লাওকোরার যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত হাজীগঞ্জ থানায় ৮ নম্বর হাটিলা (পূর্ব) ইউনিয়নে লাওকোরা অবস্থিত। ২৩ অক্টোবর লাওকোরায় মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানিদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। লাওকোরা যুদ্ধের ভয়াবহতা ঐ এলাকার জনগণ এখনও ভােলেনি। লাওকোরায় সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত থেমে থেমে যুদ্ধ হয়। মুক্তিযােদ্ধারা ছিলেন লাওকোরার মজুমদারবাড়িতে। এ সংবাদ ১জন দালাল পাকিস্তানিদের গােপনে জানিয়ে দেয়। মজুমদারবাড়ির পূর্ব দিকে ছােট খাল। পাকিস্তানিরা যাতে সরাসরি বাড়িতে প্রবেশ না করতে পারে, সে জন্য তারা খালের বাঁশের সাঁকোটি ফেলে দেন। উয়ারুক থেকে দু’ভাগ হয়ে পাকিস্তানিরা হেঁটে এবং নৌকায় করে লাওকোরায় পৌছায়। পাকিস্তানিদের আক্রমণের সংবাদ শুনে খুব ভােরে মুক্তিযােদ্ধারা খালপাড়ে বাঁশঝাড়ের গােড়ায় ও বাগানে অ্যামবুশের জন্য অবস্থান গ্রহণ করেন। কিন্তু পাকিস্তানিরা হঠাৎ করে এসে মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিযােদ্ধাদের এলএমজিম্যান আব্দুল হাকিম মােল্লা হঠাৎ তার সামনে পাকিস্তানিদের দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। ভয়ে আতঙ্কে এলএমজি পানিতে ফেলে তিনি পিছনে চলে আসেন, যা ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। এ পরিস্থিতিতে মুক্তিযােদ্ধা মােল্লা আব্দুল খায়ের বীরত্বের পরিচয় দেন। সম্মুখযুদ্ধের অন্যতম প্রধান অস্ত্র এলএমজিম্যানকে পিছিয়ে পড়তে দেখে তিনি। বুঝতে পারেন যে এখনই পাল্টা আক্রমণ না করলে সবাইকে মরতে হবে।
সাথে সাথেই তিনি গুলি শুরু করার আদেশ দেন। মুক্তিযােদ্ধারা আদেশের সাথে সাথে তুমুল গুলিবর্ষণ শুরু করেন পাকিস্তানিদের প্রতি। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের কবলে পড়ে পাকিস্তানিরা দিশেহারা হয়ে যায়। তারা মুক্তিযােদ্ধাদের সামনে টিকতে না পেরে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানিদের সবচেয়ে বড়াে সমস্যা ছিল সঠিকভাবে আড়াল নিয়ে অবস্থান নেওয়ার মতাে কোনাে স্থান সেখানে ছিল না। ঝােপঝাড়ে, জঙ্গলে, পানিতে দাড়িয়ে যিনি যেভাবে পারেন, সেভাবেই লড়াই করে যান। গ্রামের শত শত লােক দেশি অস্ত্র বর্শা, লাঠি, শাবল ইত্যাদি নিয়ে অপেক্ষায় থাকে কখন পাকিস্তানিদের জীবন্ত ধরতে পারবে। এদিকে পাকিস্তানিরা যখন বুঝতে পারে যে তাদের গুলি প্রায় শেষ এবং জনতার হাতে তাদের নির্মমভাবে মরতে হবে, তখন লড়াইয়ের চেয়ে তারা বেশি লাশ সরানাের কাজে গুরুত্ব দেয়। শেষ পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধাদের প্রবল গুলিবর্ষণের কারণে তারা কিছু লাশ ফেলে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ সংঘর্ষে ২জন বীর মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। তাঁরা হলেন জহির হােসেন ও ইলিয়াছ হােসেন। আনুমানিক ১৫জন বেসামরিক লােকও শহিদ হন। এ ছাড়া ১জন অফিসারসহ পাকিস্তানিদের আনুমানিক ২৫জন নিহত হয়। পাকিস্তানিরা পালিয়ে যাওয়ার সময় লাওকোরা মজুমদারবাড়ির প্রায় সব কটি বসতঘর ও রান্নাঘরে অগ্নিসংযােগ করে।
সূচিপাড়ার যুদ্ধ
চাদপুর জেলার শাহরাস্তি থানায় সূচিপাড়া অবস্থিত। সূচিপাড়ায় মুক্তিযােদ্ধাদের ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। ২৭ অক্টোবর খবর আসে, সূচিপাড়া চাঁদপুর খেয়াঘাটের কাছে কয়েক হাজার পাকিস্তানি নদী পার হয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের ঘাঁটিতে আঘাত হানতে আসছে। মুক্তিযােদ্ধাদের মাত্র ২টি ১০জনের দল সূচিপাড়া খেয়াঘাট থেকে মাত্র ৬০০ গজ দূরে অবস্থান গ্রহণ করে। এরই মধ্যে আনুমানিক ৮০জন। পাকিস্তানি নদী অতিক্রম করে রাস্তায় উঠে আসে। শত্রুদের অবস্থান থেকে মুক্তিযােদ্ধারা মাত্র দুই-তিন শ গজ দূরে। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল। সুবিধাজনক স্থানে। কিন্তু শক্রর অবস্থানের রাস্তার উভয় দিকেই ছিল অথৈ পানি। ১০জনের ১টি দলের অধিনায়ক হাবিলদার মােহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে শত্রু প্রতিরক্ষা অবস্থান নেওয়ার আগেই মুক্তিযােদ্ধারা গুলি শুরু করেন। ৩টি এলএমজি ও ১৯টি রাইফেলের লক্ষ্যভেদী ফায়ারে শত্রুর বেশির ভাগ সৈন্যই মারা যায়। নদীর অপর পারে অবস্থিত পাকিস্তানিরা একটানা অটোমেটিক গুলি ও মর্টারের গােলাবর্ষণ করতে থাকে। অথৈ পানিতে মর্টারের গােলা পড়তে থাকে। প্রায় সারা দিন বিরতিহীন যুদ্ধ চলে। অপর পাড়ে অবস্থানরত পাকিস্তানিরা শত চেষ্টা করেও নদীর এ পাড়ে আসতে পারেনি। এদিকে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের পূর্ব-উত্তর দিকও নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। সেদিক দিয়েও শক্র এলাকায় ঢুকতে চেষ্টা করে। নােয়াপাড়ায় ১টি দল রেখে মুক্তিযােদ্ধাদের সাব সেক্টরের অধিনায়ক জহিরুল হক পাঠান মুক্তিযােদ্ধাদের পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণের অবস্থানের পুনর্বিন্যাস করেন, যাতে শত্রু মুক্তিযােদ্ধাদের মুক্ত অঞ্চলে ঢুকতে না পারে। শত্রুপক্ষ যে পরিমাণ মর্টার শেল নিক্ষেপ করে, তা মুক্তিযােদ্ধাদের সমস্ত গােলাগুলির সমান হবে। এ যুদ্ধে আনুমানিক ৩৬জন পাকিস্তানি নিহত হয়। কোনােপ্রকার ক্ষয়ক্ষতি। ছাড়া মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানিদের হটিয়ে দিতে সক্ষম হন।
কামালপুর-শাসিয়ালীর যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানায় কামালপুর-শাসিয়ালী অবস্থিত। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে সুবেদার আ. রব, নায়েব সুবেদার আ. রশিদ ও সুবেদার আ. হকের নেতৃত্বে কামালপুর-শাসিয়ালীতে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানিদের সম্মুখযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে পাকিস্তানিরা পর্যদস্ত হয়। এ যুদ্ধে ফরিদগঞ্জ থানার সেকেন্ড অফিসার মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে মারা যায়। অপর দিকে মুক্তিযােদ্ধা ল্যান্স নায়েক ফারুক হােসেন পাটোয়ারী পাকিস্তানিদের গুলিতে শহিদ হন।
লােহাগড়ের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানায় বালুথুরা ইউনিয়নে লােহাগড়ের অবস্থান। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে লােহাগড় মাঠে মুক্তিযােদ্ধারা একটা ঘাটি স্থাপন করেন। ডাকাতিয়া নদীপথে পাকিস্তানিদের লঞ্চ দেখলেই মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণ করতেন। অক্টোবরের মাঝামাঝিতে মুক্তিযােদ্ধারা গােপন সূত্রে খবর পান যে, পাকিস্তানিদের বেশ কিছু সৈন্য নদীপথে লােহাগড় অতিক্রম করবে। খবর পেয়ে মুক্তিযােদ্ধারা ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে অবস্থান নেন। পাকিস্তানিরা নদীপথে লােহাগড় আসার সময় মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পড়ে। দুই পক্ষের প্রচণ্ড যুদ্ধে পাকিস্তানিদের উল্লেখযােগ্যসংখ্যক সৈন্য আহত হয়। অবশেষে প্রচণ্ড বাধার মুখে তারা পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হয়।
নাসিরাকান্দির যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত মতলব থানার মােহনপুর ইউনিয়নে নাসিরাকান্দি অবস্থিত। ২০ নভেম্বর মতলব থানা সদর থেকে ২০ কিলােমিটার উত্তর-পশ্চিমে মােহনপুর ইউনিয়নের নাসিরাকান্দি গ্রামে মেঘনা নদীতে মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক সুবেদার আ, রবের নেতৃত্বে পাকিস্তানিদের সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে আনুমানিক ৭জন পাকিস্তানি ধরা পড়ে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানিদের লিলি নামক জাহাজটি ডুবে যায়।
