ব্রাহ্মণবাড়িয়া আক্রমণ
যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান ও যুদ্ধের পটভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি ঐতিহ্যবাহী শহর ও বাণিজ্যকেন্দ্র। পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের মতাে এ শহরটিও দখল করে এবং প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা তৈরি করে। শহরের মাঝখানে রেল স্টেশনটি অবস্থিত এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ভৈরব, কুমিল্লা, ময়মনসিংহে রেলপথের যােগাযােগ ব্যবস্থা বিদ্যমান। পর্যাপ্ত যােগাযােগ ব্যবস্থার কারণে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। যাতায়াত, রসদ, গােলাবারুদ ইত্যাদি আদান প্রদান করা খুব সহজ। মিত্রবাহিনীর অবস্থান শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানিরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে না পেরে চারদিক থেকে এ শহরে জড়াে হয়। তাদের উৎখাত করার জন্য যৌথ বাহিনী চতুর্দিক থেকে শহরকে আক্রমণের পরিকল্পনা করে। অবস্থানের দিক দিয়ে এ শহর শত্রু ও মিত্রবাহিনী উভয়ের জন্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ঐ স্থানের গুরুত্ব মুক্তিবাহিনীকে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আশুগঞ্জ রাস্তাটি ছিল সবচেয়ে উত্তম ও সহজ। পাশাপাশি সিলেটের জন্যও এ শহর একই রকম গুরুত্বপূর্ণ। তাই যৌথ বাহিনীর লক্ষ্য ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখল করে সামনে অগ্রসর হওয়া এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য ঢাকায় পৌছে সামগ্রিক বিজয় অর্জন করা। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন ছিল নিম্নরূপ: ১. মুক্তিবাহিনী
ক. ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। খ, ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।
গ, ৩ নম্বর সেক্টর মুক্তিবাহিনী। ২. ভারতীয় বাহিনী। ক, ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেড
• ১৪ গার্ডস রেজিমেন্ট (১৪ গার্ডস)। • ১৯ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট (১৯ পাঞ্জাব)। • ১৯ রাজপুত রাইফেলস (১৯ রাজপুত)।
৩, পাকিস্তানি বাহিনী ক. ২৭ পদাতিক ব্রিগেড
• ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স (১২ এফএফ)।
• ৩৩ বালুচ রেজিমেন্ট (৩৩ বালুচ)। খ, ৪ ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস (ইপিসিএএফ)। যুদ্ধের পরিকল্পনা ১. পাকিস্তানি বাহিনী: আখাউড়ায় পরাজয়ের পর পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপযুক্ত শক্ত অবস্থান ছিল এবং ঢাকার দিকে অগ্রাভিযান প্রতিহত করার জন্য ছিল আদর্শ স্থান। তাই পাকিস্তানিরা শহরটিতে দুর্গ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করে। পাকিস্তানি বাহিনী মনতলা ও তেলিয়াপাড়ায় প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে এবং শাহবাজপুরে বিমানঘাঁটি তৈরি করে।
