You dont have javascript enabled! Please enable it!
ফেনীর প্রাথমিক যুদ্ধ
২৬ মার্চের পর পরই ফেনী চলে যায় পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে। এর মাঝেও এপ্রিলের প্রথম ভাগে নােয়াখালীর ফেনী শহরে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল। এ বাহিনী গঠিত হয় বেঙ্গল ও ইপিআর বাহিনীর সৈনিক, পুলিশ, আনসার, ছাত্র এমনকি সাধারণ মানুষের দ্বারা। তাদের কাছে অস্ত্র বলতে ছিল শুধু রাইফেল ও বন্দুক। এ ছাড়া বর্শা, বল্লম ও লাঠিসোটা। এসব হালকা অস্ত্র সম্বল করে তারা জেনেশুনে শক্রর কামান, মটার আর মেশিনগানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল। মুক্তিবাহিনী প্রস্তুতি নেবার জন্য বেশি সময় পায়নি। এপ্রিলের প্রথম দিকেই পাকিস্তানি সৈন্যের একটি দল ফেনী শহর দখল করার জন্য কুমিল্লা সেনানিবাস হতে মার্চ করে এগিয়ে এলাে। কিন্তু কাজটাকে তাদের যতটা সহজ মনে করছিল, তা ছিল ভুল এবং কার্যক্ষেত্রে সেটা প্রমাণিত হয়ে গেল। পাকিস্তানি বাহিনী ফেনী শহরে প্রবেশ করার পূর্বেই মুক্তিবাহিনী তাদের পথ রােধ করে দাঁড়ালাে। মুক্তিবাহিনীর লক্ষ্য ছিল, নিজেদের আড়ালে রেখে নানা দিক দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে শত্রুপক্ষকে অস্থির করে তােলা। কিন্তু প্রথম মােকাবিলায় জয় পরাজয় চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হলাে না। পাকিস্তানি বাহিনী বুঝতে পারলাে, দুর্ধর্ষ মুক্তিবাহিনীর সাথে জয়লাভ করা সহজ কথা নয়। এ সত্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ওরা তখনকার মতাে স্থলপথে আক্রমণের কাজটি স্থগিত রাখে।
বেলােনিয়ার প্রথম যুদ্ধ
ভূমিকা
একাত্তরের মে মাসের শেষ ভাগে দেশের অভ্যন্তরে অভিযান পরিচালনাকারী মুক্তিবাহিনীর বেশির ভাগ সংগঠনগুলাে পাকিস্তানিদের প্রবল আক্রমণের মুখে আন্তর্জাতিক সীমারেখা অতিক্রম করে ভারতে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী রাজনৈতিক নেতারা এবং মুক্তিবাহিনীর ওপরস্থ কর্মকর্তারা স্বদেশের কিছু অংশ স্বাধীন বাংলার প্রতীক এবং মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করার জন্য শত্রুমুক্ত রাখার প্রয়ােজনীয়তায় বেলােনিয়াকে সবচেয়ে উপযােগী ভূখণ্ড হিসেবে নির্বাচিত করেন। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, তিন দিকে ভারত পরিবেষ্টিত এ ভূখণ্ডটির দক্ষিণ ভাগে একটি শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থানই ২৬ কিলােমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১০ কিলােমিটার প্রস্থ অংশটি শত্রুমুক্ত রাখার পক্ষে যথেষ্ট। এভাবেই দেশের এ অংশটিকে কেন্দ্র করে যুদ্ধের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি শুরু হয়। যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান পরিচিতি বাংলাদেশের পূর্ব-দক্ষিণে আন্তর্জাতিক সীমারেখা বরাবর একটি অংশ অনেকটা স্ফীত হয়ে ভারতে প্রবেশ করে আছে। ফেনী থেকে সােজা উত্তরে অনেকটা মােজার ন্যায় স্ফীত এ অংশটিকেই বলা হয় বেলােনিয়া। দেশের এ অংশটি উত্তর দক্ষিণে প্রায় ২৬ কিলােমিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ১০ কিলােমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত। মুহুরী নদী এ এলাকাকে প্রায় সমান দুভাগে ভাগ করে উত্তর হতে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়েছে। দুটি পাকা রাস্তা ফেনী ও ছাগলনাইয়া থেকে উত্তরে এসে পরশুরামে মিলিত হয়ে বেলােনিয়া পর্যন্ত চলে গেছে। ফেনী। হতে বেলােনিয়া পর্যন্ত মিটার গেজ রেললাইনও রয়েছে।
যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বেলােনিয়ার গুরুত্ব ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘােষণার পর পরই বেলােনিয়ায় বিভিন্ন সীমান্ত ফাঁড়ির ইপিআর-এর বাঙালি সৈনিকেরা বিদ্রোহ করে এবং অবাঙালি সৈন্যদের সরিয়ে দেয়। এরপর তারা ফেনীতে একটি কোম্পানিতে সংঘবদ্ধ হয়। এরই মধ্যে ১জন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে একটি কমান্ডাে প্লাটুনকে রণকৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ বেলােনিয়ার ভূখণ্ডের ছাগলনাইয়া থানার শুভপুর ব্রিজ পাহারায় রেখে যায়। এ ছাগলনাইয়া সংকীর্ণ ভূখণ্ডের মাধ্যমে চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের মূল। ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত করেছে। ফেনীতে সংগঠিত ঐ ইপিআর কোম্পানি ৩১ মার্চ শুভপুর ব্রিজে আক্রমণ করে এবং ক্যাপ্টেন এনামুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে আনসার, মুজাহিদ, অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক অসামরিক স্বেচ্ছাসেবক এবং ছুটিতে থাকা সৈনিকদের নিয়ে একটি সম্মিলিত বাহিনী গড়ে তােলে। | এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত এ দুই বাহিনীর একত্র শক্তি ফেনীকে শত্রুমুক্ত রাখে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা বিভিন্ন ভবনের ওপর শােভা বর্ধন। করতে থাকে। এরপর পাকিস্তানি বাহিনী তাদের প্রধান সাপ্লাই পথকে হস্তক্ষেপমুক্ত এবং কুমিল্লা-চট্টগ্রামের মধ্যে যােগাযােগ রক্ষার্থে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে ফেনী দখল করে। এপ্রিলের প্রথম থেকেই ছাগলনাইয়ায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম অত্যন্ত সফলতার সাথে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র বাহিনী দিয়েও শত্রুকে প্রতিহত করেন। সেক্টর অধিনায়ক মেজর খালেদ মােশাররফ ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে এ অঞ্চলের দায়িত্ব দেন।
এ সময় শত্রুরা ফেনীতে সুদৃঢ় অবস্থান নেয় এবং বেলােনিয়ার নিয়ন্ত্রণ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। একইভাবে দেশের স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে এ ভূখণ্ডটিকে শত্রুমুক্ত রাখাও মুক্তিবাহিনীর জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে। সংগঠন বেলােনিয়া ভূখণ্ডের প্রথম যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী উভয়পক্ষের সংগঠন নিম্নরূপ: ১. মুক্তিবাহিনী: হরিণা হতে ৩টি নিয়মিত কোম্পানি, মেলাগড় হতে মেজর আমিনুল হকের নেতৃত্বে ৪টি নিয়মিত কোম্পানি এবং মর্টার প্লাটুন বেলােনিয়ার প্রথম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। পাকিস্তানি বাহিনী: আনুমানিক ১টি ব্রিগেড, ১টি হেলিবর্ন কমান্ডাে কোম্পানি, ১টি ট্যাংক টুপ এবং কয়েকটি গানবােট এ প্রথম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং ১টি আর্টিলারি রেজিমেন্ট ব্যাটারি এদের প্রত্যক্ষ ফায়ার সাপােট প্রদান করে। মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান বেলােনিয়ার 
এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে ফেনী পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে চলে গেলে মুক্তিবাহিনী ছােট ছােট দলে অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মূলত বেলােনিয়া, ছাগলনাইয়া, শুভপুর, চট্টগ্রাম এলাকার রেইড, অ্যামবুশ ইত্যাদি খণ্ডযুদ্ধের মাধ্যমে শত্রু পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। অপরদিকে মেজর খালেদের বাহিনী মূলত ঢাকা, কুমিল্লা, নােয়াখালী জেলায় তাদের যুদ্ধ কার্যক্রম পরিচালনা করার পাশাপাশি বেলােনিয়াতেও যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। এদিকে শত্রু ফেনী দখল করার পর তাদের মূল লক্ষ্য থাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম যােগাযােগ নিরাপদ রাখা। প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩টি কোম্পানি চান্দগাজীর কিছু দক্ষিণ দিয়ে বেলােনিয়ার পূর্ব সীমান্ত অতিক্রম করে প্রবেশ করে এবং আন্তর্জাতিক সীমানা হতে মুহুরী নদী পর্যন্ত ৩টি কোম্পানিই সামনে রেখে দক্ষিণমুখী হয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। এ প্রতিরক্ষার লাইনে মুহুরী নদীর কাছের কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন অলি আহমদ। মধ্যবর্তী কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মাহফুজুর রহমান এবং সর্বামে সীমান্তবর্তী কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান।  ঐ একই সময়ে মেজর আমিনুল হকের নেতৃত্বে নােয়াপুর ও জামুরা হয়ে বেলােনিয়ার পশ্চিমে সীমান্ত অতিক্রম করে মুহুরী নদীর পশ্চিম তীর হতে আন্তর্জাতিক সীমারেখা পর্যন্ত বিস্তৃত তিন কোম্পানি সামনে রেখে এবং এক কোম্পানি গভীরে বা পেছনে রেখে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে।
এ অবস্থানের সীমান্তবর্তী কোম্পানির দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন গাফফার হালদার, মাঝের কোম্পানির দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম, মুহুরীর তীরবর্তী কোম্পানির দায়িত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট ইমাম-উজ-জামান ও পেছনের কোম্পানির দায়িত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম চৌধুরী এবং এই পেছনের কোম্পানির সাথেই ছিল মর্টার প্লাটুন। এ সেক্টরের সার্বিক দায়িত্বপ্রাপ্ত মেজর আমিনুল তার কমান্ড পােস্ট বা আদেশ চৌকি মুন্সিরহাটে স্থাপন করেন। ৩ জুনের মধ্যে প্রতিরক্ষা সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয়। যুদ্ধের বর্ণনা ৪ জুন পাকিস্তানিরা বেলােনিয়ার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হয়ে বন্দুয়া দৌলতপুর ও ছাগলনাইয়া হতে উত্তরের রাস্তা অনুসরণ করে আক্রমণ রচনা করে। এ সময়ে শত্রু তাদের এ আক্রমণে হয়তাে দুর্বল প্রতিরােধ আশা। করেছিল কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তারা মুক্তিবাহিনীর সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। এ সময়ই প্রতিরক্ষা সম্মুখে ফায়ার শুরু হয়। শত্রু
পক্ষের ৬০-৭০জন সেনা নিহত হয়। পাকিস্তানিরা অনুমান করতে পারে, এটা কোনাে গেরিলারা তৈরি করেছে। যা হােক ৭ জুন প্রথম আলােয় পাকিস্তানি সেনা ঐ দুই অক্ষে পুনরায় অগ্রাভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু একইভাবে এবারও তারা মুক্তিবাহিনীর ফায়ারের মধ্যে পড়ে এবং অত্যন্ত সফলতার সাথে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনার আক্রমণ প্রতিহত করে। এতে প্রায় ৫০-৬০জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। 
