খিলাবাজারের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ থানায় খিলাবাজার অবস্থিত। ২১ জুলাই আনুমানিক সাড়ে ৬টায় যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। ৩ ইঞ্চি মর্টার দিয়ে খিলাবাজারে অনবরত সেলিং করা হয় এবং বাঙালিদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পাকিস্তানিরা খিলাবাজার রেল স্টেশন থেকে পায়ে হেটে খিলাবাজারে এসে আগুন জ্বালায় । মুক্তিযােদ্ধাদের দুই প্লাটুন মালিগাও এবং দুই প্লাটুন খিলা রেল স্টেশনের কাছে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানিদের উপস্থিতি টের পাবার পর খিলাবাজারের পাশে মুক্তিযােদ্ধারা অ্যামবুশের জন্য অবস্থান গ্রহণ করেন। সেখানে থাকেন। নায়েব সুবেদার রব, হাবিলদার লােকমান, নায়েব সুবেদার আব্দুস সাত্তার, হাবিলদার গােলাম মাওলা, সিপাহি কালাম, বেলায়েত, শফিক পাঠান, নয়ন ও রহমতসহ আরও অনেকে। পাকিস্তানিরা আয়ত্তের মধ্যে আসার পর পরই গর্জে ওঠে মুক্তিযােদ্ধাদের ব্রিটিশ এলএমজি। সাথে রাইফেলের গুলি। মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানিদের অ্যামবুশে ফেলেন। উভয় পক্ষে দীর্ঘ দুই ঘণ্টা প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানিরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। তাদের এ খবর পেয়ে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে আরও অনেক পাকিস্তানি সৈন্য। তারা পাকিস্তানিদের শক্তি বৃদ্ধি করার পর পুনরায় ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর। যেহেতু পাকিস্তানিরা মরিয়া হয়ে উঠেছে তাদের মৃত সৈন্যদের উদ্ধার করার জন্য এবং মুক্তিযােদ্ধাদের গােলাবারুদও সীমিত, তাই মুক্তিযােদ্ধারা পেছনে চলে আসেন। পাকিস্তানিরাও আর সামনে এগােনাের সাহস পায়নি। পিছু হটে যায় তারা।
এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে আনুমানিক ১২জন পাকিস্তানি ও রাজাকার মারা যায়। যুদ্ধের প্রথম দিকে যখন পাকিস্তানিরা প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে, ঠিক সেইসময় রাজাকাররা আশপাশে পালাতে থাকে এবং জনগণ ২জন রাজাকারকে ধরে ফেলে, বাকিরা খিলা রেল স্টেশন দিয়ে পালিয়ে যায়। বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত জনতা অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। সেদিনই সেকান্দার আলী নামক ১জন রাজাকার অধিনায়ককে হত্যা করা হয়। তার বাড়ি উভরামপুর। জনগণ সেকান্দার আলীর মাথা কেটে সূচিপাড়া হাইস্কুলে চালের ওপর ঝুলিয়ে রাখে। এখানে জনতার সাথে একাত্ম হয়ে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখে সূচিপাড়া হাইস্কুলের হেডমাস্টার আলী আহমেদ, সালেহ আহমেদ বিএসসি (নরিংপুর), আব্দুল মান্নান বিএসসি এবং নাম না জানা আরও সংগ্রামী জনতা।
গাজীপুরে লঞ্চ আক্রমণ
চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানায় পাইকপাড়া ইউনিয়নে গাজীপুর অবস্থিত। অক্টোবর মাসে পাকিস্তানিদের রসদ ও বেতনের টাকা নিয়ে ১টি লঞ্চ চাঁদপুর থেকে ফরিদগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সংবাদ পেয়ে মুক্তিযােদ্ধারা গাজীপুর বাজারের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে বাংকার তৈরি করে সুবেদার আ. রব ও নায়েব সুবেদার আব্দুল হকের নেতৃত্বে অপেক্ষা করতে থাকেন। আনুমানিক বিকাল ৪টায় লঞ্চ গাজীপুর অতিক্রম করার সময় মুক্তিযােদ্ধারা লঞ্চের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করেন। এতে এক পাঞ্জাবি সৈনিক গুলিবিদ্ধ হয়ে এলএমজিসহ নদীতে পড়ে যায়। উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। লঞ্চ কিছুদূর যাওয়ার পর নষ্ট হয়ে যায়। সন্ধ্যার অন্ধকারে রাজাকারেরা পানিতে নেমে সাঁতার কেটে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ফরিদগঞ্জে চলে আসে। ধানুয়া ও চরবসন্ত গ্রামের মানুষ লঞ্চটি গাজীপুরে নিয়ে আসে। লঞ্চ থেকে আটা, চিনি ও গােলাবারুদসহ বিভিন্ন দ্রব্যাদি উদ্ধার করা হয়।
হাসনাবাদের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ থানায় হাসনাবাদ অবস্থিত। ২৭ আগস্ট হাসনাবাদে মুক্তিযােদ্ধা আবুল হােসেন পাকিস্তানিদের হাতে শহিদ হন। আবুল হােসেনের মৃত্যুর বদলা নিতে হাসনাবাদের মুক্তিযােদ্ধারা সংকল্পবদ্ধ হন। ঐ রাতেই সুবেদার জহিরুল হক পাঠান সব প্লাটুনের অধিনায়কদের নিয়ে ১টি পরিকল্পনা। করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৮ আগস্ট খুব ভােরে প্লাটুন অধিনায়করা হাসনাবাদের ডান ও বাম পাশে প্রায় দেড় মাইল এলাকাজুড়ে অ্যামবুশের জন্য অবস্থান নেন। নির্দেশ অনুসারে মুক্তিযােদ্ধারা হাসনাবাদের কোনাে লােককে বাইরে যেতে দেন নি এবং বাইরে থেকে কেউ, ভেতরে এলেও তাকে চলে যেতে দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ মুক্তিযােদ্ধারা পুনরায় রাতে এসে অ্যামবুশের অবস্থান গ্রহণ করার সংবাদ যাতে পাকিস্তানিদের কাছে না পৌছায়, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আনুমানিক সকাল সাড়ে ৮টার দিকে মুক্তিযােদ্ধাদের গােপন তথ্য প্রদানকারী এসে খবর দেয় যে একদল পাকিস্তানি হাসনাবাদের দিকে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতােমধ্যেই হাসনাবাদের লােকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা নিজ নিজ অবস্থানে চলে যান। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, সামনের পানচাইল গ্রামের লােকজন চিৎকার দিতে দিতে এদিক সেদিক ছােটাছুটি করছে। কিছুক্ষণ পরই মর্টারের গােলা মুক্তিযােদ্ধাদের সামনে পেছনে পড়তে লাগল। আনুমানিক ১০ মিনিট ধরে মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর মর্টারের গােলা নিক্ষেপ করা হয়। হঠাৎ ১৫-১৬টি নৌকাকে রাজাকার ও পাকিস্তানিদের নিয়ে হাসনাবাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়।
মুক্তিযােদ্ধারা আনুমানিক ৪ ঘণ্টা ধরে অ্যামবুশের অবস্থানে বসে থাকেন। হঠাৎ কয়েক শ পাকিস্তানিকে গুলি করতে করতে হেঁটে মুক্তিযােদ্ধাদের দিকে আসতে দেখা যায়। কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা হাসনাবাদ বাজারের পূর্ব পাশের গ্রামের শেষে ডান মাথায় একটি মসজিদের ছাদে অবস্থান নেন। এখানে গােলাম মওলা হারেস ছিলেন এলএমজিম্যান। ডান পাশে কেউ ছিলেন না। বামে গ্রামের বিরাট এলাকা নিয়ে অবস্থান নেয় সুবেদার রবের প্লাটুন। বাজারে একটি মাটির উঁচু ডিবিতে অবস্থান নেন সাব-সেক্টর অধিনায়ক সুবেদার জহিরুল হক পাঠান। তার সাথে খালি গায়ে কলিমুল্লা ভূঁইয়া এবং তাদের সাথে এলএমজি নিয়ে অবস্থান নেন নায়েক ছিদ্দিক। বাম পাশের বাজারে অবস্থান নেন। হাবিলদার রশিদের নেতৃত্বে ২টি করে ১০জনের দল। সর্বমােট ৫টি এলএমজি নিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা বসে থাকেন। প্রথমেই নির্দেশ দেওয়া হয় সুবেদার পাঠানের আদেশে প্রথম মাঝখান থেকে এবং পরে ডান পাশ থেকে গুলি শুরু করা হবে। তাদের প্রথম আক্রমণে পাকিস্তানিরা রাস্তার বাম পাশে পড়ে গেলে হাবিলদার রশিদের দল গুলি শুরু করবে। পাকিস্তানিরা টার্গেটমতাে এসে পড়ামাত্রই সুবেদার পাঠান ফায়ারের আদেশ দেন। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় পাকিস্তানিদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ। তাদের অতর্কিত আক্রমণে পাকিস্তানিরা দিশেহারা হয়ে যায়। আনুমানিক ৫-৭ মিনিট পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে কোনাে আক্রমণ আসেনি। আনুমানিক ২৫ মিনিট তাদের ওপর একটানা আক্রমণ করার পর পানচাইল গ্রাম থেকে পাকিস্তানিরা ৪-৫টি হেভি মেশিনগান দিয়ে বৃষ্টির মতাে গুলিবর্ষণ শুরু করে।
সাথে ৩ ইঞ্চি মর্টারের গােলাও বৃষ্টির মতাে পড়তে থাকে । আনুমানিক ১ ঘণ্টা পর মুক্তিযােদ্ধাদের আদেশ দেওয়া হয় গুলি করতে করতে পিছিয়ে যেতে পিছিয়ে গিয়ে জিনের আগরান্দবপুর, নয়নপুর ও কমলপুর গ্রামের ভেতর দিয়ে তারা পানিতালার কাছে চলে আসেন। এখান থেকে আরও দেড় ঘণ্টা পাকিস্তানিদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। পাকিস্তানিরা আনুমানিক ৫ ঘণ্টা হাসনাবাদে নিজেদের লাশ সংগ্রহ করে পিছু হটে যায়। এ সংঘর্ষে আনুমানিক ২৫জন পাকিস্তানি নিহত হয়। ফিরে যাওয়ার সময় পাকিস্তানিরা হাসনাবাদ ক্যাম্পে ও হাসনাবাদ বাজারে অগ্নিসংযােগ করে।
বাজাপ্তি গ্রামের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার হাইমচর থানার গাজীপুর ইউনিয়নে বাজাপ্তি গ্রাম অবস্থিত। গাজীপুর ইউনিয়নের বাজাপ্তি গ্রামসংলগ্ন বেড়িবাঁধের পাশে ৫০জন মুক্তিযােদ্ধার একটি অস্থায়ী ক্যাম্প ছিল। তাদের নেতৃত্ব দিতেন সুবেদার (অব.) নূরুজ্জামান। এখানকার মুক্তিযােদ্ধাদের দায়িত্ব ছিল মেঘনা নদী দিয়ে শক্রদের কোনাে যানবাহন চলাচল করলে তাতে আক্রমণ করা। ৩০ আগস্ট আনুমানিক বেলা ১টায় পাকিস্তানিরা এ সংবাদ পেয়ে। মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালানাের জন্য চাঁদপুর থেকে রওনা হন। পাকিস্তানিদের এ সম্ভাব্য আক্রমণের খবর পেয়ে দেলােয়ার হােসেন স্বপন, মনছুর গাজী, ফয়েজবক্স বেপারী, হামিদ উল্লাহ গােলজার, ড. তাজুল ইসলাম হাওলাদার, আব্দুল মজিদ মুন্সি, শাহজাহান হাওলাদার, শহিদ এলাহী বক্স পাটোয়ারী, শহিদ সিরাজুল ইসলাম খান, শহিদ আবুল হােসেন পাকিস্তানিদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বেড়িবাঁধের পাশে অবস্থান নেন।
পাকিস্তানিরা বাজাপ্তি গ্রামের সন্নিকটে পৌছে অতর্কিত গুলিবর্ষণ শুরু করে। উভয় পক্ষের মধ্যে আনুমানিক ৩ ঘণ্টাব্যাপী গুলিবর্ষণ চলে। মুক্তিযােদ্ধাদের বেপরােয়া আক্রমণের ফলে পাকিস্তানিরা মুক্তিযােদ্ধাদের অস্থায়ী ক্যাম্পের সন্ধান লাভ করতে পারেনি। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিরা চাঁদপুরের দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে উভয় পক্ষের কতিপয় সদস্য আহত হয়। তবে কেউ মারা যায়নি। এ ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পর পাকিস্তানিরা রাত আনুমানিক ২টায় বাজাপ্তি গ্রামে হানা দেয় এবং চানবক্স কাজী, মাখন লাল চক্রবর্তী ও আসেন্দ্র দাসের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।
গঙ্গাজলী ব্রিজের লড়াই
গঙ্গাজলী ব্রিজ রূপসা বাজারের সন্নিকটে ফরিদগঞ্জ থানার অন্তর্গত। মুক্তিযােদ্ধাদের একটি প্লাটুন খাজুরিয়া গল্লাক ও রামগঞ্জের অবস্থানে ছিল। এদিকে রূপসার একটু আগের গঙ্গাজলী ব্রিজের কাছে ২টি ১০জনের দল নিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থানে থাকেন নায়েব সুবেদার হারেসের দল। সুবেদার পাঠান। পাকিস্তানিদের রূপসা বাজারের দিকে আগমনের খবর পেয়ে খাজুরিয়া গল্পাক ও রামগঞ্জের প্রতিরক্ষায় অবস্থানরত প্লাটুনের প্লাটুন অধিনায়ক হাবিলদার আ. রশিদসহ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধাকে গঙ্গাজলী ব্রিজের কাছে অবস্থানরত অন্য মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে যােগ দিতে বলেন। ৩১ আগস্ট, বুধবার। স্থানীয় জনগণ মুক্তিযােদ্ধাদের জানায় যে একদল পাকিস্তানি ও রাজাকার হেঁটে রূপসার দিকে আসছে। সুবেদার পাঠানের পরিকল্পনামতাে নায়েব সুবেদার হারেস তার দল নিয়ে অবস্থান নেন গঙ্গাজলী ব্রিজের উভয় দিকে এবং হাবিলদার রশীদের দল অবস্থান নেয় রূপসা দেওয়ানজী বাড়ি ও দিঘির পাড়ে। শক্ররা রূপসা বাজারে এসে একদল রূপসা দিঘির পশ্চিম পাড়ে অবস্থান নেয় এবং বাকিরা রাজাকারদের নিয়ে দোকানের তালা ভেঙে মালপত্র স্থূপ করতে থাকে। এ অবস্থায় সর্ব প্রথম আক্রমণ করা হয় নায়েব সুবেদার হারেসের দল থেকে এবং এরই সাথে আক্রমণ করেন হাবিলদার রশীদ। হঠাৎ আক্রমণে শত্রুরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। বাজারে উপযুক্ত পজিশনের স্থান না থাকায় রাজাকাররা রূপসা দিঘিতে লাফিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর শুরু হয় পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে পাল্টা আক্রমণ। শুরু হয় দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ। স্থানীয় কিছু জনতাও যােগ দেয় মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্যে।
মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচণ্ড প্রতিরােধের মুখে পাকিস্তানিরা পিছু হটতে শুরু করে। | সেদিন মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানিদের তেমন হতাহত করতে না পারলেও, তাদের প্রচণ্ড প্রতিরােধে শত্রুরা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়ে পালাতে বাধ্য হয়। মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুর ফেলে যাওয়া আনুমানিক ২০০ রাউন্ড গুলি এবং ১টি চাইনিজ রাইফেল হস্তগত করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে কেউ কেউ আহত হলেও সামগ্রিক বিবেচনায় এ প্রতিরােধ ছিল উল্লেখযােগ্য।
মজুমদারবাড়ির যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার চাঁদপুর সদর থানায় ১২ নম্বর চান্দ্রা ইউনিয়নে মজুমদারের বাড়ি। ২ সেপ্টেম্বর শুক্রবার আনুমানিক রাত দেড়টায় মজুমদারবাড়িতে পাকিস্তানি বাহিনী ও মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধ পরদিন আনুমানিক সকাল ৮টা পর্যন্ত চলতে থাকে। মেজর নূর আহম্মদ গাজীর নেতৃত্বে ৪২জন মুক্তিযােদ্ধা এ রক্তক্ষয়ী সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। ১১টি নৌকাযােগে আনুমানিক ৮০জন পাকিস্তানি। (রাজাকারসহ) যুদ্ধক্ষেত্রে আসে। উভয় পক্ষের মধ্যে তীব্র গুলিবিনিময় হয়। শত্রুবাহিনীর সঙ্গে প্রাণপণ লড়াই করে শহিদ নূর আহম্মদ গাজী, আ. সােবাহান গাজী, আ, কুদুস গাজীসহ আরও কতিপয় নাম না জানা মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। এ যুদ্ধে ৮জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন এবং ৭জন মুক্তিযােদ্ধা আহত হন। ৮জন মুক্তিযােদ্ধার মধ্যে মেজর নূর আহাম্মদ গাজীও শহিদ হন। এ ছাড়া ৫জন পাকিস্তানি নিহত এবং ৭জন আহত হয়।
আকন্দহাট বাজারের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলা সদরের কাছে আকন্দহাট বাজারে মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি কোম্পানি তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। রামচন্দ্রপুর স্থানীয় দালাল ও রাজাকারেরা পাকিস্তানিদের এ ঘাটি সম্বন্ধে খবর দেয়। এ বাজারটির তিন দিকে পানি থাকায় মুক্তিযােদ্ধারা ঘটিটিকে যথেষ্ট নিরাপদ মনে করতেন। ৬ সেপ্টেম্বর সকাল ৬টার সময় পাকিস্তানিদের ১টি শক্তিশালী দল স্থানীয় দালালদের সহযােগিতায় মুক্তিযােদ্ধাদের এ ঘাঁটি আক্রমণের জন্য আসে। আক্রমণের সময় তারা নৌকার সাহায্যে খাল পার হয়ে ঘাটির দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। পাকিস্তানিরা কাছে এসে পৌঁছলে মুক্তিযোেদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ চালান। দুই ঘণ্টার যুদ্ধে ১জন মেজরসহ আনুমানিক ৩৭জন পাকিস্তানি নিহত হয়। খাল পার হতে না পেরে এবং হতাহতের ফলে তারা। ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। মুক্তিযােদ্ধাদের কোম্পানিটি পরে সেখান থেকে নিরাপদে অন্য ঘাটিতে চলে যায়।
সূচিপাড়া গুদারাঘাটের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি থানার সূচিপাড়া ইউনিয়নে সূচিপাড়া গুদারাঘাট অবস্থিত। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মেহের রেল স্টেশনের শক্ত অবস্থান থেকে ডাকাতিয়া নদীর উত্তর তীরে পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকলেও নদীর দক্ষিণে শােরশাক, সূচিপাড়া ইত্যাদি এলাকা থেকে আগত মুক্তিযােদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে পাকিস্তানিরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। অবশেষে তারা সূচিপাড়া গুদারাঘাট দিয়ে ডাকাতিয়া নদী অতিক্রম করে নদীর দক্ষিণে তাদের অবস্থান সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়। মুক্তিযােদ্ধারা তা প্রতিহত করার জন্য শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেন। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে শুক্রবার সকাল ১০টায় স্থানীয় রাজাকারসহ পাকিস্তানিদের আনুমানিক ৮০জনের ১টি দল সূচিপাড়া গুদারাঘাটে পৌছে নদী অতিক্রমের চেষ্টা চালায়। নদীর অপর পাড় থেকে সুবেদার সিরাজ, হাবিলদার আরব আলীসহ অবস্থানকারী আনুমানিক ১৫০জন মুক্তিযােদ্ধা পাকিস্তানিদের আক্রমণ করেন। শুরু হয় তুমূল যুদ্ধ। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর পাকিস্তানি ১জন মেজর নিহত হলে পাকিস্তানিরা আত্মরক্ষার্থে পালিয়ে যায়।
রঘুনাথপুরের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ থানার কালাচৌ (উত্তর) ইউনিয়নে রঘুনাথপুর অবস্থিত। ৮ সেপ্টেম্বর রঘুনাথপুরে রাজাকারদের সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধ। হয়। এখানে ছােট-বড়াে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ হয় রঘুনাথপুর বাজারের কচুয়ায়। ৮ সেপ্টেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা রঘুনাথপুর বাজারে প্রবেশ করেন। উদ্দেশ্য, ছবি তােলা। মুক্তিযােদ্ধারা বাজারটিকে মুক্ত ভেবেছিলেন, যেখানে পাকিস্তানি বা রাজাকার সহজে প্রবেশ করবে না। তাই ইচ্ছে করেই তারা কোনাে প্রতিরােধব্যবস্থা গ্রহণ না করে কেবল অস্ত্র নিয়ে বাজারে প্রবেশ করেন। দালালরা তাদের আগমনের কথা রাজাকারদের জানিয়ে দেয়। হঠাৎ উল্টো পথে বাজারের পেছন দিক দিয়ে রাজাকাররা মুক্তিযােদ্ধাদের ঘিরে ফেলে। দেরি না করে সরাসরি তারা মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ করে। হঠাৎ আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা কিছুটা ভড়কে যান। তবে দেরি না করে তারাও অবস্থান নিয়ে রাজাকারদের ওপর পাল্টা আক্রমণ করেন। তুমুল যুদ্ধে একসময় রাজাকারদের প্রতিরােধের দুর্গ ভেঙে মুক্তিযােদ্ধারা একদিক দিয়ে বেরিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে আসেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মুক্তিযােদ্ধা মতিন নিজ অবস্থান থেকে নিরাপদ স্থানে যেতে পারেননি। অসীম সাহস নিয়ে তিনি একাই রাজাকারদের সাথে লড়ে যান। একসময় রাজাকারের দল মতিনকে ঘিরে ফেলে।
মতিন যখন দেখলেন কেউ কাছাকাছি অবস্থানে নেই, ততক্ষণে তাঁর গুলি প্রায় শেষ হয়ে যায়। মৃত্যু অবধারিত জেনেও শেষ পর্যন্ত তিনি রাজাকারদের বিরুদ্ধে লড়ে যান। রাজাকাররা মতিনকে তার অবস্থানেই গুলি করে। তার দেহ রাজাকাররা গুলির পর গুলি করে ঝাঁঝরা করে ফেলে। পরে মুক্তিযােদ্ধারাও অনেক চেষ্টা করে রাজাকারদের প্রতিহত করেন। মতিনের লাশটি রেখে দেওয়ার জন্য। কিন্তু ততক্ষণে তাদের গােলাবারুদ শেষ হয়ে যায়। ঘাতকেরা তার লাশটি সাথে করে নিয়ে যায় । রঘুনাথপুরের যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধা আব্দুল মতিন এবং আরও ৪-৫জন গ্রামবাসীও শহিদ হন।
মুন্সিরহাটের সম্মুখযুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার মতলব থানায় মুন্সিরহাট অবস্থিত। সেপ্টেম্বর মাসে গােপন সূত্রে মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে খবর আসে যে, শত্রুর একটি দল মুন্সিরহাটে আনুমানিক রাত ৯টা থেকে বারােটা পর্যন্ত টহল দেয়। তাদের অতর্কিত আক্রমণ করার জন্য মুক্তিযােদ্ধারা পরিকল্পনা করেন। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে আনুমানিক রাত ১০টায় মুন্সীরহাটের রাস্তার দুই পাশে মুক্তিযােদ্ধারা অবস্থান গ্রহণ করেন। উদ্দেশ্য, টহলরত শক্রদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করা। হঠাৎ টহলরত দলটিকে মুক্তিযােদ্ধাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। টহলরত দল নিয়ন্ত্রণ এলাকায় আসামাত্রই মুক্তিযােদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ শুরু করেন। হঠাৎ আক্রমণে শক্ররা কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও সাথে সাথে তারাও মুক্তিযােদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে কিছু রিকশাওয়ালাও যােগ দেন। মুক্তিযােদ্ধা ও রিকশাওয়ালাদের হাতে ২জন শত্রু মারা যায়। শত্রুর পাল্টা আক্রমণে বেয়নেটের আঘাতে ২জন মুক্তিযােদ্ধা ও রিকশাওয়ালা শহিদ হন।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড