মেহের নাওড়ার যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত শাহরাস্তি থানায় শাহরাস্তি পৌরসভায় নাওড়ার অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে পাকিস্তানিরা কুমিল্লা থেকে এসে রাতে নাওড়া হাইস্কুলে অবস্থান নেয়। বাঁশের খুঁটির ওপর টিনের ঘর, ভাঙা বেড়ার পাশে একটি দিঘি এবং দিঘির পাড়ে ১টি মঠ আছে। পাকিস্তানিরা স্কুল ও মঠে আশ্রয় নেয়। পাকিস্তানিদের উপস্থিতির খবর পেয়ে সর্বপ্রথম মিত্রবাহিনী তাদের আক্রমণ করে। উভয় পক্ষে রাতভর লড়াই হয়। মিত্রবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানিরা দিঘি ও মঠের ভেতর আশ্রয় নেয়। মিত্রবাহিনীর সাথে কিছুসংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা। মিলে মেহের রেলরাস্তার অপর দিক থেকে পাকিস্তানিদের ঘেরাও করে ফেলে। | ১০ ডিসেম্বর সূচিপাড়ায় অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধারা এ সংবাদ পেয়ে যান। সংবাদ পাবার সাথে সাথে ১০জনের ১টি দল হাবিলদার রশিদের নেতৃত্বে প্রাণপণ দৌড়ে নাওড়ায় চলে আসে। মেহের কালীবাড়ির কাছে আসার পর ২১জন তাদের সাহায্যের জন্য দৌড়ে চলে আসে। মেহের আসার পর জনগণ তাদের মঠের অবস্থান দেখিয়ে দেয়। মুক্তিযােদ্ধারা নাওড়ার মঠের পেছনে ঠাকুরবাড়িতে অবস্থান নেন। ২জন। অবস্থান নেন ঠাকুরবাড়ির বাগানের ভেতর পুকুরপাড়ে কাঠালগাছের গােড়ায় ।
নাওড়ায় পৌছার আগেই মিত্রবাহিনীর সাথে পাকিস্তানিদের আরেক দফা যুদ্ধ হয়। মিত্রবাহিনী বুঝেছিল, পাকিস্তানিদের গােলাবারুদ শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই তাদের আত্মসমর্পণ করার চেষ্টায় মিত্রবাহিনী মঠের কাছে পৌছলে পাকিস্তানিরা মঠ থেকে মিত্রবাহিনীর উদ্দেশ্যে ব্রাশফায়ার করে। তাদের কৌশলগত আক্রমণে সেখানেই মিত্রবাহিনীর ৬-৭জন সৈনিক শহিদ হন। এ অবস্থায় মিত্রবাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে পাকিস্তানিদের ছেড়ে দিয়ে মেহের রেল স্টেশনে চলে যায়। এবার মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের ওপর রাস্তার উত্তর পাশ থেকে ছাদের গ্রুপ এবং দক্ষিণ পাশ থেকে সুবেদার পাঠানের দল আক্রমণ শুরু করে। দীর্ঘ ৮ ঘণ্টা যুদ্ধের পর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। পাকিস্তানিরা এরপর কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এবার তাদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে তারা মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে বলে জানায়। সন্ধ্যায় মিত্রবাহিনী আসার পর তাদের কাছে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করে। এ সংঘর্ষে আনুমানিক ৭০জন পাকিস্তানি আত্মসমর্পণ করে। আনুমানিক ৭জন মিত্রবাহিনীর সৈন্য শহিদ হন। পাকিস্তানিদের আনুমানিক ১৩জন মারা যায়।
ফুলচোয়ার যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলায় হাজীগঞ্জ থানার অন্তর্গত ২ নম্বর রাজারগাঁও (দক্ষিণ) ইউনিয়নে ফুলচোয়ার অবস্থান। ফুলচোয়ায় অবস্থানরত পাকিস্তানিদের হটিয়ে দেওয়ার জন্য মুক্তিযােদ্ধারা যুদ্ধের একটি পরিকল্পনা করেন। এ যুদ্ধে উল্লেখযােগ্যসংখ্যক পাকিস্তানি মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ১০ ডিসেম্বর সকাল আনুমানিক ৭টায় একদল পাকিস্তানি কুমিল্লা। সেনানিবাস থেকে ক্যাপ্টেন অনিক নেওয়াজের নেতৃত্বে সিমলা, বােরখাল