৯ জুন শত্রু তাদের রণকৌশলে পরিবর্তন এনে ছােট ছােট দলে পুরাে প্রতিরক্ষার সম্মুখভাগ দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়। শত্রুর এ অভিযানকালে ১টি আর্টিলারি রেজিমেন্ট ফায়ার সাপাের্ট প্রদান করে। এ অভিযান মুক্তিবাহিনী। সফলতার সাথে ব্যর্থ করে দেয়। এ সময় প্রতিরক্ষার সম্মুখ দুই প্রতিরক্ষা অবস্থানের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গায় মাইন লাগানাের প্রয়ােজনীয়তা অনুভূত হয়। পরবর্তী ৩-৪দিন ধরে প্রতিরক্ষার সম্মুখভাগেও পাশে মাইন ফিল্ড স্থাপন করা পাকিস্তানিরা পুনরায় ১১ জুন প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর আক্রমণ রচনা করে এবং পূর্বের ন্যায় এবারও মুক্তিবাহিনী শত্রু আক্রমণ প্রতিহত করে।  এবারও শক্রসেনাদের অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে। এভাবে প্রায় ১১ বার শত্রু | প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ চালিয়েও তেমন কোনাে সাফল্য অর্জন করতে | পারেনি। দিনরাত তারা অনবরত প্রতিরক্ষা অবস্থানে আর্টিলারি গােলাবর্ষণ করতে থাকে। অবশেষে তারা উপলব্ধি করতে পারে, এ প্রতিরক্ষা অবস্থান সাধারণ আক্রমণে, দখলে নেয়া সম্ভব নয়। এদিকে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা জানতে পারে, বেলােনিয়া তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। এটা জানার পর ইয়াহিয়া খান তার ভ্রমণের তারিখ পরিবর্তন করেন এবং তার চিফ অব স্টাফ জেনারেল আব্দুল হামিদ খানকে ফেনীতে পাঠান ২১ জুনের মধ্যে বেলােনিয়া দখল করার জন্য। মূল যুদ্ধের বর্ণনা ১৯ জুনের পর যুদ্ধ কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসে। শত্রু মাঝেমধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে প্রতিরক্ষা অবস্থানে আর্টিলারি গােলাবর্ষণ করতে থাকে। ঘটনাক্রমে ২১ জুন। প্রতিরক্ষা অবস্থানে মুক্তিযােদ্ধাদের মাঝে একটি খবর ছড়িয়ে পড়ে যে কর্নেল  ওসমানী মুক্তিবাহিনীর সাথে সাক্ষাতের জন্য হেলিকপ্টারে বেলােনিয়া আসবেন। সারাদিন পার হয়ে গেলেও পরিদর্শন হয় না।
এদিকে প্রতিরক্ষা অবস্থানে যখন সান্ধ্যকালীন স্ট্যান্ড টু চলছিল হঠাৎ দেখা গেলাে, ৩টি হেলিকপ্টার দক্ষিণ দিক থেকে অর্থাৎ ফেনীর দিক থেকে উড়ে আসছে। মুক্তিযােদ্ধাদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। এরই মধ্যে হেলিকপ্টারগুলাে প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর দিয়ে আনুমানিক ৫০০ গজ পেছনে অবতরণ করে এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্রান্ত্রের। ফায়ারের শব্দ শােনা যায়। তখন পরিষ্কার বােঝা যায়, শত্রু হেলিকপ্টারের সাহায্যে প্রতিরক্ষার পেছনে অবতরণ করেছে। পাকিস্তানি বাহিনী নামিয়ে যখন হেলিকপ্টার ফেরত যাচ্ছিল, তখন প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে ফায়ার করলেও অনেক ওপরে থাকার কারণে ফায়ার কার্যকরী করা সম্ভব হয়নি। ২০ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে আবারও হেলিকপ্টার। ৩টি প্রতিরক্ষার অবস্থানের দিকে উড়ে আসে এবং একইভাবে প্রতিরক্ষার পেছনে শত্রুর হেলিবর্ন ট্রুপস নামিয়ে দিয়ে আবারও অনেক উচু দিয়ে উড়ে যায়। এরই মধ্যে প্রতিরক্ষার অবস্থান থেকে শত্রু সেনাদের দিকে ফায়ার করা হয়। কিন্তু অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় তার ফলাফল অনুধাবন করা যায়নি। এ সময়ে। মুক্তিবাহিনীর মধ্যে সন্দেহ ও ভীতির সৃষ্টি হয়। এদিকে সেক্টর অধিনায়কদের এ পরিস্থিতি জানানাে হলে তারা প্রতিরক্ষার কিছু সৈন্য পেছন দিকে ফিরে অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দেন এবং সে অনুযায়ী প্রতিরক্ষা অবস্থান সমন্বয় করা হয়। মাঝে মাঝে উভয় পক্ষের মধ্যে বিক্ষিপ্ত গােলাগুলি চলতে থাকে। আনুমানিক রাত ৮টার দিকে ক্যাপ্টেন গাফফারের কোম্পানির ওপর শক্র আক্রমণ করে। এবং রাত ৯টার দিকে পেছনের কোম্পানি পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়। মর্টার প্লাটুনও এ সময় পশ্চাদপসরণ করে প্রায় অসংগঠিতভাবে।
