You dont have javascript enabled! Please enable it!
উজানচর-আসাদনগর লঞ্চ আক্রমণ
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সবচেয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে বাঞ্ছারামপুর থানা অবস্থিত। নদীপথেই জেলার বিভিন্ন থানার সাথে যােগাযােগ ব্যবস্থা ছিল। এ সময় পাকিস্তানি সেনারা তাদের অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলােয় লঞ্চ ও নৌকার সাহায্যে রসদ সরবরাহ করতাে। নদীপথে জলযান বন্ধ করে দেওয়ার জন্য মেজর খালেদ মােশাররফ একটি গেরিলা দলকে বাঞ্ছারামপুর থানার উজানচরের কাছে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী পাইলনগুলাে কেটে নদীতে ফেলে নদীপথে বাধা সৃষ্টি করার নির্দেশ দেন। নির্দেশমতাে মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা দল বৈদ্যুতিক পাইলনগুলাে কেটে নদীতে ফেলে দিয়ে একটু দূরে অ্যামবুশ পেতে অপেক্ষা করতে থাকে। পাইলন কাটার সংবাদ পেয়ে ৩-৪ লঞ্চভর্তি পাকিস্তানি সেনা, মুজাহিদ ও রাজাকার নদীপথে এ বাধাগুলাে পরিষ্কার করার জন্য আসে। | পাকিস্তানি সেনারা যখন কাজে লেগে যায়, ঠিক তখনই অদূরে অ্যামবুশ পেতে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধারা তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। এর ফলে প্রায় ৭০-৮০জন পাকিস্তানি সেনা, মুজাহিদ ও রাজাকার নিহত হয়।
গেরিলাদের প্রচণ্ড গােলার মুখে অবশিষ্ট পাকিস্তানি সেনারা লঞ্চ নিয়ে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করে। এ বিপর্যয়ের কয়েকদিন পর পাকিস্তানি সেনারা প্রতিশােধ নেওয়ার জন্য ৫-৬টি লঞ্চে বিপুলসংখ্যক সৈন্য বিমান বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিযােদ্ধারা শুধু হালকা মেশিনগান, রাইফেল ও এসএলআর নিয়ে পাকিস্তানিদের এ বিপুল শক্তির বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ চালান। কিন্তু বিমান আক্রমণের বিরুদ্ধে টিকতে না পেরে অবশেষে অবস্থানটি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন। এর ৩ দিন পর ১১ অক্টোবর বিকাল ৪টায় মুক্তিযােদ্ধাদের এ দলটি জানতে পারে যে, পাকিস্তানিদের ১টি প্লাটুন লঞ্চযােগে বাঞ্ছারামপুর থানার আসাদনগর এলাকা লুট করার জন্য অগ্রসর হচ্ছে। এ খবর পেয়ে গেরিলা দলটি পাকিস্তানিদের লঞ্চটিকে। আসাদনগরের কাছে অ্যামবুশ করে। অ্যামবুশে ৮জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং অন্যরা পালিয়ে যায়। মুক্তিযােদ্ধাদের আরেকটি দল হােমনায় তাদের ঘাঁটি তৈরি করে। এ সময় হােমনা থানায় পাকিস্তানি সেনারা পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশ মােতায়েন করে। মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা দলটি হােমনা থানায় অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ৭জন পাকিস্তানি পুলিশকে হত্যা করে এবং ৭টি রাইফেল ও কয়েক’শ রাউন্ড গুলি। দখল করে।
নয়াপুর ফুলগাজী আক্রমণ
ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা থানা কসবার অন্তর্গত নয়াপুর ফুলগাজীতে ২৯ অক্টোবর ভাের ৪টার সময় পাকিস্তানি সেনারা শালদায় মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর কামানের সাহায্যে প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ করে। মুক্তিযােদ্ধাদের কামান গুলি ও প্রত্যুত্তর দেয়। সকালে পাকিস্তানি সেনারা তিন দিক থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়। প্রায় ৫ ঘণ্টা যুদ্ধের পর। মুক্তিযােদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিদের আক্রমণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সাড়ে ১২টার সময় পাকিস্তানিদের আক্রমণ সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়ে পড়ে। প্রচণ্ড বাধার সামনে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি সেনারা পেছন দিকে পালিয়ে যায়। সংঘর্ষে ৪০জন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। অনেক অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়। ২জন মুক্তিযােদ্ধা শাহাদতবরণ করেন।
কৃঞ্চপুর ও বাগবাড়ি দখল
কসবা থানাধীন কৃষ্ণপুর বাগবাড়িতে ১১ ও ১২ নভেম্বর ৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘এ’ ও ‘বি’ কোম্পানি কৃষ্ণপুর ও বাগবাড়ি অবস্থান থেকে পাকিস্তানিদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের কুমিল্লার দিকে আরও পিছু হটিয়ে দেয়। ২ দিনের যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ১৪জন নিহত ও ৭জন আহত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে ২জন শহিদ এবং ১জন আহত হন। এ সময় ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট শালদা নদীর দিক থেকে পাকিস্তানিদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। এ ২ ব্যাটালিয়নের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা। পরাস্ত হয়ে শালদা নদী, কসবা, মন্দভাগ প্রভৃতি এলাকা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করে নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে কুমিল্লায় আশ্রয় নেয়। ১ ডিসেম্বর কুমিল্লার উত্তর এলাকা সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হওয়ার পর ৪টি সাব-সেক্টর কোম্পানিকে এ এলাকায় মােতায়েন রেখে ৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে কুমিল্লার দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ার বাজার এলাকায় সমাবেশ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।  ২ ডিসেম্বর ৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে মিয়াবাজারের দিকে অগ্রসর হয়। ক্যাপ্টেন মাহবুবের ৬টি সেক্টর কোম্পানিও তার সঙ্গে যােগ দেয়। ৩ ডিসেম্বর সকালে এ সম্মিলিত বাহিনী মিত্রবাহিনীর কামানের সহায়তায় মিয়াবাজারে পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষাব্যুহর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি সেনারা এ আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে কুমিল্লার দিকে পিছু হটে যায়।
নবীনগর পৌর এলাকার যুদ্ধ
নবীনগর থানার নবীনগর পৌরসভা এলাকার সন্নিকটে ৮-১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত এখানে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের বিচ্ছিন্ন যুদ্ধ হয়। ১৯ ডিসেম্বর নবীনগর শত্রুমুক্ত হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধা আ. ছালাম শাহাদতবরণ করেন। মুক্তিযােদ্ধা মাে. ওমর আলী ও খয়ের আলী আলমনগরে ৩৬জন রাজাকারকে কুপিয়ে হত্যা করেন।
সিংগার বিল-আজমপুরে অ্যামবুশ
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর থেকে ১৪ কিলােমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে আজমপুর অবস্থিত। এটি আন্তর্জাতিক সীমারেখার খুব কাছে অবস্থিত। তিতাস নদ আজমপুর এলাকার পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। যুদ্ধের প্রারম্ভিক অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনী আখাউড়ায় অবস্থান গ্রহণ করে এবং সিলেট-আখাউড়া রেল যােগাযােগ স্থাপনের চেষ্টা চালায়। এ কারণে তারা সিলেটের দিক থেকে ১টি লাইট ইঞ্জিন বগিসহ মাধবপুর থেকে দক্ষিণে পাঠায় যেন পরবর্তী সময় রেলপথে রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র আনা নেওয়া করতে পারে। তাই এ রেললাইনটি দখলে রাখা তাদের জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২ নম্বর সেক্টরের সেক্টর অধিনায়ক মেজর খালেদ মােশাররফ পাকিস্তানি বাহিনীর রসদ সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির পরিকল্পনা করেন এবং সেই মােতাবেক লেফটেন্যান্ট হারুনের নেতৃত্বে ইপিআররের ১টি কোম্পানি এবং ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১টি প্লাটুন আজমপুর প্রেরণ করেন। কোনাে অবস্থাতেই পাকিস্তানি বাহিনী যাতে সিলেট-আখাউড়া রেল যােগাযােগ স্থাপন করতে না পারে, তা নিশ্চিত করাই ছিল এ অভিযানের মূল উদ্দেশ্য। পরিকল্পনা মােতাবেক লেফটেন্যান্ট হারুন তার দল নিয়ে আজমপুর রেলওয়ে কলােনির পেছনে মাধবপুর সড়ক এবং রেললাইনের ওপর প্রতিরক্ষাব্যুহ গঠন করেন। এ জায়গাটি ছিল উঁচু এবং তিতাস নদের পাড়ে অবস্থিত। প্রতিরক্ষার জন্য এটি ছিল আদর্শ একটি স্থান।
সিলেটের দিক থেকে শত্রু ১টি লাইট ইঞ্জিন বগি আখাউড়ার দিকে পাঠায়। তারা বুঝতে পারেনি যে মুক্তিবাহিনী পথিমধ্যে কোনাে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এদিকে সিংগার বিল স্টেশনের কিছু দক্ষিণে ব্রিজের কাছে লেফটেন্যান্ট হারুন কয়েকটি অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন পুঁতে রাখেন। এ লাইনের ওপর দিয়ে যাওয়ার। সময় ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়ে যায়। এর কিছুদিন পর পাকিস্তানি বাহিনীর কিছু । সৈন্য এবং রেলওয়ের কর্মচারীরা ক্রেন নিয়ে আসে একে উদ্ধার করতে। কিন্তু। লেফটেন্যান্ট হারুন তাদের আগমন পথে অ্যামবুশ করেন। এতে ২০জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এর কিছুদিন পর মুক্তিবাহিনী সিংগার বিল রেলওয়ে ব্রিজ ১৪০ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে উড়িয়ে দেয় । রেল যােগাযােগ স্থাপনের প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনী। এ সেতুটি মেরামত করার জন্য রেলওয়ের কর্মচারী ও সরঞ্জাম সিংগার বিলে রেলওয়ে সেতুটির কাছে নিয়ে আসে। লেফটেন্যান্ট হারুন তখন সুবেদার শামসুল হকের মর্টার প্লাটুন নিয়ে শত্রুর ব্রিজ মেরামতের প্রচেষ্টা ভণ্ডুল করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা মােতাবেক তিনি তার কোম্পানি ও মর্টার। প্লাটুন নিয়ে ব্রিজ এলাকায় যান। শত্রু যখন সেতু মেরামত শুরু করে, ঠিক তখন সুবেদার শামসুল হকের মর্টার থেকে অবিরাম গােলাবর্ষণ শুরু হয়। সঙ্গে সঙ্গে লেফটেন্যান্ট হারুন তার কোম্পানি নিয়ে আক্রমণ করেন। এ প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে শত্রু টিকতে না পেরে পলায়ন করে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ১০জন | সৈন্য নিহত হয় এবং বাকিরা পলায়ন করে। মুক্তিবাহিনী তাদের রেলওয়ে সেতু মেরামতের প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে দেয় এবং সিলেট-চট্টগ্রাম রেল যােগাযােগ বন্ধ হয়ে যায়।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে চাঁদপুর
পাকিস্তানের হাত থেকে প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা সংগ্রামে যখন সমগ্র বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ, তখন চাঁদপুরের জনগণও বসে থাকেনি। চাঁদপুরের বিভিন্ন গ্রামে, ইউনিয়নে, থানায় ২৫ মার্চের অনেক পূর্বেই দেশপ্রেমিক সংগঠনগুলাে গােপনে সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তােলে। প্রতিরােধের অগ্নিতে প্রজ্বলিত হয়ে অনেকে গােপনে দেশি হাতিয়ার ও বােমা তৈরি শুরু করে। বােমা তৈরির সময় বােমা বিস্ফোরণে চাঁদপুরের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ছাত্রকর্মী শাহাদতবরণ করেন। চাঁদপুর স্টাফরােড বালুর মাঠের পাশের স্মৃতিফলক আজও সেসব শহীদের স্মৃতিকে চিরজাগরুক রেখেছে। দেশকে পাকিস্তানিদের অনাচারের হাত থেকে রক্ষার কাজে সমগ্র জাতি যখন ঐক্যবদ্ধ, সে সময় চাঁদপুর মহকুমা সর্বদলীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের নেতাকর্মীরাও স্বাধীনতা আন্দোলনে তৎপর হয়ে ওঠেন। তাঁদের উদ্যোগে চাঁদপুর নতুন বাজার বালির মাঠে কাঠের রাইফেল নিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ছাত্রদের সহযােগিতায় শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরাও সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসেন। চলমান জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে শুরু থেকেই যাঁরা সংগঠিত ও বেগবান করেন তারা হলেন: মিজানুর রহমান চৌধুরী, করিম পাটোয়ারী, আবু জাফর মাইন উদ্দিন, অ্যাডভােকেট সিরাজ, ডা. আব্দুস ছাত্তার, কলিমুল্লাহ ভূঁইয়া, জীবন কানাই দাস, রাজা মিয়া, ইসমাইল হােসেন তালুকদার, ফজলুল হক তালুকদারসহ বহু নাম না জানা নেতাকর্মী।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা ঢাকাসহ সারাদেশে এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড শুরু করে। এ ভয়াবহ পরিস্থিতিতে যােগাযােগ ব্যবস্থা, অফিস আদালত, স্কুলকলেজ বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ অসহায়ের মতাে সহায়সম্বল হারিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে গ্রামগঞ্জে ছুটে যায়। সেই অসহায় মানুষ যখন ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে পাকিস্তানিদের অত্যাচারের ভয়ে জীবন বাঁচানাের জন্য নৌকায় বা পায়ে হেঁটে চাঁদপুরে আসে, তাদের সাহায্যে চাদপুরবাসী বিভিন্ন স্থানে লঙ্গরখানা খােলে। যার যা ছিল টাকাপয়সা, চিড়া, মুড়ি, ডাল, চাল, গুড়, চা, চিনি ইত্যাদি নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে এসে দাড়ান।
প্রাথমিকভাবে চাঁদপুর মহকুমার প্রতিটি সংগ্রামী কর্মকাণ্ড চাঁদপুর আনসার ক্লাব থেকে নিয়ন্ত্রিত হতাে। ইতােমধ্য প্রতিটি থানায় সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক যুবকদের ভারতে পাঠানাের ব্যবস্থা করা হয়। অন্য জেলা শহরগুলাে যেমনিভাবে এক এক করে পাকিস্তানিদের হাতে চলে গেল, চাদপুরকেও সেভাবে জল ও স্থলপথে আক্রমণ করে তাদের দখলে নিয়ে নিল। চাঁদপুর থেকে বিভিন্ন দলে মুক্তিযােদ্ধারা বিছিন্ন হয়ে কেউ কেউ অন্যত্র চলে গেলেও অনেকেই পুনরায় সংগ্রাম কমিটির ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় একত্র হন। করিম পাটোয়ারী, সুবেদার জহিরুল হক পাঠান, কলিমুল্লাহ ভূঁইয়া, জীবন কানাই দাস, আব্দুর রব শেখ, হাফেজ আহম্মদ প্রমুখ এবং তাদের সহযােগী অসংখ্য নেতাকর্মী জনগণকে সাথে নিয়ে চাঁদপুরে প্রতিরােধের দুর্গ গড়ে তােলেন। এ প্রতিরােধ বাহিনী শুরু থেকেই দেশ শত্রুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধভাবে সুবেদার জহিরুল হক পাঠানের নেতৃত্বে কাজ করে। প্রকৃত অর্থে ১টি সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ বলতে যা বােঝায়, সেই হিসেবে দেশীয় অস্ত্রের সমাবেশ গুরুত্বহীন হলেও জাতীয় ঐক্য প্রকৃত যুদ্ধের নিয়ামক শক্তি হিসেবে পরবর্তী সময় প্রতিভাত হয়।
টেকনিক্যাল হাই স্কুলের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর সদর থানার তরপুরচণ্ডী ইউনিয়নে টেকনিক্যাল হাই স্কুলের অবস্থান। ৭ এপ্রিল হঠাৎ খবর আসে পাকিস্তানিরা চাঁদপুরে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের প্রতিহত করার জন্য অবস্থান। নেন। | ৮ এপ্রিল পাকিস্তানিরা চাঁদপুর শহরে প্রবেশের পূর্বে চাঁদপুর সদর থানার টেকনিক্যাল স্কুলের কাছে মুক্তিযােদ্ধাদের দ্বারা প্রচণ্ড প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে পাকিস্তানিরা পর্যন্ত দিশেহারা হয়ে যায়। তবে পরক্ষণেই তারা পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। ৮ এপ্রিল আনুমানিক সকাল ১০টা। পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গুলিবিনিময় হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধা মাে. সেকান্দার পাটোয়ারী পাকিস্তানিদের গুলিতে আহত হন এবং বেশ কয়েকজন শক্র আহত হয়।
ওয়্যারলেস বাজারের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর সদর থানার তরপুরচণ্ডী ইউনিয়নে ওয়্যারলেস বাজারের অবস্থান। ৩ এপ্রিল হঠাৎ খবর আসে, পাকিস্তানিরা চাঁদপুরে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। তাদের প্রতিহত করতে চাঁদপুর শহরে প্রবেশের পূর্বে চাঁদপুর সদর থানা ওয়্যারলেস বাজারের পূর্ব পাশের কড়ইগাছের নিচে মুক্তিযােদ্ধারা প্রচণ্ড প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। | ৮ এপ্রিল সকাল ১০টায় দুই পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময় হয়। ওয়্যারলেস বাজারের মধ্য থেকেই মুক্তিযােদ্ধারা তাদের আক্রমণ চালিয়ে যান। দুই পক্ষের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ লড়াই অব্যাহত থাকে। এতে ১জন মুক্তিযােদ্ধা পাকিস্তানিদের গুলিতে আহত হন। এ ছাড়া মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিতেও আনুমানিক ১০জন পাকিস্তানি আহত হয়।
বড়কুলের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলায় হাজীগঞ্জ থানার অন্তর্গত ৬ নম্বর বড়কুল (পূর্ব) ইউনিয়নে বড়কুলের অবস্থান। এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তানি ও রাজাকাররা বড়কুল গ্রামে অতর্কিত গুলিবর্ষণ করে এবং বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয় দেয়। পাকিস্তানি ও রাজাকারদের আক্রমণে বেশ কয়েকজন নিরীহ গ্রামবাসী আহত ও শহিদ হন। এ সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের পাল্টা আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এতে আনুমানিক ৪৫জন গ্রামবাসী শহিদ হন।
গাজীপুরের যুদ্ধ-১ (অ্যামবুশ)
চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলায় গাজীপুর অবস্থিত। পাকিস্তানিরা মুক্তিযােদ্ধাদের খবর পেয়ে ফরিদগঞ্জ আক্রমণের জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। একদিন রাতে তারা ফরিদগঞ্জে চলে আসে। প্রথম দিকে তারা ফরিদগঞ্জের চতুর্দিকে পরিখা খনন করে তাদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করে। হঠাৎ খবর এলাে, পাকিস্তানিদের অস্ত্র, গােলাবারুদ ও খাদ্যসামগ্রীর সহযােগিতার জন্য ১টি লঞ্চ | চাঁদপুর থেকে ফরিদগঞ্জ আসছে।  পাকিস্তানিদের আসার খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধারা যুদ্ধের একটি পরিকল্পনা করেন। প্রথমে ১টি প্লাটুন চান্দাবাজার পাঠানাে হয়। সেখানে। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিরক্ষায় অবস্থান করার ভালাে স্থান না থাকায় পুনরায় গাজীপুরে তিন দিক থেকে প্রতিরক্ষা অবস্থান বসানাে হয়। ১টি প্লাটুন পাইকপাড়ায় সংরক্ষিত রাখা হয়। কমান্ডারের নির্দেশে ধানুয়া এবং চান্দাবাজার ও ফরিদগঞ্জ রাস্তায় কারফিউ দেওয়া হয়। তার ফলে কোনাে লােক বাইরে। থেকে ভেতরে আসতে পারবে কিন্তু ভেতর থেকে কেউ বাইরে যেতে পারবে  সুবেদার জহিরের প্লাটুন মানিকরাজ নদীর বাঁকে (শহিদ মেম্বরের বাড়ির সামনে) এবং সুবেদার রবের প্লাটুন গাজীপুর ঈদগাহ ময়দান ও ফরিদগঞ্জ রাস্তা কভার করে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। অধিনায়ক দেলােয়ারের নির্দেশানুযায়ী পাকিস্তানি লঞ্চটি যখন মাঝবরাবর আসবে, তখন তাঁর নির্দেশে ফায়ার শুরু করা হবে। তার ফায়ারিংয়ের সাথে সাথে সামনে ও পেছন থেকে বাকিরাও আক্রমণ করবে। খবর আসে, পাকিস্তানি বাহিনী ডুবগী পর্যন্ত এসে গেছে। মুক্তিযােদ্ধাদের অপেক্ষার সময় অতিক্রম করে পাকিস্তানিদের লঞ্চটি মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণের সীমানায় প্রবেশ করে। ধীরে ধীরে লঞ্চটি বাঁক ঘুরে গাজীপুর বরাবর ঠিক মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্রের সীমানায় পৌছাল অধিনায়ক।
আদেশ দিলেন, ‘ফায়ার’। সাথে সাথে গাজীপুরে শুরু হলাে আক্রমণ। মুক্তিযােদ্ধাদের ত্রিমুখী আক্রমণে পাকিস্তানিদের অনেকেই গুলি খেয়ে নদীতে ঝাঁপ দেয়। কেউ কেউ পাল্টা আক্রমণ করলেও তাদের তীব্র আক্রমণে টিকতে পেরে নদীতে ঝাপ দেয়। বেশিরভাগ শত্রুই নদী সাঁতরিয়ে অপর পাড়ে গিয়ে ওঠে। তারা ধানুয়ার ভেতর দিয়ে গুলি করতে করতে রাস্তায় উঠে ফরিদগঞ্জ চলে যায়। এদিকে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে লঞ্চটি ছিদ্র হয়ে যায়। লঞ্চটি একসময় গাজীপুরের শেষ মাথায় শেখবাড়ির ডানে (শেখবাড়ির টেক) নিমজ্জিত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা তখনাে প্রতিরক্ষায়। কারণ, পরবর্তী আক্রমণ ফরিদগঞ্জ বা অন্য কোনাে স্থান থেকে আসতে পারে। পরদিন মুক্তিযােদ্ধাদের অনুরােধ পেয়েই জনগণ পানিতে নেমে নিমজ্জিত লঞ্চটি টেনে পাড়ে নিয়ে আসে।
এ যুদ্ধে আনুমানিক ১০জন পাকিস্তানি নিহত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানিদের কাছ থেকে ২টি হেভি মেশিনগান, ১টি ৩ ইঞ্চি মর্টার, ১টি রকেট লঞ্চার, ৪টি চাইনিজ এলএমজি ও রাইফেলসহ প্রচুর গােলাবারুদ উদ্ধার করেন।
বলাখাল খেয়াঘাটের অ্যামবুশ
চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত হাজীগঞ্জ থানার হাজীগঞ্জ ইউনিয়নে বলাখাল খেয়াঘাট অবস্থিত। মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে গােপন সূত্রে খবর আসে যে পাকিস্তানিরা লঞ্চে করে মাঝে মাঝে বলাখালের রামচন্দ্রপুর নদীতে টহল দেয়, তারা মাঝে মাঝে মুন্সীর হাট চলে আসে। উদ্দেশ্য, নদীর এ পারে ঘাঁটি তৈরি করা। কলিমুল্লা ভূঁইয়া, নায়েব সুবেদার নূর আহমেদ গাজী ও আরও কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা এলাকা রেকি করেন। জনগণের দেওয়া তথ্য এবং নিজেদের দেখা সব তথ্য যখন ঠিক হলাে, মুক্তিযােদ্ধারা তখন পরিকল্পনায় বসেন। ১৭ মে খুব ভােরে ১টি প্লাটুন অ্যামবুশ করার জন্য রামচন্দ্রপুর খেয়াঘাটে অবস্থান গ্রহণ করে। খুব ভােরেই তারা মাঝিবাড়ির পুকুর এবং নদীর পাড়ে অবস্থান নেয়। ইতােমধ্যেই খবর আসে, পাকিস্তানিরা আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ অ্যামবুশের কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয় মুক্তিযােদ্ধা দেলােয়ার হােসেন খানকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩টি ভাগে ভাগ হয়ে মুক্তিযােদ্ধারা অবস্থান। নেন। ইতােমধ্যেই পাকিস্তানি ২টি কার্গো লঞ্চ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। সর্বর্ডানে অবস্থান নেন অধিনায়ক নিজে, মাঝখানে কলিমুল্লা ভূঁইয়া ও সর্ববামে সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারীর ১০জনের দল।
পরিকল্পনা অনুয়ায়ী অধিনায়ক প্রথমে গুলি শুরু করবেন। ৩টি দলে ৫টি এলএমজি, ২টি ২ ইঞ্চি মটার ও পর্যাপ্ত রাইফেল নেওয়া হয়। লঞ্চ অ্যামবুশ এলাকা প্রবেশ করার পর দেখা যায়, আরও ২টি লঞ্চ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। সামনের লঞ্চ দুটো টার্গেট বরাবর আসতেই গুলির আদেশ দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় লঞ্চ ২টির ওপর প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ। বেশিরভাগ শত্রুই নদীতে ঝাপ দেয়। পেছনের লঞ্চ ২টি গুলি করতে করতে পালিয়ে যায়। একটানা ১০/১২ মিনিট গুলিবিনিময় হয়। পাকিস্তানিদের বেশ কয়েকজন মারা যায় এবং যারা বেঁচে যায়, ওপারে গিয়ে তারা গুলি করতে শুরু করে। পাকিস্তানিদের দুর্দশার খবর পেয়ে হাজীগঞ্জ থেকে কয়েক ট্রাক পাকিস্তানি সৈন্য বলাখাল চলে আসে এবং নদীর ওপার থেকে তারাও আক্রমণ শুরু করে। ওয়্যারলেসের ছাদ থেকে শুরু হয় পাকিস্তানিদের প্রচণ্ড গুলি। টানা ২ ঘণ্টা যুদ্ধ। চলার পর মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকিস্তানিরা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
ঠাকুরবাজার মহামায়ার যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি থানার অন্তর্গত মেহের উত্তর ইউনিয়নে ঠাকুরবাজার মহামায়া অবস্থিত। চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি থানার অন্তর্গত মেহের রেল স্টেশনে পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি ছিল। পাকিস্তানিরা স্থানীয় রাজাকার ও দালালদের সহায়তায় আশপাশের গ্রামে ও বাজারগুলােয় লুটপাট চালাতাে। নিরীহ জনগণের বাড়িঘর ও দোকানপাটে অগ্নিসংযােগ দেওয়া ছিল। পাকিস্তানিদের নৈমিত্তিক ঘটনা। ঠাকুরবাজারের নিরীহ জনগণের জানমাল রক্ষার জন্য সূচিপাড়ায়। অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি দল পাকিস্তানি ঘাঁটিতে অবস্থানরত শত্রুর ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। মুক্তিযােদ্ধারা শক্রর অবস্থান ও গতিবিধি। স্থানীয় জনগণের মাধ্যমে এবং নিজেরা সংগ্রহ করে সুযােগের অপেক্ষায় থাকেন। মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে খবর আসে যে ২২ জুন শুক্রবার মেহের রেল স্টেশনের ঘাঁটি থেকে প্রায় দেড় কিলােমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত এলাকার সবচেয়ে বিখ্যাত ঠাকুরবাজারটি লুট করার জন্য পাকিস্তানিরা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় সংগঠক রুস্তম আলীর মাধ্যমে শক্রর সব খবরাখবর মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে সময়মতাে পেীছে। মুক্তিযােদ্ধারা পরিকল্পনা করেন, শত্রুদের অ্যামবুশের মাধ্যমে ধ্বংস করার। সুবেদার আ, রবের নেতৃত্বে ৪০জন মুক্তিযােদ্ধা ঠাকুরবাজারের প্রবেশপথে মহামায়া নামক স্থানে হেদু চৌধুরীর বাড়ির ঝােপে অবস্থান নেন। মুক্তিযােদ্ধারা যে পাকিস্তানিদের অ্যামবুশে ফেলতে পারে, এ ধারণাই শত্রুদের ছিল না। দুপুরবেলা জুম্মার নামাজের সময় পাকিস্তানিরা ঠাকুরবাজারের সন্নিকটে পৌঁছে যায়। শত্রু এক সারিতে বাজার পার হয়ে যেই অ্যামবুশের জন্য সুবিধাজনক স্থানে পৌছায়, তখনই শুরু হয় মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ। 
মুক্তিযােদ্ধাদের এ অতর্কিত আক্রমণে আনুমানিক ১০-১২জন পাকিস্তানি সৈন্য মারা যায় এবং বহু পাকিস্তানি গুরুতর আহত হয়। দ্রুত অবস্থান নিয়ে। পাকিস্তানিরা পাল্টা আক্রমণ চালালেও মুক্তিযােদ্ধারা কোনাে ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই নিরাপদে ঘাটিতে ফিরে যেতে সমর্থ হন।
মতলব থানা আক্রমণ
চাঁদপুর জেলার সদর থেকে উত্তরে মতলব থানা অবস্থিত। লেফটেন্যান্ট মাহবুবের নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিযােদ্ধা মতলব এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করেন। প্লাটুনটি গােপন সূত্রে জানতে পারে, মতলব থানায় পাকিস্তানি পুলিশসহ কিছু রাজাকার মােতায়েন করা হয়েছে। এসব পুলিশের অত্যাচারে স্থানীয় জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। পাকিস্তানি পুলিশ সদস্যরা স্থানীয় দালালদের সহায়তায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ব্যর্থ চেষ্টা চালাতে থাকে। একপর্যায়ে লেফটেন্যান্ট মাহবুবের নেতৃত্বাধীন জনৈক জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের দলটি মতলব থানা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। থানা সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে। পরিকল্পনা অনুয়ায়ী ২ জুলাই গেরিলারা থানার ওপর আক্রমণ করে। মুখােমুখি যুদ্ধে পুলিশের ৫জন সদস্য মারা যায় এবং ৭জন আহত হয়। গেরিলা দলের ১জন শহিদ হন।
রামচন্দ্রপুর ব্রিজ ধ্বংস এবং ফেরিঘাট আক্রমণ
কুমিল্লা-চাঁদপুর রাস্তায় হাজীগঞ্জের কাছে রামচন্দ্রপুরের ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার পর পাকিস্তানিদের যােগাযােগকে বিনষ্ট করার জন্য লেফটেন্যান্ট মাহবুব ১টি কোম্পানিকে ক্যাম্প করার জন্য রামচন্দ্রপুরে পাঠান। ৬ জুলাই ভােরে এ দলটি চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ থানার রামচন্দ্রপুর ফেরিঘাটের কাছে অ্যামবুশ করে। এ দলের অন্য অংশ ফেরিঘাট থেকে দক্ষিণে আরেকটি অ্যামবুশ করে। ঐ দিনই সকাল ৭টার সময় পাকিস্তানিদের ১টি দল রামচন্দ্রপুর ফেরিঘাটে আসে। তাদের জিনিসপত্র তখন ফেরিতে ওঠাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় অ্যামবুশ দল তাদের ওপর গুলি চালায়। এতে পাকিস্তানিদের ৪জন মারা যায়। উভয় পক্ষে প্রায় ঘন্টা খানেক গােলাগুলি চলে। গােলাগুলির সংবাদ পেয়ে চাঁদপুর থেকে পাকিস্তানিদের প্রায় দুই কোম্পানি সৈন্য সাহায্যের জন্য সেখানে আসে। পাকিস্তানিরা ফেরিঘাটের কিছু দূরে এসে গাড়ি থেকে নামে এবং অ্যামবুশ অবস্থানের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। ঠিক সেইসময় মুক্তিযােদ্ধাদের অন্য অ্যামবুশ দলটি তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এ আক্রমণে পাকিস্তানিরা সম্পূর্ণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং তাদের আনুমানিক ৩১জন মারা যায় এবং ৫৪জন আহত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের ১জন এনসিও এবং ১জন সিপাহি গুরুতর আহত হন। এরপর মুক্তিযােদ্ধাদের দলটি অ্যামবুশ অবস্থান পরিত্যাগ করে। আসার পথে ৮ জুলাই মুদাফফরগঞ্জ সড়কসেতুটি উড়িয়ে দিয়ে আসে। এরপর পাকিস্তানিরা সেতুটির নিকটবর্তী কয়েকটি গ্রামে মর্টারের সাহায্যে গােলাগুলি করে। সেসময় পাকিস্তানিদের অভ্যর্থনার জন্য স্থানীয় অনেক দালাল শান্তি কমিটির সভার আয়ােজন এবং মিছিল সহকারে পাকিস্তানিদের অভ্যর্থনার জন্য এগিয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পাকিস্তানিরা এ মিছিলের ওপর গুলি চালিয়ে তাদের অনেককেই হত্যা করে।
খাজুরিয়ার গণ-প্রতিরােধ
চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলায় খাজুরিয়া বাজার অবস্থিত। ২০ জুন খাজুরিয়া বাজারে মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি বড়াে দল এসে ওয়াপদা বেড়িবাঁধের ওপর প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয় রামগঞ্জ, নােয়াখালী থেকে আগত পাকিস্তানিদের প্রতিহত করার জন্য। মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে ছিল এলএমজি, রাইফেল এবং ২ ইঞ্চি মর্টার। ইতােমধ্যেই পাকিস্তানিরা খাজুরিয়ায় অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের কাছাকাছি পৌছে যায়। মুক্তিযােদ্ধারা নিজ নিজ অবস্থান ছেড়ে এলএমজি, রাইফেল, ২ ইঞ্চি মর্টার ইত্যাদি নিয়ে খাজুরিয়ার দিকে দৌড়াতে থাকে। খাজুরিয়া বাজারে এসে বিরাট একটি গাছের সামনে সবাই বসে পড়ে। জানা যায়, পাকিস্তানিরা মহামায়া থেকে খাজুরিয়া বাজারের সিংহ গেইটের সামনে কড়ইগাছের নিচে খাবার খাচ্ছিল। এমন সময় মুক্তিযােদ্ধারা তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু স্থানীয় ১জন কুখ্যাত দালাল মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণের সংবাদ পাকিস্তানিদের জানিয়ে দেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে পাকিস্তানিরা পালাতে শুরু করে। এ অবস্থায় বেঙ্গল রেজিমেন্টের গফুর বালুচ (অধিনায়ক), নায়েব সুবেদার আব্দুস সাত্তার (হারেস), হাবিলদার মতিন, নায়েক নুরুল ইসলাম, সিপাহি কাশেম, বােরহান চৌধুরী, হাফিজুর রহমান মিন্টু, বিডি পােদ্দার, আব্দুল লতিফ, মহিউদ্দিন খান, আলাউদ্দিনসহ আরও অনেকে ছিলেন। তাঁরা পলায়নরত পাকিস্তানিদের পেছন থেকে আক্রমণ করেন। গুলিতে কয়েকজন পাকিস্তানি হতাহত হয়।
মুক্তিযােদ্ধারা এরপর খাজুরিয়া মাদ্রাসায় আশ্রয় নেন। কিন্তু পরক্ষণেই খবর আসে, পাকিস্তানিরা মুক্তিযােদ্ধাদের হেডকোয়ার্টার্সে ত্রিমুখী আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়েছে। তাই সব প্লাটুন পুনরায় নিজ অবস্থানে ফিরে পাকিস্তানিদের প্রতিহত করার প্রস্তুতি নেয়। পাকিস্তানিরা ততক্ষণে কামতাবাজার এসে পৌছে, ১ নম্বর প্লাটুনের ৩টি ১০জনের দলকে নির্দেশ দেওয়া হয় রাস্তার বাম পাশে ও ডান পাশে এবং রাস্ত র ওপর অবস্থান নেওয়ার। প্লাটুন অধিনায়ক সিরাজ ও কলিমুল্লাহ ভূঁইয়াকে পাকিস্তানিরা এক সারিতে করে মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে আসা মাত্রই আক্রমণের সংকেত দেওয়া হয়। পূর্বপরিকল্পনামতাে অধিনায়ক পাঠান ফার্স্ট ফায়ার করেন। তাঁর সাথে অন্যরাও প্রচণ্ড আক্রমণ করেন। এ অবস্থায় পাকিস্তানিরা ডান পাশে পড়ে গেলে ডান পাশ থেকে সুবেদার সিরাজ আক্রমণ করেন। একই সময়ে রাস্তার ওপর থেকে কলিমুল্লাহ ভূঁইয়া আক্রমণ চালান। মুক্তিযােদ্ধাদের ত্রিমুখী আক্রমণে কোণঠাসা হয়ে পড়ে পাকিস্তানিরা। প্রায় এক ঘণ্টা প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ সংঘর্ষে আনুমানিক ৭-৮জন পাকিস্তানি মারা যায় এবং বহু আহত হয়। পাকিস্তানি কিছু আহত সৈন্য মুন্সিরহাটে এসে মারা যায় এবং আহত পাকিস্তানিদের চাঁদপুর পাঠিয়ে দেয়। বাকি কয়েকজন সৈন্য হাজীগঞ্জে চলে আসে।
নরিংপুর বাজারের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলায় শাহরাস্তি থানার অন্তর্গত সূচিপাড়া (দক্ষিণ) ইউনিয়নে নরিংপুরের অবস্থান। মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতা বন্ধের জন্য পাকিস্তানি বাহিনী নরিংপুর বাজারে পাকা পরিখা তৈরি করে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তােলে। নরিংপুর। বাজার থেকে ৭-৮ কিলােমিটার পূর্বে অবস্থিত তাদের চিতােষী বাজার ঘাটির সাথে তারা টেলিফোন সংযােগ স্থাপন করে। শােরশাক বাজারে অবস্থিত মুক্তিযােদ্ধারা নরিংপুর ঘাটিটি ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেন। পাকিস্তানিদের কাছে ছিল এলএমজি, মর্টার, রকেট লঞ্চার। মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র বলতে ১টি এলএমজি, ১টি ২ ইঞ্চি মর্টার, ২টি স্টেনগান ও .৩০৩ রাইফেল। এ সীমিত অস্ত্র নিয়েই মুক্তিযােদ্ধারা ১৫ জুলাই রাতে পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। মুক্তিযােদ্ধারা ওগারিয়া বাজারের দক্ষিণ দিকে খালের পাড়ে অবস্থান নেন। তারা প্রথমেই ওগারিয়া বাজারের পশ্চিম পাশে পাকিস্তানিদের টেলিফোনের সংযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সুবেদার জহিরুল হকের নেতৃত্বে ১১০জন মুক্তিযােদ্ধার ১টি দল নরিংপুর বাজার আক্রমণের পরিকল্পনা করে। মুক্তিযােদ্ধারা তিন দিক দিয়ে অবস্থান গ্রহণ করে নরিংপুর বাজারটি তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেন। অধিনায়ক সুবেদার আলী আকবরের নির্দেশে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানিদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ শুরু করেন। পাকিস্তানিরাও পাল্টা আক্রমণ শুরু করে।
দু’পক্ষের মধ্যে গােলাগুলি অব্যাহত থাকে। ইতােমধ্যে আনুমানিক ৭-৮জন পাকিস্তানি মারা গিয়েছে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের ২জন শহিদ হন। দীর্ঘ ৪৮ ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকিস্তানিরা উগারিয়া হয়ে চিতােষী ঘাটির দিকে পালিয়ে যায় এবং নরিংপুর ক্যাম্প মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে আসে।  নরিংপুর ক্যাম্প থেকে ১৬জন যুবতী মেয়েকে উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া। জনগণের বাড়িঘর লুট করা বিভিন্ন প্রকারের কাঠের, স্টিলের আসবাবপত্র, স্বর্ণালংকার, ২৮ জোড়া বুট, ২৮ জোড়া পিটি শু, ২৫টি রেইন কোট, ৩ ঝুড়ি তরকারি, ৮টি ছাগল, ১০ বস্তা ময়দা, ২ বস্তা চিনি ও কিছু তেল উদ্ধার করা হয়। নরিংপুর পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে পাওয়া মালামাল সুবেদার জহিরুল হক পাঠান সগ্রাম কমিটির মাধ্যমে উপযুক্ত প্রমাণ সাপেক্ষে জনগণের মাল তাদের হাতে তুলে দেন।
মহনপুরা কান্দি হাজির ঘাটের যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার হাইমচর থানায় মহনপুরা কান্দি হাজির ঘাটের অবস্থান। ২৮ জুলাই রাত আনুমানিক ২টা হাইমচর থানার চরভৈরবী ইউনিয়ন দিয়ে প্রবাহিত মেঘনা নদীপথে পাকিস্তানিরা নৌযানে এসে মহনপুরা কান্দি হাজির ঘাটে থামে। তারা সেখানে লােকালয়ে প্রবেশ করে আক্রমণ চালানাের পরিকল্পনা নেয়। এ খবর সেখানকার সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা যথাক্রমে নূরুদ্দিন মােল্লা, মহিউদ্দিন জিন্নাহ, মতিউর রহমান বেপারী, শাহ মাে, বারিক বকাউল, আজিজ ভূইয়া, জাহিদুল ইসলাম, নুরুল ইসলাম, রমিজ উদ্দিন, বিল্লাল হােসেন ও আলাউদ্দিনের কানে পৌঁছলে তাঁরা চর ভৈরবীতে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের সংবাদ দেন। সাথে সাথে মুক্তিযােদ্ধারা অস্ত্রসহ চাঁদপুর সেচ প্রকল্প বেড়িবাঁধে অবস্থান নেন এবং গুলিবর্ষণ শুরু করেন। পাকিস্তানিরাও পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।  এ সংঘর্ষে কোনাে পক্ষেরই কেউ মারা যায়নি। তবে উভয় পক্ষের বেশ কিছু সদস্য আহত হয়।
শাসিয়ালীর যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানায় শাসিয়ালী অবস্থিত। ২৯ জুলাই শুক্রবার মুক্তিযােদ্ধাদের ২ নম্বর প্লাটুন ও সুবেদার রবের ১ নম্বর প্লাটুন শাসিয়ালী। মাদ্রাসায় (হাজীবাড়িতে) অবস্থান নেয়। চারদিকে অথৈ পানি। আনুমানিক দুপুর ১২টার দিকে কয়েকজনকে পাহারায় রেখে মুক্তিযােদ্ধারা খেতে বসেন। এমন সময় খবর আসে যে প্রায় ১৫টি নৌকা করে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের দিকে আসছে। এ খবর পৌছার সাথে সাথে যিনি যেখানে পেরেছেন মুক্তিযােদ্ধারা অবস্থানে চলে যান। আবার উপযুক্ত অবস্থানের স্থান না পেয়ে ১০জনের একটি দল। পাটোয়ারী হাটের দিকে চলে যায়। মুক্তিযােদ্ধারা অবস্থানে এসে পাকিস্তানিদের জন্য অপেক্ষা করেন। এরই মধ্যে গ্রামবাসী খবর নিয়ে আসে যে পাকিস্তানিরা দুই ভাগ হয়ে আসছে। কিছু কড়ইতলীর ভেতর দিয়ে পায়ে হেঁটে, বাকিরা নােকায়। এ খবরের সাথে সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের ১০জনের একটি দলকে স্থলপথে যারা আসছে, তাদের প্রতিহত করার জন্য পাঠানাে হয়। সেই দলের কমান্ডে থাকলেন সুবেদার আব্দুল হক। সুবেদর রব রইলেন যারা পানি পথে হাজীবাড়ির দিকে আসছে তাদের আক্রমণ করার জন্য। মুক্তিযােদ্ধারা প্রস্তুত, জনগণও ইতােমধ্যে বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদে আশ্রয় নিয়ে নেয়। পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে ঢুকে পড়লে মুক্তিযােদ্ধাদের ত্রিমুখী আক্রমণে তারা নৌকা থেকে চতুর্দিকে লাফিয়ে পড়ে। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রথম আক্রমণে ১জন অফিসারসহ আনুমানিক ৫জন পাকিস্তানি সৈন্য, ১জন দারােগা ও আনুমানিক ৭-৮জন পাকিস্তানি পুলিশ মারা যায়। মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে ৫টি নৌকাও পানিতে ডুবে যায়। এ যুদ্ধে বেশ কয়েকজন রাজাকারও মারা যায়। মুক্তিযােদ্ধাদের একটানা অনেকক্ষণ আক্রমণে পাকিস্তানিরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তাদের একদল চলে যায় কমলাপুরের দিকে। পাকিস্তানিদের ১টি দল কমলাপুর ধােপাবাড়ির কাছে একটি আখক্ষেতের মাচায় আশ্রয় নেয়। মুক্তিযােদ্ধারা তাদের ওপর এলএমজির গুলিবর্ষণ করেন। যে কয়জন মাচায় বসেছিল, তারা সবাই মারা যায়।
চিতােষীর যুদ্ধ
চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি থানায় চিতােষীর অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে লাকসাম থানার সীমান্তবর্তী চিতােষী বাজারটি ছিল পাকিস্তানিদের একটি উল্লেখযােগ্য বৃহৎ ও মজবুত ঘাঁটি। এ ঘাঁটির পাকিস্তানি বাহিনী রাজাকার ও স্থানীয় দালালদের সহযাগিতায় পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলােয় নিয়মিত লুটতরাজ ও অত্যাচার চালাতাে। তাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয় নিকটবর্তী বড়তুলা, ছােটতুলা ও ঘড়িমগুরের অনেক মহিলা। ভারতে পলায়নরত শরণার্থী দলের অনেক কিশােরী, যুবতী ও মহিলাকে পাকিস্তানিরা জোর করে ধরে এনে এখানে আটক রাখে এবং তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়।  এ মর্মস্পর্শী ঘটনার প্রতিশােধ নেওয়ার জন্য মুক্তিযােদ্ধারা ২৯ জুলাই চিতােষী ঘাটির নিকটবর্তী স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন। রাত ১২টায় সুবেদার আ, রবের নেতৃত্বে বর্তমান থানা মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক শহিদ মাসুদ আলম এবং ৪০জন মুক্তিযােদ্ধা পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ শুরু করেন। রাতটি ছিল দুর্যোগপূর্ণ। সাগরের লঘু চাপের কারণে তখন আবহাওয়া বিভাগের ১০ নম্বর মহা বিপদ সংকেত ছিল।  ভাের ৫টা পর্যন্ত তুমুল যুদ্ধ চলে। একসময় যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে ১০/১৫জন আহত পাকিস্তানি চিতােষী ছেড়ে পালিয়ে যায়। যুদ্ধের পর শক্রদের ক্যাম্প থেকে ১৫ থেকে ২০ বছর বয়সী ২৮জন নির্যাতিতা মহিলাকে উদ্ধার করা হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে অভিযানে অংশগ্রহণকারী মহিলা চিকিৎসক ডা. সৈয়দা বদরুন্নাহার নির্যাতিতা মহিলাদের চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করেন।
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!