সাহেববাজারের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার সদর থানায় বাগাদী ইউনিয়নে সাহেববাজারের অবস্থান। ২৪ নভেম্বর বেলা ১১টায় চাঁদপুর সদর থানার অন্তর্গত সাহেববাজারের নদীপথে পাকিস্তানিদের মালবাহী জাহাজে মুক্তিযােদ্ধারা গুলিবর্ষণ করলে পাকিস্তানিরাও পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। উভয় পক্ষের পাল্টাপাল্টি আক্রমণের একপর্যায়ে পাকিস্তানিরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে আনুমানিক ৮জন পাকিস্তানি আহত হয়। এতে নেতৃত্ব দেন হাবিলদার দেলােয়ার হােসেন(অব.) ও অধিনায়ক হানিফ পাটোয়ারী।
নওগাঁর যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত মতলব থানার উপাদী ইউনিয়নে নওগাঁর অবস্থান। ২৬ নভেম্বর শুক্রবার মুক্তিযােদ্ধা নূরুল হক আমিনের বাড়িতে পাকিস্তানিরা অতর্কিত আক্রমণ করে এবং বাজারের দোকানপাট জ্বালিয়ে দেয়। এখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সুবেদার জহিরুল হকের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানিদের সম্মুখযুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ৫জন আত্মসমর্পণ করে এবং বাকিরা মারা যায়।
লালার হাটের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার মতলব থানায় লালার হাট অবস্থিত। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে পাকিস্তানিরা নওগাঁ থেকে পিছু হটে মতলব থানা সদর থেকে দুই কিলােমিটার পূবে লালার হাট নামক স্থানে অবস্থান নেয়। এ খবর পেয়ে মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক এনামুল হক, সাইদুর রহমান (রতন) ও সিরাজুল ইসলাম বকাউলের যৌথ নেতৃত্বে চারদিক থেকে পাকিস্তানিদের ঘেরাও করা হয়। অবস্থা বুঝে পাকিস্তানিরাও পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। দুই পক্ষের মুখােমুখি সংঘর্ষের একপর্যায়ে পাকিস্তানিদের ঘাঁটিটি মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে আসে। এ যুদ্ধে আনুমানিক ২৬জন পাকিস্তানি মারা যায় এবং ৫জন রাজাকার বন্দি হয়। ৫জন রাজাকারের মধ্যে ৪জনকে মেরে ফেলা হয় এবং ১জন রাজাকারকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পাকিস্তানিদের কাছ থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
ফরিদগঞ্জ থানা আক্রমণ
চাঁদপুর জেলার দক্ষিণ-পূর্বে ফরিদগঞ্জ থানা অবস্থিত। থানাটিতে পাকিস্তানিরা অবস্থান নেয়। নভেম্বরের শেষ দিকে মুক্তিযােদ্ধারা থানাটি আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। ২৭ নভেম্বর আনুমানিক ভাের ৫টায় মুক্তিযােদ্ধারা ফরিদগঞ্জ থানায় অবস্থানরত পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ চালান। তিন দিক থেকে থানা আক্রমণ করা হয়। সুপরিকল্পিত আক্রমণের মাধ্যমে থানাটি মুক্তিযােদ্ধারা নিজেদের দখলে নেন। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে ৩৮জন পাকিস্তানি এবং ১২জন রাজাকার মারা যায়। ১০জন আহত হয় এবং অন্যরা পালিয়ে গিয়ে জীবন রক্ষা করে। মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
দাসদিহাটের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার চাঁদপুর সদর থানায় কল্যাণপুর ইউনিয়নে দাসদিহাটের অবস্থান। চাঁদপুর সদর থানার অন্তর্গত মাষুরহাট মতলব সড়কের কালীভাংতি নামক স্থানে ২ ডিসেম্বর সকালে পাকিস্তানি বাহিনী ও মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে সম্মুখযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে ১জন পাকিস্তানি মারা যায় এবং কয়েকজন আহত হয়। যুদ্ধে কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা আহত ও শহিদ হন। এ সময় পাকিস্তানিরা কয়েকটি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এ সংঘর্ষে নেতৃত্ব দেন মুক্তিযােদ্ধা শাহ মহিউদ্দিন দুলু।
বাবুরহাটের যুদ্ধ