এদিকে সাড়ে ৮টার দিকে সামনের কোম্পানিগুলাের প্রশাসনিক এলাকাও শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়। ক্যাপ্টেন গাফফারের কোম্পানি সদর এবং মেজর আমিনুল হকের কমান্ড পােস্ট শক্র আক্রমণ করে। শক্র প্রতিরক্ষায় ব্যবহৃত গােলাবারুদ বহনকারী একটি গরুর গাড়ি দখল করে নেয়। রাত আনুমানিক ১২টার দিকে প্রতিরক্ষা অবস্থানে শত্রুর গােলাবর্ষণ শুরু হয়। এ সময় সাের্স কর্তৃক শক্রর বিশাল রণবহর ট্যাংক ও আর্টিলারিসহ অগ্রাভিযানের প্রস্তুতির খবর। পাওয়া যায়। সমস্ত পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে দেওয়ার। আদেশ দেওয়া হয়। রাত আনুমানিক ২টার সময় পশ্চাদপসরণের আদেশ দেওয়া হয়। দৈবক্রমে একই সময়ে শত্রুর হেলিকপ্টারযােগে আগত সেনারা। রক্ষণাত্মক অবস্থান নিতে শুরু করে। পশ্চাদপসরণ ছােট ছােট দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন রাস্তা অনুসরণ করে সম্পাদন করা হয়। ফুলগাজী-পরশুরামে দ্বিতীয় দফায় প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণের লক্ষ্যে ক্যাপ্টেন গাফফারের কোম্পানি রেললাইন অনুসরণ করে, ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের কোম্পানি গ্রামের রাস্তা অনুসরণ করে এবং লেফটেন্যান্ট ইমাম-উজজামানের কোম্পানি মুহুরী নদীর বাঁধ অনুসরণ করে পশ্চাদপসরণ শুরু করে।
সময় বিক্ষিপ্তভাবে শক্রর সাথে গুলিবিনিময় হলেও প্রথম আলাের আগেই একটি প্লাটুন ছাড়া সবাই নিরাপদে শত্রুর কমান্ডাে বাহিনীর পেছনে চলে আসতে সমর্থ হয়। এদিকে ক্যাপ্টেন গাফফারের কোম্পানির যে প্লাটুন নােয়াপুরে লেফটেন্যান্ট শহিদুলের দায়িত্বে প্রতিরক্ষায় ছিল, তারা পশ্চাদপসরণ সম্পর্কে জানতে পারেনি। সে জন্য তখনাে তারা প্রতিরক্ষা অবস্থানেই থেকে যায়। পরদিন ভোের ৫টার সময় পাকিস্তানি বাহিনীর আনুমানিক ১টি ব্রিগেড ট্যাংকের সহায়তা এবং মুহুরী নদীতে গানবােট নিয়ে মুক্তিবাহিনীর ছেড়ে যাওয়া প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ করে এবং শুধু লেফটেন্যান্ট শহিদুল ইসলামের কোম্পানি ব্যতীত সমগ্র প্রতিরক্ষা অবস্থান দখল করে নেয়। এ সময় লেফটেন্যান্ট শহিদুলের প্লাটুন সাহসিকতা ও বীরত্বের সাথে শত্রুর প্রবল গােলাবর্ষণ সত্ত্বেও আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে। শেষ অবধি শত্রুর ১টি রকেট লঞ্চারের গােলা প্লাটুনের মধ্যস্থিত এমজি বাংকারে আঘাত হানলে সবাই পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়। এ সময় তারা। ঐ এমজিটি পুকুরে ডুবিয়ে রেখে আসে, যাতে তা শত্রুর হস্তগত না হয়।  পরদিন রাতে অসীম সাহসী একজন সৈন্য ওই এমজিটি শত্রুর অবস্থানে প্রবেশ করে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়। সকাল আনুমানিক ১০টার সময় মুক্তিযােদ্ধারা ফুলগাজী ব্রিজের উত্তরে চলে আসে।
হতাহতদের ট্রেনের ১টি বগিতে করে পেছনে প্রেরণ করা হয়। এ সময় প্রয়ােজনীয় অন্যান্য সামগ্রীর সাথে কিছু ভারী অস্ত্র গাড়িতে করে নিয়ে আসা হলেও প্রচুর পরিমাণে গােলাবারুদ প্রতিরক্ষা অবস্থানে ফেলে আসতে হয়, যার বেশির ভাগই শত্রুর হাত থেকে রক্ষার্থে পুকুর, নদীনালায় নিক্ষেপ করা হয়। অধিনায়ক মেজর খালেদ মােশাররফ এ সময় সব কোম্পানি অধিনায়কদের নিয়ে আদেশ দল গঠন করে পরশুরামের অল্প দক্ষিণেই পূর্ব-পশ্চিমে আন্তর্জাতিক সীমানা বরাবর প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণের নির্দেশ দেন; যাতে কমপক্ষে বেলােনিয়ার উত্তরাংশ শত্রুমুক্ত রাখা যায়। আদেশ পাওয়ার পর পরই ক্যাপ্টেন গাফফার ও লেফটেন্যান্ট ইমাম-উজ-জামান তাদের কোম্পানি নিয়ে চিথলীয়া ও সাতকুচিয়ায় শত্রুর অগ্রাভিযান বাধা দিতে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেবার জন্য রওয়ানা হন। দুপুর ১টার মধ্যে তারা নিজ নিজ অবস্থানে পৌছে খননকার্য শুরু করার জন্য প্রস্তুতি নেন। | লেফটেন্যান্ট ইমাম-উজ-জামানের কোম্পানি অস্ত্র স্থাপন করা শেষ করে খনন শুরু করতেই অগ্রবর্তী দল কালীর বাজার পর্যন্ত চলে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শক্রর ২টি হেলিকপ্টার দক্ষিণ থেকে সৈন্য এনে অগ্রবর্তী দলের শক্তি বৃদ্ধি করে। লেফটেন্যান্ট ইমাম-উজ-জামানের কোম্পানি এ সময় দ্রুত প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করার প্রচেষ্টা চালায়।
কিছুক্ষণ পর লেফটেন্যান্ট ইমামউজ-জামানের কোম্পানির ওপর কাপ্তানবাজার এলাকা হতে শত্রু আক্রমণ করে। অবস্থা প্রতিকূলে দেখে তিনি ছােট ছােট দলে পশ্চাদপসরণ শুরু করেন। এ সময় শক্র পাশ থেকে এবং পেছন থেকে গুলি করতে শুরু করে এবং মটার। ও রকেট লঞ্চারের গােলাও চারপাশে এসে পড়তে থাকে। বেশ কিছু শত্রুর মােকাবিলা করে লেফটেন্যান্ট ইমাম-উজ-জামান তার কোম্পানি নিয়ে গুতমার দিকে অগ্রসর হন। সেখানেও শত্রু তাকে অনুসরণ করে এবং শেষ পর্যন্ত সীমান্ত অতিক্রম করে শেষ আলাের আগেই ভারতে পৌছে যান। এদিকে চিতলিয়ায় ক্যাপ্টেন গাফফারের কোম্পানির ওপরও দুই দিক থেকে শক্র আক্রমণ করে। রেললাইনের বাধকে ব্যবহার করে তার কোম্পানি পরশুরামের দিকে পশ্চাদপসরণ করে। সেখানেও শক্র কর্তৃক আক্রান্ত হলে ছােট ছােট দলে সীমানা অতিক্রম করে ভারতে অবস্থান নেয়। সেদিন সন্ধ্যায় বিভিন্ন। দলের খোঁজ না মিললেও পরদিন সকালেই পুনরায় কোম্পানিগুলাে সংগঠিত করা হয়। এদিকে ঐদিন সকালের মধ্যে পাকিস্তানিরা বেলােনিয়া চেকপােস্ট পর্যন্ত অগ্রসর হতে সমর্থ হয়।
এভাবেই বেলােনিয়া প্রথম যুদ্ধ শেষ হয় এবং পাকিস্তানি বাহিনী ১৫ বালুচ রেজিমেন্ট এবং এপকাফের এক ব্যাটালিয়ন সৈন্যের মাধ্যমে বেলােনিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। উভয় পক্ষের হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ। বেলােনিয়ার প্রথম যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধারা যথেষ্ট সফলতা অর্জন করে। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় দেড় শতাধিক সৈন্য মৃত্যুবরণ করে। ২১ জুনএর পরবর্তী সময়ে পশ্চাদপসরণকালে মুক্তিযােদ্ধাদের অল্প কিছুসংখ্যক সৈন্য। হতাহত হয় এবং উল্লেখযােগ্য পরিমাণে গােলাবারুদ প্রতিরক্ষা অবস্থানে এবং আশপাশের পুকুর ডােবায় ফেলে আসতে বাধ্য হয়। উপসংহার স্বাধীতা যুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম এ বেলােনিয়ার প্রথম যুদ্ধ যদিও এতে শত্রুর কাছে মুক্তিযােদ্ধারা পরাজয় মানতে বাধ্য হন, তথাপি এর মাধ্যমে প্রাপ্ত শিক্ষা পরবর্তী সময় অন্যান্য যুদ্ধে সফলভাবে প্রয়ােগে সমর্থ হন। বেলােনিয়ার এ যুদ্ধ। আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। (বেলােনিয়ার প্রথম যুদ্ধের নকশাটি দেখুন ৮৬৩ পাতায়)

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!