যৌথবাহিনী: ডিসেম্বরের প্রথম দিকে পাকিস্তানি বাহিনী যৌথ বাহিনীর প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে পশ্চাদপসরণ করতে থাকে। মুক্তিবাহিনী আখাউড়া দখলের পর ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার পদক্ষেপ হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখলের পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মােতাবেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, দুদিক থেকে আক্রমণ করা হবে। মুক্তিবাহিনীর ১টি কলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দক্ষিণ থেকে অগ্রসর হয়ে শহরের দিকে এবং অপর কলাম উত্তর দিক থেকে সিলেট সড়ক দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে পৌছাবে। ভারতীয় সেনাবাহিনী আখাউড়াব্রাহ্মণবাড়িয়া রেললাইন এবং উজানিসার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সড়ক ধরে জেলা শহরের দিকে অগ্রসর হবে। ‘এস’ ফোর্স সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের দিক থেকে অগ্রসর হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরে আক্রমণ করবে। বিভিন্ন দলের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন: ১. মেজর নুরুজ্জামানকে ‘এস’ ফোর্স অধিনায়ক মনতলা ও তেলিয়াপাড়া।
দখলের নির্দেশ দেন। ২. ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে চান্দুরার উত্তরাংশে ১টি রােড ব্লক তৈরি
করতে বলা হয়। ৩, ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বলা হয় ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে।
অনুসরণ করে সামনে অগ্রসর হতে। ৬ ডিসেম্বর ‘এস’ ফোর্স অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহ সেক্টর অধিনায়ক মেজর নুরুজ্জামানকে তার বাহিনী নিয়ে মনতলা ও তেলিয়াপাড়া দখলের নির্দেশ দেন। এদিকে এস ফোর্সের ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নির্দেশ দেন সামনে অগ্রসর হতে। ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বলা হয় ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে অনুসরণ করতে। ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দায়িত্ব ছিল চান্দুরার উত্তরাংশে ১টি রােড ব্লক তৈরি করা, যাতে সিলেট থেকে পলায়নের পর পাকিস্তানি সেনারা এদিকে না আসতে পারে। দ্বিতীয় কাজ হলাে চান্দুরা থেকে সরাইল পর্যন্ত এলাকা শত্রুমুক্ত করা। এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করার জন্য ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। মেজর সুবিদ আলী ভূঁইয়াকে তার নেতৃত্বে ১টি কোম্পানিকে চান্দুরার উত্তরাংশের সড়ক ব্লক করতে এবং ব্যাটালিয়নের অবশিষ্ট সৈন্যকে চান্দুরা থেকে সরাইল পর্যন্ত এলাকা শত্রুমুক্ত করে সামনে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলেন। মেজর সুবিদ আলী ভূঁইয়া নির্দেশ পেয়ে যথাস্থানে অবস্থান নেন। ব্যাটালিয়নের অবশিষ্ট সৈন্য হরিশপুর দিয়ে চান্দুরার দিকে অগ্রসর হয়। ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পাইকপাড়া নামক স্থানে পৌছলে ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক মেজর নাসিম তার সেনাদলকে চান্দুরা হয়ে শাহবাজপুর, সরাইল ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেন। | লেফটেন্যান্ট নজরুলকে তার কোম্পানি নিয়ে অগ্রবর্তী দল হিসেবে অগ্রসর হতে বলেন। লেফটেন্যান্ট নজরুল তার কোম্পানি নিয়ে অগ্রবর্তী দল হিসেবে সদরের সামনে অগ্রসর হচ্ছিলেন। ব্যাটালিয়ন সদরের সৈন্যরা সামনে অগ্রসর হয়ে ইসলামপুরে এসে অবস্থান গ্রহণ করে। তখন সেখানে ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক মেজর নাসিমসহ মাত্র ৮জন সৈনিক অবস্থান করছিলেন।
