You dont have javascript enabled! Please enable it! সিও অফিস এলাকার যুদ্ধ,শুভপুরের যুদ্ধ-১,ফুলগাজীর যুদ্ধ,বেলােনিয়া-মুন্সিরহাটের যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
সিও অফিস এলাকার যুদ্ধ
ফেনীর প্রাণকেন্দ্র ছিল ফেনী সদরের সিও অফিস এলাকা। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ওই স্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ মার্চ রাতে সাধারণ জনগণের ওপর আক্রমণ চালিয়ে নিরীহ মানুষ হতাহত করে ক্যাপ্টেন ফারুকী সিও অফিসে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। তাদের পরিকল্পনা ছিল প্রাথমিক অবস্থায় তারা এখান থেকে ফেনী নিয়ন্ত্রণ করবে। ২৬ মার্চ স্থানীয় জনগণ এ ঘাঁটি ঘেরাও করে রাখলে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এতে ৪জন শহিদ এবং ১০জন বাঙালি। আহত হন। এতে বাঙালিরা আরও ক্ষিপ্ত হয় এবং তারা আরও একত্র হয়ে এটি ঘিরে রাখে। খবর পেয়ে বাঙালি নায়েব সুবেদার আফতাব উদ্দিন এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে শালধর বাজার বিওপিতে নায়েব সুবেদার বাদশা মিয়া ও তার প্লাটুনের সাথে একত্র হয়ে ফেনীর দিকে অগ্রসর হন। ফেনীতে পৌছে তারা। স্থানীয় ছাত্র, জনতা, আনসার, পুলিশ ও অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যদের নিয়ে এক বিরাট বাহিনী গড়ে তােলেন। এ বাহিনীর নেতৃত্ব দেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আবদুর রউফ। তার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী ২৭ মার্চ দুপুরের দিকে একযােগে সিও অফিস আক্রমণ করে। মুখােমুখি এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। তাদের নেতা ক্যাপ্টেন ফারুকী নিহত হলে তারা আত্মসমর্পণ করে।
শুভপুরের যুদ্ধ-১
শুভপুর সেতু ছাগলনাইয়া থানায় চট্টগ্রাম-ফেনী সড়কের ওপর অবস্থিত। এ ব্রিজটি মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনী উভয়ের জন্যই ছিল গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এ ব্রিজের ওপর দিয়ে ঢাকার সাথে সড়কপথে চট্টগ্রামের সাথে যােগাযােগ করা যেত। এ ব্রিজ এলাকা রক্ষার দায়িত্ব ছিল ইপিআর সুবেদার ফকর উদ্দিনসহ ১০০জন মুক্তিযােদ্ধার ওপর। পাকিস্তানি বাহিনীর ব্রিজ দখল ও অগ্রাভিযান প্রতিহত করার জন্য মুক্তিযােদ্ধারা বিএসএফের সহায়তায় এর একটি অংশ আগেই ধ্বংস করেছিলেন। কিন্তু মে মাসের দিকে এ ব্রিজ এলাকায় যুদ্ধ আসন্ন হয়ে ওঠে। ব্রিজ রক্ষার দায়িত্বে যারা ছিলেন, তাদের অধিকাংশই ছিলেন ১০০ দিনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অসামরিক মুক্তিযােদ্ধা। | ১২ মে কুমিল্লা সেনানিবাস হতে ২ ব্যাটালিয়ন পাকিস্তানি বাহিনী শুভপুর ব্রিজের কাছে আসে। তারা ট্যাংক ও কামানের গােলাবর্ষণ করে ব্রিজ পার হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় এবং মুক্তিবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে তাদের প্রায় ২ কোম্পানির সৈনিক আহত হয়। বেলা ১১টায় প্রথম আক্রমণ ব্যর্থ হলে তারা পিছু হটে যায়। এরপর বেলা ৩টায় প্রচণ্ড গােলাবর্ষণের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনী পুনরায় আক্রমণ চালায়। এ সময় অনেক মুক্তিযােদ্ধা আহত হন। | বিকেল ৫টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী ব্রিজের ৩০০ গজের মধ্যে চলে আসে। তাদের ট্যাংক আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর অনেক অস্ত্র ধ্বংস হলেও মুক্তিযােদ্ধারা অসীম সাহসিকতা দেখিয়ে অগণিত পাকিস্তানি সেনা আহত করে। সন্ধ্যার দিকে আহত মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী পশ্চাদপসরণ করে। সীমান্তের ওপারে চলে যায়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ৩০০জন সৈন্য হতাহত হয়, পক্ষান্তরে মুক্তিবাহিনীর ৫০জনের মতাে আহত হন। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী যে অদম্য সাহস ও মনােবল দেখিয়েছে, তা তাদের পরবর্তী সময় অন্যান্য যুদ্ধে রসদ জুগিয়েছে।
ফুলগাজীর যুদ্ধ
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি অন্যতম জেলা ফেনী। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এটি বৃহত্তর নােয়াখালী জেলার অন্তর্গত ছিল। ফুলগাজী ফেনীর একটি থানা। এটি মুহুরী নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত। এর উত্তরে পরশুরাম থানা, দক্ষিণে ফেনী সদর এবং পূর্ব-পশ্চিম উভয় পাশেই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য অবস্থিত। মুক্তিবাহিনীর মূল দল অবস্থান করছিল বেলােনিয়ার পূর্বে বন্দুয়ায়। পাকিস্তানি বাহিনীর আগমনের খবর পেয়ে একটি অগ্রবর্তী দল বন্দুয়ায় বেলােনিয়া নদীর ব্রিজের উত্তর পাশে অবস্থান গ্রহণ করে। মুক্তিবাহিনীর অগ্রবর্তী দলটি বন্দুয়াতে বেলােনিয়ার ব্রিজের পাশে এমনভাবে পজিশন নিয়েছিল, যাতে করে তাদের অবস্থান কোনােভাবে শক্রর জন্য বােঝার উপায় ছিল না। তাদের ওপর নির্দেশ দেওয়া ছিল, কেউ যেন হঠাৎ করে গুলি না করে। গুলির আদেশ পাওয়ামাত্র সবাই একসাথে গুলি করবে, যতদূর সম্ভব শক্রকে হতাহত করার চেষ্টা করবে এবং সবশেষে ব্রিজটি ধ্বংস করবে। শক্ররা যখন নদীর তীরে এলাে, তখন বিকেল তারা একজন একজন করে ব্রিজে উঠছিল। মুক্তিবাহিনীও অপেক্ষা করছিল, কখন সর্বোচ্চ সংখ্যাক শত্রু ব্রিজে উঠবে শত্রুর প্রথম ব্যক্তি ব্রিজের মাঝ বরাবর আসতেই গুলির আদেশ হলাে একসাথে মুক্তিবাহিনীর সব অস্ত্র গর্জে উঠল। কাটা কলাগাছের মতাে পাকিস্তানি বাহিনী নদীর পানিতে পড়ে যেতে লাগলাে তারা পুরােপুরি অবাক হয়ে যায় এ হঠাৎ আক্রমণে। পাল্টা আক্রমণের কোনাে সুযােগও তারা পায়নি। বাধ্য হয়ে তারা পিছু হটে পিছু হটার সময় তারা গােলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় আর্টিলারি শেল নিক্ষেপ করে। এভাবে প্রায় ২-৩ ঘণ্টা তারা ফায়ার অব্যাহত রাখে। এ ফাকে মুক্তিবাহিনী তাদের অবস্থান ত্যাগ করে মূল বাহিনীর সাথে রাত আনুমানিক ১০টার দিকে যােগদান করে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কমপক্ষে ৩০জন নিহত হয় এবং আরও প্রচুরসংখ্যক আহত হয়। পক্ষান্তরে মুক্তিবাহিনীর কোনােরূপ হতাহতের খবর পাওয়া যায় নি।
মাইধবাড়িয়া ও বন্দুয়া গ্রামের রেললাইন ও ব্রিজ সংলগ্ন যুদ্ধ
মাইধবাড়িয়া ও বন্দুয়া গ্রামটি ফেনী জেলার অন্তর্গত ফুলগাজী থানার আনন্দপুর। ইউনিয়নে অবস্থিত। দুই গ্রামের ঠিক মাঝ দিয়ে রেললাইনটি চলে গেছে। এপ্রিল মাসের শেষ দিকে পাকিস্তানি বাহিনী বেলােনিয়া দখলের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। কিন্তু তারা জানতাে না, তাদের সামনে মৃত্যুর্ফাদ অপেক্ষা করছে। পাকিস্তানি বাহিনীর আগমনের খবর পেয়ে সুবেদার আবুল কালামের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি অ্যামবুশ গ্রুপ রেললাইনের কাছাকাছি রাস্তা ও পুকুরপাড়ে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি বাহিনী বন্দুয়া গ্রাম হতে মাইধবাড়ীয়া গ্রামে যাওয়ার পথে রেল স্টেশনের উভয় দিকে রেললাইন অতিক্রম করার সময় মুক্তিবাহিনী তাদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। এ যুদ্ধ প্রায় ২ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। অবশেষে পাকিস্তানি বাহিনী সেখান হতে পিছু হটতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ৬০জন সৈন্য এ যুদ্ধে নিহত হয়, পক্ষান্তরে মুক্তিবাহিনীর। কোনােরূপ হতাহতের খবর পাওয়া যায় নি।
বাঁশপাড়ার যুদ্ধ
ফেনী সদরের উত্তরে ফুলগাজী থানা অবস্থিত। এ ফুলগাজী থানার একটি গ্রাম হলাে বাঁশপাড়া। জুলাই মাসের দিকে খবর পাওয়া যায়, পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের আস্তানা করতে এ গ্রামে আসছে। এ খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনী গ্রামের। রেজুমিয়া ব্রিজের পূর্ব পাশে কালাপুলের পশ্চিমে মাঠের মধ্যে ট্রাংক রােডের ওপর মাইন পুঁতে রাখে। পাকিস্তানি বাহিনী যখন এ রাস্তা অতিক্রম করছিল, তখন মাইনগুলাে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ফেটে ওঠে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়। তাদের একজন মেজরসহ ৪জন সৈনিক নিহত হয় এবং ১টি মােটরযান বিধ্বস্ত হয়। এ খবর ফেনীতে পাকিস্তানি বাহিনীর সদর দপ্তরে পৌছালে এরপর পাকিস্তানি বাহিনী রেজুমিয়া ব্রিজ হতে বাংলাবাজার পর্যন্ত রাস্তায় যে কয়েকজন নিরীহ মানুষ পেয়েছে, তাদের ধরে নিয়ে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এতে ১জন মুক্তিযােদ্ধাসহ ১৫জন সাধারণ মানুষ শহিদ হন।
শুভপুরের যুদ্ধ-২
মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধের মধ্যে শুভপুর যুদ্ধ অন্যতম। শুভপুর ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার একটি প্রসিদ্ধ ইউনিয়ন, যা বাংলাদেশের সীমান্তে অবস্থিত। শুভপুর ইউনিয়নে অবস্থিত শুভপুর ব্রিজ মুক্তিযুদ্ধে ফেনী এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনার জন্য রণকৌশলগত দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ১৫ বালুচ বেলােনিয়া থেকে ফেনী পর্যন্ত রেললাইন বরাবর অনেক পয়েন্ট স্থাপনে সমর্থ হয়। ১৫ বালুচও ইপিসিএফ ব্যাটালিয়নের ১টি কোম্পানি পরশুরাম-ছাগলনাইয়া থেকে শুভপুর পর্যন্ত প্রতিরক্ষায় অবস্থান নেয়। ২ প্লাটুন শুভপুরের ব্রিজের কাছে শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করে। কিছু রাজাকার ও পুলিশ ব্রিজের পাশে অবস্থান করত এবং বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে পাকিস্তানি বাহিনীকে জানাত। এ প্রতিরক্ষায় ২-১টি ভারী মেশিনগান এবং ১টি আর্টিলারি পজিশন ছিল বলে ধারণা করা হয়। ২৫জন পুলিশ ৩০জন রাজাকারের সমন্বয়ে ছাগলনাইয়া এলাকায় অবস্থান সুদৃঢ় করার চেষ্টা করে এবং রেলপথে বিভিন্ন সেতু ও কালভার্টে নিরাপত্তা চৌকি হিসেবে কাজ করে। পাকিস্তানি বাহিনী যখন ছাগলনাইয়া হতে শুভপুর পর্যন্ত প্রতিরক্ষা নেয় তখন বাংলাদেশে সেনাবাহিনী প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানির আদেশে ফ্লাইং অফিসার কামালের নেতৃত্বে তাদের প্রতিরক্ষাব্যুহ ঘিরে অবস্থান নেন। পাকিস্তানি বাহিনীর ৫০জন নিহত এবং ৭-৮জন আহত হয়। ‘কে’ ফোর্সের ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম ছাগলনাইয়া হতে লক্ষ্মীপুর পর্যন্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। এ প্রতিরক্ষার জন্য শত্রুবাহিনী দেশের উত্তরাঞ্চলে অভিযান চালাতে ব্যর্থ হয়। এ প্রতিরক্ষায় থেকে ভারতীয় দুটো কোম্পানি বেলােনিয়ায় অবস্থান নেয়। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে এ প্রতিরক্ষা শক্তিশালী হয়। গােলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে। গােলা চালানাে হয় পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষায়। তাতে পাকিস্তানি বাহিনীর মনােবল ভেঙে যায় এবং পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ৫০জন হতাহত হয় এবং পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অপর পক্ষে মুক্তিযাদ্ধাদের ৭জন শহিদ হন। এ শুভপুরের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বিজয় হয় এবং ফেনীর ছাগলনাইয়া এলাকা শত্রুমুক্ত হয়।
মন্দারহাটের যুদ্ধ
মন্দারহাট ফেনী জেলার চৌমুহনী থানার দেড় মাইল উত্তরে অবস্থিত। এখানে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের একটি বিরাট ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। ১২ মে সুবেদার লুর রহমান এ ঘাটিতে অ্যামবুশ করার জন্য পরিকল্পনা করেন। তারপর তিনি ১ প্লাটুন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে অ্যামবুশের উদ্দেশ্যে মন্দারহাট রাস্তার পাশে অপেক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু এরই মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী গােপনে তাদের আগমনের খবর পেয়ে যায়। এ খবর পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ১ ব্যাটালিয়ন। সৈন্য নিয়ে মুক্তিবাহিনীকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করলে মুক্তিযােদ্ধারা কোনাে রকমে সেখান থেকে পালিয়ে আসে। পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের না পেয়ে পুরাে মন্দারহাট গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়।
বেলােনিয়া-রাজাপুর ও সুয়াগাজীর যুদ্ধ
ফেনী জেলার দাগনভূঞা থানায় রাজাপুর ও সুয়াগাজী গ্রাম অবস্থিত। এখানে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। ৪ জুন রাত ২টার দিকে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এ কোম্পানির ২টি প্লাটুন মর্টারসহ গােপনে শত্রু এলাকায় প্রবেশ করে শালদা নদীর দক্ষিণে বাগড়াবাজার নামক স্থানে অবস্থান। নেয়। ভােরবেলায় পাকিস্তানিরা যখন তাদের পরিখার ওপর অসতর্কভাবে ঘােরাফেরা করছিল, সে সময় মুক্তিবাহিনী অতর্কিত মর্টার ও মেশিনগানের সাহায্যে তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এ আকস্মিক আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী পুরােপুরি হতচকিত হয়ে যায়। আধ ঘণ্টা পর্যন্ত তাদের পক্ষ হতে কোনােরূপ পাল্টা জবাব আসেনি। এরপর তারা আক্রমণের জবাব দিতে শুরু করে কিন্তু তখন অপরপক্ষ থেকে কোনাে জবাব আসেনি। এ হঠাৎ আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর ১৭জন নিহত এবং ৫জন আহত হয়। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর ১জন মুক্তিযােদ্ধা বুকে গুলি লেগে গুরুতরভাবে আহত হন। এ আক্রমণের ৩ ঘণ্টা পর শত্রু যখন ভেবেছিল, মুক্তিবাহিনী তাদের অবস্থান পরিত্যাগ করেছে তাই তারা তাদের আহতদের পেছনে সরিয়ে নিচ্ছিল। ঠিক সেই সময় মুক্তিবাহিনী আবার আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর আরও ৫জনকে হত্যা করে। এরপর মুক্তিবাহিনী তাদের অবস্থান পরিত্যাগ করে চলে আসে। ঐ একই দিনে সকাল ৭টার দিকে আরেকটি মুক্তিযােদ্ধার গ্রুপ শত্রুদের রাজাপুর অবস্থানের ওপর হঠাৎ আক্রমণ চালিয়ে ৬জন পাকিস্তানি সেনা খতম করে। আরেকটি দল রাত ১টার দিকে কুমিল্লার দক্ষিণে সুয়াগাজীতে চট্টগ্রামঢাকা মহাসড়কে একটি সেতু এবং পরে বাগমারা সেতু উড়িয়ে দেয়।
বেলােনিয়া-মুন্সিরহাটের যুদ্ধ
ফেনী জেলার ফুলগাজী থানায় দরবারপুর ইউনিয়নে মুন্সিরহাট অবস্থিত। মেজর খালেদ মােশাররফ জুন মাসের প্রথম দিকে ক্যাপ্টেন গাফফারকে খবর পাঠান যে ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা হেলিকপ্টারযােগে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান দেখতে আসতে পারেন। সে জন্য খালেদ মােশাররফ কোনাে হেলিকপ্টারে গুলিবর্ষণ না করার নির্দেশ দেন। সময়টা ছিল বর্ষাকাল। সারাদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছিলাে। বেলা ২টার দিকে হেলিকপ্টারের আওয়াজ শােনা গেল। একজন সৈনিক দৌড়ে এসে খবর দেন। যে ২টি হেলিকপ্টার মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের পেছনে উড়ছে যা পশ্চিম দিক অর্থাৎ ভারতীয় দিক হতে আসতে দেখা গেছে। ক্যাপ্টেন গাফফার ভাবলেন, সারাদিন বৃষ্টি হওয়ার কারণে জেনারেল অরােরা হয়তাে আসতে পারেন নি, তাই বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর তিনি এসেছেন। ইতােমধ্যে ১৮০ ডিগ্রি ঘােরে ২টি হেলিকপ্টার দুদিকে উড়ে গেল। হেলিকপ্টার ২টি দুদিকে যাওয়ায় ক্যাপ্টেন গাফফারের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। ১৫ মিনিট পর হেলিকপ্টার ২টিকে আবার ভারতীয় সীমান্তের দিকে উড়ে যেতে দেখা গেল।
এর পর পরই আকস্মিকভাবে পাকিস্তানি সেনাদের মেশিনগানের গােলাবর্ষণ শুরু হয়। ক্যাপ্টেন গাফফার বুঝতে পারলেন যে হেলিকপ্টার ২টিতে জেনারেল অরােরা ছিলেন না, বরং হেলিকপ্টার ২টি দিয়ে পাকিস্তানিরা তাদের অবস্থানের পেছনে অবতরণ করেছে। দ্রুততার সাথে ক্যাপ্টেন গাফফার প্রধান রাস্তা রেললাইন বরাবর অবস্থান নেওয়ার জন্য সুবেদার ফরিদ আহমেদকে নির্দেশ দেন। সুবেদার খােরশেদ আলমকে উত্তর ও পশ্চিম দিকে নজর রাখতে বলা হয় এবং তিনি নিজে পূর্ব-দক্ষিণ দিকে অবস্থান নেন। এ সময় ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম খবর পাঠান যে তিনি এফডিএল দিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন। তখন পাকিস্তানি গােলন্দাজ বাহিনী কামান, মর্টার ও রিকয়েলেস রাইফেলের সাহায্যে বৃষ্টির মতাে গােলাবর্ষণ করছিল। ইতােমধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী দ্বিতীয়বার হেলিকপ্টার দ্বারা তাদের কমান্ডােদের মুক্তিবাহিনীর পেছনে অবতরণ করায়। রাত ৯টার দিকে লেফটেন্যান্ট ইমাম-উজ-জামান জানান, তিনি পাকিস্তান। বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। ক্যাপ্টেন গাফফার তখন একিনপুর থেকে তার অবস্থান সরিয়ে নেন। লেফটেন্যান্ট ইমাম-উজ-জামান ক্যাপটেন গাফফারের কাছে কিছু গােলাবারুদ পাঠানাের অনুরােধ করেন এবং তিনি আরও জানান যে ছাগলনাইয়া থেকে মুহুরী নদী পর্যন্ত যে প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল, তা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং তারা ফুলগাজীর দিকে চলে যাচ্ছেন। প্রায় একই সময় ক্যাপ্টেন গাফফারের বাহিনী পাকিস্তানি কমান্ডাে বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হয়। পাঠান নগর হয়ে অগ্রসর হয়ে পাকিস্তানি সেনারা বাম দিক ও সামনের দিক হতে আক্রমণ। চালায়। ঠিক সেইসময় ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম ক্যাপ্টেন গাফফারকে জানান যে, মেজর খালেদ মােশাররফ যেন মুক্তিবাহিনীকে নিয়ে ফুলগাজীর পেছনে চিথলিয়ায় অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দেন। ঠিক সময়ই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কারণ, পেছনে সরে এসে সময়মতাে চিথলিয়ায় অবস্থান না নিলে যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড