You dont have javascript enabled! Please enable it!
মুকুন্দপুরের যুদ্ধ
ভূমিকা
মুকুন্দপুর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একটি দুর্গম গ্রাম। ভারতীয় সীমান্ত এখান থেকে প্রায় ৫০০ গজ পূর্বে ছােট ছােট টিলা, ছড়ানাে ছিটানাে ঝােপঝাড় আর চড়াই উৎরাইয়ের মাঝে নিচু জলাভূমি এলাকাটিকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। আখাউড়া থেকে রেলপথে সিলেট যাওয়ার সময় আজমপুর রেল স্টেশন পেরিয়ে সিংগার বিল এবং তারপর মুকুন্দপুর স্টেশন। মুকুন্দপুরের ১টি উল্লেখ্যযােগ্য স্থান এ রেল স্টেশনটি। এখানে আছে ১টি সীমান্ত ফাঁড়ি। এ সীমান্ত ফাঁড়িতে ছিল পাকিস্তানিদের ১টি শক্ত ঘাঁটি। এ ঘঁটি মুক্ত করতেই এখানে স্বাধীনতা সগ্রামের এক উল্লেখযােগ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পটভূমি মে মাসের শেষের দিকে পাকিস্তানিদের ১টি দল বিনা বাধায় মুকুন্দপুর এলাকা দখল করে নেয় । মুকুন্দপুর গ্রাম ও রেল স্টেশনের মাঝামাঝি সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত সীমান্ত ফঁাড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের ১টি প্লাটুন শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তােলে। তাদের লক্ষ্য ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ থেকে রেল যােগাযােগ ব্যবস্থা নিরাপদ রাখা, এলাকায় কর্তৃত্ব স্থাপন এবং মুক্তিযােদ্ধাদের অনুপ্রবেশ রােধ করা। অপরদিকে মুক্তিযােদ্ধারাও এলাকাটি মুক্ত করার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। যাতে উত্তরে ধর্মগড় পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নভেম্বরের প্রথম দিকে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের এ তৎপরতা জোরদার করে এবং মুকুন্দপুর মুক্ত করার পরিকল্পনা করে। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন ছিল নিম্নরূপ: ১. মুক্তিবাহিনী: ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (২ ইস্ট বেঙ্গল), ১৮  রাজপুত রাইফেল (১৮ রাজপুত), ৩ নম্বর সেক্টর মুক্তিযােদ্ধা। ২. পাকিস্তানি বাহিনী: ৩৩ বালুচ রেজিমেন্ট (৩৩ বালুচ)।
পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ নভেম্বরের প্রথম দিকে ৩ নম্বর সেক্টরের ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রশিক্ষণে ব্যস্ত ছিল আর ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি বেলােনিয়া অভিযানে অংশগ্রহণের জন্য গিয়েছিল। অতএব মুকুন্দপুর হামলার জন্য ১টি কোম্পানি
ছাড়া ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ১৮ রাজপুতকে নির্ধারিত করা হয়। স্থির। করা হয় যে ১৮ রাজপুত উত্তরে জলিলপুরে রেললাইন ধরে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করবে এবং ২টি কোম্পানি বাদে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট দক্ষিণে কলাছড়া নদীর এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করবে। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সাঈদ এক কোম্পানি সৈন্যসহ মুকুন্দপুরে হামলা চালাবেন। ১৮ নভেম্বর রাতে হামলা। শুরুর সময় বা ডি-ডে হিসেবে নির্ধারিত হয়। খুব ভােরে পশ্চিম দিক থেকে হামলা করার পরিকল্পনা হয়। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দরকার ছিল বিস্তারিত পর্যবেক্ষণের। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সাঈদ প্রায় প্রতি রাতেই তাঁর যােদ্ধাদের নিয়ে রেকি । করতে যান। সব সময় প্রাণের ঝুঁকি। ঝুঁকি গােপনীয়তা ফাসের। এভাবে তারা আবিষ্কার করলেন, শত্রু অবস্থান নিয়েছে উঁচু এলাকায়। পূর্বদিকে আধা। কিলােমিটার দূরেই ভারতীয় সীমান্ত। শত্রু তার প্রতিরক্ষা অবস্থানের সামনে। লাগিয়েছে চোখা বাঁশের কঞ্চি (পাঞ্জি), আর তার পেছনে লাগিয়েছে প্রচুর অ্যান্টি পারসােনেল মাইন। চারদিকে হালকা ও ভারী মেশিনগান বসিয়ে তৈরি করছে সর্বমুখী প্রতিরক্ষা। তবে উত্তর ও পশ্চিম দিক অপেক্ষাকৃত অরক্ষিত। কিন্তু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সম্পর্কে আরও তথ্য দরকার। আর এ তথ্য নিয়ে এগিয়ে এলাে গােয়ালনগরের রাজাকার আজিজ চৌকিদারের মেয়ে সায়রা। মুতা বিয়ের নামে তার বাবা তাকে পাঠাতে পাকিস্তানিদের কাছে আর এর সুযােগে সে এসে বলে দিত সব অস্ত্রের অবস্থান। এভাবে পূর্ণ হলাে পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা সম্পর্কে সব তথ্য জানা। প্রস্তুত হলাে আক্রমণের চূড়ান্ত নকশা। যুদ্ধের বর্ণনা লক্ষ্যস্থলের উত্তরে ১৮ রাজপুত এবং দক্ষিণে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিবন্ধক প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সাঈদ তার কোম্পানিসহ ছােট ছােট দলে বিভক্ত হয়ে মুকুন্দপুরের দক্ষিণে ১টি ফলের বাগানে সমবেত হন। এটি ছিল পাকিস্তানিদের অধিকৃত এলাকা। গ্রামের দক্ষিণ ধারে এফইউপি বা ফর্মিং আপ প্লেস নির্বাচন করা হয়। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মনসুরের প্লাটুন দক্ষিণে, উত্তরে সুবেদার মান্নাফের প্লাটুন এবং মাঝে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সাঈদ আরও ১টি প্লাটুন নিয়ে।
১৮ রাজপুতের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ভার্মা সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সাঈদকে জানালেন যে আক্রমণ রচনা করবে উত্তর দিক থেকে মেজর আব্রাহামের কোম্পানি। অথচ তার সামনে ছিল উঁচু ভূমি, ফলে শত্রুর ওপর কার্যকর ফায়ার সম্ভব নয়। সামগ্রিক তৎপরতা হামলা শুরুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যতটা সম্ভব গােপনে চলতে থাকে। গােলন্দাজ সেনাদলকে সতর্কাবস্থায় রাখা হয় অর্থাৎ হামলাকারী অধিনায়ক আক্রমণ ধ্বনি শুরু হলে অথবা যখন তারা চান, তখনি কেবল গােলন্দাজ গােলাবর্ষণের সহযােগিতা দেওয়া হবে। ১৯ নভেম্বর প্রভাতে হামলা শুরু হয়। আব্রাহামের কোম্পানি শক্রর গুলির মুখে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পুনরায় অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। পাকস্তানিদের ওপর বেপরােয়া আক্রমণ শুরু করল সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সাঈদের কোম্পানি। পাকিস্তানি সেনারাও প্রতিরােধের সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়, কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা তাদের প্রতিরােধ করেন। অপরাহু পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। শেষ পর্যন্ত মুকুন্দপুর মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে আসে। ফলাফল মুক্তিযােদ্ধাদের কেউ এ যুদ্ধে মারাত্মক আঘাত পাননি। পাকিস্তানিদের ৩১জন মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়। হস্তগত হয় ২৭টি রাইফেল, ২টি স্টেনগান, ২টি এলএমজি এবং ১টি ৩ ইঞ্চি মর্টার। পরবর্তী অভিযানগুলাের ক্ষেত্রে মুকুন্দপুরকে উন্মুক্ত এলাকা হিসেবে ব্যবহার করার সুযােগ হয়। শিক্ষণীয় বিষয় এ যুদ্ধে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সাঈদ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে হলেও সঠিক রেকি করেন, যা পরবর্তী সময় তার সাফল্য অর্জনে সহায়তা করে। পর্যবেক্ষণে ব্যয় করার সময় কখনােই অপচয় নয়। (মুকুন্দপুর যুদ্ধের নকশাটি দেখুন ৮৬২ পাতায়)

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!