এ সময় ইসলামপুরে একটা বড়াে রকমের দুর্ঘটনা ঘটে। মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত ব্যাপক আক্রমণে পাকিস্তানিরা ক্রমশ পিছু হটছিল। যদিও চান্দুরা মাধবপুরের মাঝামাঝি স্থানে মেজর সুবিদ আলী ভূঁইয়া তার বাহিনী নিয়ে অবস্থান করছিলেন, তথাপি পাকিস্তানিদের ১টি গাড়ি তেলিয়াপাড়া থেকে মেজর ভূইয়াকে অতিক্রম করে চলে আসে। এ গাড়ির খবর মেজর ভূইয়া কিংবা লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহ কেউই জানতেন না। পাকিস্তানিদের গাড়িকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহ নিজেদের গাড়ি মনে করে ভুল করলেন। গাড়ি থামলে দেখা গেল, গাড়িতে পাকিস্তানি সেনা। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহ সবাইকে হাত ওঠাতে বললে কেউ কেউ হাত ওঠালাে। গাড়ির সামনে বসা পাঠান সুবেদার লাফ দিয়ে পড়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহকে ধরে ফেলে। এ সুযােগে পাকিস্তানি সেনারা তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে গুলি চালানাে শুরু করে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহর সাথে বেশ কিছুক্ষণ মল্লযুদ্ধ হয়। মুক্তিবাহিনীর পেছনের দল ছিল বেশ পেছনে। অপরদিকে সামনের দলও। | বেশ এগিয়ে গেছে। ঘটনার শেষপর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর পেছনের দলটি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। উভয় পক্ষে বেশ কিছুক্ষণ গুলিবিনিময় হয়। শেষ পর্যন্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহ, মেজর নাসিম প্রমুখ প্রাণে বেঁচে যান। এ সংঘর্ষে ২জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। মেজর নাসিমসহ ১১জন মারাত্মকভাবে আহত হলেন। পাকস্তানিদের ১১জনকে জীবিত ধরা হয়।
ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক নাসিম আহত হওয়ায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহ, মেজর মতিন ও মেজর আজিজকে সঙ্গে নিয়ে ৭ ডিসেম্বর পাইকপাড়ায় পৌছান। এরপর মেজর মতিনকে ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর অপর অংশ শাহবাজপুরে তিতাস নদের ওপরের ব্রিজটি ধ্বংস করে অপর পাড়ে বিমান ঘাঁটি প্রস্তুত করে দৃঢ় অবস্থান নেয়। মেজর সুবিদ আলী ভূঁইয়া তার কোম্পানি নিয়ে ৭-৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীকে পেছনে সরে যেতে বাধ্য করে শাহবাজপুর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। এরপরই পুরাে ব্যাটালিয়ন শাহবাজপুর পৌছে। তারপর ৮ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখল করার পর সকালে মেজর ভূঁইয়া এবং ‘এস’ ফোর্সের অগ্রবর্তী দল সরাইল হয়ে আশুগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়। এভাবে মুক্তিবাহিনী। ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখল করে। যুদ্ধের ফলাফল বিশ্লেষণ বা সার্বিক মূল্যায়ন ১. পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যর্থতা: যুদ্ধের শেষপর্যায়ে পাকিস্তানিদের মনােবল ও প্রতিরক্ষাব্যবস্থা উভয়ই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তা ছাড়া মুক্তিবাহিনীর নানা অন্তর্ঘাতমূলক হামলা তাদের পরিকল্পনাহীন। পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া যুদ্ধে তাদের পরাজয়ের কারণ হিসেবে এগুলাে চিহ্নিত করা যায়। মুক্তিবাহিনীর সাফল্য: বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে যৌথ বাহিনীর মনােবল ছিল অত্যন্ত উঁচু। এলাকার সাধারণ জনতার সহযােগিতা থাকায় তারা খুব সহজে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে সমর্থ হন। এর মাধ্যমে সঠিক পরিকল্পনার দ্বারা এ যুদ্ধে বিজয় অর্জন সহজ হয়।
