You dont have javascript enabled! Please enable it! চিথলিয়ার যুদ্ধ,শুভপুর-মধুগ্রামের যুদ্ধ,মুন্সিরহাট মুক্তারবাড়ির যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
চিথলিয়ার যুদ্ধ
ভূমিকা
ফেনী জেলার অন্তর্গত পরশুরাম থানার ৩ নম্বর ইউনিয়ন হচ্ছে চিথলিয়া। এ ইউনিয়নের ওপর দিয়ে সিলােনিয়া নদী প্রবাহিত হয়ে গেছে। সীমান্ত পরিবেষ্টিত পরশুরাম থানার ১টি অন্যতম প্রধান ইউনিয়ন হচ্ছে চিথলিয়া। ফেনী-পরশুরাম রােডের পশ্চিম পাশে এ ইউনিয়নের অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধে পরশুরাম থানার ১টি দুর্ভেদ্য অঞ্চল হিসেবে চিথলিয়া পরিচিত ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী পরশুরাম চিলুবাগান ও ঘুটুমা নামক স্থানে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে এবং ওই ক্যাম্পগুলাে থেকে তাদের আঞ্চলিক যুদ্ধগুলাে পরিচালনা করে আসছিল। তাই পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পগুলাে দখল ও সেনাদের পরশুরাম থানা থেকে। উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে অক্টোবর মাসের এক রাতে ক্যাম্প ২টি ঘেরাও করে। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ওই স্থানের সামরিক গুরুত্ব স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা ঘাঁটি ছিল চিথলিয়া, পরশুরাম ও বেলােনিয়া থানার নিকটবর্তী স্থানগুলােয়। এসব ঘাঁটিগুলােয় পাকিস্তানি সেনারা রেলওয়ের ট্রলির সাহায্যে ফেনী থেকে রসদ প্রেরণ করত। পাকিস্তানি সেনাদের এ রসদ সরবরাহ লাইন নষ্ট করতে উল্লিখিত এলাকাটি ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন ছিল নিম্নরূপ: ১. মুক্তিবাহিনী: ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি। ২. পাকিস্তানি বাহিনী ক, ১৫ বালুচ রেজিমেন্ট। খ, পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর ৪টি জঙ্গিবিমান। উভয় বাহিনীর অবস্থান যুদ্ধের সময় উভয় বাহিনীর অবস্থান ছিল নিমরূপ: ১. পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান: পাকিস্তানি বাহিনী মূলত চিথলিয়া, পরশুরাম ও ঘুটুমা থানায় তাদের ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। পরবর্তী। সময় চিথলিয়া নদীর দক্ষিণ পাড়ে তারা পরিখা খনন করে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে।
২. মুক্তিবাহিনীর অবস্থান: মুক্তিবাহিনী মূলত প্রাথমিক পর্যায়ে বর্ডারের ওপর হতে এসে চোরা বা গুপ্ত হামলা পরিচালনা করতাে। তবে চিথলিয়া আক্রমণের প্রাক্কালে চিথলিয়ায় মুক্তিবাহিনী প্রতিরক্ষা। অবস্থান গ্রহণ করে এবং পরবর্তী সময় সে অনুপাতে যুদ্ধ পরিচালনা করে। পাকিস্তানি বাহিনীর পরিকল্পনা। পাকিস্তানি বাহিনীর মূল পরিকল্পনা ছিল, যে-কোনাে উপায়ে বেলােনিয়াসহ ঘুটুমী, পরশুরাম এলাকাটি তাদের দখলে রাখতে। কেননা ভৌগােলিক দিক দিয়ে ঐ স্থানটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম রােড ধরে যােগাযােগ রক্ষা করতে হলে ঐ স্থানের দখল ছিল অত্যাবশ্যক। মুক্তিবাহিনী মূল পরিকল্পনা ছিল পরশুরাম থানা থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত করা এবং পরবর্তী সময় ফেনী জেলা দখল করা থেকে মুক্ত রাখা। এরপর ঢাকা চট্টগ্রাম রােড দখল করে পাকিস্তানি বাহিনীর যােগাযােগ ব্যবস্থা নষ্ট করা। যুদ্ধের প্রস্তুতি ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি পরশুরাম থানা হতে পাকিস্তানি বাহিনীকে বিতাড়িত করার সার্বিক সবরকম প্রস্তুতিই গ্রহণ করে। তারা তাদের পেছনে গােলন্দাজ বাহিনীর ১টি ইউনিটকে সার্বক্ষণিক তৈরি রেখেছিল আকস্মিক সহায়তার জন্য। যুদ্ধের বিবরণ মুক্তিবাহিনী কর্তৃক ঘেরাওকৃত পাকিস্তানি সেনাদের উদ্ধারের লক্ষ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি ট্রলি ঐদিন ভােরে ফুলগাজী হতে রওনা হয়। চিথলিয়া রেল স্টেশন পার হওয়ার সাথে সাথে স্টেশনের উত্তর দিক রেললাইনের পূর্ব দিক ও ডিবি বাের্ডের পশ্চিম দিকের পুকুর হতে মুক্তিবাহিনী তাদের আক্রমণ করে। হাবিলদার এয়ার আহমেদ প্রথম ট্রলি লক্ষ্য করে ২ ইঞ্চি মর্টার ফায়ার করেন এবং সেই সাথে এলএমজির ব্রাশফায়ারের মাধ্যমে ট্রলিটি ধ্বংস করেন ও ১১জন পাকিস্তানিকে হত্যা করেন। পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর ফঁাদের আলামত ধরে ফায়ার করতে করতে চিথলিয়ার দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে এবং গুলিবিনিময়ের একপর্যায়ে হাবিলদার এয়ার আহমেদ শাহাদতবরণ করেন। ৩ দিন পর মুক্তিবাহিনীর ওপর ৪টি জঙ্গিবিমান আক্রমণ করে।
তবে  বেশ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা শাহাদতবরণ করলেও প্রতিরক্ষা অবস্থান হতে মুক্তিযােদ্ধাদের বিতাড়িত করতে পারেনি। কয়েক দিন মুখােমুখি যুদ্ধ চলার পর মুক্তিযােদ্ধারা ৯০জন পাকিস্তানি সেনাকে ধরে ফেলেন। ৫ নভেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনীর ১টি পার্টি চিথলিয়ার দক্ষিণে রেললাইনের ওপর অ্যামবুশ পাতে। ৬ নভেম্বর সকাল ৭টায় পাকিস্তানিদের ট্রলি অ্যামবুশের আওতায় এলে তা সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়। এতে পাকিস্তানি সেনাদের এক অফিসারসহ ৪জন সৈনিক নিহত হয়। বেশ কিছু অস্ত্র মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়। ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পাকিস্তানিদের আক্রমণ সমূলে ব্যর্থ করার পর বেলােনিয়া হতে তাদের সমূলে বিতাড়িত করার পরিকল্পনা করে। সে অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ে চিথলিয়া-পরশুরামের মাঝে পাকিস্তানি সেনাদের সরবরাহ লাইন সড়কটি বিচ্ছিন্ন করার প্রস্তুতি নেয়।  ৬ নভেম্বর ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি চিথলিয়ার উত্তরাঞ্চলে দখল করে এবং সালিয়া ও ধনীকুণ্ডার মাঝখানের রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে পরশুরাম ও ফেনীর মধ্যে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এতে পাকিস্তানি সেনাদের মনােবল সম্পূর্ণ ভেঙে যায় এবং তারা চিথলিয়ার দক্ষিণে পিছু হটতে থাকে। চিথলিয়ায় পাকিস্তানিরা ২ কোম্পানি শক্তি নিয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। গােলন্দাজ সহায়তার আড়ালে ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানি অসীম সাহসিকতার সাথে পাকিস্তানি সেনাদের এ আক্রমণ ব্যর্থ করে দেয়। মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষার ওপর পাকিস্তানি বিমান আক্রমণকালে গােলার আঘাতে ১টি বিমানকে ভূপাতিত করা হয়। যুদ্ধের ফলাফল। অক্লান্ত পরিশ্রম, অসীম সাহস ও দুর্নিবার জয়ের নেশাই মুক্তিবাহিনীর জয়ের প্রধান কারণ ছিল। ওই যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গােলাবারুদ ও রসদ মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয় এবং পাকিস্তানি বাহিনী চিরতরে পরশুরাম থানা হতে পিছু হটে যায়।
শুভপুর-মধুগ্রামের যুদ্ধ
ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা। এ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গঠিত হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং পরবর্তী সময় অন্যান্য বাহিনীর সমন্বয়ে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী আনে বিজয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সর্বাত্মক, যা এখনাে পরিপূর্ণভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়নি, এমনি একটি যুদ্ধ শুভপুর মধুগ্রামের যুদ্ধ।
যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান বা স্থান পরিচিতি
ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে ধরে ভারতের সীমান্তবর্তী ফেনী বর্তমানে চট্টগ্রাম বিভাগের ১টি জেলা। ১৯৮৪ সালের পূর্বে ফেনী ছিল নােয়াখালী জেলার ১টি মহকুমা। ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার অন্তর্গত শুভপুর ও মধুগ্রাম অংশটি শুভপুর ও রাধানগর ইউনিয়নের অন্তর্গত। শুভপুর-মধুগ্রাম, মুহুরী ও সেলােনিয়া নদীর তীরে অবস্থিত এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম রােডের গুরুত্বপূর্ণ শুভপুর রেলওয়ে ও সড়ক ব্রিজটি এখানে অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই স্থানটি ২ নম্বর সেক্টরের ১টি সাব-সেক্টর ছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন মেজর রফিক (অব.)। পাকিস্তানি বাহিনী কুমিল্লা থেকে সড়কপথে এসে ফেনী দখল করে নেয় কিন্তু ফেনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান তখনাে মুক্তিবাহিনীর দখলে ছিল। এসব স্থানের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পরবর্তী সময় পাকিস্তানি বাহিনী এ অবস্থানকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে তাদের দখল স্থায়ী করার জন্য চেষ্টা চালায়। মূলত বেলােনিয়া বাজ ও শুভপুর ব্রিজই ছিল তাদের প্রধান টার্গেট। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ঐ স্থানের গুরুত্ব চট্টগ্রামে অবস্থিত একমাত্র সমুদ্রবন্দর থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্র, সরঞ্জামাদি ঢাকা-চট্টগ্রাম রােড ধরে এবং পরবর্তী সময় সারা দেশে সরবরাহ করা হতাে। তাই এর রণকৌশলগত গুরুত্ব ছিল অত্যন্ত বেশি।
এপ্রিলের শেষ দিক থেকেই এর নিয়ন্ত্রণের জন্য পাকিস্তানি বাহিনী মরিয়া হয়ে ওঠে এবং একপর্যায়ে তারা ফেনী দখল করে নেয়। শুভপুর-মধুগ্রাম স্থানটি ফেনী সদর থেকে ১৫ কিলােমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। শুভপুর সড়ক ও রেলওয়ে ব্রিজটি এখানে অবস্থিত। যার ফলে মুক্তিবাহিনী ওই স্থানটি নিজেদের অধীনে রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা চালায়, যাতে পাকিস্তানি বাহিনীর সরবরাহ ব্যাহত করা হয় । তদুপরি ছাগলনাইয়া উপজেলাটি সীমান্তবর্তী হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের জন্য দেশত্যাগী যােদ্ধা এ পথে ভারত গিয়ে প্রশিক্ষণ নিতেন এবং ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্র ও গােলাবারুদসহ ফিরে এসে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তেন। সংগঠন। যুদ্ধের সময় উভয় বাহিনীর সংগঠন ছিল নিম্নরূপ: ১. মুক্তিবাহিনী: ক, সেক্টর কোর্স-২ নম্বর সেক্টর। খ. ‘কে’ ফোর্সের অংশবিশেষ। গ, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের ১টি কোম্পানি। ঘ. মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন ছােট ছােট উপদল । পাকিস্তানি বাহিনী: ক. ৩৯ বালুচ রেজিমেন্ট। খ. ২১ আজাদ কোম্পানি রাইফেলস্। গ. ১টি গােলন্দাজ ইউনিটের অংশবিশেষ। ঘ. ১টি ক্যাভলরি ইউনিটের অংশবিশেষ। ঙ. এসিএএফ-এর ১টি কোম্পানি। মুক্তিবাহিনীর অবস্থান। মুক্তিবাহিনীর প্রধান অবস্থান ছিল ফেনীর বেলােনিয়া ও মুন্সিরহাটে। তা ছাড়া মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত যুদ্ধের বাইরে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করতাে। তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম রােডের বিভিন্ন কালভার্ট ও ব্রিজ নিয়মিতভাবে ক্ষতিসাধন করতাে, যাতে পাকিস্তানি বাহিনীর সরবরাহ ব্যবস্থাকে ব্যাহত করা যায়। পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান বা প্রতিরােধ/প্রতিরক্ষা অবস্থান। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান অবস্থান ছিল কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে। ফেনীতে তাদের অবস্থান ছিল এবং মুন্সিরহাটে তাদের শক্তিশালী অবস্থান ছিল। তদুপরি তারা বিভিন্ন ছােট ছােট উপদলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। পাকিস্তানি বাহিনী এ এলাকায় নিয়মিতভাবে টহল দিত।
রেকি, পর্যবেক্ষণ ও যুদ্ধের পরিকল্পনা পাকিস্তানি বাহিনী টহলের মাধ্যমে এলাকায় তাদের সুবিধাজনক প্রতিরক্ষা অবস্থান নির্বাচন করে। তাদের পরিকল্পনা ছিল শুভপুর ব্রিজ পার হয়ে সামনে কোথাও তারা অবস্থান নেবে। মুক্তিবাহিনী পূর্বেই পরিকল্পনা করেছিল,
পাকিস্তানি বাহিনী যখনই ব্রিজ অতিক্রম করে সামনে অগ্রসর হবে, তখন তারা পাকিস্তানি বাহিনীকে বাধা দেবে। কুতুবপুর, জাম্পমুড়া, বেলােনিয়া পর্যন্ত ক্ষুদ্র উপদলে ভাগ হয়ে ছােট ছােট অবস্থানে প্রতিরক্ষা নেয়। পাকিস্তানি বাহিনী ওই এলাকায় তাদের দখল নিতে আসবে, এটি মুক্তিবাহিনীর জানা ছিল। তাই এমনভাবে তারা দখলের পরিকল্পনা করে, যাতে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের অবস্থান সম্পর্কে কোনাে ধারণা না পায়। যুদ্ধের প্রস্তুতি ১. পরিকল্পনা চূড়ান্তকরণ বা সিদ্ধান্ত: সেক্টর অধিনায়ক মেজর রফিকের পরিকল্পনা ছিল, যে-কোনাে মূল্যে শুভপুর-মধুগ্রাম অঞ্চল নিজেদের দখলে রাখা। তাই তিনি ওই অঞ্চলে পর্যবেক্ষণ করে আশানিঘাট এলাকায় শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণের নির্দেশ দেন। পাকিস্তানি বাহিনীর যুদ্ধ চলাচল বা প্রতিরােধব্যবস্থা: পাকিস্তানি। বাহিনীর পরিকল্পনা ছিল, শুভপুর ব্রিজ পার হয়ে সামনে কোথাও প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করবে। সেই লক্ষ্যে তারা পূর্বেই এ স্থান চাক্ষুস পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে আসে এবং মুক্তিবাহিনী কর্তৃক বাধাগ্রস্ত হয়ে ফিরে যায়।
মুক্তিবাহিনীর প্রতিরােধ ব্যবস্থা: মুক্তিবাহিনী সমগ্র এলাকাজুড়ে ছােট ছােট খণ্ড দলে বিভক্ত হয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। বিশেষ করে বন্দুয়া ব্রিজ, আমলিঘাট, রাধানগর তাদের অবস্থান জোরদার করে। ৪. বিভিন্ন যুদ্ধ দলের ভেতর দায়িত্ব বণ্টন: মেজর রফিক পুরাে এলাকাকে ৪টি খণ্ড দলে বিভক্ত করেন। ৪টি খণ্ড দলের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মাহফুজ, ক্যাপ্টেন এনাম, সুবেদার জালাল ও সুবেদার আবুল হােসেন। তাদের দায়িত্ব ছিল শুভপুর থেকে রাধানগর পর্যন্ত এলাকা নিজেদের দখলে রাখা। যুদ্ধযাত্রা: ১৮ জুলাই পাকিস্তানি বাহিনী ২টি কোম্পানি ও বেশ কিছু যানবাহনসহ শুভপুর ব্রিজ পার হয়ে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সামনে কোথাও প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করবে। মুক্তিবাহিনী আগে থেকেই তাদের আগমনের সংবাদ পেয়েছিল। তারা প্রস্তুত ছিল, যখনই পাকিস্তানি বাহিনী বন্দুয়া আমালিঘাট এলাকায় আসবে, তখনই তাদের প্রতিহত করা হবে। অন্যদিকে পাকিস্তানিরা। মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেনি। যুদ্ধের বিবরণ সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী শুভপুর ব্রিজ অতিক্রম করে। এদিকে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রধান ডিফেন্স মধুগ্রামের সামনে বন্দুয়ায় ১টি সেকশন রাখা হয়। যখনই তারা বন্দুয়া ব্রিজের কাছাকাছি পৌছায়, মুক্তিবাহিনী সঙ্গে সঙ্গে তাদের আক্রমণ করে। হঠাৎ আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় এবং তাদের আনুমানিক ১০ থেকে ১২জন সদস্য নিহত হয়।
পরের দিন তারা পুনরায় অধিক শক্তি নিয়ে ফিরে আসে। মুক্তিবাহিনী পুরাে রাস্তা জুড়ে মাইন পেতে রেখেছিল, যাতে ট্যাংক আসতে পারে। তারপরও পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ চালায়। তারা মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরক্ষার সামনে পড়ে ব্যাপক ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। তবু তারা অগ্রসর হতে থাকে। একপর্যায়ে দৃঢ় প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়ে তারা তাদের আক্রমণ স্থগিত করে এবং ঐ স্থানেই বাংকার খুঁড়তে চেষ্টা করে। যখনই তারা বাংকার খুঁড়তে চেষ্টা করতাে, তখনই মুক্তিবাহিনী তাদের ওপর গােলাবর্ষণ করতাে। অন্যদিকে জুলাই মাসের অত্যধিক বর্ষণে তাদের অবস্থা শােচনীয় হয়ে ওঠে। পাকিস্তানি বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে দূরত্ব ছিল মাত্র ৫০০ গজ এবং ঐ অবস্থাতে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর ১৫ থেকে ২০ দিন। সম্মুখযুদ্ধ হয়। শত্রুরা বাংকারে থাকলেও রাতে তারা বিভিন্নভাবে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালানাের চেষ্টা করে। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের শক্ত বাধার জন্য তারা ব্যর্থ হয়। বিশেষ করে, সৈনিক লােকমান নামে একজন এলএমজিম্যান একাই পুরাে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করেন। পরবর্তী সময়। বাংকারের ফাঁক দিয়ে এক ঝাঁক ফায়ারে তিনি শহিদ হন। যুদ্ধের ফলাফল। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ৬০জন নিহত হয়। তাদের ১০টি যানবাহন ধ্বংস করা। হয়। যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনী অধিকৃত গাড়ি থেকে প্রচুর পরিমাণে রেশন, অস্ত্র ও অন্যান্য মালামাল দখল করে। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ৫-৬জন শহিদ হন। যুদ্ধের ফলে পাকিস্তানি বাহিনী ওই অঞ্চলে তাদের অবস্থান সুসংহত করতে পারে নি।
মুন্সিরহাট মুক্তারবাড়ির যুদ্ধ
ভূমিকা
এপ্রিলের শেষের দিকে ঢাকা-চট্টগ্রামে যােগাযোেগ প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী ফেনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে তারা কুমিল্লার দিক থেকে স্থলপথে আক্রমণ চালিয়ে ফেনী দখল করে নেয়। ফেনী দখলের পর মুক্তিবাহিনী পূর্বদিকে ছাগলনাইয়ায় অবস্থান নেয়। সেখানে তারা ১টি শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যুহ গঠন করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বেলােনিয়া যুদ্ধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। | পাকিস্তানি বাহিনী মে মাস থেকে এ স্থান দখলের চেষ্টা চালায়। বেলােনিয়া মুন্সিরহাট থেকে প্রায় ৯ কিলােমিটার দূরে ছিল। বেলােনিয়াকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাত হতে মুক্ত রাখার জন্য মুক্তিযােদ্ধারা বন্দুয়ায় (ফেনী হতে ৩ কিলােমিটার দূরে) ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে এবং লেফটেন্যান্ট ইমামউজ-জামানের নেতৃত্বে মুন্সিরহাটে প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তােলে। মুন্সিরহাটে প্রতিরক্ষাব্যুহটি অত্যন্ত মজবুত ছিল। মুহুরী নদীর পশ্চিম পাড় হতে শুরু করে পশ্চিমে ভারতীয় সীমান্ত পর্যন্ত এ প্রতিরক্ষাব্যুহ ছিল ৬ কিলােমিটার পর্যন্ত বেলােনিয়া হতে মুন্সিরহাট এ ১৮ কিলােমিটার এলাকা ছিল পুরােপুরি মুক্ত এলাকা। কিন্তু পরবর্তী সময় পাকিস্তানি সেনাদের প্রবল চাপের মুখে এ অবস্থান। রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাড়ায়। তবু জাফর ইমাম মাত্র ২জন অফিসার ও ৩ কোম্পানি সৈন্য নিয়ে এ অবস্থান ধরে রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। শত্রু ক্রমেই মরিয়া হয়ে উঠছিল। ৭ জুন সকালে খবর পাওয়া গেলো, পাকিস্তানি বাহিনী ফেনী থেকে বেলােনিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মুন্সিরহাট যেহেতু বেলােনিয়ার পূর্বে, তাই মুন্সিরহাটে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনী পুরােপুরি প্রস্তুত হলাে শত্ৰু মােকাবিলায়। যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান ফেনী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১টি অন্যতম জেলা। মুন্সিরহাট ফেনী হতে উত্তরে ফুলগাজী উপজেলার দেবরামপুর ইউনিয়নের ১টি গ্রাম। এটি মুহুরী নদীর পশ্চিম পারে অবস্থিত। এর উত্তরে পরশুরাম থানা, দক্ষিণে ফেনী সদর | এবং পূর্ব-পশ্চিমে উভয় পাশেই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য অবস্থিত।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ওই স্থানের গুরুত্ব
ভারত সীমান্তের নিকটবর্তী হওয়ায় ফেনীতে এমনিতেই মুক্তিযুদ্ধের তৎপরতা বেশি ছিল। মুন্সিরহাটের দুই পাশেই ছিল ভারতের সীমান্ত, তাই এ স্থানের দখল নেয়া মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনী উভয়ের জন্যই সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বেলােনিয়া ছিল ফেনীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান আর এ স্থান দখলের জন্য বাহিনীকে মুন্সিরহাট অতিক্রম করতে হতাে। তাই এদিক দিয়েও এ স্থান ছিল বিশেষ প্রয়ােজনীয়। সংগঠন। যুদ্ধের সময় উভয় বাহিনীর সংগঠন ছিল নিম্নরূপ: ১. মুক্তিবাহিনী: ক. ৪ রাইফেলের ‘বি’ কোম্পানি। খ. ইপিআর-এর ১টি কোম্পানি। গ. গণবাহিনীর ১টি কোম্পানি। পাকিস্তানি বাহিনী: ক, ৫৩ ব্রিগেড। খ. ১৫ বালুচ রেজিমেন্ট। গ. ৩১ বালুচ রেজিমেন্ট। ঘ, ৩৯ বালুচ রেজিমেন্ট। উ. ২১ আজাদ কাশ্মীর রাইফেলস্রে অংশবিশেষ। চ. গােলন্দাজ বাহিনী। পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান বা প্রতিরােধ/প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এপ্রিলের প্রথম দিকেই পাকিস্তানি বাহিনী ফেনীতে প্রবেশ করে। সে সময় তারা বিক্ষিপ্তভাবে মুক্তিবাহিনীর বাধার সম্মুখীন হয়। এ আক্রমণে তারা পিছু হটলেও ৪ এপ্রিল হঠাৎ করে ফেনীর ওপর বিমান হামলা শুরু করে। এতে শহরের বহু বাড়িঘর ধ্বংস এবং বহু নিরীহ মানুষ হতাহত হয়। মুক্তিবাহিনী শক্রর ১টি বিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করতে পারলেও আরেকটি বিমান পালিয়ে যায়।
১৫ এপ্রিল কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে এক ব্রিগেড সৈন্য অগ্রসর হয়ে। ফেনীর কাছে এসে ২টি ভাগে বিভক্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীকে আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী তাদের ২২ এপ্রিল পর্যন্ত আটকে রাখতে সক্ষম হয়। এরপর ফেনীতে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং মুন্সিরহাট যুদ্ধের পূর্বে তারা ফেনী হতে যাত্রা করে। মুক্তিবাহিনীর অবস্থান মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ছিল মুন্সিরহাটে। মুহুরী নদীর পশ্চিম পাশ হতে শুরু করে পশ্চিমে ভারতীয় সীমান্ত পর্যন্ত এ প্রতিরক্ষাব্যুহ্যের সীমারেখা ছিল, যা ছিল প্রায় ৬ কিলােমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এ অবস্থানটি এপ্রিলের শেষের দিকে স্থাপিত হলেও মে মাসের শেষের দিকে এটি বেশ মজবুত ঘাঁটিতে পরিণত হয়। এর কারণ হলাে, এর সম্মুখে বেশ কিছু প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধক ছিল, যা শক্রর জন্য আক্রমণের বেশ বড় বাধা ছিল। এ অবস্থানটি এমনভাবে পরিকল্পনা করে তৈরি করা হয়, যা শত্রুসেনাদের বাধ্য হয়ে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি অতিক্রম করার সময় প্রতিরক্ষার শুধু সামনে ছাড়া কোনাে উপায়ে ফিরে আসার রাস্তা ছিল না। যুদ্ধের পরিকল্পনা উভয় বাহিনীর যুদ্ধের পরিকল্পনা ছিল নিমরূপ: ১. মুক্তিবাহিনী: আগেই বলা হয়েছে, মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানটি এমন ছিল যে শত্রুকে শুধু প্রতিরক্ষার সামনে থেকে আক্রমণ করতে হতাে। এতে যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী যেদিক থেকেই আসার চেষ্টা করেছে সেখানেই বেশি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে এবং হতাহত হয়েছে। যেহেতু এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী সবদিক হতেই পাকিস্তানি বাহিনী হতে দুর্বল ছিল, তাই তারা যুদ্ধের পরিকল্পনা করে অনেক ভেবেচিন্তে। এ জন্য এটি স্বাভাবিক যুদ্ধের পরিকল্পনা হতে কিছুটা ভিন্নতর ছিল।
তাদের প্রথম পরিকল্পনাটি ছিল, শত্রুকে নিজের অবস্থান সম্পর্কে ধোকা দেওয়ার জন্য একটি অগ্রবর্তী ঘাঁটি স্থাপন করা, এটি ছিল একটি ডিলেয়িং পজিশন। এ পজিশনের সামনে রাস্তা ও রেলের সেতুগুলাে ধ্বংস করে দেওয়া হয়, যাতে শত্রুদের অগ্রসর আরও বাধার সৃষ্টি হয়। শত্রুদের অগ্রসরের রাস্তার পশ্চিমে ও পাশে রাস্তার দিকে মুখ করে বেশ কয়েকটি উঁচু জায়গায় এবং পুকুরের উঁচু বাঁধে শক্ত ও মজবুত পরিখা তৈরি করা হয়, যাতে হালকা মেশিনগান লাগিয়ে দেওয়া হয়। এটা ছিল এ রকম ফাদ, যাতে একবার অবস্থানের ভেতর অগ্রসর হলে দুপাশের গুলিতে শত্রুসেনারা ফিরে যেতে না পারে। এসব পরিখা এমনভাবে লুকানাে ছিল যে সম্মুখ থেকে বােঝার কোনাে উপায় ছিল না। পাকিস্তানি বাহিনী অগ্রসর হবার সময় যখন গােলাগুলি শুরু করেছিল, তখন মুক্তিবাহিনী এসব গােলাগুলির কোনাে জবাব দেয়নি, যাতে তারা তাদের অবস্থান বুঝতে না পারে। শত্রু যখন বন্দুয়া সেতুর ওপর বাঁশ দিয়ে সাঁকো নির্মাণ করে এগিয়ে আসছিল, তখন অগ্রবর্তী দল হতে তাদের ওপর প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ করে প্রচুর পাকিস্তানি সেনা হতাহত করা হয়।
এটি ছিল পরিকল্পনার একটি অংশ। তেমনিভাবে সিলােনিয়া নদী পার হবার সময় একইভাবে তাদের প্রচুর সৈন্য হতাহত হয়। এ ছাড়া মুক্তিবাহিনীর ওপর আদেশ হয়, যেন শত্রু একদম কাছে না আসা পর্যন্ত ফায়ার শুরু করা না হয়। মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের সম্মুখে ৩০০ গজ পর্যন্ত স্থল মাইন বসানাে ছিল। এভাবে মুক্তিবাহিনী যুদ্ধের পূর্বে বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যা তাদের যুদ্ধের সময় প্রচণ্ডভাবে সাহায্য করে। পাকিস্তানি বাহিনী: পাকিস্তানি বাহিনী যেহেতু জনবল ও অস্ত্রের দিক দিয়ে বেশ ভালাে অবস্থানে ছিল, তাই তারা তাদের জয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল। এ জন্য তারা স্বাভাবিক গােলাবর্ষণ করে নদী পার হয়। মুক্তিবাহিনীর দিকে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে তারা তাদের গােলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় আর্টিলারি শেল নিক্ষেপ করে মুক্তিবাহিনীকে দুর্বল করে দেবার পরিকল্পনা করে। তারা যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, তাই তাদের পরিকল্পনা ছিল শত্রুর কাছে গিয়ে তাদের ধ্বংস করা। যুদ্ধের বর্ণনা ১০ জুন সকালে জানা যায়, শত্রুরা ফেনী হতে বেলােনিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সকাল ১০টার দিকে তারা বন্দুয়ার আশপাশে জমায়েত হতে থাকে এবং প্রথমবারের মতাে মুন্সিরহাটে প্রতিরক্ষার ওপর ফায়ার করতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর নির্দেশ ছিল, শত্রুদের এসব গােলাগুলির কোনাে জবাব যেন না দেওয়া হয়।
শত্রুসেনারা বন্দুয়া সেতুর ওপর সাঁকো নির্মাণ করে যেমনি পার হবার চেষ্টা করেছিল, ঠিক সে সময় মুক্তিবাহিনীর অগ্রবর্তী ডিলেয়িং পজিশনের বীর সৈনিকেরা তাদের ওপর গুলি চালায়। এতে প্রথমবারে সব শত্রুসেনা নদী পার হচ্ছিলাে, ফলে কমপক্ষে ৪০-৫০জন লােক হতাহত হয়। এরপর শত্রুসেনারা। কিছুটা পিছু হটে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার বিরাট গােলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় তীব্র আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর ডিলেয়িং পজিশনের সৈনিকেরা শত্রুদের আরও বহুসংখ্যক লােক হতাহত করে বীরত্বের সাথে আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে। কিন্তু আক্রমণ যখন আরও তীব্ররূপ ধারণ করে, তখন তারা ডিলেয়িং পজিশন ত্যাগ করে প্রধান ঘাঁটি মুন্সিরহাটে পিছু হটে আসে। শত্রুরা কিছুটা সফলতা লাভ করায় আরও প্রবল বেগে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং সেলােনিয়া নদী পর্যন্ত অগ্রসর হয়। সেখানে এসে তারা নদী পার হবার সব প্রস্তুতি নেয়। প্রধান ঘাঁটি হতে ৮০০ গজ সামনে আনন্দপুর গ্রামে শত্রুসেনারা তাদের সমাবেশ ঘটাতে থাকে।
নদী পার হবার পূর্ব মুহূর্তে কামানের সাহায্যে তারা মুন্সিরহাট প্রধান ঘাটির ওপর প্রবল আক্রমণ আরম্ভ করে। এ সুযােগে পাকিস্তানিরা নদী পার হবার জন্য নৌকা ও বাঁশের পুলের সাহায্যে এগিয়ে আসতে থাকে। যদিও মুক্তিবাহিনী শত্রুর কামানের গােলায় যথেষ্ট বিপর্যস্ত ছিল, তবু মানুষিক দিক দিয়ে তারা ছিল। যথেষ্ট চাঙা। ওদের বেশ কিছু সৈন্য নদী পার হয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের •৩০০-৪০০ গজ সামনে চলে আসে এবং কিছুসংখ্যক সেনা নদী পার হচ্ছিলাে। ঠিক সে সময় মুক্তিবাহিনীর মর্টার ও মেশিনগান গর্জে ওঠে। মুক্তিযােদ্ধাদের অকস্মাৎ পাল্টা উত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের অনেক হতাহত হতে থাকে। তবু তারা বাধা বিপত্তি ডিঙিয়ে প্রবল বেগে অগ্রসর হতে থাকে। অন্যদিকে মুক্তিযােদ্ধারাও তাদের ব্যাপক ক্ষতি করতে থাকে। তবুও তারা এ রকম নিঃসহায় অবস্থায় দক্ষতার সাথে সামনে অগ্রসর হচ্ছিলাে। এ সময় তারা প্রতিরক্ষার সামনে স্থাপিত মাইনফিল্ডের সামনে এসে পড়ে। তাদের পায়ের চাপে একটার পর একটা মাইন ফাটতে আরম্ভ করে। এতে অনেক শক্রসেনা তুলাের মতাে উড়ে যেতে লাগলাে। প্রতিরক্ষার পাশে গােপনে স্থাপিত মেশিনগানের গুলি ও মাইনের আঘাতে শত্রুসেনাদের ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। শুধু কয়েকজন শত্রু এসব বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে কয়েকটি পরিখার সামনে পৌছায় কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা তাদের জন্য গ্রেনেড হাতে প্রস্তুত ছিল এবং তারা সেখানেই গ্রেনেডের মুখে ধ্বংস হয়।
এ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে তারা আর সামনে এগােতে সাহস পায়নি। যারা পেছনের দিকে ছিল, তারাও এ সংকটজনক অবস্থা ও ভয়াবহতা বুঝতে পেরে পেছনের দিকে পালাতে শুরু করে। শত্রুসেনাদের পালাতে দেখে মুক্তিযােদ্ধারা প্রচণ্ড উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং আরও প্রবল বেগে গুলি চালাতে থাকে।  মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ হতে রক্ষা পেয়ে খুব কমসংখ্যক সৈন্য সেলােনিয়া নদী পার হয়ে পিছু হটে যেতে সক্ষম হয়। এ সময় তারা অনবরত কামানের গােলা চালিয়ে যাচ্ছিল, যাতে তাদের বিপর্যস্ত ও পর্যদস্ত যেসব সৈনিক ছিল, তারা নিরাপদে পশ্চাদঘাটি আনন্দপুর পর্যন্ত যেতে পারে। এর কিছু পর বেলা দুটোর দিকে তাদের গােলন্দাজ বাহিনীর গােলাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্রে একটা নীরবতা নেমে আসে। মুক্তিবাহিনী কিছুক্ষণ তাদের পুনরায় আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে কিন্তু পরবর্তী সময় জানা যায়, তাদের অবস্থা সত্যিই বিপর্যস্ত এবং তাদের মনােবল একেবারেই ভেঙে গেছে, পুনরায় আক্রমণের শক্তি আর তাদের নেই।
যুদ্ধের ফলাফল
যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর শােচনীয় পরাজয় ঘটেছিল। সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের অন্ততপক্ষে ৩০০জনের মৃতদেহ পাওয়া যায় এবং সেলােনিয়া নদীতে কত মৃতদেহ ভেসে গিয়েছিল, তার হিসেব পাওয়া যায়নি। পরে জানা যায় পাকিস্তানি বাহিনী একটা ব্যাটালিয়নের চেয়েও বেশি সৈন্যদল নিয়ে এ আক্রমণ চালিয়েছিল এবং এ ব্যাটালিয়নের ৬০ ভাগের মতাে লােক নিহত বা আহত হয়েছিল। পক্ষান্তরে মুক্তিবাহিনীর খুব কমসংখ্যক শহিদ বা আহত হয়েছিলেন। মুন্সিরহাট যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা কয়েকজন বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা। ক্যাপ্টেন (পরবর্তী সময় মেজর) জাফর ইমাম, বীরবিক্রম তিনি ছিলেন এ যুদ্ধের অধিনায়ক। তার সুদক্ষ পরিকল্পনা ও চাতুর্যতার কারণেই এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী রণে ভঙ্গ দেয়। তিনি মাত্র ২জন অফিসার এবং ৩জন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার নিয়ে দক্ষতার সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধে জয়লাভ করেন, যা পরবর্তী সময় মুক্তিবাহিনীর মনােবল অনেক বাড়িয়ে দেয়। লেফটেন্যান্ট (পরবর্তী সময় মেজর জেনারেল) ইমাম-উজ-জামান, বীরবিক্রম তিনি ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে এ যুদ্ধ পরিচালনা করেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। হাবিলদার নুরুল ইসলাম সিনিয়ার টাইগার্সের গর্বিত সৈনিক, যিনি এ যুদ্ধে শহিদ হন। মুন্সিরহাট যুদ্ধে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। প্রতিরক্ষার সামনে স্থল মাইন বসাতে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড