You dont have javascript enabled! Please enable it!
তন্তর বাজার-সাইদাবাদ রেইড ও মতুরা সেতু ধ্বংস
যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান তন্তরবাজার-সাইদাবাদ কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিঅ্যান্ডবি সড়কে কসবা থানার অন্তর্গত। জুন মাসে এখানে মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুর গান পজিশনে রেইড পরিচালনা যুদ্ধের পটভূমি গঙ্গাসাগর ও নিয়মতাবাদ থেকে বিতাড়িত শত্রু প্রথমে সাইদাবাদে পিছু হটে। সেখান থেকে তারা কসবার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। পরবর্তী সময় শত্রুর কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলােয় ঘাঁটি গাড়ে এবং রাস্তা বরাবর টহল কার্যক্রম বৃদ্ধি করে, কিন্তু সীমান্তবর্তী এলাকাগুলাে তখন। মুক্তিবাহিনীর আয়ত্তে। সায়দাবাদে পাকিস্তানির ৫৩ ফিল্ড রেজিমেন্টের ৪টি ১০৫ মিলিমিটার হাউইটজারের একটি আর্টিলারি গান পজিশন ছিল, যার মাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই সীমান্তবর্তী এলাকায় সম্ভাব্য মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে ফায়ার করতাে। ফলে এ গান পজিশনটা ধ্বংস করা মুক্তিবাহিনীর জন্য অতি প্রয়ােজনীয় হয়ে ওঠে। যুদ্ধের সংগঠন। যুদ্ধের সংগঠন ছিল নিম্নরূপ: ১. মুক্তিবাহিনী ক. ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট)। খ. মুজাহিদ, আনসার ও ছাত্র প্লাটুন। পাকিস্তানি বাহিনী ক. ৩০ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট (৩০ পাঞ্জাব)। খ, ৩৩ বালুচ রেজিমেন্ট (৩৩ বালুচ)। গ. ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স (১২ এফএফ)। ঘ. ৪ ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স (ইপিসিএএফ)। ঙ. ৫৩ ফিল্ড রেজিমেন্টের ১টি ফিল্ড ব্যাটারি।
উভয় বাহিনীর অবস্থান যুদ্ধের সময় উভয় বাহিনীর অবস্থান ছিল নিমরূপ: ১. পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান: পাকিস্তানি বাহিনীর ২টি ব্যাটালিয়ন যথাক্রমে ৩০ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও ৩৩ বালুচ রেজিমেন্ট নয়নপুর, কামালপুর, শালদা নদী রেল স্টেশন, চান্দলা প্রভৃতি স্থানে অবস্থান। গ্রহণ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর গােলন্দাজ বাহিনীর ১টি ব্যাটারি কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের পাশে সাইদাবাদ নামক স্থানে অবস্থান নেয়। এ ব্যাটারির সাহায্যে আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় গােলা নিক্ষেপ করা হতাে। ২. মুক্তিবাহিনীর অবস্থান: মুক্তিবাহিনী ২ নম্বর সেক্টর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় অপারেশন পরিচালনা করছিল। ২ নম্বর সেক্টরের ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট উক্ত এলাকায় বিভিন্ন গেরিলাযুদ্ধ পরিচালনা করে এবং ছােট ছােট স্থাপনার ওপর আক্রমণ করছিল। মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ পরিকল্পনা জুন মাসের ২য় সপ্তাহে ২ নম্বর সেক্টর অধিনায়ক মেজর খালেদ মােশাররফ পাকিস্তানি বাহিনীর কামানগুলাে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত মােতাবেক লেফটেন্যান্ট হুমায়ুন কবিরের নেতৃত্বে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডি। কোম্পানির প্রায় ৪০জনের (২টি প্লাটুন) ১টি দল ১৬ জুন রাত সাড়ে ১০টায় শত্রু অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। পাটুন ২টির অধিনায়ক ছিলেন নায়েব সুবেদার সাত্তার ও শহিদ। সমস্ত রাত চলার পর দলটি কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রাস্তার পশ্চিমে সাইদাবাদের ৪ মাইল উত্তরে পেীছে এবং তাদের ১টি গােপন অবস্থান তৈরি করে। 
১৭ জুন সমস্ত দিন লেফটেন্যান্ট হুমায়ুন কবির তাঁর সঙ্গে কয়েকজনকে নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সাইদাবাদ অবস্থানটি সম্পূর্ণরূপে পর্যবেক্ষণ করেন। এ সময় তিনি পাহারাদারদের অবস্থান, অস্ত্রশস্ত্র, পাহারার সময় এবং বাংকারগুলাের অবস্থান সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করেন। রেকি দলের। প্রতিবেদন অনুযায়ী সাইদাবাদের পূর্বপাশে তন্তরে ৩ লাখ পীর ব্রিজের দক্ষিণ পাশে গান পজিশনে ২টি কামান উত্তরমুখী ও ২টি কামান দক্ষিণমুখী করে বসানাে আছে। গান পজিশনের নিরাপত্তার জন্য এক কোম্পানির অধিক সৈনিক। রয়েছে। এরপর নিরাপদে নিজ গুপ্তাশ্রয়ে ফেরত আসেন এবং পাকিস্তানি ঘাটিতে আক্রমণের পরিকল্পনা স্যান্ড মডেল বানিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে দেন এবং একটি মহড়ার আয়ােজন করেন। যুদ্ধের বিবরণ ১৮ জুন ভাের ৪টায় লেফটেন্যান্ট হুমায়ুনের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের দলটি পাকিস্তানি বাহিনীর কামান ঘাঁটির ওপর পেছন দিক থেকে অনুপ্রবেশ করে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি সেনারা তাবুর মধ্যে শুয়ে ছিল।
তারা এ আক্রমণের জন্য মােটেই প্রস্তুত ছিল না। সেদিনই কুমিল্লা থেকে পাকিস্তানিদের ২টি কোম্পানি সামনের ঘাঁটিগুলােকে শক্তিশালী করার জন্য যাচ্ছিল, তারাও রাতের বিশ্রামের জন্য এখানে অবস্থান করছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে ভীষণ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় এবং অনেক শত্রুসেনা মুক্তিবাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারায়। মুক্তিযােদ্ধারা কয়েকটি জিপ ও ট্রাকে গ্রেনেড ছুড়ে আগুন লাগিয়ে দেন। পাকিস্তানি সেনারা এত বেশি ভীত হয়ে পড়ে যে তারা তাদের হেডকোয়ার্টার্সে জঙ্গিবিমানের সাহায্যের প্রার্থনা জানায়। যুদ্ধ বেশ কিছুক্ষণ ভয়ংকরভাবে চলে। এবং মুক্তিযােদ্ধারা কামান, গাড়ি ইত্যাদি ধ্বংস করেন। কিন্তু ইতােমধ্যে সকাল হয়ে যায় এবং শত্রুদের প্রতিরােধশক্তি বাড়তে থাকে। তাদের আবেদনে ৩টি জঙ্গিবিমান ঘটনাস্থলে পৌছে মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালায়। লেফটেন্যান্ট হুমায়ুনের দলটি তখন আটকা পড়ে যাওয়ার ভয়ে আক্রমণ শেষ করে গ্রামের গােপন পথে মেঘনার দিকে পশ্চাদপসরণ করে। এ পশ্চাদপসরণের সময় তারা বারবার পাকিস্তানি জঙ্গিবিমান দ্বারা আক্রান্ত হয়। তবু সমস্ত বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে তারা সাফল্যের সাথে শত্রুদের আওতার বাইরে চলে। আসে। ১ দিন পর তারা অন্য পথে আবার কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রধান সড়কের ওপরে আসে এবং মতুরা সেতুটি উড়িয়ে দিয়ে নিজ ঘাটিতে নিরাপদে। ফিরে আসে। যুদ্ধের ফলাফল এ যুদ্ধে শত্রুর ৮০-৯০জন সৈন্য হতাহতসহ ২টি গান ধ্বংস হয় এবং পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকটি জিপ ও ৩ টনি ট্রাক ধ্বংস করে ফেলে।
মুক্তিবাহিনীর ২জন মুক্তিযােদ্ধা আহত হন। গান পজিশন ধ্বংসের ফলে পাকিস্তানি বাহিনী সীমান্তে মুক্তিবাহিনীর ওপর গােলাবর্ষণ বন্ধ হয়ে যায় এবং মতুরা সেতু ধ্বংসের কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লার মধ্যে সড়ক যােগাযােগ সাময়িকভাবে বিঘ্নিত হয়। যুদ্ধের ফলাফল বিশ্লেষণ ১. শক্রর ব্যর্থতার কারণ। ক. রাতে কামান ঘাঁটির পেছনে কোনাে পাহারা না থাকায় মুক্তিবাহিনী সহজে অনুপ্রবেশ করতে পারে।  ঘাটিতে বিশ্রামরত সৈন্যরা সতর্ক ছিল না এবং তারা কোনােরূপ আক্রমণের জন্যও প্রস্তুত ছিল না। গ, মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে শত্রু বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে এবং যার। কারণে তারা কোনােরূপ প্রতিরােধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। ২. মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের কারণ ক. লেফটেন্যান্ট হুমায়ুন কবির পাকিস্তানি সৈন্যের ঘাঁটি আক্রমণের পূর্বে তার লােকজন নিয়ে বিস্তারিত রেকি করেন, যা তাকে শত্রুর পাহারা ও অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেয় এবং স্যান্ড মডেল তৈরি করে মহড়া দেন। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা নিজের দেশ রক্ষার জন্য সংগ্রাম করছিলেন, তাই তাদের সংকল্প ছিল দৃঢ় আর মনােবলও ছিল উঁচু এ কারণে তাঁরা সাফল্য অর্জন করেন। গ. লেফটেন্যান্ট হুমায়ুন কবির আক্রমণের জন্য কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন এবং মুক্তিযােদ্ধাদের দৃঢ় সংকল্প পরিকল্পনা বাস্ত বায়িত করে। শিক্ষণীয় বিষয় এ যুদ্ধ থেকে আমাদের শিক্ষণীয় বিষয়গুলাে হলাে: ১. সব অপারেশনের জন্য বিস্তারিত রেকি অবশ্যই প্রয়ােজন। ২. দৃঢ় মনােবল ও সংকল্প যুদ্ধের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ৩. যুদ্ধক্ষেত্রে অসতর্কতা বিপদ ডেকে আনে।  

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!