আশুগঞ্জ-ভৈরবের যুদ্ধ-২
যুদ্ধের পটভূমি এখানে ১টি প্রসিদ্ধ সাইলাে গােডাউন আছে, যেখানে পাকিস্তানি সেনারা ডিভিশন সদর স্থাপন করে বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ পরিচালনা করতাে। সাইলাে গােডাউনেই তারা বন্দিশিবির স্থাপন করে। আশুগঞ্জ ঢাকার খুব কাছে হওয়ায় সড়কপথেও যে-কোনাে সংবাদ খুব সহজে পাঠানাে যেত। পাশাপাশি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে বিশেষ করে আখাউড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া পতনের পর বিতাড়িত হয়ে আসা পাকিস্তানি সেনারাও আশুগঞ্জে সমাবেশ করে। এবং ঢাকার সাথে যােগাযােগ স্থাপন করে। যথাযথ কারণেই মিত্রবাহিনীর পরিকল্পনা ছিল, যদি আশুগঞ্জ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে বিতাড়িত করা যায়, তাহলে চূড়ান্ত বিজয়ের পথ অনেকটা প্রশস্ত হবে। অপরপক্ষে পাকিস্তানি সেনাদের ধারণা ছিল, যদি তারা আশুগঞ্জে টিকে থাকতে পারে, তাহলে তাদের পরাজিত করা খুবই কষ্টসাধ্য হবে। এসব নিরিখে যৌথ বাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনী উভয়ের জন্য আশুগঞ্জে যুদ্ধ ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন ছিল নিম্নরূপ: ১. মুক্তিবাহিনী:
ক. ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। খ. ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।
গ. ৩ নম্বর সেক্টর মুক্তিবাহিনী। ২. ভারতীয় বাহিনী: ক. ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন
• ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেড। • ১০ বিহার রেজিমেন্ট। • ১৮ রাজপুত রাইফেল।
• ৪ গার্ড রেজিমেন্ট। খ, ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেড
• ১৯ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট।
• ১৪ গার্ড রেজিমেন্ট। • ১৯ রাজপুত রাইফেল।
• ৮টি ভারতীয় পিটি-৭৬ ট্যাংক। ৩. পাকিস্তানি বাহিনী: ক. ১৪ ডিভিশন।
• ২৭ পদাতিক ব্রিগেড। • ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স (১২ এফএফ)। • ৩৩ বালুচ রেজিমেন্ট (৩৩ বালুচ)।
• ২টি ট্যাংক ট্রপস।
খ. ৪ ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স (ইপিসিএএফ)।
যুদ্ধের বিবরণ ১-৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রচণ্ড যুদ্ধের পর ৫ ডিসেম্বর যৌথবাহিনী আখাউড়া মুক্ত করে এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। যৌথবাহিনীর যুদ্ধের পরিকল্পনায় এ সময় পূর্ব রণাঙ্গনে আখাউড়া-আশুগঞ্জ অক্ষ বরাবর লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহর বাহিনীর ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং আখাউড়া যুদ্ধ থেকে আগত ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে এর পেছনে রাখা হয়।
৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যার মধ্যেই ১১ ও ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট নাসিরউদ্দিন আশুগঞ্জের প্রায় ৩ মাইল পূর্বে দুর্গাপুরে এবং ঐ রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানির অধিনায়ক ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া দুর্গাপুরের উত্তর-পূর্বে আজবপুরে অবস্থান গ্রহণ করতে সমর্থ হন। ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সরাইল ও শাহবাজপুরের মধ্যে অবস্থান নেয় এবং সেক্টরভুক্ত এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য পেছন দিক থেকে অগ্রসর হতে থাকে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ৬ ডিসেম্বর সরাইলের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় ইসলামপুরের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে এক সম্মুখযুদ্ধে ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর নাসিম নিতম্বে গুলিবিদ্ধ হয়ে ভীষণভাবে আহত হলে চিকিৎসার জন্য তাকে আগরতলায় প্রেরণ করা হয় এবং মেজর মতিন ১১ ও ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক নিযুক্ত হন। | ভারতীয় ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেডের ১০ বিহার রেজিমেন্ট দুর্গাপুরের দক্ষিণে আশুগঞ্জের কাছাকাছি স্থানে সমবেত হয়। দুর্গাপুর ও তালশহরের মধ্যে ১৮ রাজপুত, তালশহরে ৪ গার্ড রেজিমেন্ট এবং ৮টি ভারতীয় পিটি-৭৬ ট্যাংক অগ্রসরমাণ যৌথবাহিনীর পেছনে এসে অপেক্ষা করতে থাকে। শক্র তাদের আশুগঞ্জ ভৈরব অবস্থান থেকে এলােপাতাড়িভাবে দূর পাল্লার কামান থেকে বিরামহীন গােলাবর্ষণ করতে থাকে। অপরপক্ষে ভারতীয় গােলন্দাজ বাহিনী তখনাে অনেক পেছনেই রয়ে গেছে। এমতাবস্থায় গােলন্দাজ বা বিমান বাহিনীর কোনােরূপ ছত্রছায়া ব্যতিরেকে আশুগঞ্জ আক্রমণ করা মিত্রবাহিনীর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। ৯ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় শক্র। আশুগঞ্জ-ভৈরব রেলসেতুটির আশুগঞ্জ দিকের একাংশ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ফলে সেতুর ১টি স্প্যান নদীতে পড়ে যায়। | শত্রু সেতুটি উড়িয়ে দেওয়ায় মিত্রবাহিনীর মধ্যে ধারণা জন্মায় যে শত্রু আশুগঞ্জ ছেড়ে ওপারে ভৈরব চলে গিয়েছে। কেননা পেছনে হটার যোেগাযােগ বিনষ্ট করে শক্র এখন আর আশুগঞ্জ থাকতে পারে না।
তারা ধরেই নেয় যে আশুগঞ্জ এখন মুক্ত। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা ছিল উল্টো। তখনাে আশুগঞ্জে ২-৩টি পদাতিক ব্যাটালিয়নের সমপরিমাণ পাকিস্তানি সেনা অবস্থান করছিল। পাকিস্তানি বাহিনী আশুগঞ্জ থেকে সরে গিয়েছে-এ ধরনের ১টি খবরের ভিত্তিতে মিত্রবাহিনী আশুগঞ্জ দখলের সিদ্ধান্ত নেয়। এস’ ফোর্স এবং ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেড আশুগঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পেছনে অবস্থানরত ট্যাংক বহরের কাছে কোনােরূপ নির্দেশ আসার আগেই সম্মুখভাগে অবস্থিত ১৮ রাজপুত বাহিনী প্রথমেই আশুগঞ্জের দিকে ধাবিত হওয়ার নির্দেশ পায়। একই লক্ষ্যে ১০ বিহারের ৩টি কোম্পানিকে তাদের অনুসরণ করতে বলা হয় । উল্লেখ্য যে কোনােরূপ বিমান ও গােলন্দাজ বাহিনীর ছত্রছায়া ব্যতিরেকেই মিত্রবাহিনী আশুগঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। | অগ্রবর্তী ১৮ রাজপুত আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা দেওয়ালের ৫০ গজের মধ্যে এসে পৌছামাত্র অপেক্ষাকৃত উচু ভূমিতে অবস্থিত। বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা দেওয়াল বরাবর অবস্থান নিয়ে থাকা পাকিস্তানি বাহিনীর ২টি পদাতিক ব্যাটালিয়ন তাদের সর্বশক্তি নিয়ােগ করে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর ওপর প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ চালায়। ঘটনার আকস্মিকতায় ও আক্রমণের প্রচণ্ডতায় অগ্রবর্তী ১৮ রাজপুত ও ১০ বিহার এবং তাদের সাথের ট্যাংক। স্কোয়াড্রনটি বেসামাল হয়ে পড়ে। ট্যাংকবিধ্বংসী গােলার আঘাতে নিমিষের মধ্যে ৩টি ট্যাংক ধ্বংস হয়ে যায়। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে মিত্রবাহিনীর অন্তত ৪জন সেনা অফিসারসহ প্রায় ৭০-৮০জন শহিদ হন। আহত হন অসংখ্য।
পাকিস্তানি গােলন্দাজ বাহিনীর কভারেজে পাকিস্তানি পদাতিক বাহিনীর এ আক্রমণ মিত্রবাহিনীর কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। এর জন্য তারা মােটেই প্রস্তুত ছিল না। তথাপি ১৮ রাজপুত ও ১০ বিহার অসীম সাহসিকতার সাথে বীরের মতাে লড়তে থাকে। অক্ষত ৫টি ট্যাংক নিজেদের নিরাপত্তা বিপন্ন করেও অত্যন্ত সুনিপুণভাবে তাদের পদাতিক বাহিনীকে পশ্চাদপসরণে সহায়তা প্রদান করে এবং একই সাথে পাকিস্তানিদের দিকে পাল্টা আক্রমণ অব্যাহত রাখে। পেছন থেকে অগ্রসরমাণ মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী এ পর্যায়ে পাকিস্তানিদের আক্রমণ প্রতিহত করতে স্ব স্ব অবস্থান সুদৃঢ় করতে সচেষ্ট হয়। পাকিস্তানি বাহিনী নিজেদের সাময়িক সাফল্যে মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহী হয়ে ওঠে। কালবিলম্ব না করে তারা তাদের অবস্থান থেকে উঠে মিত্রবাহিনীর পিছু ধাওয়া করে এবং পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে ‘ইয়া আলী’ ‘ইয়া আলী’ বলে চিৎকার করে পাকিস্তানি সেনার একাংশ খােলা মাঠ দিয়ে দুর্গাপুরের দিকে অগ্রসর হয়। ২০০ গজ রেঞ্জের মধ্যে এসে পৌছামাত্র মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সব কয়টি রাইফেল, মেশিনগান, স্টেনগান একসাথে গর্জে ওঠে। এ পর্যায়ে যুদ্ধ তীব্র আকার ধারণ করে। বেপরােয়া প্রতিরােধের মুখে পাকিস্তানিদের অগ্রবর্তী প্রথম দলটি এলােমেলাে হয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করতে থাকে। একপর্যায়ে বেয়নেট চার্জ ও হাতাহাতি লড়াই শুরু হয়ে যায়। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাকে এলএমজির বাট দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। দিগভ্রান্ত পাকিস্তানিদের অনেকেই গ্রামবাসীর হাতে প্রাণ হারায়। এ পরিকল্পনাহীন আক্রমণে পাকিস্তানিদের চরম মূল্য দিতে হয়।
পাকিস্তানিরা যে গতিতে হামলা চালাচ্ছিল, ঠিক একই গতিতে তারা পশ্চাদপসরণ করে। তারা আবার ফিরে যায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে তাদের পূর্বের অবস্থানে। শত্রু তাদের অবস্থানে ফিরে যাওয়ার পর পরই মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর অবস্থানের ওপর পাকিস্তানিদের অবিরাম গােলন্দাজ আক্রমণ চলতে থাকে। কিন্তু সন্ধ্যার বেশ পূর্বেই ঝাকে ঝাকে ভারতীয় বিমান আশুগঞ্জ ও ভৈরবে পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড বােমাবর্ষণ শুরু করে। ভারতীয় গােলন্দাজ বাহিনীও এ সময় সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিমানগুলাে আশুগঞ্জ-ভৈরবের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে দফায় দফায় আক্রমণ চালায়। প্রচণ্ড আওয়াজে গােলার বিস্ফোরণ ঘটে। চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা অনেক দূর থেকেও দৃষ্টিগােচর হয়। ১০ ডিসেম্বর সকালবেলা সমস্ত রণাঙ্গন জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে অসংখ্য লাশ। গলিত লাশের গন্ধে সমস্ত এলাকা এক নারকীয় রূপ ধারণ করে। জনমানবশূন্য গ্রামগুলােয় একটা ভূতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করতে থাকে। গােটা। এলাকা লণ্ডভণ্ড। ভারতীয় সৈন্যরা রণাঙ্গন থেকে তাদের সহযােদ্ধাদের লাশ উদ্ধার করে এক জায়গায় স্তুপ করতে থাকে। বেশ কয়েকটি ভারতীয়। হেলিকপ্টার আহত সৈন্য ও লাশগুলােকে স্বদেশে নিয়ে যেতে থাকে। পূর্বের। দিনের যুদ্ধে যে ৪জন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা নিহত হন তাঁদের মধ্যে বিহার রেজিমেন্টের মেজর টেটা সিং এবং উড়িষ্যার মেজর টি এল শর্তা অন্যতম। ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর উল্লেখযােগ্য কোনাে তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। তবে সন্ধ্যার পর থেকেই ভারী মটার ও কামানের সাহায্যে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য করে গােলাবর্ষণ শুরু করে। মাঝরাত পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে।
গােলাবর্ষণের আড়ালে পাকিস্তানি সেনারা ঐদিনই আশুগঞ্জ ত্যাগ করে ভৈরব চলে যায়। ১১ ডিসেম্বর ভােরে মিত্রবাহিনীর গােলাবর্ষণের ছত্রছায়ায় ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও মিত্রবাহিনী ক্ষিপ্রতার সাথে আশুগঞ্জ পুনর্দখল করে নেয়। বি’। কোম্পানির অধিনায়ক মেজর সুবিদ আলী ভূঁইয়া আশুগঞ্জ-ভৈরব রেললাইনের দক্ষিণ দিয়ে অগ্রসর হয়ে আশুগঞ্জ সাইলাে থেকে নদীর পাড় ঘেঁষে চারতলায় অবস্থান নেন। ক্যাপ্টেন নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে ডি কোম্পানি আশুগঞ্জ রেল স্টেশনসংলগ্ন শরীয়ত উল্লাহ হাজীর লাল দালান থেকে শুরু করে উত্তরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা দেওয়াল পর্যন্ত মেঘনার কূল ঘেঁষে অবস্থান নেয়। | ভারতীয় বাহিনী আশুগঞ্জের মধ্যাঞ্চলে অবস্থান গ্রহণ করে। আশুগঞ্জ পুনর্দখলের বেশ কয়েক ঘণ্টা আগেই পাকিস্তানিদের শেষ দলটি আশুগঞ্জ ত্যাগ করে ভৈরব চলে যায় এবং সকাল ৮টা থেকে পাকিস্তানিরা তাদের ভৈরব অবস্থান থেকে কামানের সাহায্যে আশুগঞ্জে প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ করতে থাকে। কামান আক্রমণের ছত্রছায়ায় এদিন সকাল ১১টায় পাকিস্তানি সৈন্যরা মেঘনা সেতুর ভৈরব দিকের একাংশ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। সেতুর ২টি স্প্যান নদীতে পড়ে যায়। পাকিস্তানিদের গােলাবর্ষণের তীব্রতায় সমগ্র এলাকা ধোয়াচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
ভারতীয় গােলন্দাজরা কয়েক মিনিটের মধ্যেই পাকিস্তানিদের অবস্থানে কামানের অব্যর্থ আঘাত হানতে সক্ষম হয়। এর কিছুক্ষণ পরই ভারতীয় বিমান বাহিনী ভৈরবের ওপর দু-দুবার প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। বােমার আঘাতে আগুনের শিখা ও ধুম্রকুণ্ডলী ভৈরবকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এভাবে কামান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১১ ডিসেম্বর রাত কেটে যায়। যৌথবাহিনী আশুগঞ্জ প্রবেশের পর পরই শহরে ব্যাপক তল্লাশী চালায়, কিন্তু পাকিস্তানিদের অগণিত মৃতদেহ ছাড়া এখানে আর কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রতিটি স্থানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তাদের বাসস্থানসংলগ্ন ছােট পার্কটিতে নিহত পাকস্তানিদের বেশ কিছুসংখ্যক লাশ মাটি চাপা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। তড়িঘড়ি করে মাটি চাপা দেওয়া লাশগুলাের শরীরের কিছু অংশ মাটির ওপরেই রয়ে যায়। উত্তরের নিরাপত্তা দেওয়াল বরাবর পরিখা ও বাংকারগুলােতেও পাকিস্তানিদের অনেক লাশ পড়েছিল। | নিরাপত্তা দেওয়ালের উত্তর পাশের বাইরে ভারতীয় সৈনিকদের লাশ বিক্ষিপ্তভাবে পড়েছিল। সােহাগপুর গ্রামের অনেক বাড়িতে কিংবা বাড়ির আশপাশেও পাকিস্তানিদের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। সাইলাের উত্তর পাশের বালুচরেও অসংখ্য লাশ মাটি চাপা দেওয়া ছিল। লাশগুলাের হাত-পা বালুর ওপরে বেরিয়ে থাকতে দেখা যায়। পরদিন ১২ ডিসেম্বর সকালেও পাকিস্তানিদের বিক্ষিপ্ত গােলাবর্ষণ চলছিল। তবে তীব্রতা ছিল অনেক কম।
ভারতীয় কামানগুলােও থেমে ছিল না। তারাও সমানভাবে জবাব দিতে থাকে। তা ছাড়া সকাল থেকেই ভারতীয় বিমান আক্রমণ শুরু হয়। এক ঝাক এসইউ-৭ বােমারু বিমান পূর্ব দিক থেকে এসে ভৈরবে পাকিস্তানি লক্ষ্যবস্তুতে ব্যাপক আঘাত হানতে থাকে। ২টি বিমান। ভৈরবে রেল স্টেশন এলাকায় বােমা নিক্ষেপ করে। প্রচণ্ড আওয়াজে চারদিক কেঁপে ওঠে। পাকিস্তানিরা তাদের দূরপাল্লার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে প্রতিরােধ গড়তে ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। ভারতীয় বিমান বহর প্রায় সারা দিনই উপযুপরি বিমান হামলা চালায়। ঐদিন রাতের বেলা ভারতীয় বাহিনীর একাংশ আশুগঞ্জ অবস্থান ছেড়ে নরসিংদী ডেমরার দিকে চলে যায়। হাজার হাজার মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যকে নদীর পাড়ে স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধারা অতি অল্প সময়ের মধ্যে শত শত দেশীয় নৌকা। জোগাড় করে দেন। মিত্রবাহিনী আশুগঞ্জ থেকে চলে যাওয়ার পর আশুগঞ্জ রক্ষা। এবং ভৈরবে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীকে অবরােধ করে রাখার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে ১১ ও ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ওপর বর্তায়। ১৩ ডিসেম্বর ভােরে ভৈরবে যথারীতি বিমান আক্রমণের মধ্য দিয়ে দিনের সূচনা হয়। সকাল ১০টা নাগাদ দুবার বিমান হামলা সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি গােলন্দাজ বাহিনী ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গােলাবর্ষণ করতে থাকে।
১৪ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় যথারীতি ভৈরবে পাকিস্তানি লক্ষ্যবস্তুতে ভারতীয় বিমান থেকে বােমা নিক্ষেপ করা হয়। এ আক্রমণ প্রতিহত করার ব্যাপারে পাকিস্তানিদের কোনােরূপ তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। কিছুক্ষণ পরই আত্মসমর্পণ করার জন্য ভারতীয় ১টি বিমান থেকে ভৈরবে পাকিস্তানিদের উদ্দেশ্যে লিফলেট ফেলা হয়। অবশ্য ভৈরবে পাকিস্তানি অবস্থানে মিত্রবাহিনীর বােমা নিক্ষেপ অব্যাহত থাকে। পাকিস্তানি গােলন্দাজরাও এর জবাব দিতে থাকে। ১৫ ডিসেম্বর নিয়াজি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেন। জবাবে ভারতীয় সেনা প্রধান মানেকশ নিঃশর্তে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ১৬ ডিসেম্বর ভৈরবে পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর গােলাবর্ষণ আবার শুরু হয়। কিন্তু পাকিস্তানিরা সেদিন আর পাল্টা আক্রমণ চালায়নি। ভৈরবে অনেক সাদা পতাকা। উড়তে দেখা যায়। পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি চলতে থাকে বিকেলে মুক্তিবাহিনীর প্রতি অস্ত্র সংবরণের নির্দেশ এলে সব কটি অস্ত্র স্থায়ীভাবে থেমে যায়। যুদ্ধের ফলাফল স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষলগ্নে পাকিস্তানি সেনারা আশুগঞ্জে টিকতে না পেরে পশ্চাদপসরণ করে নরসিংদীর দিকে চলে যায়। মূলত এ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা পরাভূত হয় এবং মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী জয়লাভ করে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড