You dont have javascript enabled! Please enable it!
মিরপুর-মাধবপুর অভিযান
ভূমিকা
কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের পাশেই অবস্থিত মিরপুর-মাধবপুর গ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের বেশ কয়েকটি উল্লেখযােগ্য অপারেশন এ এলাকায় করা হয়। বিশেষত কালামুড়িয়া ব্রিজ ধ্বংস এবং তার পরবর্তী সময় রাস্তায় অ্যামবুশ পরিচালনা ছিল অত্যন্ত উল্লেখযােগ্য। পটভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সব থানায় মুক্তিযুদ্ধের সময় শত্রু প্রধান সড়কপথের প্রায় সব কটি ব্রিজ কালভার্ট স্থানীয় রাজাকারদের সাহায্যে পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। বড়াে বড়াে ব্রিজগুলােয় ইপিসিএএফ ও রাজাকারদের সমন্বয়ে পাহারার ব্যবস্থা করে। কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কে কালামুড়িয়া ব্রিজটিতে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার বোরহান উল্লাহর নেতৃত্বে একদল রাজাকার দিবারাত্রি পাহারারত ছিল। অপরদিকে মুক্তিযােদ্ধারাও কালামুড়িয়া ব্রিজ ধ্বংস করার জন্য উদগ্রীব। ছিলেন, কারণ তাহলে প্রধান রাস্তা পাকিস্তানিদের ব্যবহার অনুপযােগী হয়ে। যাবে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই মুক্তিবাহিনী কালামুড়িয়া ব্রিজ ধ্বংসের পরিকল্পনা করে। অভিযানের বর্ণনা হাবিলদার বােরহান উল্লাহ মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। সে কারণে ঐ রাস্তা দিয়ে মুক্তিবাহিনী বা শরণার্থীদের যাতায়াতে কোনােপ্রকার বাধা দিতেন না। মুক্তিবাহিনী কর্তৃক কালামুড়িয়া ব্রিজটা উড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সহযােগিতা চাওয়া হলে তিনি তাতে সম্মতি দেন। ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানির অধিনায়ক ক্যাপ্টেন গাফফার এ কাজের দায়িত্ব দেন সুবেদার (ইপিআর) গােলাম আম্বিয়াকে। ২৪ আগস্ট রাত ১২টায় অপারেশনটি পরিচালনার দিন ও ক্ষণ হিসেবে নির্ধারিত হয়। অপারেশনটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে সি’ কোম্পানি থেকে ১টি অ্যামবুশ পার্টি পাঠানাে হয় কালামুড়িয়া ব্রিজের উত্তর পাশে। উদ্দেশ্য, ডেমােনিশনের কাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত উত্তর দিক থেকে শত্রুর কোনাে যানবাহন যাতে না আসতে পারে। আরেকটি অ্যামবুশ পার্টি পাঠানাে হয়।
কালামুড়িয়া ব্রিজের প্রায় দেড় মাইল দক্ষিণে  যাতে শক্রর কোনাে যানবাহন অপারেশন চলাকালে ঐ দিক থেকে না আসতে পারে। এ ২টি অ্যামবুশ পার্টি ছাড়া ‘সি’ কোম্পানির ১টি শক্তিশালী দলকে পাকিস্তানিদের শালদা নদী প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর ১২টা ৩০ মিনিট থেকে গােলাগুলি নিক্ষেপের নির্দেশ দেওয়া হয় । সন্ধ্যার পর সুবেদার আম্বিয়া তাঁর ডেমােনিশন পার্টি নিয়ে কালামুড়িয়া ব্রিজের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান। অ্যামবুশ পার্টিগুলােও নিজ নিজ গন্তব্যস্থানের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। রাত ১১টা ৩০ মিনিটের দিকে সুবেদার আম্বিয়া কালামুড়িয়া ব্রিজ অবস্থানে পৌছে ফাঁকা গুলি নিক্ষেপ করেন। পাহারারত ১৮জন রাজাকার পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। আনুমানিক রাত ১২টার দিকে ডেমােনিশন পার্টি এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে ব্রিজটি ধ্বংস করে দেয়।  ৭ নম্বর প্লাটুন অধিনায়ক সুবেদার ওহাবের প্লাটুনটি কালামুড়িয়া ব্রিজ ডেমােনিশনের সময় শক্রর শালদা নদী অবস্থানে গোলাগুলি নিক্ষেপে নিয়ােজিত ছিল। ব্রিজটি ধ্বংস করার শব্দ পেয়ে তিনি তাঁর প্লাটুন নিয়ে অন্যদের সাথে মন্দভাগ রেল স্টেশন এলাকায় চলে আসেন। ইতােমধ্যে অ্যামবুশ পার্টির লােকেরাও কোনাবনে ফিরে আসে। এদিকে সুবেদার আম্বিয়া আত্মসমর্পণকারী ১৮জন রাজাকারকে সাথে নিয়ে কোনাবন ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন গাফফারের কাছে রিপাের্ট করেন। এসব রাজাকারকে ঐদিন থেকেই মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
মন্দভাগ পৌছেই সুবেদার ওহাব পরদিন কালামুড়িয়া ব্রিজ এলাকায় তাঁর প্লাটুন নিয়ে অ্যামবুশ স্থাপনের অভিপ্রায় জানিয়ে ক্যাপ্টেন গাফফারের অনুমতি চান। কারণ হিসেবে সুবেদার ওহাব জানান যে কালামুড়িয়া ব্রিজের মতাে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্রিজ ডেমােনিশনের সংবাদ পেয়ে উর্ধ্বতন পাকিস্তানি সেনা। কর্মকর্তারা অবশ্যই ব্রিজ অবস্থানের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য আসতে পারেন। ক্যাপ্টেন গাফফার সুবেদার ওহাবকে অ্যামবুশ অপারেশনে যাওয়ার অনুমতি দিলেও মর্টার ২টি নিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন। অনুমতি পেয়েই সুবেদার ওহাব ঐ রাতেই তার প্লাটুনের সব সদস্যকে ভােরে অ্যামবুশ অপারেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন বলে জানিয়ে দেন।  ২৫ আগস্ট ভােরবেলা বেরিয়ে পড়লেন সুবেদার ওহাব তাঁর প্লাটুন নিয়ে। চারদিকে পানি। নৌকাই একমাত্র ভরসা। ৪০-৫০জনের দল। লুঙ্গি-গেঞ্জি। পরনে। যেন সাধারণ গ্রামবাসী। তারা শালদা নদী এলাকা থেকে চাড়রা, ঝিকুরা, শাইটগুলা হয়ে পৌঁছলেন মাধবপুর গ্রামে। স্থানীয় লােকজন জানালাে, কালামুড়িয়া ব্রিজের প্রায় দেড় মাইল দক্ষিণে। যাতে শক্রর কোনাে যানবাহন অপারেশন চলাকালে ঐ দিক থেকে না আসতে পারে। এ ২টি অ্যামবুশ পার্টি ছাড়া ‘সি’ কোম্পানির ১টি শক্তিশালী দলকে পাকিস্তানিদের শালদা নদী প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর ১২টা ৩০ মিনিট থেকে গােলাগুলি নিক্ষেপের নির্দেশ দেওয়া হয়। | সন্ধ্যার পর সুবেদার আম্বিয়া তাঁর ডেমােনিশন পার্টি নিয়ে কালামুড়িয়া ব্রিজের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান। অ্যামবুশ পার্টিগুলােও নিজ নিজ গন্তব্যস্থানের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। রাত ১১টা ৩০ মিনিটের দিকে সুবেদার আম্বিয়া কালামুড়িয়া ব্রিজ অবস্থানে পৌছে ফাঁকা গুলি নিক্ষেপ করেন। পাহারারত ১৮জন রাজাকার পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। আনুমানিক রাত ১২টার দিকে ডেমােনিশন পার্টি এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে ব্রিজটি ধ্বংস করে দেয়। 
৭ নম্বর প্লাটুন অধিনায়ক সুবেদার ওহাবের প্লটুনটি কালামুড়িয়া ব্রিজ ডেমােনিশনের সময় শক্রর শালদা নদী অবস্থানে গোলাগুলি নিক্ষেপে নিয়ােজিত ছিল। ব্রিজটি ধ্বংস করার শব্দ পেয়ে তিনি তার প্লাটুন নিয়ে অন্যদের সাথে মন্দভাগ রেল স্টেশন এলাকায় চলে আসেন। ইতােমধ্যে অ্যামবুশ পার্টির লােকেরাও কোনাবনে ফিরে আসে। এদিকে সুবেদার আম্বিয়া আত্মসমর্পণকারী ১৮জন রাজাকারকে সাথে নিয়ে কোনাবন ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন গাফফারের কাছে রিপাের্ট করেন। এসব রাজাকারকে ঐদিন থেকেই মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে। অন্তর্ভুক্ত করা হয়।  মন্দভাগ পৌছেই সুবেদার ওহাব পরদিন কালামুড়িয়া ব্রিজ এলাকায় তার প্লাটুন নিয়ে অ্যামবুশ স্থাপনের অভিপ্রায় জানিয়ে ক্যাপ্টেন গাফফারের অনুমতি চান। কারণ হিসেবে সুবেদার ওহাব জানান যে কালামুড়িয়া ব্রিজের মতাে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্রিজ ডেমােনিশনের সংবাদ পেয়ে উর্ধ্বতন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা অবশ্যই ব্রিজ অবস্থানের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য আসতে পারেন। ক্যাপ্টেন গাফফার সুবেদার ওহাবকে অ্যামবুশ অপারেশনে যাওয়ার অনুমতি দিলেও মর্টার ২টি নিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন। অনুমতি পেয়েই সুবেদার ওহাব ঐ রাতেই তাঁর প্লাটুনের সব সদস্যকে ভােরে অ্যামবুশ অপারেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন বলে জানিয়ে দেন।
২৫ আগস্ট ভােরবেলা বেরিয়ে পড়লেন সুবেদার ওহাব তার প্লাটুন নিয়ে চারদিকে পানি নৌকাই একমাত্র ভরসা। ৪০-৫০জনের দল। লুঙ্গি-গেঞ্জি পরনে। যেন সাধারণ গ্রামবাসী। তারা শালদা নদী এলাকা থেকে চাড়রা, ঝিকুরা, শাইটগুলা হয়ে পৌছলেন মাধবপুর গ্রামে। স্থানীয় লােকজন জানালাে, পাকিস্তানিদের ১টি পতাকাবাহী জিপ আর ২টি মাঝারি আকারের গাড়ি। ইতােমধ্যে কুমিল্লার দিক থেকে কালামুড়িয়া ব্রিজের দিকে চলে গেছে। সুবেদার ওহাবের বুঝতে অসুবিধা হলাে না যে পতাকাবাহী জিপটিতে। অবশ্যই পাকিস্তানি কয়েকজন ঊর্ধ্বতন অফিসার রয়েছে। এরা অবশ্যই দিনের। বেলায় কুমিল্লা সেনানিবাসে ফিরে যাবে। শক্র হননের এ এক বিরাট সুযােগ। কালক্ষেপণ না করে সুবেদার ওহাব রাস্তার পূর্ব পাশে উত্তর দিকে মুখ করে অ্যামবুশ স্থাপন করলেন। সর্বদক্ষিণের পুকুরপাড়ের ঝােপঝাড়ের অবস্থানে। এলএমজিসহ পাঠালেন নায়েক তাহেরকে, উত্তরে নায়েব সুবেদার মঙ্গল মিয়ার। দলকে। নিজে ১টি এলএমজিসহ অবস্থান নিলেন রাস্তার পাশে মাটির। দেওয়ালের ১টি কুড়েঘরের আড়ালে। অ্যামবুশ এলাকায় ছিল ছােটে ২টি কালভার্ট। কালভার্ট ২টি পাহারা দিচ্ছিল। রাজাকাররা। সুবেদার ওহাবের অবস্থান থেকে পাকা সড়কের দূরত্ব ছিল বড়ােজোর ১৫ গজ। রাজাকারেরা মুক্তিবাহিনীর ঐ এলাকায় আগমন সমন্ধে কিছুই টের পেল না। খুবই সতর্কতার সাথে ১টি এলএমজিসহ ১টি দলকে। নায়েব সুবেদার মঙ্গল মিয়া আরও কিছুটা দূরত্বে উত্তরে গিয়ে অবস্থান নিতে বললেন। উদ্দেশ্য, শক্রর বেশিসংখ্যক যানবাহন যদি আসে, তার সবই যাতে অ্যামবুশ এলাকায় পড়ে যায়। টহলরত রাজাকারদের নায়েব সুবেদার মঙ্গল মিয়া এ বলে হুমকি দেন যে তারা যদি পাকিস্তানিদের কোনােপ্রকার ইঙ্গিত প্রদান করে, তাহলে প্রাণে মারা পড়বে। অন্যথায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। এ সময় দক্ষিণ দিক থেকে জানালা বন্ধ ৩টি সিভিল বাসকে আসতে দেখা গেল।
১জন বৃদ্ধ রাজাকার বাসগুলাে থামিয়ে পেছনে ফিরে যেতে সংকেত দিল। জিজ্ঞেস করতে সে জানায়, ওগুলাে সিভিল বাস। বাস ৩টির পেছনেই ছিল। কয়েকটি সেনা ট্রাক। বৃদ্ধ রাজাকারটি ঐ গুলােকে থামিয়ে দেয়। সেনা ট্রাক দেখে বৃদ্ধ রাজাকারের সাহস বেড়ে যায়। সে বাসগুলােকে ব্যাক গিয়ারে পেছনে। যেতে নির্দেশ করে। এ সময় সিভিল বাস ৩টি থেকে দ্রুতবেগে পাকিস্তানি সেনা। সদস্যদের বেরিয়ে এসে রাস্তার আড়ালে অবস্থান নিতে দেখা গেল। বেলা ২টার দিকে নায়েক আবু তাহের সুবেদার ওহাবের কাছে গুলি ছােড়ার অনুমতি চান। সুবেদার ওহাব তাতে সম্মতি দেন। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় দু’পক্ষের। ব্যাপক গুলিবিনিময়। মুহূর্তের মধ্যেই পুরাে এলাকাটি একটি যুদ্ধক্ষেত্রের রূপ নেয়। সুবেদার ওহাবের অ্যামবুশ পার্টি রাস্তার পূর্ব পাশে অবস্থান নেওয়ার কারণে। পাকিস্তানি বাহিনীকে রাস্তার পশ্চিম পাশে অবস্থান নিতে হয়। রাস্তার পশ্চিম পাশে ছিল খােলা মাঠ। রাস্তার আড়াল ছাড়া অবস্থান নেওয়ার মতাে কোনাে উপযুক্ত জায়গা ছিল না। শত্রু ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অ্যামবুশ পার্টির সবার নজর যখন দক্ষিণ দিকে, ঠিক সে সময় উত্তর দিক থেকে ১টি পতাকাবাহী জিপ সুবেদার ওহাবের অবস্থান অতিক্রম করে দ্রুতবেগে চলে গেল। তৎক্ষণাৎ সুবেদার ওহাব পতাকাবাহী জিপ ও ডজ গাড়ি ২টি লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লেন। কিন্তু সেফটি ক্যাচ বন্ধ থাকায় গুলি নিক্ষেপে ব্যর্থ হন। জিপটি রাস্তার পাশ ধরে দ্রুতগতিতে এগিয়ে গেল। 
দক্ষিণে নায়েক তাহেরসহ যাদের অবস্থান ছিল, তারা শত্রুর বাস, ট্রাক ও রাস্তার আড়ালে অবস্থানকারী পাকিস্তানি বাহিনী লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছিলেন। তারাও সময়মতাে পতাকাবাহী জিপটিকে লক্ষ্য করে কার্যকরভাবে গুলি ছুড়তে ব্যর্থ হলেন। কয়েকটি গুলি জিপটিকে বিদ্ধ করে চলে গেল। পরবর্তীকালে জানা। যায় যে ঐ জিপটির ড্রাইভার ছিল কুমিল্লা শাসনগাছার হক মােটর ওয়ার্কশপের মালিক আব্দুল হক। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি দূরের কোনাে প্রতিরক্ষা অবস্থানে যেতে হলে আব্দুল হককে নিয়ে যেতেন। আব্দুল হক ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির খুবই প্রিয়পাত্র ছিলেন এবং বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি ছিলেন। আব্দুল হক ১জন দক্ষ মেকানিকও ছিলেন। রাস্তাঘাটে গাড়ির কোনাে ত্রুটি দেখা দিলে সাথে সাথে তিনি তা ঠিক করে ফেলতে পারতেন। সে কারণেও আব্দুল হকের ওপর ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। আব্দুল হক এ সুযােগ নিয়েই মাঝে মাঝে কোনাবনে গিয়ে শত্রুসম্পর্কিত তথ্য দিয়ে আসতেন এবং ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফিকে মুক্তিবাহিনীর তথ্য দিতেন। ব্যাপক গুলিবর্ষণের কারণে ডজ গাড়ি ২টি অচল হয়ে থেমে গিয়েছিল। আরােহীদের অনেকেই হতাহত হয়। গাড়ি ২টিতে যারা জীবিত ছিল, তাদেরকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়। ছাত্র মােজাম্মেল এগিয়ে যান। ওদিকে। নায়েব সুবেদার মঙ্গল মিয়া উচ্চস্বরে সারেন্ডার বলে শত্রু সৈন্যদের অস্ত্র নীচে ফেলে দিতে নির্দেশ দেন। রাস্তার পশ্চিম পাশ থেকে ১জন নায়েক আত্মসমর্পণের ভান করে এসএমজি উচু করে পাকা সড়কের ওপর উঠেই সুবেদার মঙ্গল মিয়াকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে দ্রুতগতিতে রাস্তার পশ্চিমে আড়াল নেয়। মুক্তিযােদ্ধা মােজাম্মেল আগের থেকেই তাঁর স্টেনগানটি তাক করে রেখেছিলেন। নায়েব সুবেদার মঙ্গল মিয়া অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন। আবার জীবিত পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের কড়া নির্দেশ দিলেন সুবেদার ওহাব।
এ সময় বালুচ রেজিমেন্টের ১জন নায়েক অস্ত্র তুলে আত্মসমর্পণের জন্য সড়কে উঠে আসে। নির্দেশমতাে অস্ত্র ফেলে সুবেদার ওহাবের অবস্থানের দিকে আসে। এরপর পরই আরেকজন সিপাহি অস্ত্র রাস্তার ওপর ফেলে দিয়ে এগিয়ে আসে। ঐ নায়েকটি নিরুপায় হয়ে অস্ত্র রাস্তার ওপরে ফেলে দিয়ে আসে। এদের ৩জনকেই ত্বরিত বেঁধে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়। মােজাম্মেল অস্ত্রগুলাে কুড়িয়ে সুবেদার ওহাবের কাছে নিয়ে আসেন। | ডজ গাড়ি ২টিতে বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ পাওয়া যায়। ওদিকে দক্ষিণে পর্যাপ্ত আড়াল না পাবার কারণে সড়কপথটিকে আড়াল করে শত্রুসৈন্যরা ক্রলিং করে অনেক দূর পেছনে চলে গিয়েছিল। অ্যামবুশ পাটির গুলির আঘাতে ঐদিকে শত্রুর হতাহতের সংখ্যা ছিল অনেক। ফিল্ড অব ফায়ার পরিষ্কার থাকার কারণে অ্যামবুশ পার্টির সদস্যরা দেখে দেখে শত্রুসৈন্যদের গুলি নিক্ষেপ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির জিপের ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে কসবা ও কোম্পানীগঞ্জ অবস্থানে সংবাদ দিলে শত্রু পেছন থেকে এসে সুবেদার ওহাবের দলকে ঘেরাও করে ফেলতে পারে। এ আশঙ্কায় বেশিক্ষণ না থেকে সুবেদার ওহাব সিগন্যাল পিস্তল থেকে ছােড়া ভেরি লাইটের মাধ্যমে সবাইকে অবস্থান ছেড়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌছার সংকেত দিলেন। গ্রামের পূর্ব দিকে ঝােপঝাড়ের আড়ালে নৌকাগুলাে লুকানাে ছিল। তখন প্রায় সন্ধ্যা হয় হয়। সুবেদার ওহাব তার বাহিনী নিয়ে কোনাবনের উদ্দেশ্যে রওনা হন। সাথে ৩জন বন্দি পাকিস্তানি। সেনা। ফলাফল এ অভিযানে কালামুড়িয়া ব্রিজ ধ্বংস হয় এবং পাকিস্তানিদের যােগাযােগ ব্যবস্থা। বিঘ্নিত হয়। তা ছাড়া ৩জন পাকিস্তানি সেনা বন্দি হয়। শত্রুপক্ষের হতাহতের সংখ্যা আনুমানিক ৪০জনের অধিক ছিল। শিক্ষণীয় বিষয় ১. কালামুড়িয়া সেতুর ধ্বংস শক্রর ওপর ফাঁদ পাতার যে সুযােগ এনে দিয়েছিল, তা সুবেদার ওহাব গ্রহণ করেছিলেন। ২. শত্রু সৈন্যকে নিয়ন্ত্রণ এবং বন্দি করার সময় অবশ্যই বিশেষ সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।
শালদা নদীর যুদ্ধ
ভূমিকা কসবা থানার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত শালদা নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলাে যেমন: শালদা নদী স্টেশন এলাকা, কৈবালা, বড় বায়েক, সাগর তলা, অষ্টজঙ্গল এবং কেল্লা পাথর প্রভৃতি স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে তা অত্যন্ত বীরত্বগাঁথা ও উল্লেখযােগ্য। শালদা নদীর পরিচিতি ও গুরুত্ব অনেক। শালদা নদী স্টেশন কসবা থানার অন্তর্গত। এ এলাকাটি সাধারণত খােলা ও সমতল, যার উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে বয়ে গেছে তিতাস নদ। এ এলাকায় অসংখ্য জলাভূমি থাকায় মেঠোপথে চলাচল কষ্টসাধ্য। এ এলাকাটি কসবা থানা থেকে ৭ কিলােমিটার দক্ষিণে। অবস্থিত। শালদা নদী রেল স্টেশন আন্তর্জাতিক সীমারেখাসংলগ্ন। এ রেলপথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আশুগঞ্জ হয়ে ঢাকা, সিলেট এবং কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে অতি সহজে যাতায়াত করা যায়। শালদা নদীর পাশ দিয়ে সড়ক থাকায় খুব সহজে কসবাআখাউড়ার মধ্যে যাতায়াত সম্ভব। এ কারণে এ এলাকায় অসংখ্য ছােট ছােট সংঘর্ষ হয়, যার মধ্যে শালগড় অ্যামবুশ, মন্দভাগ রেল স্টেশন অ্যামবুশ, ঝিকুরা অ্যামবুশ, মিরপুর-মাধবপুর অভিযান ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য। যুদ্ধের সংগঠন। যুদ্ধের সংগঠন ছিল নিমরূপ: ১. মুক্তিবাহিনী। ক. ২ নম্বর সেক্টর • ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (৪ ইস্ট বেঙ্গল)। ইপিআর-এর ১টি কোম্পানি। • মর্টার প্লাটুন। • মুজিব ব্যাটারি। ২. পাকিস্তানি বাহিনী ক. ২৭ পদাতিক ব্রিগেড • ৩৩ বালুচ রেজিমেন্ট (৩৩ বালুচ)। • ৩০ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট (৩০ পাঞ্জাব)।
পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান পাকিস্তানি বাহিনীর ৩৩ বালুচ কসবা, কামালপুর, মন্দভাগ ও কুটি এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করে। অপর ব্যাটালিয়ন ৩০ পাঞ্জাব শালদা নদীর দক্ষিণে নয়নপুর এলাকায় অবস্থান করছিল। মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ২ নম্বর সেক্টরের সেক্টর অধিনায়ক মেজর খালেদ মােশাররফের পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যাপ্টেন গাফফার এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে নয়নপুর সড়কের কাছে অবস্থান নেন। মেজর সালেক শালদা নদী অতিক্রম করে শালদা রেল স্টেশনের পশ্চিম গােডাউন এলাকায় অবস্থান নেন। ক্যাপ্টেন আব্দুল আজিজ পাশা নবগঠিত মুজিব ব্যাটারির কামান নিয়ে মন্দভাগে অবস্থান গ্রহণ করেন। সুবেদার জব্বার মর্টার সেকশন নিয়ে বায়েকের পেছনে অবস্থান নেন। মেজর খালেদ মােশাররফ নিজে এ যুদ্ধের সার্বিক পরিচালনার ভার নেন। যুদ্ধের বর্ণনা শালদা নদীর যুদ্ধ-১ ৩০ সেপ্টেম্বর ভাের ৬টা ৩০ মিনিটে রণঘণ্টা নির্ধারণ করা হয়। মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল, নয়নপুর এলাকায় পাকিস্তানি ঘাটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা। ক্যাপ্টেন পাশা প্রথমে আর্টিলারি গােলা নিক্ষেপ করেন এবং এরপর চতুর্দিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু হয়। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের তােড়ে শত্রু নয়নপুর ছেড়ে পিছু হটতে থাকে। এমন সময় মেজর সালেকের গােলাবারুদ শেষ হয়ে যায় এবং তিনি পিছে সরে আসেন।  পাকিস্তানি সেনারা কসবা, কুটি, চাণ্ডালা এলাকা থেকে আর্টিলারির গােলা নিক্ষেপ করতে থাকে। ফলে শালদা স্টেশন দখল করতে মুক্তিবাহিনী ব্যর্থ হয়। এ যুদ্ধে বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং অনেক মুক্তিযােদ্ধা শাহাদতবরণ করেন। শালদা নদীর প্রথম যুদ্ধ ব্যর্থ হওয়ায় মেজর খালেদ মােশাররফ পুনরায় শালদা নদী রেল স্টেশন দখলের দায়িত্ব ক্যাপ্টেন গাফফারের ওপর ন্যস্ত করেন।
ক্যাপ্টেন গাফফার পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা করার পরিকল্পনা। প্রণয়ন করেন। তিনি এক অভিনব পন্থা গ্রহণ করেন। চূড়ান্ত আক্রমণের দিন। নির্ধারণ করেন ৮ অক্টোবর। রেকি করেন সেই মােতাবেক। পাকিস্তানি বাহিনীর মনােযােগ অন্যদিকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি শত্রুর নিকটবর্তী ক্যাম্পে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী ছােট ১টি দলকে গােবিন্দপুর ও চাণ্ডালা এলাকায় পাঠানাে হয়। ৭ অক্টোবর এ দলটি পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। পাকিস্তানি সেনারা বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে ভারী মেশিনগান ও মর্টারের সাহায্যে সারারাত গােলা নিক্ষেপ করে এবং সকালবেলা বন্ধ করে। পাকিস্তানি সেনারা ধারণা করেছিল, প্রতিপক্ষ পর্যদস্ত হয়েছে। তাই তারা বিশ্রামের জন্য চলে যায়। ক্যাম্প পাহারা দেওয়ার জন্য রাজাকারদের নিয়ােজিত করে পাকিস্তানি সেনারা। বিশ্রাম নেয়। এ চমৎকার সুযােগে ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পুরাে উদ্যমে ৮ অক্টোবর সকাল ৮টায় শালদা নদী রেল স্টেশন আক্রমণ করে। ক্যাপ্টেন গাফফার পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তার কোম্পানিকে ৪টি প্লাটুনে ভাগ করে ৩ দিক থেকে আক্রমণ করেন। নায়েব সুবেদার সিরাজ শালদা নদীর পূর্ব পাশে এক প্লাটুন নিয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। নায়েব সুবেদার মঙ্গল মিয়া ১টি প্লাটুন নিয়ে শালদা নদী অতিক্রম করে গােডাউনের পশ্চিম পাশে অবস্থান। নেন। নায়েব সুবেদার বেলায়েত শালদা নদীর উত্তর তীরে এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। অপর প্লটুনটি সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে নায়েব সুবেদার মঙ্গল মিয়ার প্লাটুনের পেছনে ফলােআপ প্লাটুন হিসেবে অবস্থান নেয়। এ প্লাটুনটির ওপর দায়িত্ব ছিল শত্রুর প্রতি-আক্রমণ প্রতিরােধ করা । নায়েব সুবেদার সিরাজের প্লাটুন রেল স্টেশনের পূর্ব প্রান্তে শক্রর পরিখার ওপর আক্রমণ করে। নায়েব সুবেদার মঙ্গল মিয়ার প্লাটুন রেল স্টেশনের পশ্চিম প্রান্তে শক্রর যােগাযােগ বিছিন্ন করে দেয়। নায়েব সুবেদার বেলায়েতের নেতৃত্বে ১টি প্লাটুন উত্তর দিক থেকে হামলা চালায়। ৩ দিক থেকে এ অতর্কিত হামলায় পাকিস্তানি সেনারা তাদের প্রতিরক্ষাব্যুহ ছেড়ে নদীর দক্ষিণে চলে যায়। নায়েব সুবেদার বেলায়েত এবং তার প্লাটুন নদীতে ঝাপ দেয় এবং দক্ষিণ তীরে উঠে শত্রুর বাংকার ধ্বংস করে। নায়েব সুবেদার বেলায়েত গ্রেনেডের সাহায্যে শত্রুর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেন।
পাকিস্তানি সেনারা বাধ্য হয়ে গােডাউন এলাকা ছেড়ে চলে যায়। সেই মুহূর্তে ক্যাপ্টেন গাফফার পাকিস্তানি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বেতার কথােপকথন শােনেন। তাতে বলা হয়, মুক্তিবাহিনীর ১টি ব্যাটালিয়ন ৩ দিক থেকে শালদা নদী থেকে রেল স্টেশন আক্রমণ করেছে এবং তাদের প্রতিহত করা সম্ভব নয়। এ সংবাদ পাকিস্তানিদের মনােবল ভেঙে দেয়। শালদা নদীর যুদ্ধ-২ ১৪ অক্টোবর মেজর খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে পাকিস্তানিদের শালদা নদী। প্রতিরক্ষা অবস্থানে এক প্রচণ্ড আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। এ আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ৩টি নিয়মিত ব্যাটালিয়ন এবং ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে ২টি নিয়মিত ব্যাটালিয়ন অংশগ্রহণ করে। ফায়ার সাপাের্ট দেওয়ার জন্য ভারতীয় বাহিনীর ১টি আর্টিলারি ইউনিট এবং মুক্তিবাহিনীর পক্ষে প্রথম মুজিব ব্যাটারি অংশগ্রহণ করে। এখানে উল্লেখ্য যে ইতােমধ্যে ২য় ও ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল।  রেজিমেন্টের কিছুসংখ্যক অভিজ্ঞ সেনাসদস্যদের নিয়ে ৪র্থ, ৯ম ও ১০ম নামের ৩টি বেঙ্গল রেজিমেন্টের পুনর্গঠন করা হয়েছিল। পুনর্গঠিত ৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব নেন। মেজর আইনউদ্দিন, ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার হন মেজর আবু সালেক চৌধুরী এবং ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হন মেজর। গাফফার হাওলাদার। শালদা নদী অপারেশনে ৪র্থ, ৯ম ও ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ৩টি সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল। এ অভিযানে অসুস্থ থাকার কারণে সুবেদার ওহাবকে ১টি কাট অফ পাটির দায়িত্ব দিয়ে চৌবাশ ও নাগাইশ গ্রামে পাঠানাে হয়। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ৩টি নিয়মিত ব্যাটালিয়ন ছাড়া বহু মুক্তিযােদ্ধাও এ অভিযানে যােগ দিয়েছিলেন। চূড়ান্ত আক্রমণের পূর্বে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর আর্টিলারি গানগুলাে থেকে অসংখ্য আর্টিলারি গােলা শত্রুর অবস্থানের ওপর নিক্ষিপ্ত হয়। এক হিসাবে জানা যায় যে, অন্যূন ১,৪০০টি। ফিল্ড ও মিডিয়াম আর্টিলারি (৬০০টি) গােলা নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। তা ছাড়া ৮২ মি.মি. মর্টার এবং ১০৬ মিলিমিটার আরআর থেকেও অসংখ্য গােলা নিক্ষিপ্ত ।
হয়েছিল শত্রুর অবস্থানের ওপর। শত্রুর বাংকারগুলাে ছিল খবুই মজবুত। মিত্রবাহিনীর আর্টিলারির। গােলাগুলাে লক্ষ্যস্থলে খুব একটা আঘাত হানতে পারেনি। ফলে শক্র নিজ নিজ বাংকারে অবস্থান নিয়েই শেষ পর্যন্ত আক্রমণ প্রতিহত করে যায়। প্রতিটি বাংকার ছিল খুবই সুরক্ষিত। শেষ পর্যন্ত শালদা নদী দখলের আশা ত্যাগ করতে হয়। এ আক্রমণে অনেক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। এত বড়াে প্রথাগত । আক্রমণ শত্রু এর আগে কখনাে দেখেনি। শালদা নদীর যুদ্ধ-৩ মেজর আইনুদ্দিনের সাথে কসবা অপারেশনে গিয়ে সেক্টর অধিনায়ক মেজর খালেদ মােশাররফ শত্রুর নিক্ষিপ্ত ১টি আর্টিলারির গােলার আঘাতে মারাত্মক আহত হন। মেজর খালেদ মােশাররফকে তাৎক্ষণিকভাবে আগরতলায় চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। মেজর খালেদ মােশাররফের স্থলে মেজর সালেক চৌধুরী সেক্টর অধিনায়কের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পুনর্গঠনকালে সুবেদার ওহাবকে ‘সি’ কোম্পানির অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরই মধ্যে ভারত থেকে কমিশন্ডপ্রাপ্ত সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট জামিলকে ‘সি’ কোম্পানিতে কোম্পানি অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট জামিল ‘সি’ কোম্পানিতে যােগ দিলেও কার্যত কোম্পানির সার্বিক অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব থেকে যায় সুবেদার ওহাবের ওপর।
সুবেদার ওহাব ‘সি’ কোম্পানি নিয়ে শালদা নদী শত্রুমুক্ত করার পরিকল্পনা। নিলেন। মন্দভাগ ও শালদা নদী এলাকায় শত্রুর অবস্থানগুলাে এবং গতিবিধি। পর্যবেক্ষণ করে তিনি তার কোম্পানির ৭ নম্বর প্লাটুনটিকে মন্দভাগ গ্রামকে সামনে রেখে চাউলা গ্রামে প্রতিরক্ষা অবস্থানে যেতে নির্দেশ দিলেন। ৮ নম্বর প্লাটুনটিকে ৭ নম্বর প্লাটুনের বাম দিকে শালদা নদীর উত্তর এবং শত্রুর শালদা নদী প্রতিরক্ষা অবস্থানকে সামনে রেখে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিতে নির্দেশ দেন। ৯ নম্বর প্লাটুনটিকে ৭ নম্বর প্লাটুনের ডান দিকে কায়েমপুরকে সামনে রেখে চানখােলা গ্রামে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিতে নির্দেশ দেন। এ ব্যবস্থায় প্রতিটি অবস্থানের সামনেই শক্রর প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল । কাজেই মজবুত বাংকার খননের মাধ্যমে সবাইকে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিতে হয়। প্রায় প্রতিদিনই এসব অবস্থান থেকে শক্রর সাথে খণ্ডযুদ্ধ চলতে থাকে। শক্রর প্রতিরক্ষা অবস্থানের মুখােমুখি চলাচলও নিরাপদ ছিল না। ১২ নভেম্বর শত্রুর শালদা নদী প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা করা হয়। এদিন সকাল ৭টার সময় ৭ নম্বর প্লাটুন অধিনায়ক নায়েব সুবেদার মঙ্গল মিয়া, ৮ নম্বর প্লাটুন অধিনায়ক নায়েব সুবেদার বেলায়েত হােসেন, ৯ নম্বর প্লাটুন অধিনায়ক নায়েব সুবেদার শহিদ এবং মর্টার প্লাটুন অধিনায়ক সুবেদার সামছুল হককে কোম্পানি সদর দপ্তরে এক জরুরি আলােচনার জন্য ডেকে পাঠানাে হয়। এ সভায় কোম্পানি অধিনায়ক সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট জামিলউদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত সবাই আক্রমণের প্রস্তাবে সম্মতি জানালেন। বেলা ১১টার দিকে সুবেদার ওহাব ব্যাটালিয়ন অধিনায়কের সম্মতির জন্য কোনাবনের উদ্দেশ্যে রওনা হন। পথিমধ্যে তিনি তার পরিকল্পিত অপারেশনের কথা মুজিব ব্যাটারির অধিনায়ক মেজর আবদুল আজিজ পাশাকে জানালেন। মেজর আজিজ পাশা তার আর্টিলারি গানগুলাে দিয়ে প্রয়ােজনীয় ফায়ার সাপাের্ট দেওয়ার আশ্বাস দেন। 
মেজর আবদুল আজিজ পাশা ও সুবেদার ওহাব অপারেশনটির ব্যাপারে ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক মেজর গাফফারের সাথে আলােচনার জন্য রওনা হলেন। কোনাবনে পৌছে ব্যাটালিয়ন অধিনায়কের কাছে অপারেশনটি পরিচালনার ব্যাপারে অনুমতি চাওয়া হলে তিনি তাতে সম্মতি দিলেন। সম্মতি পেয়ে সুবেদার ওহাব ‘সি’ কোম্পানি হেডকোয়ার্টার্স চাউরায় ফিরে এলেন। সবার সাথে আলােচনা করে আক্রমণের তারিখ এবং সময় ১৩ নভেম্বর ভাের ৪টা স্থির। হয়। আক্রমণের ধরন এবং প্লাটুনগুলাের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়। যথাসময়ে ‘সি’ কোম্পানি আক্রমণ শুরু করে কিন্তু শত্রু তাদের শক্ত অবস্থান থেকে প্রতিরােধ করে যাচ্ছিল। বিশেষ করে ৭ ও ৯ নম্বর প্লাটুন বেশি বাধার সম্মুখীন হচ্ছিল। ৮ নম্বর প্লটুন কিছুটা অগ্রসর হতে পারে। শত্রুরা তাদের অবস্থান থেকে দেখে দেখে গােলা নিক্ষেপ করছিল। একটি ১০৬ মিলিমিটার আরআর দ্রুততার সাথে ৮ নম্বর প্লাটুন এলাকায় নিয়ে আসা হয়। এরই মধ্যে রকেট লঞ্চারের গােলার আঘাতে শক্রর ৩-৪টি বাংকার ধ্বংস করা হয়। ওদিকে ওয়্যারলেস সেটে মুজিব ব্যাটারি থেকে ফায়ার সমর্থনে অনুরােধ জানানাে হয়। মুক্তিযােদ্ধারা খুবই সতর্কতার সাথে শত্রুর অবস্থানের দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে থাকে। এ সময় সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট জামিল সুবেদার ওহাবের অবস্থানে এসে পৌছান। সবদিক থেকেই সার্বিক অবস্থা তখন মুক্তিযােদ্ধাদের অনুকূলে আসতে থাকলাে। প্রতিটি প্লাটুনই সতর্কতার সাথে শক্রর অবস্থানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ১০৬ মিলিমিটার আরআর এবং রকেট লঞ্চার, ৬০ মিলিমিটার এবং ২ ইঞ্চি মর্টারগুলাে নিখুঁতভাবে শক্রর বাংকারগুলােয় গােলা। নিক্ষেপ করে চলছিল । ওদিকে মুজিব ব্যাটারিও নিখুঁতভাবে গােলা নিক্ষেপ করে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে দেখা যায় যে, শত্রু অবস্থান ছেড়ে রেললাইন ধরে দক্ষিণে মনােয়ারা গ্রামের দিকে পশ্চাদপসরণ করছে। সাথে সাথেই নায়েব সুবেদার মঙ্গল মিয়া এবং নায়েব সুবেদার বেলায়েত নদী অতিক্রম করে পশ্চিম দিকে শত্রুর অবস্থানে ঢােকার জন্য এগিয়ে যান। 
শক্রর অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সংবাদে মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল চাঙা হয়ে যায়। মুক্তিযােদ্ধারা তখন দাঁড়িয়ে ফায়ার করতে করতে সামনে এগিয়ে যেতে থাকেন। শত্রুর প্রতিটি প্রতিরক্ষা অবস্থান তখন মুক্তিযােদ্ধাদের ৫০-৬০ গজের মধ্যে। শক্রর পক্ষ থেকে তেমন গােলাগুলি আসছিল না দেখে মুজিব ব্যাটারিকে গােলা নিক্ষেপ বন্ধ করতে বলা হয়। ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিটি সৈনিকই তখন ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে শত্রুর শালদা নদীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে উঠে পড়েন। সকাল ৭টার মধ্যেই শত্রুর শক্তিশালী শালদা নদীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের পতন ঘটে। প্রতি-আক্রমণের (Counter Attack) আশঙ্কা করে মুক্তিযােদ্ধাদের শত্রুর পরিত্যক্ত বাংকারে অবস্থান গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। শত্রুর আর্টিলারি গােলা | নিক্ষেপের ভয়ও কম ছিল না। শত্রুর বিপুল পরিমাণে গােলাবারুদ, অস্ত্রশস্ত্র ও রেশনসামগ্রী ফেলে খালি হাতে অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। মেশিনগান, ৩ ইঞ্চি মর্টার, আরআর এর মতাে ভারী অস্ত্রগুলােও তারা ফেলে যায়। যেকোনাে দিক থেকেই শত্রু অগ্রসর হলে যাতে আগে থেকেই শত্রুকে প্রতিহত করা যায়, তেমন করে পুরাে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সাজিয়ে তােলা হয়। ছােট ছােট কয়েকটি দলকে শক্রর সম্ভাব্য আক্রমণ পথে অ্যামবুশ পাতার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শালদা নদী মুক্ত হওয়ার সংবাদ বিদ্যুৎ বেগে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে বহুসংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা এসে প্রতিরক্ষা এলাকায় অবস্থান  নেন। ফলে বিকেলের মধ্যেই পুরাে শালদা নদী এলাকায় মুক্তিবাহিনীর | শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
শত্রুর মজবুত বাংকারগুলােই মুক্তিবাহিনীর নিরাপত্তার কাজে ব্যবহৃত হয়। পরবর্তী সময় পরদিন ১৪ নভেম্বর। সকাল থেকে স্বেচ্ছাসেবক ও সাধারণ মুক্তিযােদ্ধা সৈনিকদের মাধ্যমে উদ্ধারকৃত অস্ত্র, গােলাবারুদ ও রেশনসামগ্রী মন্দভাগ রেল স্টেশনে বহন করে নিয়ে। যাওয়া হয়। ১৪ নভেম্বর বেলা ১টার দিকে পাকিস্তানিদের একটি শক্তিশালী দলকে। মনােয়ারা গ্রামের পশ্চিম দিকে শালদা নদী গােডাউন এলাকা হয়ে তাদের। শালদা নদী প্রতিরক্ষা অবস্থান পুনর্দখলের জন্য এগিয়ে আসতে দেখা যায়। ঐদিন নায়েব সুবেদার বেলায়েতের নেতৃত্বে ১টি দল প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিল। নায়েব সুবেদার বেলায়েত অগ্রসরমাণ পাকিস্তানিদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু। করেন। নায়েব সুবেদার বেলায়েতের প্রতিরােধের মুখে শত্রুসেনারা পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। নায়েব সুবেদার বেলায়েত তার দল নিয়ে দক্ষিণ দিকে পলায়নরত। শত্রুসেনাদের পিছু ধাওয়া করেন। পাকিস্তানি বাহিনীও পশ্চাদপসরণের সময় পেছনের দিকে গুলি নিক্ষেপ করতে করতে যাচ্ছিল। একসময় শত্রুর ১টি বুলেট এসে নায়েব সুবেদার বেলায়েতের বুকে বিধে। সাথে সাথে নায়েব সুবেদার বেলায়েতের দেহটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। শত্রুসৈন্য এরপর শালদা নদী। পুনর্দখলের আর কোনাে প্রচেষ্টা নেয়নি। এক অবিশ্বাস্য বিজয় ছিনিয়ে আনলাে। ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানির সৈনিকেরা। মাত্র এক মাস আগে যে স্থান দখল করতে গিয়ে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর ৬টি নিয়মিত ব্যাটালিয়ন ব্যাপক আর্টিলারি ফায়ার সাপাের্ট দেওয়া সত্ত্বেও ব্যর্থ হয়েছিল, সেই স্থানটি মাত্র। এক কোম্পানি সৈন্য দখল করে নিল।
এ অপারেশনটি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে এক ব্যতিক্রমধর্মী অপারেশন।  হিসেবেই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৫ নভেম্বর সকাল থেকেই সর্বস্তরের হাজার হাজার জনতা মুক্ত শালদা নদী এলাকা পরিদর্শনে আসতে শুরু করে। মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সাবেদ সিংসহ ঊর্ধ্বতন অনেক সামরিক অফিসার মুক্ত শালদা নদী দেখতে আসেন। যুদ্ধের ফলাফল শালদা নদীর যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর কাছে শােচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এ যুদ্ধে বীর মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানিদের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গােলাবারুদ দখল করে। এগুলাের মধ্যে ২১টি রাইফেল, ১টি এসএমজি, ৩টি এলএমজি ম্যাগাজিন, ২টি এমজির অতিরিক্ত ব্যারেল, ২০০টি বােমা, ২,২৫০ রাউন্ড বিভিন্ন ধরনের গােলাবারুদ, ১টি ওয়্যারলেস সেট, ৩টি ফিল্ড টেলিফোন, ১টি জেনারেটর এবং রেশন ও কাপড়চোপড় উল্লেখযােগ্য। ফলাফল বিশ্লেষণ। যুদ্ধের ফলাফল বিশ্লেষণ ছিল নিম্নরূপ: ১. মুক্তিবাহিনীর জয়লাভের কারণ: ব্যতিক্রমধর্মী ও অভাবনীয় যুদ্ধপরিকল্পনা এবং স্থানের সাথে বিশেষ পরিচিতিই মুক্তিযােদ্ধাদের এ যুদ্ধে জয় লাভের কারণ। সর্বোপরি ছিল মাতৃভূমির জন্য তাদের আত্মনিবেদন ও সাহসিকতা। ২. শক্র পরাজয়ের কারণ: বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অবস্থান নেওয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান দুর্বল ছিল। তাদের অসতর্কতাও ছিল পরাজয়ের ১টি কারণ। শিক্ষণীয় বিষয় পরিস্থিতি ভেদে প্রথাগত রণকৌশলের পরিবর্তে আমরা নতুন কৌশল কাজে লাগাতে পারি। ১. যুদ্ধ জয়ের জন্য মনােবল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ২. প্রতিরক্ষা অবস্থানে কখনাে অসতর্ক হওয়া উচিত নয়। ৩. শত্রুর শক্তিকে অবমূল্যায়ন করা বােকামি।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!