চরশােলাদী গ্রামের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার হাইমচর থানায় নীলকমল ইউনিয়নে চরশােলাদী অবস্থিত। ৩০ জুলাই আনুমানিক বিকাল ৪টায় প্রায় ২০জন পাকিস্তানি ১০-১২জন রাজাকারসহ হাইমচর থানার নীলকমল ইউনিয়নে চরশােলাদী গ্রামের আওয়ামী লীগ সাবেক নেতা আব্দুল্লাহ সরকারের বাড়িতে আক্রমণ চালায়। তারা ঐ নেতার বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। এ সময় নীলকমল ইউনিয়নের সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্যরা যথাক্রমে সুলতান আহম্মদ মাস্টার, দেলােয়ার হােসেন স্বপন, মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ, নেওয়ার আহম্মদ, মুন্নাফ পাটোয়ারী, আবু সাইদ কবিরাজ, আব্দুল বাতেন বেপারী, আলী হােসেন আকন্দ, যুদ্ধাহত গােলজার আহম্মদ ও শহিদ আব্দুল কাদের মাখন মুক্তিযােদ্ধাদের খবর দেন। চরভৈরবী ইউনিয়নের আলমগীর ও আলগী (উত্তর ও দক্ষিণ) এবং হাইমচর ইউনিয়ন থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানিরা রাজাকারসহ এ স্থান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তবে এ আক্রমণে কোনাে পক্ষের লােকজন মারা যায়নি। উভয় পক্ষের বেশ কয়েকজন আহত হয়।
দিয়া আড়ংয়ের যুদ্ধ
চাদপুর জেলার মতলব থানায় বরদিয়া আড়ং অবস্থিত। আগস্টের প্রথম দিকে। গােপনসূত্রে মুক্তিযোদ্ধারা খবর পান যে বরদিয়া আড়ংয়ের বাজার বরাবর রাস্তায় পাকিস্তানিরা টহল দেয়। গােপন খবর অনুযায়ী তারা জানতে পারেন যে পাকিস্তানিরা রাত আনুমানিক ১১টা থেকে ভাের ৪টা পর্যন্ত এ এলাকায় টহল দেয়। অতিগােপনে শক্রর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার পর মতলব থানায় অবস্থানরত মুক্তিযোেদ্ধারা তাদের অ্যামবুশের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। অ্যামবুশের নেতৃত্ব দেয় মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক কাজী সাইদুর রহমান রতন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৪ আগস্ট মধ্যরাতে অ্যামবুশের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। ৪ আগস্ট রাত ১০টার মধ্যে মতলব থানার ৩ কিলােমিটার দক্ষিণে বরদিয়া আড়ংয়ের বাজারসংলগ্ন রাস্তার দুই পাশে অতিগােপনে মুক্তিযােদ্ধারা অ্যামবুশের জন্য অবস্থান গ্রহণ করেন। অপারেশনের গােপনীয়তা রক্ষার উদ্দেশ্যে ঐদিন গ্রামের কাউকেই গ্রাম থেকে বের হতে দেওয়া হয় নি, আবার বাইরে থেকে কেউ ভেতরে এলে তাকেও বের হতে দেওয়া হয় নি।
রাত ১০টার পর রাস্তার ওপর চলাচল বন্ধ হয়ে আসে। শুরু হয় অপেক্ষার পালা। রাত আনুমানিক ১টার দিকে হঠাৎ পাকিস্তানিদের টহলরত দলকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। ধারণার চেয়ে বেশি শত্রু আসায় মুক্তিযােদ্ধাদের পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন আসে। টহলরত দলটি কাছাকাছি আসামাত্রই অধিনায়ক সাইদুর রহমান গুলিবর্ষণ শুরু করার আদেশ দেন। পাকিস্তানিরাও প্রস্তুত ছিল। তাই অতর্কিত আক্রমণের সাথে সাথে তারাও পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। উভয় পক্ষে আনুমানিক ১ ঘণ্টা যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে কোনাে পক্ষেই হতাহত হয় নি। তবে দীর্ঘ ১ ঘণ্টা যুদ্ধ করার পর মুক্তিযােদ্ধাদের সুতীব্র আক্রমণের কারণে পাকিস্তানিরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। হতাহত না হলেও এ যুদ্ধের পর পাকিস্তানিরা এ এলাকায় পরবর্তী সময় টহল দেওয়ার সাহস করে নি।
বাসারা বাজারের যুদ্ধ
চাদপুর জেলার হাজীগঞ্জ থানায় বাসারা বাজার অবস্থিত। ৫ আগস্ট এখানে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানিদের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের ২ নম্বর প্লাটুন ছিল হাজীগঞ্জ থানার তামান ঠাকুরবাড়িতে। সম্ভবত বৃহস্পতিবার খুব ভােরে মুক্তিযােদ্ধাদের বাসারা বাজার প্রতিরক্ষা অবস্থানে পাঠানাে হয়। চারদিকে অথৈ পানি। কোথাও অবস্থান নেওয়ার উপযুক্ত স্থান নেই। এদিকে সুবেদার জহিরুল হক পাঠান রাতেই খবর পান যে, পাকিস্তানিরা মুন্সিরহাট হয়ে। ননায়াখালীর রামগঞ্জ বাজার যেতে পারে। সুবেদার জহিরুল হক পাঠানের নির্দেশে প্লাটুন অধিনায়করা মুক্তিযােদ্ধাদের কামতা বাসারা থেকে প্রায় আধা মাইল নিয়ে পাকিস্তানিদের আক্রমণের জন্য। ১টি প্লাটুনকে ওয়াপদা রাস্তার অপর পাশে সুবেদার আ, রবের নেতৃত্বে রাখেন। পাঠান কলিমুল্লা ভূঁইয়া মাঝখানে কামতাবাজার প্রতিরক্ষার অবস্থানে থেকে যান। ঠিক সকাল ৭টার সময় জনগণের মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধাদের খবরদাতা। জানালেন, পাকিস্তানিরা মুন্সিরহাট পৌছে সেখান থেকে দুইভাগে রওনা হয়েছে। তারা আনুমানিক ৭০জনের মতাে পায়ে হেঁটে এবং ৩৫জনের মতাে লঞ্চে আসছে। মুক্তিযােদ্ধারা জহিরুল হক পাঠানের নির্দেশমতাে যিনি যেভাবে পেরেছেন, বাড়িতে, রাস্তায় এবং বড়াে বড়াে গাছের আড়ালে দাড়িয়ে বিভিন্নভাবে অবস্থান নিয়েছেন। হঠাৎ করে বাসারা ও তার আশপাশের গ্রামে শুরু হয় মর্টারের গােলাবর্ষণ।
তাদের গােলাগুলি বিশেষ করে বাসারা, কামতাবাজারে। মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানেই পড়ে। পানির কারণে দু-একটি বিস্ফোরিত হলেও বেশির ভাগই অকেজো হয়ে মাটিতে ঢুকে যায়। ঠিক টার্গেটমতাে পড়ছে দেখে মুক্তিযােদ্ধাদের সেকশন অধিনায়ক গানার নায়েক আ, মতিন ও সিপাহি রহমত এবং অন্যরা ধারণা করেন যে পাকিস্তানিরা মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান দূরবিনের মাধ্যমে ঠিকই দেখে ফেলেছে। প্রায় আধা ঘণ্টা পর দেখা যায়, নদীতে লঞ্চ দিয়ে সমান গতিতে আস্তে আস্তে পাকিস্তানিরা এগিয়ে আসছে। এবার তারা মর্টারের সাথে সাথে একক ও মাঝে মাঝে অটোমেটিক হাতিয়ারের ব্রাশফায়ার এদিকে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান দেখে খুব ভােরেই জনগণ নৌকায়, পানি। সতরিয়ে এবং হেঁটে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। পাকিস্তানিরা ধীরে ধীরে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানে পৌছে যায়। মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান ছিল বাসারা বাজারের একটু আগে। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে কামতাবাজার থেকেই শুরু হয় আক্রমণ, সাথে সাথে বাসারার আশপাশ থেকেও মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ শুরু হয়। এবার পাকিস্তানিদের লঞ্চ পাড়ে ভিড়ে গেল। তাদের বেশির ভাগই রাস্তায় অবস্থান নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর বৃষ্টির মতাে অনবরত গুলি করে। যায়। অধিনায়ক লক্ষ্য করছেন, লঞ্চটিও আস্তে আস্তে মােড় ঘুরিয়ে পেছনের দিকে চলে যাচ্ছে। দূরত্ব বেশি হওয়ার কারণে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের প্রতি গুলিবর্ষণের মাত্রা কমিয়ে দেন। পাকিস্তানিরা মর্টারের ও হেভি মেশিনগানের অবস্থান থেকে একটানা গুলি করে যায়। নির্দেশ অনুযায়ী আধা ঘণ্টা পর যখন সুবেদার আ. রব আক্রমণ শুরু। করেন, এবার পাকিস্তানিরা কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পিছু হটতে শুরু করে। পাকিস্তানিরা প্রায় ২ ঘণ্টা মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানে একটানা গুলিবর্ষণ করে। মুক্তিযােদ্ধারা কিছু করতে না পারলেও প্রায় ২ ঘণ্টা তাদের প্রতিরােধ করে রাখেন। মুক্তিযােদ্ধাদের ত্রিমুখী প্রবল প্রতিরােধের মুখে তারা পরাস্ত হয়ে। পুনরায় হাজীগঞ্জে চলে যায়।
ওটতলী ও পাইকপাড়া হাই স্কুলের যুদ্ধ
আব্দুল মােমেন খান মাখনের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযােদ্ধা প্রচুর গােলাবারুদ ও অটোমেটিক হাতিয়ার, রাশিয়ান এলএমজি, মর্টারসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র নিয়ে চাঁদপুর জেলার ওটতলী ও পাইকপাড়া হাইস্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ওটতলীতে আগমনকারী পাকিস্তানিদের ধ্বংস করা। ১০ আগস্ট গােপন সূত্রে খবর আসে, পাকিস্তানিরা ওটতলীতে আসছে। আনুমানিক সকাল ৮টায় খবর পেয়ে ক্যাম্পে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানিদের প্রতিহত করার জন্য অবস্থান নিয়ে থাকেন। গ্রামের আড়াল দিয়ে অগ্রসর হয়ে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানিদের আক্রমণ করেন। পাকিস্তানিরা মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরােধ আক্রমণে টিকতে না পেরে বাধ্য হয়ে ধাওয়া খেয়ে মুন্সিরহাট দিয়ে নৌকায় হাজীগঞ্জে চলে যায়। প্রায় ১ ঘণ্টা হিট অ্যান্ড রান। লড়াইয়ে আনুমানিক ৩-৪জন পাকিস্তানি মারা যায় ও কয়েকজন আহত হয়। সাব-সেক্টর অধিনায়ক পাঠান জানতে পারেন যে, পাকিস্তানিরা এসে হঠাৎ ইস্টা স্কুলে ক্যাম্প করেছে। তারা এখন পাইকপাড়া হয়ে কড়ইতলী এসে হাসপাতালে রাতে থাকবে। খবর পাবার সাথে সাথে জহিরুল হক পাঠান। সুবেদার রবের ১ নম্বর প্লাটুনকে পাইকপাড়া ও কাসারার রাস্তায় অ্যামবুশের জন্য অবস্থান নিতে বলেন। তাদের সাথে কলিমুল্লা ভূঁইয়া যােগদান করেন। মুক্তিযােদ্ধারা পাইকপাড়ার বাম পাশে কাতারা রাস্তায় অ্যামবুশের জন্য অবস্থান নেন। আব্দুল মােমেন খান মাখনের গ্রুপও সেখানে তাদের সাথে অ্যামবুশ। করে। ২ নম্বর প্লাটুন হাবিলদার রশীদের নেতৃত্বে পাইকপাড়ার একটু আগে সাইচাখালীর কাছে অ্যামবুশের জন্য অবস্থান নেয়। আনুমানিক দুপুর ১২টায় পাকিস্তানিরা পাইকপাড়ার কাছাকাছি আসামাত্রই শুরু হয় অতর্কিত আক্রমণ। পাকিস্তানিরা প্রথম আক্রমণ সামলে গুলি করতে করতে সাইড রােল দিতে থাকে। এবং এভাবে তারা খুব দ্রুত প্রায় ১ ঘণ্টার মধ্যে পাইকপাড়া থেকে রূপসার দিকে যে রাস্তা গিয়েছে, সেখানে গিয়ে ওঠে। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে কোনাে মুক্তিযােদ্ধা রাখা হয়নি বলেই তাদের পুরােপুরি ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। এ সংঘর্ষে আনুমানিক ৬-৭জন পাকিস্তানি মারা গেছে এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। সংঘর্ষের পর ১টি চাইনিজ রাইফেল এবং বেশ কিছু গােলাবারুদ মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানিদের পরিকল্পনা ছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের ঘিরে ফেলে আক্রমণ করা, সে জন্য তারা কিছু দুর্ধর্ষ সৈনিক মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর আক্রমণের জন্য পাঠায়। কিন্তু ওটতলী ও পাইকপাড়ায় মুক্তিযােদ্ধাদের অপ্রতিরােধ্য আক্রমণে তারা নাজেহাল হয়ে ফিরে যায়।