হয়ে ফুলচোয়া চলে আসে। তারা মুক্তিযােদ্ধাদের ভয়ে বাড়িঘরের আশপাশে না এসে ফুলচোয়া খােলা ফসলের মাঠের মধ্য দিয়ে যায়। এ অবস্থায় মুক্তিযােদ্ধা আবুল কালাম আজাদ ১১জন সহযােদ্ধাকে নিয়ে পাকিস্তানিদের ঘিরে ফেলেন। সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধারা হলেন: রুহুল আমিন মাওলানা, আবুল খায়ের নিয়াজি, শাহজাহান মাস্টার, শহিদউল্লাহ বকাউল, শুকরুল আলম, এমদাদুল হক পাটোয়ারী, মােখলেছুর রহমান, সামছুল আলম, জয়নাল আবেদীন, জাহাঙ্গীর পাটোয়ারী প্রমুখ। সেখানে পরে অন্য মুক্তিযােদ্ধারাও তাদের সাথে যােগদান করেন।
পাকিস্তানিরা ফুলচোয়া গ্রামের ফাজিলউদ্দিন পণ্ডিত সাহেবের বাড়িতে মুক্তিযােদ্ধারা আছে বলে এলােপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে। পাকিস্তানিদের গুলিতে মুক্তিযােদ্ধা আবুল হােসেন শহিদ হন। এ অবস্থায় পাকিস্তানিদের সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচণ্ড লড়াই হয়। পাকিস্তানিরা কোণঠাসা হওয়ার পরও মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানিরা মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ না করায় মিত্রবাহিনীকে খবর দেওয়া হয়। বেলা আনুমানিক সাড়ে ১১টায় সুবেদার জহিরুল হক পাঠান ও মিত্রবাহিনী এলে আনুমানিক ৮০জন পাকিস্তানি আত্মসমর্পণ করে। এ যুদ্ধে ১জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন এবং ৬জন পাকিস্তানি ও ক্যাপ্টেন আনিক নেওয়াজ আহত হয়। এ ছাড়া ৪জন বেসামরিক লােক শহিদ হন।
নাগদার যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত মতলব থানার খাদেরগাঁও ইউনিয়নে নাগদা অবস্থিত। ১২ ডিসেম্বর হঠাৎ কুমিল্লা থেকে আগত পাকিস্তানিরা নাগদা এলাকায় গুলি করতে করতে প্রবেশ করে। এ খবর মুক্তিযােদ্ধাসহ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক সিরাজুল ইসলাম বকাউল, মুন্সিরহাট এলাকা থেকে অধিনায়ক সাইদুর রহমান (রতন), বহরী এলাকা থেকে অধিনায়ক নাছিরউদ্দিন। পাটোয়ারী, খিদিরপুর থেকে নূরুল ইসলাম এবং এনায়েত নগর থেকে অধিনায়ক শামছুল হক তালুকদার পাকিস্তানিদের চারদিক থেকে আক্রমণ করেন। প্রচণ্ড গােলাগুলির মধ্যে পাকিস্তানিরা পিছু হটে চাঁদপুরের দিকে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধা জসিম উদ্দিন দফাদার আহত এবং সহযােদ্ধা আজিজুর রহমান শহিদ হন।
চাঁদপুরের নৌ-কমান্ডাে অভিযানের ইতিকথা
প্রথমে জুলাই এবং পরবর্তী সময় আগস্ট মাসের মধ্যে গােটা বাংলাদেশকে যুদ্ধ পরিচালনার স্বার্থে ভৌগােলিক সীমারেখা দ্বারা ভাগ করা হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও সমুদ্র এলাকাকে তথা গােটা নৌ-অঞ্চলকে ১০ নম্বর সেক্টর হিসেবে ঘােষণা দেওয়া হয়। আমাদের নৌবাহিনীর কোনাে অফিসার না থাকায় ভারতীয় নৌবাহিনীর অফিসারদের তত্ত্বাবধানে ভারতের পশ্চিম বাংলার ভাগিরথী নদীর তীরে পলাশী নামক স্থানে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে একটি নৌ-কমান্ডাে প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করা হয়।
চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর এবং অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন নদীবন্দর ব্যবহারের অযােগ্য করে দেওয়ার জন্য অস্ত্র, গােলাবারুদ, সামরিক রসদ ও সরঞ্জাম। পরিবহনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জাহাজে লিমপেট মাইন দ্বারা আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পলাশির এ গােপনীয়তার সার্থে এ ক্যাম্পের সাংকেতিক নাম দেওয়া হয় C2P। পাকিস্তান নৌবাহিনী ফ্রান্স থেকে কেনা তার তৃতীয় ডেফনে ক্লাস (DAPHNE CLASS) সাবমেরিন আনার জন্য ভূমধ্যসাগরীয় ফরাসি পােতাশ্রয় ল্যতে পাঠায়। এ সাবমেরিনটির নাম ছিল পিএনএস ম্যাংগ্রো (PNS MANGRO)। এ নাবিকদের মধ্যে ১৩জন ছিলেন বাঙালি। এ বাঙালি নাবিকদের মধ্যে ৮জন পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। এঁরাও নৌ-কমান্ডাে ঘাঁটি C2P-তে ছিলেন। এঁরা হলেন ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার সৈয়দ মােশাররফ হােসেন, রেডিও আর্টিফিসার মাে. রহমত উল্লাহ, ইঞ্জিনিয়ার মেকানিক আহসান উল্লাহ, সাপ্লাই অ্যান্ড সেক্রেটারিয়েট বিভাগের স্টুয়ার্ড আবিদুর রহমান, ইলেকট্রিক্যাল মেকানিক আব্দুর রকিব। শিক্ষিত ও শারীরিকভাবে সমর্থ এ রকম ছেলেদের বিভিন্ন মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্প থেকে নির্বাচন করে পলাশি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণদানের জন্য আনা হয়। ২৭ মে থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ চলে।
পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ১৪ আগস্টকে প্রথম নৌ-অপারেশনের জন্য বেছে নেওয়া হয়। পরে একদিন পিছিয়ে ১৫ আগস্ট দিনটিকে নির্বাচিত করা হয়। চট্টগ্রাম, মংলা, চাঁদপুরের সমুদ্র ও নদীবন্দরগুলােকে ১৫ আগস্টের অপারেশনের জন্য নির্বাচন করা হয়। এ অপারেশনের স্থানীয় প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পিত থাকে আঞ্চলিক সেক্টর অধিনায়কদের ওপর। অপারেশনের প্রথম দিকে ৪জন সাবমেরিনার দলনেতা নির্বাচন করা হয়। তারা হলেন আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী, বদিউল আলম, আবিদুর রহমান এবং আব্দুর রকিব ভূঁইয়া। আব্দুর রকিব ভূঁইয়াকে দলনেতা করে বাংলাদেশের বিভিন্ন নৌবন্দরে পাঠানাে হয়। রহমতউল্লাহ মংলা-খুলনা এলাকার বিভিন্ন স্থানে নৌ-অপারেশনে অংশ নেন। আব্দুর রকিব মৃধা উত্তরবঙ্গের নৌবন্দরগুলাে অপারেশন করেন। তিনি। শহিদ হন ফুলছড়ি ঘাটে। চাঁদপুর অপারেশনে দ্বিতীয় পর্যায়ে আমিনুল্লাহ শেখ নৌ-অভিযানের নেতৃত্ব দেন। চাদপুর প্রথম অভিযানের নেতৃত্ব দেন বদিউল আলম। ১৫ আগস্টের প্রথম নৌ-কমান্ডাে অপারেশনে নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রামের আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী, নারায়ণগঞ্জে আবিদুর রহমান, চাঁদপুরে বদিউল আলম এবং মংলা-খুলনা এলাকায় আহসান উল্লাহ। পরে নৌ-কমান্ডােদের অভিযান সম্প্রসারিত হয় আরিচা, নগরবাড়ি, গােয়ালন্দ, দাউদকান্দি, আশুগঞ্জ, ভৈরব, সিলেট, ময়মনসিংহ, বরিশাল, টেকের হাট, ফুলছড়ি প্রভৃতি এলাকার নৌবন্দরগুলােয়। পলাশি থেকে নতুন নতুন কমান্ডাে দল পাঠানাে হয় সব নৌবন্দরগুলােকে লক্ষ্য করে। পলাশিতে প্রশিক্ষণ চলার সময় শেষ দিকে একসাথে গােপনে ফ্রান্স থেকে পালিয়ে আসা ৮জন সাবমেরিনারকেই বিশেষ বােয়িংয়ে করে নতুন দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয় বিশেষ।
নির্দেশ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। দিল্লিতে সামরিক বাহিনীর ১টি সুরক্ষিত কক্ষে তাদের এ বিশেষ গুরুত্ববাহী। নির্দেশ বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তাদেরকে হারানাে দিনের দুটি বাংলা গান বাজিয়ে শােনানাে হয়। প্রথম গানটির প্রথম চরণ ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে
শ্বশুরবাড়ি’ – সন্ধ্যা মুখােপাধ্যায়ের গান, দ্বিতীয় গানটি পঙ্কজ কুমার মল্লিক। কিংবা সায়গলের গাওয়া, ‘আমি তােমায় যত শুনিয়েছিলাম গান। এ গানগুলাে পর্যায়ক্রমে কয়েকবারই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাজিয়ে শােনানাে হলাে, যাতে গানের প্রথম কলি বহুদিন মনে থাকে। অনেকক্ষণ গান দুটি বাজিয়ে শােনানাের পর টেপ রেকর্ডার বন্ধ করা হয়। এবার মৌখিক নির্দেশ বুঝিয়ে দেওয়ার পালা, গান দুটির গুরুত্ব বােঝাতে গিয়ে বলা হলাে, এ গান শােনার ওপরই নির্ভর করবে অপারেশন জ্যাকপট কার্যক্রমের প্রস্তুতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন শুরু করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাসি বাহিনীর বিরুদ্ধে মিত্রবাহিনীর গােপন অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে এ রকম। সংগতি ব্যবহার করা হয়েছিল। ঐ সময় বিবিসি থেকে যন্ত্রচালিত গানের মর্মার্থ অনুসরণ করে ফ্রান্সের নর্মান্ডি সমুদ্রসৈকতে মিত্রবাহিনী অবতরণ করে ১৯৪৪ সালের ৬ জুন। দিল্লিতে ভারতীয় সমরবিদেরাও অনুরূপ সাংকেতিক সংগীত বেছে নিয়ে তা সবিস্তার বুঝিয়ে দিলেন মিত্রপক্ষের সাবমেরিনারদের। তাদের বলা হলাে, মূল অপারেশন শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগ থেকেই আকাশবাণীর সংগীত অনুষ্ঠানগুলাে নিয়মিত শুনতে হবে।
আকাশবাণীর কলকাতা খ কেন্দ্র থেকে প্রচারিত নিয়মিত গানের অনুষ্ঠান একটি বিশেষ সময়ে বাজানাে হবে। প্রথম গানটি ঠিক কয়টায় বাজানাে হবে, সে ব্যাপারে আগাম কোনাে তথ্য দেওয়া হলাে না। তবে নির্দেশ থাকল, প্রথম গানটি শােনার সাথে সাথেই অপারেশন শুরু করার যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে, এমনকি জীবন বিসর্জন দেওয়ার জন্য তৈরি থাকতে হবে। প্রথম গানটি শােনার পর দ্বিতীয় গানটি শােনার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। দ্বিতীয় গান বাজানাে হবে। এ বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম গানের ঠিক ২৪ ঘণ্টা পর। একই গান শােনার জন্য প্রয়ােজনীয় বেতারমাধ্যম ঠিক সময়মতােই দেওয়া হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হলাে। নির্দেশ থাকে, শেষ এ গানটি শােনার পর সাথে ট্রানজিস্টার রাখার প্রয়ােজনীয়তা ফুরিয়ে যাবে। তখন এটি ফেলে দিলেও চলবে। কিন্তু দ্বিতীয় অর্থাৎ শেষ গান শােনার সাথে সাথে শত্রুপক্ষের নির্ধারিত টার্গেটের ওপর। আঘাত হানার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিতে হবে এবং ঐদিন মধ্যরাতেই পরিস্থিতি যত প্রতিকূলই হােক, নির্দ্বিধায় পানিতে নামতে হবে। রাত ১টা থেকে এ অভিযান শুরু করার সময়সীমা নির্ধারিত। কাজেই শেষ। গান শােনার পর এ অভিযান শুরু করার প্রয়ােজনীয় সরঞ্জাম সাথে নিয়ে মূল অপারেশন শুরু করতে হবে। এর আগে টার্গেট নির্দিষ্ট করার কাজ সেরে রাখতে হবে দিনের আলােতেই প্রয়ােজনে অপারেশনে নামার আগে টার্গেটগুলাে দেখে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু অপারেশন থেকে পেছানাে যাবে না কোনােক্রমেই।
চাঁদপুর নৌ-বন্দরে কমান্ডাে অভিযান
মধ্য আগস্টে অপারেশন জ্যাকপটের আওতায় যে ৪টি প্রধান নৌবন্দরে অপারেশনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়, চাদপুর হলাে সেগুলাের মধ্যে অন্যতম। এর প্রধান কারণ হলাে, পাকিস্তানিদের এ নদীবন্দরে চলাচল স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হলে ফরিদপুর, কুমিল্লা, মুন্সিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা শত্রুপক্ষের অস্ত্রশস্ত্রের ও রসদ সরবরাহ ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত করে দেওয়া যাবে। পলাশির প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্যে ২০জনকে বাছাই করা হয় এ অপারেশনের জন্য। চাঁদপুর অপারেশনের অধিনায়ক নিয়ােগ করা হয় সাবমেরিনার বদিউল আলমকে। তাঁর নেতৃত্বে পুরাে দলকে পলাশি থেকে আগরতলার নিউ ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। এ ক্যাম্পে তাদের শেষবারের মতাে অপারেশন সংক্রান্ত পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেওয়া হয়। দলনায়কের হাতে সবার অগােচরে ১টি ছােট ট্রানজিস্টার দেওয়া হয়। সাথে দুটো সাংকেতিক গানের কথাও লিখে দেওয়া হয়। তাদেরকে হারানাে দিনের দুটি বাংলা গান বাজিয়ে শােনানাে হয়। প্রথম গানটির প্রথম চরণ ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি’-সন্ধ্যা মুখােপাধ্যায়ের গান, দ্বিতীয় গানটি পঙ্কজ কুমার মল্লিক কিংবা সায়গলের গাওয়া, ‘আমি তােমায় যত শুনিয়েছিলাম গান’। এ গানগুলাে পর্যায়ক্রমে কয়েকবারই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাজিয়ে শােনানাে হলাে, যাতে গানের প্রথম কলি বহুদিন মনে থাকে। অনেকক্ষণ গান দুটি বাজিয়ে শােনানাের পর টেপ রেকর্ডার বন্ধ করা হয়। এবার মৌখিক নির্দেশ বুঝিয়ে দেওয়ার পালা।
গান দুটির গুরুত্ব বােঝাতে গিয়ে বলা হলাে, এ গান শােনার ওপরই নির্ভর করবে অপারেশন জ্যাকপট কার্যক্রমের প্রস্তুতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। কারণ, প্রথম গান শােনার ঠিক ২৪ ঘণ্টা পর অপারেশন বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে। কিন্তু সময়মতাে গান শুনতে ব্যর্থ। হলে সব পরিকল্পনাই পণ্ড হয়ে যাবে। | ৭ আগস্ট দিনের আলাে ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই সাবমেরিনার বদিউলের নেতৃত্বে চাঁদপুর বন্দরের উদ্দেশ্যে ২০জন নৌ-কমান্ডাের দলটি সামগ্রিক সাজসরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্রসহ আগরতলার নিউক্যাম্প ত্যাগ করে। প্রত্যেকেই হালকা অস্ত্র, শুকনাে খাবার, অপারেশনের মূল বিস্ফোরক লিমপেট মাইন, সুইমিং কস্টিউম এবং সাঁতার কাটার ফিন বহন করেন।
৭ আগস্ট গভীর রাতেই নৌ-কমান্ডােরা তৈরি হয় সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার জন্য। পথে সহায়ক মুক্তিযােদ্ধা ও গ্রামবাসীদের সহায়তায় ময়নামতি পর্যন্ত নির্বিঘ্নেই এগিয়ে যায় নৌ-কমান্ডােরা। অতি সাবধানে সিঅ্যান্ডবি সড়ক অতিক্রম করেই জলাভূমিতে পৌছে যায়। সৌভাগ্যক্রমে জলাভূমিতেই নৌকা পাওয়া যায়। নৌকা দিয়ে বিলের ঐ পারে পৌছে ঐ রাতে গ্রামের এক বাড়িতে আত্মগােপন করে থাকে। পরদিন সন্ধ্যার পর চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে হাঁটা দেয়। সারারাত একটানা হেঁটে তারা পৌছে যায় সফরমালি নামক গ্রামে। এখানে তারা আশ্রয় নেয় ইব্রাহিম মাস্টার নামক একজনের বাড়িতে কমান্ডাে দলের ২জন সদস্য শাহজাহান কবির সাজু ও শামসুল কবির দুলু ইব্রাহিম মাস্টারের ছেলে। ফলে স্থানটি তাদের জন্য নিরাপদ বলেই মনে হয়। কিন্তু চাঁদপুরের মূল বন্দর এ গ্রাম থেকে খানিকটা দূরে। এত দূর থেকে ঐ বন্দরে রেকি করতে যাওয়া কিংবা অপারেশন চালানাে অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিপূর্ণ মনে হওয়ায় কমান্ডােরা স্থান পরিবর্তনে সিদ্ধান্ত নেয়। উপরন্তু ২০জন তরুণ একসঙ্গে থাকাও ঠিক হবে ভেবে তারা কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়। চাঁদপুর রেকি শেষ হওয়ার আগের দিনই দলের অধিনায়ক বদিউল আলম তার সাথের ট্রানজিস্টারে সন্ধ্যা মুখােপাধ্যায়ের প্রথম গান সম্প্রচারের মধ্য দিয়ে প্রস্তুতির প্রথম সংকেত পেয়ে যান। ২৪ ঘণ্টা পর দ্বিতীয় সংকেতও শােনা যাওয়ার কথা। এরপর দিনের বেলা রেকি করে রেকির সমস্ত তথ্যাবলি বিশ্লেষণ করে আরেকবার অপারেশনের পরিকল্পনা স্থির করা হয়। সবাই প্রস্তুত। ১৪ আগস্ট সকালে চাঁদপুর বন্দর রেকি করা হয়। রেকির তথ্যানুযায়ী বন্দরে মােট জাহাজের সংখ্যা ৬টি। ছােট-বড়াে এ জাহাজগুলাে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নােঙর করা আছে বন্দর এলাকায়।
বন্দরের ৬টি জাহাজের জন্য মােট ১৮জন। কমান্ডােকে প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দিয়ে প্রস্তুত করা হয়। বাকি ২জনকে রাখা হয় স্থলঘাটি পাহারায়। প্রতিটি জাহাজের জন্য ৩জনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রত্যেকেই ১টি করে মাইন জাহাজে ফিট করবেন এবং যার যার সুবিধামতাে মেঘনা নদীর মােহনা ধরে সাঁতরে যাবেন নদীর পাড়ের নির্দিষ্ট এক জায়গায়। সেখানে স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধারা তাদের জন্য ১টি নৌকা প্রস্তুত রাখবেন। ৬টি গ্রুপের একটি গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত হলেন দলনায়ক স্বয়ং। এ গ্রুপের অন্য ২জন সদস্য হলেন মমিনউল্লা পাটোয়ারী ও ফজলুল করিম। বলতে গেলে নেতৃত্ব পর্যায়ের ৩জনই রইলেন এ গ্রুপে, কারণ তাদের দায়দায়িত্ব কিছুটা বেশি ছিল। ১৫ আগস্ট সন্ধ্যার পর পরই কলকাতা কেন্দ্রের দ্বিতীয় গানটি ট্রানজিস্টারে ভেসে আসে ইথারে, আমি তােমায় যত শুনিয়েছিলাম গান’। গানের মাধ্যমে সংকেত পাবার পর সবাইকে শেষবারের মতাে প্রস্তুত হতে বলা হয় ১৮জন।
কমান্ডাে ৬টি ভাগে ভাগ হয়ে রওনা হয় বন্দরের দিকে। প্রত্যেকেই ১টি করে মাইন গামছায় পেটের সাথে বেঁধে অন্ধকারে এগিয়ে যান বন্দরের দিকে। সবার পরনে সুইমিং কস্টিউম। বগলে এক জোড়া করে ফিনস্। কোমরে ধারালাে ছুরি। লম্বা জেলেনৌকায় ডাকাতিয়ার পাড় ঘেঁষে এগিয়ে যায় তারা। পেছনে। ঘুমন্ত গ্রাম। সেটা ছিল ১৫ আগস্টের মধ্যরাত। জাহাজের সার্চ লাইটের আলাে ফেলা হচ্ছে চারদিকে। এ অবস্থার মধ্যে যার যার ফিন্স এটে নিঃশব্দে নেমে পড়ল পানিতে। প্রতি গ্রুপে ৩জন করে এগিয়ে যায় ৬টি জাহাজের দিকে। সমস্ত শরীর পানিতে ডুবিয়ে খুব দ্রুত এগােচ্ছে তারা। কেউ কেউ ভাসমান কচুরিপানায় মাথা আড়াল করে নেয়। আলাে আঁধারের প্রতিবন্ধকতায় ৩জন কমান্ডাের প্রথম দলটি একটি জাহাজের কাছাকাছি এসে নিঃশব্দে ৩টি নির্দিষ্ট স্থানে মাইন লাগিয়ে দেয়। এ সময়ে অন্য গ্রুপগুলােও যার যার টার্গেটে মাইন লাগিয়ে দেয়। দলনায়ক ও তাঁর দল নিজ জাহাজে মাইন লাগানাের পর অন্য জাহাজগুলােও হাতিয়ে পরীক্ষা করে দেখে নেন মাইন জাহাজের গায়ে বসেছে কি না। কমান্ডােরা এরপর জাহাজের শরীর ধরে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। কমান্ডােদের গ্রুপগুলাে তখন পরস্পর বিচ্ছিন্ন। ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে সমন্বিতভাবে পরামর্শ করার কোনাে সুযােগ নেই। যার যার কাজ শেষ করে বিচ্ছিন্নভাবে এগিয়ে যায় মােহনার দিকে। কিন্তু বন্দরের অদূরে মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মােহনায় যে বাঁক দিয়ে কমান্ডােরা ফিরে যাওয়ার কথা, ঠিক সেখানেই নােঙর ফেলে রকেট স্টিমার। সার্ভিসের জাহাজ গাজী।
গােলাবারুদ ও পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে এ জাহাজটি খুলনা থেকে এসেছে। নতুনভাবে বিপদে পড়ে কমান্ডােরা। আবার এদিকে মাইন ফেটে যাওয়ার পর পরই শুরু হবে গােলাগুলি। ততক্ষণ পানিতে থাকা নিরাপদ নয়। আবার সাতরে ওপারে যেতে হলে পাকিস্তানিদের নজর এড়িয়ে। যাওয়ার মতাে কোনাে উপায় নেই। প্রথম গ্রুপটি আপাতত একটি বার্জের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। কেউ কোনাে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এ অবস্থায় তাদের দিকে এগিয়ে আসে দলের আরও কিছু সদস্য। ঠিক এ সময় ১টি মাইন বিস্ফোরিত হলাে। তারপর কয়েকটি একসাথে বিস্ফোরিত হয়। সাথে সাথেই সার্চ লাইটের আলাে ফেলা হয়। পানিতে। সাথে শুরু হয় বৃষ্টির মতাে গােলাগুলি, এ অবস্থায় ১জন সাহসী। কমান্ডাে বুদ্ধি করে কচুরিপানার নিচে শরীর ডুবিয়ে ভাসতে ভাসতে ওপারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সৌভাগ্যক্রমে গাজী জাহাজের কেউই তার অবস্থান টের পায়নি। সবার অলক্ষ্যে সে নদীর ওপারে পৌঁছতে পারে। তার দেখাদেখি দলের বাকিরাও কচুরিপানার আড়াল নিয়ে ভাসতে শুরু করে। ততক্ষণে বাকি জাহাজগুলােও মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায়।
সৌভাগ্যক্রমে গাজী জাহাজটিও নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য নােঙর তুলে। পেছনের দিকে রওনা হয়। সেটা কমান্ডােদের পাড়ে পৌছানাের রাস্তা আরও সহজ করে দেয়। মাইল খানেক সাঁতরে যাওয়ার পর নদীর তীরে পৌছে সবাই ধানক্ষেতের আড়ালে আশ্রয় নেয়। ক্ষেতের পাশেই তাদের জন্য নৌকা থাকার কথা ছিল। কিন্তু তাদের দেরি দেখে নৌকা ফিরে যায়। দেখা গেল, প্রায় অর্ধেক এখনও পৌছেনি, এদিকে ভােরের আলাে ফুটতে শুরু করে। তাই ঝুঁকি না নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়, ঘাটে বাধা ১টি নৌকা দিয়ে তারা নিজ গন্তব্যে পালিয়ে যাবে। তড়িঘড়ি করে সবাইকে নৌকায় উঠতে দেখে গ্রামের মানুষ তাদের ডাকাত বলে সন্দেহ করে এবং সবাই চিৎকার শুরু করে দেয়। আসন্ন বিপদের কথা আঁচ পেয়ে সবাই অতিসত্বর পানিতে নেমে পড়ে। কিন্তু পানিতে নেমে দেখা যায় অন্য বিপদ। গ্রামবাসীদের চিৎকারে তটস্থ হয়ে ওঠে মেঘনায় ভাসমান ইলিশ ধরার জেলেনৌকাগুলাে। তারাও চিক্কারের দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে লক্ষ্য করে কমান্ডােদের নৌকাটিকে। জেলেনৌকাগুলাে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। কমান্ডােদের নেীকা। সবার হাতে উদ্যত বৈঠা। কারও কারও হাতে দা, কাচিও দেখা যায়। কমান্ডােদের নৌকাটিকে মাঝখানে রেখে এ বেষ্টনী খুব দ্রুত সংকুচিত হয়ে আসছে। এমন সময় কমান্ডােদের দলনায়ক বুদ্ধি করে কালাে রংয়ের ফিন্স টেনে বের করে তাক করে ধরেন সামনের দিকে। ফিন্স তাক করেই জেলেদের উদ্দেশ্যে বললেন যে, আর যদি কেউ সামনে এগােও তবে গুলিতে ঝাঝরা করে দেওয়া হবে। তার দেখাদেখি দলের বাকিরাও ফিন্স তাক করে ধরে।
তাদের এ বুদ্ধিতে কাজ হয়, জেলেদের সবাই ভয় পেয়ে যায়। ঠিক এ সময় দূরের বন্দর থেকে আরও ১টি মাইন বিস্ফোরিত হয়। এ শব্দে আরেক দফা চমকে ওঠে জেলেরা। কোনাে কথা না বলে পিছু হটা শুরু করে এক এক করে। অল্প সময়ের মধ্যেই অসংখ্য ডিঙি নৌকার পরিবেষ্টনী। পুনরায় প্রসারিত হয়ে একসময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় আগের অবস্থানে। শুধু ১জন তরুণ সাহস করে এসে তাদের সাথে পরিচিত হন এবং নিরাপদে তাদের কলমজোড়া গ্রামের কাছাকাছি একটি স্থানে পৌছে দেন। তাকে শেষবারের মতাে ধন্যবাদ জানিয়ে খুব দ্রুত তারা অদৃশ্য হয়ে যায় গ্রামের ভেতর। এদিকে দলের বাকিরা অপারেশন শেষে বিচ্ছিন্নভাবে ভেসে যায় ডাকাতিয়ার মােহনার দিকে। রকেট স্টিমার গাজী সরে যাওয়ার পর দ্রুত সাঁতার কেটে তারা বাকের দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে জোরপূর্বক ১টি নৌকা দখল করে তারা নিরাপদে পৌছে যায় সফরমালি গ্রামের দিকে। উপসংহার ১৯৭১ সাল, এটা নিছক একটি সাল নয়, বরং এটা হলাে বাঙালি জাতির বড়াে গৌরবের এক ইতিহাস।
এটা ছিল বিশ্বের মানচিত্রে নিজেদের স্থান করে নেওয়ার ইতিহাস, বাঙালি হিসেবে নিজেদের পরিচয় করে নেওয়ার ইতিহাস, একটি পতাকার ইতিহাস, একটি জাতির বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়ানাের ইতিহাস। এ ইতিহাস সৃষ্টির জন্য গােটা জাতিকে কম খেসারত দিতে হয়নি। বহু মা হারিয়েছে তার দামাল সন্তানকে, বহু বােন হারিয়েছে ভাইকে, বহু স্ত্রী হারিয়েছে স্বামীকে, সন্তান হারিয়েছে পিতাকে। এ ছাড়া লক্ষ লক্ষ সতীসাধ্বী। নারী হারিয়েছে সন্ত্রম। আজও অনুভূতির কান পেতে শুনলে শােনা যাবে, আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে প্রিয়জন হারানাের বিষাদ বাশির করুণ সুর। শত অশ্রুর বন্যা ও রক্তের স্রোত বেয়ে বাঙালি জাতি লাভ করেছে বিজয়। এ বিজয়ের পেছনে ছিল ৭ কোটি বাঙালির প্রেরণা ও উদ্দীপনা। তাই তাে অকুতােভয় বীর বাঙালি যােদ্ধারা মাতৃভূমির মর্যাদা রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। অসীম সাহস, দৃঢ় মনােবল, আত্মত্যাগ, নিষ্ঠা ও ন্যায়নীতিতে বলীয়ান হয়ে মুক্তিযােদ্ধা ও অগণিত বাঙালি সাধারণ জনতা কঁাধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন প্রাণপণ; অকাতরে হাসিমুখে বিলিয়ে দিয়েছেন জীবন। ফলে বাঙালি জাতিকে পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠী দাবিয়ে রাখতে পারেনি। পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নিয়মিত পাকিস্তানি সেনাদল। নিহত হয়েছে শত সহস্র এবং তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর লােকেরা এ ক্ষেত্রে চাঁদপুরবাসীও কম তিতিক্ষার পরিচয় দেয়নি। আর এভাবেই বঙ্গভূমিকে হিংস্র পাকিস্তানিদের কবল থেকে ছিনিয়ে এনেছে বঙ্গ সন্তানেরা। মাত্র নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিপীড়নমুক্ত হয়েছে বাঙালি জাতি এবং অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। পীড়ন করে কোনাে আগ্রাসী বাহিনী টিকে থাকতে পারে না। তাই তাে কবির ভাষায় বলতে হয়, ”যুগের ধর্ম এই, পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তােমাকেই।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড