You dont have javascript enabled! Please enable it!
গাজীপুর বাজারের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত ফরিদগঞ্জ থানার পাইকপাড়া ইউনিয়নে গাজীপুর বাজার অবস্থিত। বাজারের পশ্চিম দিকে নদী। বাজার থেকে একটি রাস্তা পূর্ব দিকে গিয়েছে। ১৫ সেপ্টেম্বর রাত দশটায় সুবেদার পাঠান এসে আদেশ দেন। সবাইকে যার যার অস্ত্র নিয়ে নৌকায় উঠতে। এ অঞ্চলের ১টি প্লাটুনকে গাজীপুরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্লাটুনের ১০জনের ১টি দলকে নিয়ে হাবিলদার আব্দুর রশিদ গাজীপুর চলে আসেন। খবর আসে, গাজীপুরে এক লঞ্চ পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার আসছে। ৬ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টায় রাজাকারদের প্রতিহত করতে ১০জনের দলটি গাজীপুর এসেই খবর পেল, পাকিস্তানি ও রাজাকার বাহিনী ইতােমধ্যেই গাজীপুর বাজারে প্রবেশ করেছে। বাজারে প্রবেশ করেই তারা ২-১ রাউন্ড ফাকা আওয়াজ করে। ১০জনের দলের গানার অলিউল্লাহ পাটোয়ারী (চরবসন্ত) পুলিশের লােকমান হােসেন, আব্দুল মতিন পাটোয়ারী (ভাটিংগাও), আব্দুর রহমান ও সিপাহি রহমত ভূঁইয়াকে (বালিবুরা) হাবিলদার রশিদ ডান পাশে পাঠানবাড়িতে অবস্থান নিতে বলে। তাদের সাথে ১টি এলএমজি দেওয়া হয়। ২জনকে ছুতার (সূত্রধর) বাড়ির ডান পাশে রাস্তার ওপর রাখা হয়। দলনায়ক হাবিলদার রশিদ ও দেলােয়ার হােসেন খান এ ২জন পেছনে মুসলিম সওদাগরের বাড়ির মসজিদের আড়ালে অবস্থান নেন।
পাকিস্তানি ও রাজাকার বাহিনী ক্রমেই পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সংখ্যায় কম বলে দলটির সামনের মুক্তিযােদ্ধার পেছনে মানিকরাজের দিকে অবস্থান নেন। পাকিস্তানিরা মটারের শেলিং করতে করতে আরও সামনে অগ্রসর হতে থাকে। শুধু হাবিলদার রশিদ ও তার সহকারী মুক্তিযোেদ্ধা দেলােয়ার মসজিদের পাশে অবস্থান নিয়ে থাকেন। পাকিস্তানি ও রাজাকাররা ২৫ গজের সীমানার ভেতরে আসার সঙ্গে সঙ্গে হাবিলদার রশিদের আদেশে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। গুলির সাথে সাথে পাকিস্তানিরাও চিৎকার করে রাস্তার পাশে শুয়ে পড়ে। মুক্তিযােদ্ধা ২জন একটানা ৭ মিনিট গুলি করে যান। এরপর পিছিয়ে তারা সওদাগরবাড়ির পুকুরে অবস্থান নেন। আনুমানিক ১২ মিনিট পর ছুতারবাড়ি ও পাঠানবাড়ি থেকে শুরু হয় তাদের ওপর গুলিবর্ষণ। মুক্তিযােদ্ধা ২জন কয়েক ম্যাগাজিন এমজি ব্রাশফায়ার করার পর নিরাপদ নয় ভেবে পুনরায় তারা পেছনের ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে। তিনারবাড়ির দক্ষিণ পাশে নারকেলগাছের গােড়ায় অবস্থান নেয়। পাকিস্তানিদের পুনরায় নাগালের মধ্যে পেয়ে তারা গুলিবর্ষণ শুরু করেন। পাকিস্তানিরাও তাদের ওপর এলএমজি ও মর্টারের গােলাবর্ষণ করতে থাকে। পাকিস্তানিদের গােলাবর্ষণে টিকতে না পেরে আবার তাঁরা পেছনে মাঝিবাড়ির কাঠের পুলের কাছে রাস্তার ওপর অবস্থান নেন। রাস্তার পাশে বড়াে বড়াে কচুগাছের আড়ালে তারা মাথা লুকিয়ে পাকিস্তানিদের জন্য অপেক্ষা করেন। পাকিস্তানিরা রাস্তার ওপর ৪০-৫০ গজের সীমানায় আসামাত্রই তাদের ওপর পুনরায় শুরু হয় গােলাবর্ষণ। আনুমানিক ১ ঘণ্টা পাকিস্তানিদের ওপর প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ করে তাদের পিছু হটতে বাধ্য করা হয়। এ যুদ্ধের অন্যতম উল্লেখযােগ্য বিষয় হলাে মাত্র ২জন মুক্তিযােদ্ধা লঞ্চ ভর্তি একদল পাকিস্তানিকে পিছু হটিয়ে দেয়। এ সংঘর্ষে পাকিস্তানি ও রাজাকার বাহিনীর অনেক ক্ষতি সাধিত হয়। আনুমানিক ৩৫জন পাকিস্তানি ও রাজাকার নিহত হয়। কয়েকজন নিরীহ গ্রামবাসীও শহিদ হন। পরদিন পাকিস্তানিরা এখানে এসে ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালায়। সে রাতে তারা করইতলী হাসপাতালে অবস্থান নেয়। করইতলী থেকে পরদিন তারা চাঁদপুর চলে যায়।
শশাল্লার যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানায় সুবিদপাড়া (প.) ইউনিয়নে শােল্লা অবস্থিত। সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানিরা হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর ও ফরিদগঞ্জ থেকে ত্রিমুখী হামলা করে মুন্সীর হাট, শােল্লা বাজার, তামশাসন গ্রাম ও আইটপাড়া গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় এবং বহু লােককে হত্যা করে। এ খবর শােল্লায় অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের কানে আসামাত্রই তারা পাকিস্তানিদের পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। মুক্তিযােদ্ধারা প্রতিটি গ্রামে ভাগ হয়ে পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ শুরু করেন। দুই পক্ষের মধ্যে সম্মুখযুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে একসময় পাকিস্তানিরা পিছু হটে যায়।
এনায়েত নগর-সিপাইকান্দির যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত মতলব থানার ১০ নম্বর পূর্ব ফতেহপুর ইউনিয়নে এনায়েত নগর অবস্থিত। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে পাকিস্তানিদের একটি দল গানবােটসহ এনায়েত নগর-সিপাইকান্দি গ্রাম আক্রমণ করে এবং আগুন জ্বালিয়ে দেয়। মুক্তিযােদ্ধাদের অধিনায়ক এ কে এম মােয়াজ্জেম হােসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ করেন। ইত্যবসরে সংবাদ পেয়ে সুজাতপুর ক্যাম্প থেকে মুক্তিযােদ্ধা এম এ ওয়াদুদের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযােদ্ধা ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। এ খবর পেয়ে নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধারা এবং এম এ ওয়াদুদের দল তিন দিক থেকে পাকিস্তানিদের আক্রমণ করে। অনেকক্ষণ গােলাগুলির পর পাকিস্তানিরা নৌপথে। পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে ১জন পাকিস্তানি নিহত এবং ৩জন আহত হয়। তবে কোনাে মুক্তিযােদ্ধা হতাহত হন নি।
কালীর বাজারের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত মতলব থানার বাগানবাড়ি ইউনিয়নে কালীর বাজার। অবস্থিত। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে গােপন সূত্রে খবর আসে যে ২২ সেপ্টেম্বর কালীর বাজারের অদূরে নদীপথে অস্ত্রবােঝাই একটি শত্রু জাহাজ দাউদকান্দির উদ্দেশ্যে যাবে। ২২ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টার আগে মুক্তিযােদ্ধারা গােপনে শত্রুদের আক্রমণের উদ্দেশ্যে অবস্থান নেন। ঠিক ১২টায় অস্ত্রবােঝাই জাহাজটিকে কালীর বাজারের দিকে আসতে দেখা যায়। মুক্তিযােদ্ধারা জীবন বাজি রেখে কালীর বাজারের অদূরে পাকিস্তানিদের দাউদকান্দির উদ্দেশ্যে যাওয়া অস্ত্রবােঝাই জাহাজে হঠাৎ আক্রমণ করেন। এ অনাকাক্ষিত আক্রমণে। পাকিস্তানিরা হতভম্ব হয়ে জাহাজ ফেলে নদীপথে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের বহনকারী লঞ্চের সারেং নূরুল ইসলাম শহিদ হন। মুক্তিযােদ্ধারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রসহ জাহাজটির দখল নিতে সক্ষম হন। পরে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র ও জাহাজটি ব্যবহার করেন।
নূরপুর মাসনিগাছার যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত কচুয়া থানায় রহিমা নগর ইউনিয়নে নূরপুর মাসনিগাছা অবস্থিত। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে কচুয়া-বরুড়া থানার সীমানায় অবস্থিত বটতলী বাজারে পাকিস্তানিদের সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে কচুয়া থানার মুক্তিযােদ্ধারা বরুড়া থানার মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতায় পাকিস্তানিদের ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালান এবং উভয়পক্ষে প্রচণ্ড গুলিবিনিময় হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে পাকিস্তানিরা পিছু হটে যায় এবং ৩জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। অপর ২জন সাধারণ লােক গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন।
বদরপুর-গাব্দের গাঁওয়ের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানায় রূপসা (উ.) ইউনিয়নে বদরপুর-গাব্দের গাঁও অবস্থিত। সেপ্টেম্বর মাসে মুক্তিযােদ্ধারা এক রাজাকারের বাড়ি (বারাে পাইকা ফকিরবাড়ি) পুড়িয়ে দিলে পাকিস্তানি ও রাজাকাররা বদরপুর গ্রাম আক্রমণ করে। বহু ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তানিরা সামনে অগ্রসর হয়। মুক্তিযােদ্ধারা রূপসা হয়ে গাব্দের গাঁওয়ের দিকে দ্রুত অগ্রসর হয়ে। পাকিস্তানিদের আক্রমণ করলে তারা ভয়ে ফরিদগঞ্জে ফিরে আসে।
অফিস চিতসির যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার সদর থেকে সর্ব পূর্বে (নােয়াখালী বর্ডার) শাহরাস্তি থানা অবস্থিত। শাহরাস্তি থানার আওতাধীন চিতসি একটি গ্রাম ও রেল স্টেশন। অফিস চিতসি ক্যাম্পের অবস্থান রেল স্টেশনের দক্ষিণে। ক্যাম্পের ঠিক সামনেই অপর দিকে খিলা নদীর উত্তরে সূচিপাড়া, নােয়াপাড়া ও মসদপাড়া। পূর্বে খিলা নদীর অংশবিশেষ। ২৯ সেপ্টেম্বর সকাল থেকেই এ যুদ্ধের সূচনা হয়। ২৯ সেপ্টেম্বর সকাল থেকেই শুরু হয় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সাথে মেঘের গর্জন। চারদিকে হাড় কাপানাে হিমেল শীত। সকাল ৭টার দিকে হঠাৎ অফিস চিতসির দিক থেকে চাইনিজ অটোমেটিক হাতিয়ারের গুলি এবং তার সাথে মাঝে মাঝে ৩ ইঞ্চি মর্টারের গােলাবর্ষণের শব্দ আসে। সেখানে নায়েব সুবেদার রবের প্লাটুন। সেই প্লাটুনে তাঁর সাথে আছেন এরশাদ, হাবিলদার গােলাম মওলা, বজলু, হাবিলদার সিরাজ, হাবিলদার মতিন, বােরহান চৌধুরী, নেওয়ার আহমেদ, আলাউদ্দিন, নূর আহমেদ, আহমেদ উল্লাহ ভূঁইয়া, হেদায়েত উল্লাহ, কলিমুল্লাহ ভূঁইয়া। পরে জানা যায়, সেখানে প্রস্তুত আছেন সাব-সেক্টর অধিনায়ক জহিরুল হক। পাঠান। সেখান থেকেই তারা প্রায় ২০-২৫ মিনিট ব্রিটিশ এলএমজি ও রাইফেল দিয়ে আক্রমণ করেন। সূচিপাড়ায় অবস্থান নেয় মুক্তিযােদ্ধাদের আরও ১০জনের একটি দল। সেখান থেকেই তারা একটি একটি করে গুলি করতে থাকেন। সবার টার্গেটই ছিল পাকিস্তানি সেনা কিন্তু পরে জানা যায়, অফিস চিতসিতে কোনাে পাকিস্তানি নেই, শুধু রাজাকাররা আছে।
এ খবর পাবার পর সাব-সেক্টর অধিনায়ক জহিরুল হক পাঠান অফিস চিতসি ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। সুবেদার পাঠানের পরিকল্পনা অনুযায়ী রাতেই সুবেদার আব্দুর রব কলিমুল্লা ভূঁইয়া এবং অন্য যােদ্ধাদের নিয়ে বৃষ্টি ও কাদামাটি উপেক্ষা করে ক্রলিং করে একেবারে রাজাকারদের কাছাকাছি অবস্থান নেন। আরও ১০জনের একটি দল ২টি ব্রিটিশ এলএমজিসহ চান্দাইল নাগের দিঘিতে অবস্থান নেয়।  মুক্তিযােদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে রাজাকাররাও তাদের আক্রমণ করে। মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য নায়েক আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে ১০জনের একটি দল সূচিপাড়ায় রেখে সবাই অফিস চিতসিতে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে যােগ দেন। মুক্তিযােদ্ধা রাজাকারদের ক্যাম্প ২দিন ঘেরাও করে রাখেন। এ ২দিন তাদের সাথে রাজাকারদের প্রচণ্ড গােলাগুলি শুরু হয়। প্রথম রাতেই। ৩জন রাজাকার গােপনে রাইফেল ও প্রচুর গােলাবারুদ নিয়ে আত্মসমর্পণ করে। সে রাতেই পালাবার সময় ৭-৮জন রাজাকার গ্রামবাসীদের হাতে ধরা পড়ে। ২দিন অনবরত গুলিবর্ষণে রাজাকারদের গুলি প্রায় শেষ হয়ে যায়। একপর্যায়ে সুবেদার পাঠান ও কলিমুল্লা ভূঁইয়া গুলি করতে করতে দালালদের ঘরে প্রবেশ করেন। সেখানে ২জন দালালকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। একপর্যায়ে পুরাে ক্যাম্প মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে আসে।
এ যুদ্ধে আনুমানিক ৪জন রাজাকার নিহত হয় এবং ১০জন রাজাকার। জনগণের হাতে ধরা পড়ে। কিছু রাজাকার পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এ ক্যাম্প থেকে ১২জন যুবতী মেয়েকে উদ্ধার করা হয়। সেই সাথে ২টি ৩ ইঞ্চি মর্টার, ২টি চাইনিজ এলএমজি, ২০টি চাইনিজ রাইফেল ও প্রচুর গােলাবারুদ মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে আসে। এ ছাড়া দেড় শ মণ ধান, ৮০ মণ চাল, ২২০ মণ পাট, ৩০০টি শাড়ি কাপড়, প্রচুর তামা-কাসার হাঁড়ি-পাতিল এবং ৩টি নৌকা। থেকে ২০টি গরু ও ১২টি খাসি উদ্ধার করা হয়।
মিরপুরের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানায় ১৩ নম্বর ফরিদগঞ্জ ইউনিয়নে মিরপুর অবস্থিত। অক্টোবর মাসে রাজাকার অধিনায়ক নূর মােহাম্মদ দর্জি মিরপুর এলাকা পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য শীলবাড়ির কাছে ৩০জনের একটি রাজাকার বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হয়। মুক্তিযােদ্ধারা খবর পেয়ে মিরপুর ছৈয়ালবাড়ির মসজিদের কাছ থেকে গুলি চালিয়ে নূর মােহাম্মদ দর্জিকে হত্যা করেন। বাকি রাজাকারেরা প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যায়। এখানে রাইফেলের গুলি উদ্ধার করা হয়। জনতা মৃত রাজাকারের লাশ নিয়ে উৎসবে মেতে ওঠে। ২৪ নভেম্বর পাকিস্তানিরা ফরিদগঞ্জ ছেড়ে যাওয়ার দিন বেরােয়া, কাছিয়াড়া, ভাটিয়ালপুর, ধানুয়া গ্রামগুলাে থেকে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ করেন। এতে অনেক রাজাকার ও পাকিস্তানি সৈন্য আহত ও মারা যায়।
গােয়ালমারী আক্রমণ
চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত মতলব থানার পশ্চিম ফতেহপুর ইউনিয়নে গােয়ালমারী অবস্থিত। গােয়ালমারী এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধারা নভেম্বরের মাঝামাঝি ঈদের আনন্দে অংশগ্রহণের প্রস্তুতিকালে পাকিস্তানিরা সুযােগ বুঝে আক্রমণ চালায়। খবর পেয়ে মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক এম এ ওয়াদুদ, কবির আহমদ খান ও গজারিয়ার অধিনায়ক ফজলুর রহমানের (ফজলু) যৌথ নেতৃত্বে চারদিক থেকে পাকিস্তানিদের আক্রমণ করা হয়। ঈদের দিন ভাের ৬টা থেকে বিরতিহীনভাবে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানিদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। প্রচণ্ড গােলাগুলিতে মুক্তিযােদ্ধা রুহুল আমিন ঘটনাস্থলেই শহিদ হন। তাকে বাঁচাতে গিয়ে মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক এম এ ওয়াদুদ গুরুতর আহত হন। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে পাকিস্তানিরা পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের অসীম সাহসিকতায় সম্মুখযুদ্ধে আনুমানিক ১২০জন। পাকিস্তানি মারা যায় এবং মেজর আমিনসহ আনুমানিক ১৫০জন ধরা পড়ে। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধা নূরুল ইসলাম ও শামছুল হকসহ মােট ৩জন শহিদ হন।
রূপসা বাজারের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানায় রূপসা (উ.) ইউনিয়নে রূপসা বাজার অবস্থিত। অক্টোবর মাসে রূপসা বাজারে হাটের দিন পাকিস্তানিরা হঠাৎ অভিযান চালিয়ে কিছু লােককে আটক ও কিছু সাধারণ মানুষ হত্যা করে। এ ছাড়া তারা দোকানপাট লুটপাট শুরু করে। এ সংবাদ শুনে নায়েব সুবেদার রশিদ ১টি এলএমজি নিয়ে গােপনে বাজারের উত্তর দিকে অবস্থান নেন। সেখান থেকে অতর্কিতে পাকিস্তানিদের ওপর ব্রাশফায়ার শুরু করলে পাকিস্তানিরা ভয়ে। আটককৃত লােকজনক ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে ফরিদগঞ্জে চলে আসে।
ফকিরহাটের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ থানার অন্তর্গত ২ নম্বর রাজারগাঁও (দক্ষিণ) ইউনিয়নে ফকিরহাট অবস্থিত। পাকিস্তানিরা মুকুন্দসারে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে ফকির হাটে প্রবেশ করে। এ গ্রামে প্রবেশ করলে গ্রামবাসীরা সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের খবর দেয়। মুকুন্দসারে আক্রমণরত মুক্তিযােদ্ধারা ধাওয়া করতে করতে পাকিস্তানিদের এ গ্রামে নিয়ে আসেন। পুনরায় এখানে তাদের ঘেরাও করা হয়। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। এখানে মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক মুজিবের নেতৃত্বে যে-সব মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন, তাদের সাথে ফকিরহাটের অন্যান্য মুক্তিযােদ্ধাও যােগদান করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রবল বাধার মুখে পাকিস্তানিরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ফলে একসময় তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে ৪জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। তারা হলেন জয়নাল ১ (রাজাসার), জয়নাল ২ (শ্রীপুর), ১জন বিএলএফ সদস্য ও সুভাষ। বিএলএফ সদস্য ছাড়া। বাকিদের নাসির কোর্টে দাফন করা হয়।
গাজীপুর যুদ্ধ-৩ (অ্যামবুশ)
১৮ অক্টোবর আনুমানিক দুপুর ১২টা মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে খবর আসে যে পাকিস্তানিরা লঞ্চ দিয়ে চান্দ্রাবাজার ও গাজীপুর হয়ে ফরিদগঞ্জ যাবে। এ লঞ্চে খাদ্য, ওষুধ ও নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিস আছে। ইতােমধ্যেই মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুদের নিত্যপ্রয়ােজনীয় খাবার সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ২ নম্বর প্লাটুনের ১০জনের ১টি দলের অধিনায়ক নায়েক মােহাম্মদ আলী টি কে (রাজার গাঁও) তার দলের অন্যান্য মুক্তিযােদ্ধাসহ লােহাগড় ও চান্দ্রাবাজারে নদীর বাঁকে। পাকিস্তানিদের আক্রমণ করেন। কিন্তু প্রাণপণ লড়াই করেও তারা লঞ্চটির গতি রােধ করতে পারেন নি। পরবর্তী সময় পুনরায় পাকিস্তানিদের গাজীপুরের রাজারপুর বাঁকে অ্যামবুশ। করার পরিকল্পনা করা হয়। হাবিলদার মতিনের নেতৃত্বে আনুমানিক ১৫জন মুক্তিযােদ্ধা গাজীপুর রাস্তার ওপর বাংকার করে অবস্থান নেন। মাঝখানে শহিদ। মেম্বরের বাড়ি থেকে শুরু করে গাজীপুর চরবসন্ত পর্যন্ত ব্যাপক এলাকা নিয়ে তারা অবস্থান নেন। গাজীপুরের ঈদগাহ মােড়ে আছে কলিমুল্লা ভূঁইয়া, নায়েক ছিদ্দিক (মহামায়া), সিপাহি রহমত (বালিথােরা), সিপাহি শাহ আলম (রাজাপুর), সিপাহি করিম (ভাওয়াল), সুবেদার আব্দুল হক (মতলব), গফুর। (অলীপুর) বােরহান চৌধুরী, হাফিজুর রহমান মিন্টু, তরিকউল্লা পাঠান, নয়ন ও আরও অনেকে। শহিদ মেম্বরের বাড়ির কাছে অবস্থান নেন হাবিলদার মতিন, হাবিলদার। গােলাম মাওলা, সিপাহি ওয়ালিউল্লাহ পাটোয়ারী, নায়েক বাসার, সফিকুর রহমান পাঠান, ফিরােজ, নাজির আহমেদ, আলাউদ্দিন, দেলােয়ার ও আরও অনেকে। সবাই নিজ নিজ অবস্থানে বসে থাকেন। 
লঞ্চটি মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে ক্রমেই এগিয়ে আসে। লঞ্চটির মাথায় পাকিস্তানি পতাকা উড়তে দেখা যায়। পূর্বের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম গুলি শুরু করবে হাবিলদার মতিনের দল। দ্বিতীয়বারে গুলি শুরু করবে নায়েক মােহাম্মদ আলীর দল থেকে। আর পাকিস্তানিরা গাজীপুর বরাবর সােজা গেলে সুবেদার আব্দুল হক ও কলিমুল্লাহ ভূইয়ার দল আক্রমণ করবে। লঞ্চটিকে ক্রমেই কাছে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। কাছাকাছি আসার সঙ্গে সঙ্গেই হাবিলদার মতিন গুলি শুরু করার আদেশ দেন। সঙ্গে সঙ্গে সব হাতিয়ার গর্জে ওঠে। প্রচণ্ড আক্রমণে গানবােটের বালির বস্তা ছিড়ে ধােয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। আনুমানিক ৫ মিনিট পর পাকিস্তানিরা পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল লড়াই শুরু হয়। লঞ্চটিকে লক্ষ্য করে ২ ইঞ্চি মর্টারের গােলা নিক্ষেপ করা হয়, কিন্তু তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। প্রচণ্ড আক্রমণের মুখেও পাকিস্তানিরা লঞ্চটি নিয়ে ফরিদগঞ্জ পৌছতে পারে। পরবর্তী সময় মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণের সুযােগ থাকা সত্ত্বেও আক্রমণ করা হয়নি। কারণ, মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে রকেট লঞ্চার ছিল না। আর রকেট লঞ্চার ছাড়া স্টিল বডির লঞ্চ পানিতে নিমজ্জিত করা প্রায় অসম্ভব। পালিয়ে গেলেও এ সংঘর্ষে বেশ কিছু পাকিস্তানি আহত হয়।
গাজীপুরের যুদ্ধ-৪
অক্টোবর মাসের মাঝামাঝিতে ফরিদগঞ্জে অবস্থানরত পাকিস্তানি ও রাজাকারদের ক্যাম্পে রসদপত্র সরবরাহ মুক্তিযােদ্ধারা বন্ধ করে দেন। ঐ। অঞ্চলের কমান্ডারের নির্দেশে গাজীপুর ও ফরিদগঞ্জকে টার্গেট করে মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি প্লাটুনের ১০জনের ৩টি দলকে তিন জায়গায় ভাগ করে অবস্থান নেওয়া হয়। ১টি দল ফরিদগঞ্জের কাছে রূপসা রাস্তার ওপর, ১টি দল কেরবারচর ও ১টি দল গাজীপুরে রাখা হয়। এখানে অধিনায়ক হিসেবে আছেন সুবেদার আব্দুল হক ও সুবেদার রব। ফরিদগঞ্জের দক্ষিণে অবস্থান নেয় আরেকটি দল। পশ্চিম দিকে আছেন কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা। ফরিদগঞ্জের চতুর্দিকে যে প্রতিরােধের দুর্গ মুক্তিযােদ্ধারা তৈরি করেন, তা ভেদ করে ভেতরের পাকিস্তানিরাও আসতে পারেনি। হঠাৎ খবর আসে, ১টি লঞ্চ খাদ্য ও নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদি নিয়ে চাঁদপুর থেকে রওনা হয়ে চান্দাবাজার ও টুবগী হয়ে ফরিদগঞ্জে আসছে। খবর পাবার সাথে সাথে মুক্তিযােদ্ধারা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী গাজীপুরে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। সুবেদার আব্দুল হকের কমান্ডে ১টি দল গাজীপুর শহিদ মেম্বরের বাড়ি থেকে গাজীপুর বাজারের বাম পাশ পর্যন্ত এলাকায় প্রস্তুত থাকে। গাজীপুরের ঈদগাহ থেকে শেখের ডােন পর্যন্ত অবস্থান নেন ফরিদগঞ্জ থানার অধিনায়ক মাহবুবুর রহমান ও প্লাটুন অধিনায়ক খাজা আহম্মদ ও তার দল। দলের নেতৃত্বে থাকেন মাহবুব। মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে ৭টি এলএমজি, প্রচুর এসএলআর, ২ ইঞ্চি মর্টার ও রাইফেল থাকে। পূর্বেই নির্দেশ ছিল যে লঞ্চ যখন গাজীপুরের বরাবর আসবে, প্রথম গুলি শুরু হবে মাঝখান থেকে সুবেদার হকের নির্দেশে। পরে তিন দিক থেকে একযােগে আক্রমণ হবে। হঠাৎ দেখা যায়, লঞ্চটি রাজাপুর পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে। লঞ্চটি যেই শহিদ মেম্বরের বাড়ির মােড়ে আসে, অমনি গতি কমিয়ে ডানে মােড় নিয়ে আবার গতি বাড়িয়ে এগিয়ে যায়। লঞ্চটি গাজীপুর নদীপাড়ে ঐতিহাসিক বটগাছ বরাবর আসামাত্রই সুবেদার হক গুলি শুরু করার আদেশ দেন। আদেশের সাথে সাথে শুরু হয় প্রচণ্ড আক্রমণ।
লঞ্চটিতে আনুমানিক ১২জন পাকিস্তানি ছিল। তারা বেশির ভাগই লঞ্চ থেকে লাফিয়ে নদীতে পড়ে যায়। কেউ মারা না গেলেও প্রথম আক্রমণে অনেকেই আহত হয়। কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকেও আক্রমণ শুরু হয়। তারা ৩ ইঞ্চি মর্টার দিয়ে আক্রমণ শুরু করে। মর্টারের শেলের আঘাতে মুক্তিযােদ্ধা মাহবুবের মারাত্মকভাবে যখম হয়। শেষ পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণের কাছে টিকতে না পেরে পাকিস্তানিরা সাঁতরিয়ে নদীর অপর পারে গিয়ে ওঠে। তারা ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে বুকসমান পানি ভেঙে ধানুয়ার রাস্তায় গিয়ে ওঠে। পাকিস্তানিদের লঞ্চটি ছিল কার্গো ধরনের। চালকবিহীন লঞ্চটি ঘুরতে ঘুরতে শেখের ডােন অবস্থানে গেলে প্রচণ্ড আক্রমণে লঞ্চটি ছিদ্র হয়ে একসময় তলিয়ে যায়। এ যুদ্ধে আনুমানিক ৫জন পাকিস্তানি আহত হয়। ১জন মুক্তিযােদ্ধাও আহত হয়। জনগণ ও মুক্তিযােদ্ধারা লঞ্চটি টেনে পাড়ে তােলেন। লঞ্চের জিনিসপত্র জনগণ ভাগাভাগি করে নিয়ে যায়।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!