নন্দলালপুর বাজারের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত মতলব থানায় ইসলামাবাদ ইউনিয়নে নন্দলালপুর। অবস্থিত। মুক্তিযােদ্ধাদের গুপ্তচর পাকিস্তানিদের গতিবিধির ওপর বিশেষ নজর রাখে। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে মুক্তিযােদ্ধারা গােপন সূত্রে খবর পান, পাকিস্তানিদের ১টি দল নন্দলালপুর বাজার আক্রমণ করবে। খবর পাওয়ার সাথে সাথেই মুক্তিযােদ্ধারা পাল্টা আক্রমণের জন্য। পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সূত্র অনুযায়ী ১২ আগস্ট সকালবেলা পাকিস্তানিদের। বাজার আক্রমণ করার কথা। তাই ঐদিন সকালবেলা অধিনায়ক এম এ ওয়াদুদের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযােদ্ধা পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ চালানাের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ১২ আগস্ট আনুমানিক সকাল ১০টায় পাকিস্তানিরা নন্দলালপুর বাজার আক্রমণ করতে আসে। ঠিক সেই মুহূর্তেই মুক্তিযােদ্ধারা তাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালান। সারা দিন ধরে দুই পক্ষের মধ্যে সম্মুখযুদ্ধ চলতে থাকে। সারা দিন যুদ্ধের পর কোণঠাসা হয়ে পড়ে পাকিস্তানিরা। একপর্যায়ে তারা নদীপথে পালিয়ে যায়। নদীপথে পালাবার চেষ্টাকালে আনুমানিক ৩জন পাকিস্তানি মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিতে মারা যায় এবং ১জন বন্দি হয়। জীবিত শত্রু সৈনিক বন্দি করার সাফল্যে শুধু মুক্তিযােদ্ধারাই নন, জনগণও উল্লসিত হয়।
মেঘনা নদীতে অপারেশন
চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর সদর থানা হানারচর ইউনিয়নের ওপর দিয়ে মেঘনা নদী প্রবাহিত। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পাকিস্তানিদের গতিবিধি লক্ষ্য। করে মুক্তিবাহিনীর গুপ্তচরেরা শিকারির মতাে তীক্ষ সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে ফেরে। চাঁদপুর শহরসংলগ্ন ডাকাতিয়া মেঘনা নদীতে পাকিস্তানিদের গানবােটের গতিবিধি টের পেয়ে চাঁদপুর থানার হানারচর ইউনিয়নের শেখেরহাট বাজারে মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণের জন্য অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৫ আগস্ট আনুমানিক বিকাল ৫টায় ৩০জন মুক্তিযােদ্ধা পাকিস্তানিদের গানবােটে গুলিবর্ষণ করেন। পাকিস্তানিরাও পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। উভয় পক্ষের গুলিবর্ষণে ৫জন মুক্তিযােদ্ধা ও কয়েকজন পাকিস্তানি আহত হয়। উল্লিখিত তারিখে রাত ১টায় চাঁদপুর নতুন বাজার লঞ্চঘাটে মমিনউল্লাহ পাটোয়ারীর (বীরপ্রতীক) নেতৃত্ব নৌ-কমান্ডাে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ১টি মালবাহী জাহাজ মাইন দিয়ে ধ্বংস করে দেন।
বলাখাল হরিসাহার বাড়ির যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত হাজীগঞ্জ থানার হাজীগঞ্জ ইউনিয়নে বলাখাল অবস্থিত। বলাখাল বাজারের ঠিক দক্ষিণে রামচন্দ্র খেয়াঘাটের কাছে হরিসাহার বাড়ি। ১৭ আগস্ট দুপুর ১২টায় খবর আসে, রাজাকারেরা বলাখালের রামচন্দ্রপুর খেয়াঘাটের কাছে হরিসাহার বাড়ির আটচালা ঘর ভেঙে ফেলেছে। তাদের উদ্দেশ্য লুট করা। মুক্তিযােদ্ধাদের ২ প্লাটুন সৈন্য ছিল বাসারা বাজারে। খবর পাওয়ার সাথে সাথে মুক্তিযােদ্ধারা সবাই যার যার অস্ত্র নিয়ে অধিনায়ক পাঠানের নির্দেশে ৮-১০টি নৌকা নিয়ে রামচন্দ্রপুর খেয়াঘাটে চলে আসেন। অধিনায়ক পাঠানের নেতৃত্বে শাহজাহান, গফুর বালুচ, নায়েক ছিদ্দিক ডান দিক দিয়ে হরিসাহার বাড়ির কাছে অবস্থান নেন। আর দুটি দল কলিমুল্লা ভূইয়া ও হাবিলদার রশীদের নেতৃত্বে বাম দিক দিয়ে ঢুকে পড়ে।
আক্রমণের পূর্বে ছদ্মবেশে সবাই নৌকায় ওঠেন। প্রতিটি নৌকায় ৫-৬জন করে ওঠেন। প্রতি নৌকায় ১টি করে এলএমজি এবং পর্যাপ্ত রাইফেল দেওয়া হয়। ওপারে পৌছে সবাই দ্রুত হরিসাহার বাড়ির কাছে অবস্থান নেন। খেয়াঘাটে নদীর এ পারে ১০জনের ১টি দল ও এলএমজি রাখা হয়। যাতে যেকোনাে বিপদে সাহয্যে এগিয়ে আসা যায়। পাড়ে পৌছে ছদ্মবেশ খুলে হাবিলদার রশিদ ও কলিমুল্লা ভূঁইয়া সবাইকে নিয়ে পাটক্ষেতে এবং খেজুরগাছের আড়াল নিয়ে একেবারে হরিসাহার বাড়ির কাছে দাসবাড়িতে (জেলেদের বাড়িতে) অবস্থান নেন। মুক্তিযােদ্ধারা তিন দিক থেকে রাজাকারদের ঘিরে ফেলেন। এতক্ষণ পর্যন্ত লুটতরাজে মত্ত থাকার জন্য রাজাকাররা কিছুই টের পায়নি। কেউ আটচালা ঘরের টিন খুলছে কেউ খােলা টিন স্থূপ করছে। মােটামুটি সবাই লুটতরাজে ব্যস্ত। সবাইকে ইশারা করে পাঠান গুলি করার আদেশ দিলেন। গুলির সাথে সাথে রাজাকাররা চিকার শুরু করে দেয় এবং গুলির আঘাতে অধিকাংশই নীচে পড়ে যায়। ৫-৭ মিনিট গুলি করার পর জহিরুল হক পাঠান দুই পাশ দিয়ে গুলি করতে করতে মাঝখানের দল নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে অবস্থান নেন। হঠাৎ রাজাকারদের পাশ থেকে ২-১টি চাইনিজ রাইফেল থেকে গুলি বর্ষিত হয়। ইতােমধ্যেই বাকি সবাই হরিসাহার বাড়িতে ঢুকে পড়েন এবং বাকি জীবিত রাজাকারদের হাত ওপরে তুলে দাড়াতে নির্দেশ দেন।
আনুমানিক ১২জন রাজাকারকে পিছমােড়া করে বাঁধা হয়। তাদেরকে। বাজারে এনে জনগণের প্রবল চাপের মুখে তাদের কাছে ছেড়ে দেওয়া হয়। মুক্তিযােদ্ধারা এরপর নৌকায় ওঠেন এবং পরে বাসারার দিকে রওনা দেন। নৌকা ছেড়ে ১০০ গজ আসতেই পাকিস্তানিদের ৩ ইঞ্চি মর্টারের গুলি শুরু হয়। সাথে শুরু হয় এইচএমজির গুলি। মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণের জন্য ৪-৫টি ট্রাকে আনুমানিক ৭০-৮০জন পাকিস্তানি হাজীগঞ্জ থেকে এদিকে এসেই বলাখালের খেয়াঘাটে নদীর অপর পারে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানিরা এসে মৃত রাজাকারদের লাশ নিয়ে যায়। হরিসাহার বাড়ির যুদ্ধে রাজাকারদের মেরে জনগণ পাকিস্তানিদের যে শিক্ষা দেয়, তাতে তাদের ভেতরে আরও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে আনুমানিক ৩৫জন রাজাকার নিহত হয় এবং জনগণের হাতে নিহত হয় আনুমানিক ১২জন। পাকিস্তানিদের হাতে ৩জন নিরীহ বাঙালি শহিদ হন। রাজাকারদের কাছ থেকে ৪টি চাইনিজ রাইফেল এবং ৪০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড