You dont have javascript enabled! Please enable it!
বেলােনিয়ার দ্বিতীয় যুদ্ধ
ভূমিকা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ১১টি সেক্টরে সংগঠিত হয়েছিল। এ ১১টি সেক্টরের মধ্যে ২ নম্বর সেক্টর সংগঠিত হয়েছিল বেলােনিয়ার দ্বিতীয় যুদ্ধে আমরা যদি বাংলাদেশের মানচিত্রের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাবাে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে ঠিক ফেনীর উত্তরের অংশে অবস্থিত ছােট সীমান্তবর্তী শহর বেলােনিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বেলােনিয়ার সামরিক গুরুত্ব। বেলােনিয়ায় যেহেতু সড়ক, নদী ও রেলপথসহ সব ধরনের যােগাযােগ মাধ্যম বিদ্যমান তাই এখানে অবস্থানরত শত্রুদের উত্তর প্রান্ত থেকে দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত সব ধরনের যােগাযােগের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। অন্যদিকে বাহিনীর জন্য বেলােনিয়া এলাকায় আড়াআড়িভাবে অর্থাৎ বেলােনিয়া সীমানার পূর্বপ্রান্ত হতে পশ্চিমপ্রান্ত পর্যন্ত স্বল্প পরিধি দখলের মাধ্যমে খুব সহজে বেলােনিয়ার সীমানার উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃতি দীর্ঘাকার শত্রুর বিস্তৃতিকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব ছিল। অতএব সামগ্রিক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে উভয় বাহিনীর কাছেই এ স্থানের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম সংগঠন অংশগ্রহণকারী উভয় পক্ষের সংগঠন ছিল নিম্নরূপ: ১. মুক্তিবাহিনী: ২ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ‘কে’ ফোর্সের সংগঠন: ক. ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট: মেজর জাফর ইমাম। খ. ‘এ’ কোম্পানি: লেফটেন্যান্ট ইমাম-উজ-জামান।
গ. ‘বি’ কোম্পানি: লেফটেন্যান্ট মিজান। ঘ, ‘ডি’ কোম্পানি: ক্যাপ্টেন মােখলেছ। মুক্তিবাহিনী: ‘এস’ ফোর্সের সংগঠন: ক. ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি: ক্যাপ্টেন হেলাল মােরশেদ। খ, সাব সেক্টরের কিছু সৈনিক। ৩. পাকিস্তানি বাহিনীর সংগঠন: ক. ১ পদাতিক ব্যাটালিয়ন ১৫ বালুচ রেজিমেন্ট। খ. ১ ইপিসিএএফ ব্যাটালিয়ন। গ. পশ্চিম পাকিস্তান পুলিশ ও রাজাকার। মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ১. ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান বেলােনিয়ার চর্তুদিকে ২. ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়ন সদরের অবস্থান সীমান্তবর্তী এলাকা রাজনগরে। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ছিল নিম্নরূপ: ১. ১৫ বালুচ রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি এলাকা বেলােনিয়া। ২. ইপিসিএএফের ১টি কোম্পানি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত ঘিরে বেলােনিয়ার পশ্চিমে। ৩. ১৫ বালুচ রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি এলাকা পরশুরাম।। ৪. ১৫ বালুচ রেজিমেন্টের অন্য ১টি কোম্পানি পশ্চিম সীমান্ত সম্মুখে রেখে এলাকা চন্দনা সালদা বাজার নােয়াখালীতে। ৫. ইপিসিএএফের অন্য ১টি কোম্পানি পশ্চিম সীমান্ত সম্মুখে রেখে এলাকা নােয়াবারা-জামুরায়। ৬. ইপিসিএএফের অন্য ১টি কোম্পানি পূর্ব সীমান্ত সম্মুখে রেখে এলাকা ঘুটুমায়।। ৭. ১৫ বালুচ রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি পূর্বমুখী হয়ে ব্যাটালিয়ন  সদরের এলাকা আমজাদ হাটে। ৮, ১৫ বালুচ রেজিমেন্টের অবস্থান ফেনী জেলায়। ৯, মর্টার ও গান পজিশনের অবস্থান রাস্তার দুই পাশে। যুদ্ধের প্রস্তুতি ১. পরিকল্পনা চূড়ান্তকরণ: ব্রিগেড অধিনায়ক ১টি মডেলের মাধ্যমে ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সব অফিসারকে সমগ্র অপারেশন সম্পর্কে ধারণা প্রদান করেন। যেহেতু ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মােট জনবল অপারেশন পরিচালনার জন্য অপর্যাপ্ত ছিল। সে জন্য ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানিকে সুদূর সিলেট থেকে ক্যাপ্টেন মােরশেদের নেতৃত্বে অপারেশনের রি-ইনফোর্সমেন্ট হিসেবে নিয়ে আসা হয় এবং ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধীনস্থ রাখা হয়। ১ নম্বর সেক্টরের কিছু সৈনিককে ঘুটুমার মধ্য দিয়ে শত্রু এলাকায় প্রবেশ। করে বালিয়ায় ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের সাথে মিলিত হবার আদেশ প্রদান করা হয়।
২. মেজর জাফর ইমাম ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক থেকে আরম্ভ করে সেকশন। অধিনায়ক পর্যন্ত মােট ৩৬জন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত পর্যবেক্ষণ দলকে নেতৃত্ব দেন। পর্যবেক্ষণ দল ছােট ছােট দলে শত্রুর ফাকা অবস্থানের মধ্য দিয়ে এলাকায় প্রবেশ করে সম্পূর্ণ এলাকা পর্যবেক্ষণ করেন। পর্যবেক্ষণের সময় প্রতিটি সেকশন ও প্লাটুন অধিনায়ককে অপারেশনের অবস্থান ও দায়িত্বপূর্ণ এলাকা দেখানাে হয়। পর্যবেক্ষণ শেষে ফেরার পথে একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে। ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নায়েব সুবেদার জব্বার নিজের অজান্তেই ১টি অ্যান্টিপার্সোনাল মাইনের মধ্যে পা দেন এবং মারাত্মকভাবে আহত হন। মুক্তিবাহিনীর সীমান্ত আক্রমণ আক্রমণের দিন স্থির করা হয়েছিল ২ নভেম্বর। আক্রমণ পরিকল্পনা অনুসারে ব্যাটালিয়নকে প্রথমে রাজনগর এলাকায় একত্র করা হয়। রাজনগর এলাকায় | ব্যাটালিয়ন সমাগম এলাকায় যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। এদিকে ৩১ অক্টোবর থেকে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিলাে। এ আবহাওয়া মুক্তিবাহিনীর জন্য ১টি বাড়তি সুযােগের সৃষ্টি করে।
২ নভেম্বর শেষ আলাের দিকে মুক্তিবাহিনীর সৈন্যরা শত্রুর অগােচরে ধীরে ধীরে সীমান্তের ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে। বি’ কোম্পানির অধিনায়ক সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মিজান সর্বপ্রথম তার কোম্পানি নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে অপারেশন এলাকার মধ্যে প্রবেশ করেন। তাকে অনুসরণ করেন যথাক্রমে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট দিদার ‘সি’ কোম্পানি নিয়ে এবং সর্বশেষ ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সৈনিক নিয়ে ক্যাপ্টেন মােরশেদ। মুক্তিবাহিনী চুপিসারে এবং ধীরগতিতে চন্দা ও সালদার বাজারের মধ্য দিয়ে শত্রু বাহিনীর প্রতিরক্ষার মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে এবং মুহুরী নদী অতিক্রম করে সালদার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সেই সময় চাঁদের অবস্থান ছিল তৃতীয় চক্রে। কাজেই প্রচণ্ড বৃষ্টির শব্দের সুযােগ নিয়ে রেশন, গােলাবারুদ ও খনন যন্ত্রপাতি নিয়ে শত্রুর অগােচরে প্রতিরক্ষার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। একইসাথে ক্যাপ্টেন মাহফুজ তার কোম্পানি নিয়ে ঘুটুমার মধ্য দিয়ে শত্রু | এলাকায় প্রবেশ করেন এবং সালিয়ায় ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’  কোম্পানির সম্মুখ দলের সাথে মিলিত হন, যার ফলে রাত ১২টার মধ্যে চন্দনাসালিয়া-ঘুটুমা লাইন বরাবর বেলােনিয়ার উত্তর অংশের যােগাযােগ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া হয়। মুক্তিবাহিনীর সৈন্যরা নিজস্ব অবস্থানে যাওয়ার সাথে সাথে খননকাজ শুরু করে দেয়। সেকশনগুলােকে একটি উত্তর, একটি দক্ষিণে এভাবে সম্মুখ ও পশ্চাৎ উভয় দিক সম্মুখে রেখে প্রতিরক্ষায় পাঠানাে হয়।
ব্যাটালিয়ন কমান্ড পােস্ট বি ও ‘সি’ কোম্পানির মাঝখানে স্থাপন করা হয়। লেফটেন্যান্ট ইমাম-উজ-জামানকে এককভাবে ১টি কোম্পানি নিয়ে মুহুরী নদীর পূর্ব পারে অবস্থিত ধানিকুন্দা এলাকায় প্রবেশ করে পূর্ব-পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে মুখ করে প্রতিরক্ষায় অবস্থান গ্রহণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। শুধু উত্তর দিকে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানির সাথে ‘এ’ কোম্পানির যােগাযােগ ছিল। লেফটেন্যান্ট ইমাম-উজ-জামানের নেতৃত্বাধীন ‘এ’ কোম্পানিকে প্রথমত পুরাে দলের জন্য ফ্লাংক প্রটেকশন বা পার্শ্ব নিরাপত্তাকারী দল এবং দ্বিতীয়ত দক্ষিণ দিকে শত্রুকে প্রতারণামূলক বিভিন্ন কাজের জন্য নিয়ােজিত করা হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে আকস্মিক আক্রমণ: ৩ নভেম্বর প্রথম আলাের  মধ্যে মুক্তিবাহিনীর সব সৈন্য কমবেশি শত্রু অবস্থানের ভেতরে অবস্থান গ্রহণ। করে এবং শক্রর ওপর আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকে। পাকিস্তানি বাহিনীর সবাই তখনাে পরিখার মধ্যে অবস্থান করছিল এবং পরিখার বাইরে আসার প্রয়ােজন অনুভব করেনি। সকাল সাড়ে ৬টা পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী প্রবেশ সম্পর্কে পাকিস্তানি বাহিনীর  কোনােরূপ ধারণা ছিল না। এমনকি একজন পাকিস্তানি অফিসার যখন ৫ জওয়ানকে নিয়ে উত্তর দিক থেকে সালিয়ার দিকে রেলের ট্রলিতে করে যাচ্ছিল, তখন পর্যন্ত তারা ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান সম্পর্কে কোনােরূপ আঁচ করতে পারেনি, কারণ ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক অত্যন্ত সুন্দর ছদ্মবেশে আবৃত ছিল।
রেলের ট্রলিটি যখন পরশুরামের নিকটবর্তী অগ্রসর হচ্ছিলাে, তখন ‘বি’ কোম্পানির হাবিলদার ইয়ার আহমেদ তার এলএমজি লােড করে এবং শত্রুর ওপর অ্যামবুশ করার জন্য তৈরি হন। ট্রলি প্রায় ৭৫ গজ দূরত্বে আসতেই হাবিলদার ইয়ার আহমেদ এলএমজি থেকে ফায়ার শুরু করেন এবং তার এ ফায়ারের সাথে সাথে অন্যান্য পোেস্ট থেকেও ট্রলির দিকে ফায়ার চালাতে থাকে। ট্রলিতে অবস্থানরত সব পাকিস্তানি বাহিনী ফাঁদে পড়ে বাঁচার জন্য চিৎকার করতে থাকে এবং তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর মৃত্যুর সময় তাদের ১টি এসএমজি, ৩টি রাইফেলসহ ১টি রকেট লঞ্চার ভূমিতে পড়ে থাকতে দেখা যায়। হাবিলদার ইয়ার আহমেদ অস্ত্রগুলাে দেখে এত উৎসাহ পান। যে তিনি তাঁর পরিখা থেকে বের হয়ে অস্ত্রগুলাে নেয়ার জন্য ট্রলির কাছে ক্রলিং করে যান। ঠিক সেই সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে তাঁর অবস্থান দেখতে পায় এবং তার দিকে গুলিবর্ষণ করে। হাবিলদার ইয়ার আহমেদ তৎক্ষণাৎ শাহাদতবরণ করেন। তার পরও পরবর্তী সময় ভূমিতে পড়ে থাকা বিক্ষিপ্ত অস্ত্রগুলাে সংগ্রহ করা হয়েছিল। যুদ্ধের বিবরণ পাকিস্তানি বাহিনীর প্রাথমিক আক্রমণ পাকিস্তানি সৈন্যরা সালিয়ার দক্ষিণ দিক থেকে ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ করতে থাকে। একইসাথে পাকিস্তানি সৈন্যরা। উত্তর দিক থেকে বারবার আক্রমণ করতে থাকে এবং প্রতিবাদে অপর পরিখা থেকে পাল্টা ফায়ার করতে থাকে এবং শত্রুর সব চেষ্টা ব্যর্থ করে । দুই পক্ষের সাথে সারাদিন বৃষ্টির মতাে গুলিবিনিময় হতে থাকে। একই সাথে মুক্তিবাহিনী তাদের নিজস্ব অবস্থার উন্নতি সাধন করে আরও অনেক বেশি পরিখা খনন করে। এবং যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নতি করতে থাকে।
মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দিনের শেষ ভাগে মিত্রবাহিনী সৈন্যদের খবর প্রথমবারের মতাে সীমান্তের অপর পাশ থেকে পরিখার মাধ্যমে পৌছায়। পরবর্তী সময় যােগাযােগ পরিখাগুলাে আরও উন্নত করায় গােলাবারুদসহ সব ধরনের সরবরাহ সময়মতাে পৌছানাে। সম্ভব হয়। শত্রুর বিমান হামলা ৪ নভেম্বর বিকেলে অকস্মাৎ শত্রুর ৪টি এফ-৮৬ যুদ্ধ বিমান আকাশে দেখা যায়। বিমানগুলাে মিত্রবাহিনীর অবস্থানের ওপর আকাশে দুবার চক্রাকারে ঘুরতে থাকে এবং হঠাৎ করে ২টি বিমান মিত্রবাহিনীর কাছাকাছি এসে অনবরত গােলাবর্ষণ করতে থাকে। বিমানগুলাে মুক্তিবাহিনীর পরিখার ওপর রকেট লঞ্চারও ফায়ার করতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর সৈন্যরা পরিখা থেকে নিজেদের কাছে যেসব ক্ষুদ্রাস্ত্র ছিল, তা দিয়েই শত্রুর বিমানের ওপর ফায়ার করতে থাকে। ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানিতে এ সময় একজন নায়েব সুবেদার ১টি ভারী মেশিনগান দিয়ে শত্রুর বিমান লক্ষ্য করে ফায়ার করেছিলেন। তার ফায়ার চলাকালে ১টি বিমান নিচের দিকে আসে এবং তার দিকে ১টি সবুজ ট্রেসার নিক্ষেপ করে। সাথে সাথে অপর ১টি জেট বিমানও নিচে নেমে আসে এবং তার ওপর অনবরত ফায়ার করতে থাকে। কিন্তু সেই সুবেদার বীরত্বের সাথে এ মেশিনগান দ্বারা ফায়ার করতে থাকেন এবং শহিদ হন। তার ভারী মেশিনগানটিও শক্রর বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে যায়। তবে ধ্বংসের পূর্বে এ মেশিনগান দ্বারা শত্রুর বিমানও কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং একই সাথে ৪টি বিমান এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
সমস্ত বিকাল এবং পরবর্তী রাত পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময় চলতে থাকে। পরবর্তী দিন অর্থাৎ ৫ নভেম্বর পরিস্থিতি অনেকটা অপরিবর্তিত ছিল। বিকেলের দিকে ৩টি পাকিস্তানি বিমান মুক্তিবাহিনীর ওপর আক্রমণ করে এবং গােলাবর্ষণ করতে থাকে। কিন্তু তারপরও তারা মুক্তিবাহিনীকে তাদের জায়গা থেকে উৎখাত করতে সক্ষম হয়নি। বিমান হানার পর পাকিস্তানি বাহিনী অনেকবার চেষ্টা করেছিল মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষার অভ্যন্তরে প্রবেশ করার জন্য এবং উত্তরে আটকে থাকা সৈন্যদের উদ্ধারের জন্য। কিন্তু প্রতিবারই তাদের আক্রমণ ব্যর্থ হয়েছিল। সালদাবাজার দখল ধানিকুন্দার দক্ষিণে মুহুরী নদীর পশ্চিম পাশে অবস্থিত সালদাবাজারে শত্রুর অবস্থান ছিল অত্যন্ত সুদৃঢ়। লেফটেন্যান্ট ইমামের নেতৃত্বাধীন ধানিকুন্দায় অবস্থিত ‘এ’ কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল একটি ফাইটিং টহল পাঠিয়ে শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য। এ কোম্পানি ৫ নভেম্বর মােট ৩০জন জনবলের ১টি শক্তিশালী টহল দল এ উদ্দেশ্যে পাঠায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এ টহল দলটি শত্রুর অ্যামবুশের মধ্যে পড়ে এবং শত্রুপক্ষ অতি কাছ থেকে টহল দলের ওপর ফায়ার করতে থাকে। টহল দলের উপ অধিনায়ক নায়েক তৌহিদ উল্লাহ শক্রর মুখােমুখি হয়ে তার অবস্থান থেকে এলএমজি দ্বারা ফায়ার করতে থাকেন। তিনি শক্রর যথেষ্ট ক্ষতি করতে সক্ষম হন এবং অ্যামবুশ রচনাকারী শত্রুপক্ষ সবাই এলােমেলােভাবে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে নায়েক তৌহিদের ওপরও শক্র ফায়ার করে এবং তিনি ৫টি বুলেটবিদ্ধ হন। টহল অধিনায়ক নায়েক আজিজ ওখানেই শহিদ হন এবং টহলের অন্য ৩জন সৈনিকও মারাত্মকভাবে আহত হন। মধ্যরাতে এ খবর পেয়ে ‘এ’ কোম্পানির। সব সৈনিক প্রতিরক্ষা থেকে সালদাবাজারের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
এ কোম্পানি নিজস্ব মর্টার ফায়ারের আবরণে সালদাবাজারের বহির্মুখী চৌকির ওপর তরঙ্গ গতিতে আক্রমণ করতে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনী অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যে পড়ে এবং কোনােরূপ দেরি না করে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র, গােলাবারুদ ও যন্ত্রপাতি রেখে পালিয়ে যায়। ৬ নভেম্বর প্রথম আলাের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর ‘এ’ কোম্পানি সালদাবাজার সম্পূর্ণরূপে দখল করে নেয়। চূড়ান্ত আক্রমণ ইতােমধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৮৩ পাহাড়ি ব্রিগেড সীমান্তের কাছাকাছি আসতে থাকে। ভারতীয় অধিনায়ক সমগ্র এলাকা পরিদর্শন করেন এবং মুক্তিবাহিনীর প্রয়ােজনীয় সমন্বয় সাধন করেন। তারা বেলােনিয়ার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন এবং সমস্ত বেলােনিয়া দখল করতে মুক্তিবাহিনীকে তাদের প্রয়ােজনীয় সহযােগিতার পরিকল্পনা প্রদান করেন। ধারণা করা হচ্ছিলাে, বেলােনিয়ার উত্তর প্রান্তে চতুর্দিকে ঘেরাওকৃত সৈন্যরা অল্প কয়েক দিনের মধ্যে আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু ৬ নভেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্যদের একত্র থেকে ফায়ার প্রতিরােধ করা দেখে মােলান্টি-পরশুরাম এলাকা সম্পূর্ণ মুক্ত করার লক্ষ্যে শারীরিকভাবে আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩ ডগরা রেজিমেন্ট ৬-৭ নভেম্বর মধ্যরাতে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। নির্ধারিত ব্যাটালিয়ন আক্রমণে যাবার পূর্বে এলাকায় প্রায় আধা ঘণ্টা যাবৎ ২৩ পাহাড়ি ডিভিশন আর্টিলারি দ্বারা গােলাবর্ষণ করা হয়। মিত্রবাহিনীর গােলাবর্ষণে যখন লক্ষ্যবস্তু পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখনই ৩ ডগরা রেজিমেন্ট উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে আক্রমণ রচনা করে। পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক পরিখা ও শক্ত ঘাঁটি রকেট লঞ্চারের মাধ্যমে উড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এবং সম্পূর্ণ এলাকা প্রথম আলাের পূর্বে মিত্রবাহিনীর দখলে চলে আসে।
পাকিস্তানি বাহিনী মিত্রবাহিনীর আর্টিলারি গােলন্দাজ ও অ্যাসল্টের সময় প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর ২০০ এরও বেশি সৈনিক মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায় এবং আহত হয় অনেকেই। দুজন পাকিস্তানি অফিসার এবং ৭২জন অন্যান্য পদবির সৈনিক এতে আত্মসমর্পণ করে। ভারী। অস্ত্রসহ প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র বেলােনিয়া-পরশুরাম এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। ক্ষুদ্রান্ত্রের গােলাবারুদসহ বিপুল পরিমাণ রকেট লঞ্চার ও মর্টারের গােলা উদ্ধার করা হয়। যুদ্ধের ফলাফল ৭ নভেম্বর থেকে বেলােনিয়া ব্রিজের উত্তর প্রান্তের ৭৫ কিলােমিটার জুড়ে বিস্তৃত। এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। যদিও সালিয়ার দক্ষিণে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনী কিছুটা হলেও মজবুতভাবে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। তারপরও তারা পরবর্তী। সময় বেলােনিয়া-পরশুরাম এলাকা পুনর্দখলের কোনাে চেষ্টা করেনি। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ ও মিত্রবাহিনী বেলােনিয়া মুক্ত ভূমিতে প্রবেশ করতে থাকে। কে’ ফোর্সের সদর দপ্তর পরবর্তী সময় মুক্ত ভূমিতে প্রবেশ করে।  পরবর্তী সময় পরশুরাম থানায় বাংলাদেশের সবুজ রক্তিম পতাকা উড়তে থাকে এবং বেসামরিক প্রশাসন ঐ এলাকায় কার্যক্রম শুরু করে। তারপর থেকে ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা তাদের দখলকৃত এলাকাতেই অবস্থান। করতে থাকে এবং মুক্তভূমিতে পাহারা দিতে থাকে।
শিক্ষণীয় বিষয়গুলাে বেলােনিয়ার যুদ্ধ থেকে নিমােক্ত শিক্ষাগুলাে গ্রহণ করা যেতে পারে: ১. একটি বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ কমপক্ষে সেকশন পর্যায়ে সাফল্য অর্জনে  সহায়তা করে। ২. প্রতিকূল আবহাওয়া শত্রুর অগােচরে প্রবেশকারী সৈনিকদের আকস্মিকতা অর্জনে সহযােগিতা প্রদান করে। ৩. অগােচরে অনুপ্রবেশ প্রতিহত করার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনে অবশ্যই একটি মজবুত সংরক্ষিত দল রাখা উচিত। ৪. পদাতিক বাহিনীর পারস্পরিক সহযােগিতার লক্ষ্য রেখে প্রতিরক্ষা নেয়া উচিত। প্রতিরক্ষা অবস্থানে কোনাে বড় ফাকা জায়গা থাকলে তা আক্রমণাত্মক টহল দলের মাধ্যমে লক্ষ্য রাখা উচিত। ৫. যে-কোনাে যুদ্ধে জনসাধারণের সহযােগিতা অপরিহার্য। ৬, যুদ্ধক্ষেত্র যে-কোনাে অভিনব রণকৌশল জয়লাভে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে ।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!