাট অফ পার্টিকে জমিদারহাট বাজারের পশ্চিম দিকে প্রেরণ করা হয়। যাতে পশ্চিম অর্থাৎ চৌমুহনীর দিক থেকে কোনাে রি-ইনফোর্সমেন্ট আসতে না পারে। এ জোনের উপ অধিনায়ক আবু তাহের অ্যাকশন পার্টির নেতৃত্ব দেন এবং তিনি এ দলকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেন। যার প্রথম দলের ৪০জনের নেতৃত্ব দেন। হাবিলদার মােহাম্মদ আলী।
এ দলের দায়িত্ব ছিল ক্যাম্পের পশ্চিম দিকে আক্রমণ করা। দ্বিতীয় দলেও আনুমানিক ৪০জন মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন। এ দলের নেতৃত্ব দেন হাবিলদার বেলায়েত হােসেন। তাদের দায়িত্ব ছিল দক্ষিণ দিকে আক্রমণ করা। আবু তাহের মির্জা প্রথম দলের সাথে ছিলেন। মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে অস্ত্র হিসেবে রাইফেল ছাড়াও ছিল এনারগা গ্রেনেড ও ১টি জিএফ রাইফেল। জোন কমান্ডারের অবস্থান ছিল কাবিলপুর গ্রামের দক্ষিণ পাশে খালের ধারে ১টি বাড়িতে। এ ছাড়া ক্যাম্পের পূর্ব দিকে শত্রুকে ব্যস্ত রাখার জন্য একটি হােল্ডিং পার্টি স্থাপন করা হয়। উপরি-উক্ত পার্টিগুলাে ছাড়াও মুক্তিযােদ্ধারা এ অপারেশনের জন্য একটি স্পেশাল টাস্কফোর্স গঠন করেন, যাদের অবস্থান ছিল অ্যাকশন পার্টির সাথে। তাদের কাজ ছিল হােল্ডিং পার্টি যখন কাভারিং ফায়ার দেবে, তখন তারা ক্রলিং করে গিয়ে বাংকারের ভেতর এবং বিল্ডিংয়ের জানালা দিয়ে গ্রেনেড নিক্ষেপ করবেন। এ দুঃসাহসিক কাজে নিয়ােজিত ছিল প্রায় ১৫জন অল্প বয়সী তরুণ। পরিকল্পনা অনুযায়ী রাত প্রায় ৩টার দিকে মুক্তিযােদ্ধার প্রথম অ্যাকশন পার্টি থেকে জিএফ রাইফেল দিয়ে ২টি এনারগা গ্রেনেড ফায়ার করা হয়। পাকিস্তানি বাহিনী হঠাৎ এ ধরনের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে যায়। তাদের এ অবস্থার সুযােগ নিয়ে স্পেশাল টাস্কফোর্স পার্টি বিভিন্ন বাংকারে হ্যান্ড গ্রেনেড ছুড়ে মারে এবং অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসে। মুক্তিবাহিনী তাদের অবস্থান থেকে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের মরণ আর্তনাদ শুনতে পারছিল। এ সময় মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক আবু তাহের মির্জা আদেশ দেন একযােগে আক্রমণ করার।
মুক্তিবাহিনী সবাই তখন অস্ত্র তাক করে ফায়ার করতে করতে ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর অনেকে উপায় না দেখে পালিয়ে যেতে থাকে। পালিয়ে যাবার সময় একজন পাকিস্তানি সেনা এমজি ফায়ার করে। এ ব্রাশফায়ারে হাবিলদার মােহাম্মদ আলী, আবু তাহের এবং জালাল আহম্মেদ গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। প্রায় ১ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর। হাড্ডাহাডিড় যুদ্ধ হয়। অবশেষে পাকিস্তানি বাহিনীর সবাই পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী তাদের ক্যাম্প দখল করে এবং শত্রুর ফেলে যাওয়া অস্ত্র ও গােলাবারুদ সংগ্রহ করার পর পুরাে ক্যাম্পটি জ্বালিয়ে দেয়। ইতােমধ্যে খবর পাওয়া যায়, পশ্চিম দিকে অর্থাৎ চৌমুহনী থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী শক্তি বৃদ্ধি করে জমিদারহাটে মুক্তিযােদ্ধাদের কাট অফ পার্টির সাথে গুলিবিনিময় করছে। তখন মুক্তিযােদ্ধারা আনুমানিক ভাের ৫টার দিকে পশ্চাৎপসরণ করেন, কেননা তারা তাদের মূল উদ্দেশ্য সফল করতে পেরেছে। পশ্চাদপসরণের সময় তারা সাথে করে আহত ও শহিদ মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে আসেন মুক্তিযােদ্ধা আবু তাহের ও জালাল আহম্মেদ মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঘটনাস্থলেই শহিদ হন। অপর আহত মুক্তিযােদ্ধা মােহাম্মদ আলী তখনাে মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। কিন্তু কোথাও তার চিকিৎসার জন্য ডাক্তার খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে তিনিও শহিদ হন।
মনগাজীবাজারের যুদ্ধ
মনগাজীবাজার ফেনীর সােনাগাজী থানার সােনাগাজী ইউনিয়নে অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ বাজারের ভেতরের রাস্তা দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ফেনী সদর হতে অস্ত্র ও রসদ আনা নেওয়া করতাে। এ জন্য মুক্তিবাহিনী প্রায় সময় এসব অস্ত্র ও রসদবাহী দলের ওপর গেরিলা অপারেশন চালাত। যেহেতু মুক্তিবাহিনী এ এলাকায় তেমন সংগঠিত ছিল না, তাই তারা এখানে তেমন কোনাে বড় ধরনের যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারেনি। এ ছাড়া পাকিস্তানি। সেনারাও স্থায়ীভাবে কোথাও থাকতাে না। তাই তাদের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণ চালানাে মুক্তিবাহিনীর জন্য সম্ভব ছিল না, তবে ছােট ছােট অপারেশনের মাধ্যমে তারা সবসময় পাকিস্তানি বাহিনীকে ব্যস্ত রাখতাে। এসব গেরিলা অপারেশনে মুক্তিবাহিনীর কোনাে ক্ষতির সংবাদ পাওয়া যায়নি। তবে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশকিছু হতাহত এবং তাদের অস্ত্র ও রসদ লুটপাটের খবর। পাওয়া যায়।
দৌলতপুরের যুদ্ধ-১
দৌলতপুর গ্রামটি ফেনী সদরের ধলিয়া ইউনিয়নে অবস্থিত। যুদ্ধ শুরু হবার পর পরই পাকিস্তানি বাহিনী ফেনী তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। ফেনী সদর হতে তারা ফেনী নিয়ন্ত্রণ করতাে। তাই দৌলতপুর ফেনী সদরে অবস্থিত হওয়ায় ঘােষবাড়ির মন্দিরে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। এ কাজে তাদের সহযােগিতা করে স্থানীয় রাজাকাররা। তাদের দেওয়া তথ্যানুয়ায়ী গ্রামের নিরীহ মানুষকে এ ক্যাম্পে ধরে এনে নির্মমভাবে অত্যাচার চালাতাে। পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের এ অত্যাচার দিন দিন বেড়েই চলছিল। ২৩ অক্টোবর স্থানীয় মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক মাহবুবুল আলম মফিজ হঠাৎ করে পাকিস্তানি বাহিনীর এ ক্যাম্প আক্রমণ করেন। পাকিস্তানি বাহিনী এ আক্রমণের জন্য কোনােরূপ প্রস্তুত ছিল না। তবু তারা পাল্টা আক্রমণ চালায়। প্রায় ৪ ঘণ্টা যুদ্ধ করে তারা আত্মসমর্পণ করে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ১জন মেজর ও ১জন সিপাহি নিহত হয়। এ ছাড়া পাকিস্তানি বাহিনীর ৪জন। সদস্য জীবিত ধরা পড়ে। তাদের নবাবপুর বাজারে নিয়ে এসে বাজারের পূর্ব পাশে নদীতে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়।
রাজাপুরের যুদ্ধ
রাজাপুর ফেনীর দাগনভূঞা থানার রাজাপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। যুদ্ধ শুরু হবার পর পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তায় রাজাকাররা রাজাপুর চৌধুরীবাড়ি ও রাজাপুর স্কুলের দক্ষিণ পাশে রাজাপুর ইউনিয়ন পরিষদে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। এখান থেকে তারা সুন্দরপুর, বিরলী ও কোরেশ মুন্সি অর্থাৎ ফেনীর পশ্চিম। এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতাে। এসব এলাকা হতে সাধারণ মানুষকে ধরে এনে। অমানুষিক নির্যাতন চালাতাে। রাজাকারদের এ ক্যাম্প উচ্ছেদ করার জন্য এবং বিরলী ব্রিজ ধ্বংস করার জন্য মুক্তিবাহিনীর ২টি দল রমজান মাসের প্রথম রাত। ১২টার দিকে অগ্রসর হয়। ব্রিজ ধ্বংস করার জন্য মুক্তিবাহিনীর হাতে ছিল। বিস্ফোরকদ্রব্য। মুক্তিবাহিনীর হঠাৎ আক্রমণে রাজাকাররা বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে এবং কিছু রাজাকার পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী বিনা রক্তপাতে বিরলী ব্রিজ ধ্বংস করে এবং রাজাকারদের ক্যাম্প হতে উচ্ছেদ করে।
শালধরের যুদ্ধ
ফেনী জেলার অন্তর্গত পরশুরাম থানার ৩ নম্বর ইউনিয়ন হচ্ছে চিথলিয়া। এ ইউনিয়নের ওপর দিয়ে সিলােনিয়া নদী প্রবাহিত হয়ে গেছে। ফেনী পরশুরাম রােডের পশ্চিম পাশে এ ইউনিয়নের অবস্থান। চিথলিয়া ইউনিয়নে শালধর বাজার সীমান্ত ফাঁড়িতে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ঘাঁটি তৈরি করে। এখান থেকে অনেক অপারেশন পরিচালনা করে এবং পরশুরাম এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত।  ১০ নভেম্বর সাব-সেক্টর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম ১০ ইস্ট বেঙ্গল। রেজিমেন্টের ১টি প্লাটুন পাঠান পাকিস্তানি বাহিনীর এ ঘাটি আক্রমণ করার জন্য। পাকিস্তানি বাহিনীর এ ঘাটিটি বেশ মজবুত ছিল এবং তারা এ ঘাঁটি রক্ষা করার সব প্রস্তুতি নিয়েছিল। তাই এ যুদ্ধ মুক্তিবাহিনীর জন্য ছিল একটি বিরাট পরীক্ষা। অনবরত ১ দিন ১ রাত যুদ্ধ চলে। অবশেষে পাকিস্তানি বাহিনী। মুক্তিবাহিনীর দৃঢ় মনােবলের কাছে টিকতে না পেরে পশ্চাদপসরণ করে এবং শালধর বাজার এলাকা পাকিস্তানিমুক্ত হয় ২দিনের জন্য। ২দিন পর পাকিস্তানি বাহিনী পুনরায় সংগঠিত হয়ে বিপুল বেগে আক্রমণ চালিয়ে শালধর বাজার। এলাকা পুনরায় দখল করে নেয় এবং গ্রামবাসীর ওপর নারকীয় অত্যাচার চালায়। পাকিস্তানি বাহিনীর এ যুদ্ধে প্রায় ৫০জন নিহত হয়, পক্ষান্তরে। মুক্তিবাহিনীর ২জন শহিদ হন। তাদের মধ্যে একজনের নাম জানা যায়, তিনি। হলেন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ দাউদ। তবে ২দিন পর পাকিস্তানি বাহিনী পুনরায় এ গ্রাম দখল করে এবং গ্রামের ২২জন সাধারণ মানুষকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে। গুলি করে হত্যা করে।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!