চাঁদপুর সদর থানার বাবুরহাট-মতলব সড়কের কালীভাংতি নামক স্থানে বাবুরহাট অবস্থিত। বাবুরহাটের আশপাশে বড়াে রাস্তায় রাজাকার ও পাকিস্তানিরা পরিখা খনন করে অবস্থান নেয়। ২ ডিসেম্বর সংগ্রাম কমিটির লােকজন পাকিস্তানিদের খবর মুক্তিযােদ্ধাদের। জানায়। খবর শােনার সাথে সাথে ৪-৫জন মুক্তিযােদ্ধা ১টি এলএমজি, ৪টি স্টেনগান ও কিছু হ্যান্ড গ্রেনেড নিয়ে দৌড়ে আসেন। তারা ১টি পুকুরপাড়ে এসে একত্র হন। সেখানে তারা কোন দিক দিয়ে আক্রমণ করবেন, সেটাই পরিকল্পনা করছিলেন। সেখানে এলএমজিম্যান ছিলেন খােরশেদ। হঠাৎ খােরশেদ লক্ষ্য করেন, ১০-১২জন পাকিস্তানি খুব কাছে চলে এসেছে। কালবিলম্ব না করে তিনি শুরু করেন এলএমজির ফায়ার। উভয়পক্ষে তুমুল লড়াই চলে। এ সময় বিষ্ণুপুর ক্যাম্প থেকে অন্য মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। তারা এসেই পাকিস্তানিদের ওপর ঝাপিয়ে পড়েন। কারণ, ততক্ষণে পাকিস্তানিরা মুক্তিযােদ্ধাদের প্রায় ঘিরে ফেলেছিল। পেছন থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের আবরণী ফায়ার দিয়ে পেছনে সরে আসার জন্য চিৎকার দিলে তারা বুঝতে পারেন। মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্ধার করে তারা পেছনে চলে আসেন। এ যুদ্ধে ১জন পাকিস্তানি মারা যায় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়, কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধাও আহত হন। যুদ্ধের পর পাকিস্তানিরা কয়েকটি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন মুক্তিযােদ্ধা শাহ মহিউদ্দিন দুলু।
মতলব সদরের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার মতলব থানার অন্তর্গত মতলব পৌরসভা অবস্থিত। ৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা মতলব সদরে অবস্থান করে। সমগ্র বাংলাদেশ এ সময় যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ের অপেক্ষায় থাকে। এ সময় থানার মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল তুঙ্গে। মুক্তিযােদ্ধাদের অধিনায়ক খুব সতর্কতার সাথে চারদিক থেকে একযােগে আক্রমণ শুরু করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের সাহসিকতার কাছে পাকিস্তানিরা হার মানতে বাধ্য হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে পাকিস্তানি বাহিনী নদীপথে পালিয়ে চাঁদপুর চলে। যায়। বাকি সৈন্য সড়কপথে পালানাের সময় মতলবের অদূরে বরদিয়া আড়ংয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে খণ্ডযুদ্ধে লিপ্ত হয়। খণ্ডযুদ্ধে টিকতে না পেরে পাকিস্তানিরা পালাতে বাধ্য হয়। ফলে মতলব চূড়ান্তভাবে মুক্ত হয়।
বসুরহাটে লঞ্চ আক্রমণ
চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানার দক্ষিণ অঞ্চলে বসুরহাট অবস্থিত। এখানে দেলােয়ার হােসেন পাটোয়ারী, সফিক চৌধুরী (সেকশন অধিনায়ক কড়ইতলী), মােস্তফা মজুমদার (কড়ইতলী), আব্দুল মান্নান (সাচিয়া খাল) আনােয়ার হােসেন পাটোয়ারী (সেকশন অধিনায়ক দায়রা), সেকান্দর পাটোয়ারীসহ (দায়চর) আনুমানিক ৩০জন মুক্তিযােদ্ধা এ অঞ্চলে থাকেন। জনগণের মাধ্যমে খবর পেয়ে বসুরহাটের কাছে শত্রুদের ১টি লঞ্চে তারা আক্রমণ করেন। এ আক্রমণে তাদের সহযােগিতায় আসে রেগুলার বাহিনীর অধিনায়ক সুবেদার জহিরুল হক পাঠানের ১টি গ্রুপ। এখানে পাকিস্তানিদের সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধ হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকিস্তানিরা পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে আনুমানিক ৮জন পাকিস্তানি ও রাজাকার মারা যায়। তবে বেশির ভাগই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানিদের কাছ থেকে কয়েক বস্তা আটা, ময়দা, চিনি, তেল ও শুকনা রুটি উদ্ধার করা হয়।
মােহনপুর মেঘনা নদীবক্ষের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার মতলব থানার মােহনপুর ইউনিয়নে মেঘনা নদীবক্ষে মােহনপুর । অবস্থিত। ৮ ডিসেম্বর চাঁদপুর থেকে আগত পাকিস্তানিরা নদীপথে আসার সময় মােহনপুরের কাছে পৌঁছতেই অধিনায়ক আ, রবের নেতৃত্বে পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ চালানাে হয়। প্রচণ্ড গােলাগুলির মুখে একপর্যায়ে মিত্রবাহিনীর। বিমান আক্রমণে পাকিস্তানিরা পরাস্ত হয়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি মেজর জেনারেল রহিম আহত হয়। শতাধিক পাকিস্তানি ধরা পড়ে এবং তাদের নিশ্চিন্তপুর । ক্যাম্পে আটক রাখা হয়।
চরকালীপুরের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত মতলব থানার ষাটনল ইউনিয়নে চরকালীপুর অবস্থিত। ৮ ডিসেম্বর চারদিকে যুদ্ধ চলছে। হঠাৎ পাকিস্তানিদের ৩টি গানবােট অস্ত্রসহ ষাটনলের অদূরে কালীপুরে আসতেই আনুমানিক ১০০জন মুক্তিযােদ্ধার ১টি দল মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক হাফেজ মােহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে আক্রমণ করে। তুমুল গােলাগুলির মধ্যে মিত্রবাহিনীর হঠাৎ বিমান আক্রমণে পাকিস্তানি ১টি। গানবােট অস্ত্র ও সৈন্যসহ ডুবে যায়। বাকি ২টি গানবােট চরে আটকা পড়ে। আটকে পড়া পাকিস্তানিদের সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের রাত ৮টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। একপর্যায়ে গানবােট ও অস্ত্র ফেলেই পাকিস্তানিরা পালিয়ে যায়। পাকিস্তানিদের ফেলে রাখা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।
চাঁদপুর মেঘনা নদীর যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার চাঁদপুর সদর থানায় রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নে চাঁদপুর মেঘনা নদীর অবস্থান (মেঘনা নদীর অগ্রভাগ)। ৯ ডিসেম্বর দুপুর ১২টায় চাঁদপুর শহরের অদূরে মেঘনা নদীতে মুক্তিযােদ্ধা ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে পাকিস্তানিদের বহনকারী ২টি জাহাজের ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিযােদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে পাকিস্তানিরা কিছুটা ভড়কে গেলেও পরক্ষণেই তারা পাল্টা আক্রমণ করে। উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গােলাগুলি হয়। পাকিস্তানি মেজর আ. রহিমসহ বহু পাকিস্তানি আহত হয় এবং অসংখ্য মারা যায়।
মুখসারের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ থানার অন্তর্গত ১ নম্বর রাজারগাঁও (উত্তর) ইউনিয়নে মুখন্দসার এলাকা অবস্থিত। ৮ ডিসেম্বর হাজীগঞ্জ থেকে পাকিস্তানিরা চলে যায়, যার ফলে হাজীগঞ্জ মুক্ত হয়। পাকিস্তানিরা হাজীগঞ্জ থেকে পালাবার সময় পথ ভুলে মুখন্দসার গ্রামে চলে আসে। তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে জনগণ মুক্তিযােদ্ধাদের খবর দেয়। ১০ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় জনগণের মাধ্যমে পাকিস্তানিদের উপস্থিতির সংবাদ পাবার পর মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানিদের ঘিরে ফেলে। এই অপারেশনের নেতৃত্ব দেয় মুক্তিযােদ্ধাদের অধিনায়ক মজিবুর রহমান। পলায়নরত পাকিস্তানিরা মুক্তিযােদ্ধাদের দেখে ভড়কে যায়। তারপরও মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে তাদের তুমুল লড়াই হয়। যুদ্ধের একপর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধা আবু তাহের উত্তেজিত হয়ে নিজ অবস্থান ছেড়ে সামনে এগিয়ে যান। পাকিস্তানিদের ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে। ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তানিরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। গুলির আঘাতে মুক্তিযােদ্ধা আবু তাহের শহিদ হন। তখন পর্যন্ত দুই পক্ষের লড়াই তুমুলভাবে চলতে থাকে। কিন্তু অসীম সাহসী। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে ১জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন এবং অন্য কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা আহত হন। এ ছাড়া উল্লেখযােগ্যসংখ্যক পাকিস্তানি আহত হয়।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড