You dont have javascript enabled! Please enable it!
গঙ্গাসাগরের যুদ্ধ
যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে গঙ্গাসাগরের গুরুত্ব গঙ্গাসাগর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত আখাউড়া থানার মােঘড়া ইউনিয়নে অবস্থিত। গঙ্গাসাগর এলাকাটি সাধারণত খােলা ও সমতল, যার উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে বয়ে গেছে তিতাস নদী। গঙ্গাসাগর এলাকার আশপাশে অসংখ্য জলাভূমি রয়েছে। ফলে মেঠো পথে চলাচল কষ্টসাধ্য। গঙ্গাসাগর থেকে। আখাউড়া যেতে নােয়াপাড়ার কাছে রাস্তাটি সংকীর্ণ হয়ে আসায় প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণের জন্য এলাকাটি অত্যন্ত উপযােগী। গঙ্গাসাগর আগরতলা থেকে মাত্র ৩ কিলােমিটার পূর্বে অবস্থিত এবং আগরতলা এয়ার ফিল্ডের অবস্থান ছিল আন্তর্জাতিক সীমারেখা থেকে মাত্র কয়েক শ মিটার দূরে। আখাউড়ায় রেলওয়ে জংশন থাকায় এবং রেলপথে ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্টগ্রাম-এর সংযােগপথে গঙ্গাসাগরের অবস্থান হওয়ায় গঙ্গাসাগরের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। যুদ্ধের পটভূমি মার্চের মাঝামাঝি ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাঠানাে হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ঘিরে ৩টি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তােলে।
পাকিস্তানিদের ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স (এফএফ) এবং অন্যান্য বাহিনীর সহায়তায় ১৪ এপ্রিল হেলিকপ্টার ও এফ-৮৬ স্যার ফাইটার বিমানের সাহায্যে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ওপর আক্রমণ শুরু করে। শত্রুর আক্রমণের তীব্রতায় ৪র্থ। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আখাউড়ার দক্ষিণে গঙ্গাসাগর-রুইনে নতুন প্রতিরক্ষা গড়ে তােলে।  ১৬ এপ্রিল পাকিস্তানির এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য কুমিল্লা থেকে আখাউড়া অভিমুখে অগ্রাভিযান করে। কুমিল্লা থেকে পাকিস্তানি সেনারা যাতে আখাউড়া পৌঁছাতে না পারে, সে জন্য গঙ্গাসাগরে মুক্তিযােদ্ধারা বাধা প্রদানের জন্য পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৭ এপ্রিল শেষ আলাের পূর্বে গঙ্গাসাগরে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রাভিযানে বাধা প্রদান করে এবং যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
উভয় পক্ষের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন ছিল নিমরূপ: ১. মুক্তি বাহিনী: ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানি, ইপিআর
প্লাটুন, মুজাহিদ, আনসার ও ছাত্র প্লাটুন। এ সম্পূর্ণ দলের নেতৃত্বে ছিলেন মেজর শাফায়াত জামিল। পাকিস্তানি বাহিনী: ১২ এফএফ, ৪ ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স (ইপিসিএএফ) এর ২টি কোম্পানি, ১টি ট্যাংক টুপ ও ১টি
| ফিল্ড আর্টিলারি। পাকিস্তানিদের অবস্থান বা প্রতিরােধ/প্রতিরােধব্যবস্থা।
১. আখাউড়া ও গঙ্গাসাগর এলাকায় ১২ এফএফ, ইপিসিএএফের ২টি | কোম্পানি, ১টি ট্যাংক টুপ ও ১টি ফিল্ড ব্যাটারি নিয়ােজিত ছিল। ২. কসবায় ৩৩ বালুচ রেজিমেন্ট, ইপিসিএএফ-এর ১টি কোম্পানি ও
১টি ফিল্ড ব্যাটারি অবস্থিত ছিল। ৩. ২৭ পদাতিক ব্রিগেড সদর দপ্তর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩৩ বালুচের ১টি
কোম্পানি, ২১ আজাদ কাশ্মীরের ১টি কোম্পানি ও ইপিসিএএফের
১টি কোম্পানি ছিল তার সাথে। মুক্তিবাহিনীর অবস্থান।
১. ৭ নম্বর প্লাটুন, ‘সি’ কোম্পানি আখাউড়া গঙ্গাসাগর রেললাইনের  পশ্চিম পাশে দক্ষিণ-পশ্চিমে মুখ করে অবস্থান গ্রহণ করে। এ
প্লাটুনের নেতৃত্বে ছিলেন নায়েব সুবেদার মাে. মনিরুল ইসলাম।  ২. ৮ নম্বর প্লাটুন, ‘সি’ কোম্পানি সাধারণ এলাকা আখাউড়ায় অবস্থান
নেয়। ৩. মুজাহিদ, আনসার ও ছাত্র প্লাটুন আখাউড়া রেললাইনের পূর্ব পাশে
দক্ষিণ-পশ্চিমে মুখ করে অবস্থান নেয়। এ প্লাটুনের নেতৃত্ব দেন
নায়েব সুবেদার আব্দুল হক। ৪. অন্য কোম্পানিগুলাের অবস্থান ছাড়াও ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট
মেজর খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে শমসেরনগর এবং
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে। যুদ্ধের পরিকল্পনা উভয় বাহিনীর যুদ্ধের পরিকল্পনা ছিল নিমরূপ: ১. পাকিস্তানিদের পরিকল্পনা: শত্রু তাদের পূর্বাঞ্চলকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে তা ধরে রাখার জন্য চেষ্টা করে এবং জেনারেল নিয়াজির জন্য যে পরিকল্পনা করেছিলেন তা হলাে:
ক. পূর্ব সীমান্ত বরাবর সৈন্য মােতায়েন করা এবং ঢাকা অঞ্চল রক্ষার্থে তিতাস নদ অতিক্রম করা। খ, ঢাকা অঞ্চলের প্রতিরক্ষার ওপর গুরুত্ব আরােপ করা। গ. উল্লেখযােগ্য সীমান্ত শহরগুলােয় ঘাঁটি তৈরি করা এবং তা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা। জেনারেল নিয়াজির তৃতীয় কৌশল হিসেবে পাকিস্তানিরা সীমান্ত শহরগুলােয় শক্ত ঘাঁটি তৈরি করার নিমিত্তে আখাউড়া শহরে পর্যাপ্ত গােলাবারুদ, রেশন ও জ্বালানি তেলের ভান্ডার গড়ে তােলার পরিকল্পনা করে এবং গােলন্দাজের সহায়তার জন্য এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। ২. মুক্তিবাহিনীর পরিকল্পনা: মুক্তিবাহিনীর পরিকল্পনা ছিল সীমান্ত এলাকা থেকে শক্রর শক্ত ঘাঁটিগুলাে দখল করা, তাদের যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করা এবং সর্বোপরি ঢাকা অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হওয়া ও তা দখল করা। যুদ্ধের বিবরণ ১৬ এপ্রিল পাকিস্তানি ১টি ব্যাটালিয়ন কুমিল্লা থেকে আখাউড়ার উদ্দেশ্যে অগ্রাভিযান করে।
শত্রু যাতে আখাউড়া যেতে না পারে, সে লক্ষ্যে মুক্তিবাহিনী বাধা দেওয়ার পরিকল্পনা করে। ১৭ এপ্রিল সন্ধ্যার সময় গঙ্গাসাগরে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক শত্রু বাধাপ্রাপ্ত হয়। ১৮ এপ্রিল ভাের ৪টায় গােলন্দাজের সহায়তায় গঙ্গাসাগর দখলের লক্ষ্যে শত্রু ত্রিমুখী আক্রমণ রচনা করে। ১৮ এপ্রিল ভাের ৪টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত তুমুল যুদ্ধ চলে এবং মুক্তিবাহিনীর গােলাবারুদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ক্যাপ্টেন সালেক চৌধুরীর নির্দেশে পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শক্র থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করার সময় সিপাহি মােস্তফা কামাল তার এলএমজি থেকে অনবরত কভারিং ফায়ার দিয়ে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করছিল। ১৮ এপ্রিল আনুমানিক দুপুর ১টায় পাকিস্তানিরা সিপাহি মােস্তফা কামালের অবস্থান চিহ্নিত করে তার ওপর সমন্বিত আক্রমণ করে তার অবস্থান দখল করে। ফলাফল স্বাধীনতা যুদ্ধে গঙ্গাসাগর যুদ্ধে শত্রুর ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। মুক্তিযােদ্ধা সিপাহি মােস্তফা কামাল শহিদ হন। গঙ্গাসাগর যুদ্ধে শত্রু জয়লাভ করে এবং গঙ্গাসাগর দখল করে।
যুদ্ধের ফলাফল বিশ্লেষণ বা সার্বিক মূল্যায়ন
১. পাকিস্তানিদের সাফল্য: শত্রু আখাউড়ার গুরুত্বকে রণকৌশলগতভাবে বিবেচনা করে ১টি শক্ত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নেয়। আখাউড়া, সিংগার বিল ও গঙ্গাসাগরে তাদের অবস্থান যথেষ্ট শক্ত ছিল। এখানে উল্লেখ্যযােগ্য বিষয়ের মধ্যে ছিল শত্রু কর্তৃক রাজাপুর থেকে দুর্গাপুর। পর্যন্ত ৪০০ গজ অ্যান্টি-ট্যাংক ডিচ খনন করা ছিল, যা মুক্তিবাহিনীর চলাচলকে সীমিত করে। শত্রু সীমান্ত এলাকার প্রতিটি অক্ষকে ঘিরেই তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়েছিল। তাই যুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় অধিক পরিমাণ এলাকা তাদের দখলে ছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের ব্যর্থতার কারণ: যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে সংঘটিত এ সংঘর্ষে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও পূর্বপ্রস্তুতির অভাব ছিল। তা ছাড়া। শত্রুপক্ষের অনেক বেশি সংখ্যা ও শক্তির কারণে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সম্মুখসমরে টিকে থাকা সম্ভব ছিল না।
শালগড় অ্যামবুশ
যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানায় শালগড় গ্রামের অবস্থান। এ গ্রামের ভেতর দিয়ে। কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রধান সড়ক চলে গেছে। এ সড়ক ব্যবহার করেই। পাকিস্তানিরা কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া যােগাযােগ ও সরবরাহ চালু রাখে। তা ছাড়া এ রাস্তাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যও শক্র এ পথে টহল পরিচালনা করে। পটভূমি শালগড় এলাকার সাধারণ লােকেরা পাকিস্তানপন্থি ছিল এবং মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর তেমন আস্থাশীল ছিল না। এসব কারণে এ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা অত্যন্ত জরুরি ছিল। মুক্তিযুদ্ধ চরম আকার ধারণ করার আগে ২৬ এপ্রিল রাতে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (৪ ইস্ট বেঙ্গল) এর ‘সি’ কোম্পানি, ৭ নম্বর প্লাটুন বড় শালগড় এলাকায় কুমিল্লার দিক থেকে আগত প্রায় ২৫-২৮টি গাড়ির। কনভয়ের ওপর ১টি অ্যামবুশ পরিচালনা করে। শক্রর তুলনায় অনেক কম শক্তি নিয়েও এ অভিযান পরিচালনা করে। যাতায়াত ও সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি এবং এলাকাবাসীকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আস্থাশীল করে তােলা এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল। পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি ২৫ এপ্রিল ৭ নম্বর প্লাটুন অধিনায়ক সুবেদার ওহাব ২৮জনের ১টি সেনাদল নিয়ে করাতি ও কাঠমিস্ত্রির ছদ্মবেশে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কসংলগ্ন এলাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। অস্ত্রগুলাে রাখেন পাটের গাইটের ভেতর লুকিয়ে। গােলাবারুদগুলােও চটের বস্তার ভেতর লুকিয়ে নেন। রাস্তায় কেউ জিজ্ঞেস করলেই জানিয়ে দেন যে তারা কাঠ ব্যবসায়ী দল সিলেট গিয়েছিলেন। গণ্ডগােলে আটকা পড়েছিলেন। এখন দেবিদ্বার নিজ গ্রামের বাড়িতে ফিরে। যাচ্ছেন। 
কঠিন গােপনীয়তার মধ্যে পথ চলে বিকাল ৪টার দিকে সুবেদার ওহাব তার দল নিয়ে চালনা নামক স্থানে পৌছান। দিনটি ঐ গ্রামের বাজারের দিন। চালনা বাজারে প্রচুর লােকজনের সমাগম হয়েছিল। সুবেদার ওহাব তার দলের। লােকজনেকে গ্রামের পূর্ব পাশে পুকুরপাড়ের জঙ্গলে আত্মগােপন করে থাকার নির্দেশ দিয়ে নিজে ছদ্মবেশে বাজারে যান। কিছুক্ষণ বাজারে ঘােরাফিরা করতেই সুবেদার ওহাব পূর্ব পরিচিত সিদ্দিক মেম্বর এবং সেনাবাহিনীর সিগন্যাল কোরের নায়েক জামালকে পেয়ে যান। স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বর সিদ্দিক এবং নায়েক জামাল সুবেদার ওহাবকে তার লােকজন নিয়ে রাতের অন্ধকারে চালনা উচ্চবিদ্যালয়ের রুমের ভেতরে আত্মগােপন করার পরামর্শ দেন। | ২৬ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে সুবেদার ওহাব সিদলাই গ্রামে চান্দ মিয়া | মেম্বরের দেওয়া ১জন বিশ্বস্ত লােককে সাথে নিয়ে কৃষকের ছদ্মবেশে কুমিল্লাব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কে শালগড় গ্রামে যান। সেখানে তিনি দেখতে পান, গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরেই পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। প্রধান সড়কে সফল অ্যামবুশ স্থাপনের জন্য এ গ্রামটিকেই সুবেদার ওহাব নির্বাচিত করলেন। বিকাল আনুমানিক ৫টার সময় ঐ গ্রামের জলিল ফকির নামের ১জন ফকির ধরনের লােক এসে জানান যে ঐ রাতে কুমিল্লা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিঅ্যান্ডবি সড়ক এবং সড়কসংলগ্ন এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়েছে। এ সংবাদ সুবেদার ওহাব নিশ্চিত হন যে ঐ রাতে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কপথে বড় ধরনের সেনা। কনভয় চলাচল করবে।
সুবেদার ওহাব ঐ রাতেই অ্যামবুশ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন। জলিল ফকির সুবেদার ওহাবের সাথে গাইড হিসেবে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করলে তাতে সম্মতি দেওয়া হয়। সন্ধ্যার খাবারের পর সুবেদার ওহাব ৪জন। মুক্তিযােদ্ধাকে চান্দ মিয়া মেম্বারের বাড়িতে ভারী মালামালসহ থেকে যাওয়ার এবং দলের বাকি ২৪জন সদস্যকে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেন। অপারেশন শেষে মিলনস্থান হিসেবে সবাইকে চান্দ মিয়া মেম্বরের বাড়িতে একত্র হওয়ার নির্দেশ দেন। বিকল্প মিলনস্থান হিসেবে শালগড় থেকে প্রায় দেড় মাইল পূর্বে সৈয়দপুর হাইস্কুলকে নির্বাচিত করা হয়। অপারেশনের স্থায়িত্বকাল ৪ মিনিটের মতাে হবে বলেও সুবেদার ওহাব দলের সবাইকে জানিয়ে দেন। অপারেশন পূর্বকালীন, অপারেশন চলাকালীন এবং অপারেশন-পরবর্তী খুঁটিনাটি বিষয়গুলাে নিয়ে তিনি দলের সদস্যদের সাথে বিস্তারিত আলােচনা করেন। রাত ৯টা ৩০ মিনিটের দিকে সিদলাই থেকে শালঘরের উদ্দেশ্যে ২৪ জনের দলটি রওনা হয়। গােপনীয়তা রক্ষার জন্য মাঠের মধ্য দিয়ে চলা শুরু করে। রাত ১০টা ৩০ মিনিটের দিকে দলটি শালগড় গ্রামের কাছে পৌছে। দলটিকে ৪ ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম দলটিকে শালগড় গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে মূল আক্রমণকারী দলকে গ্রামের মাঝখানে, তৃতীয় দলটিকে গ্রামের উত্তর প্রান্তে এবং চতুর্থ দলটিকে কভারিং ফায়ার দেওয়ার জন্য আরও উত্তরে অবস্থান নিতে বলা হয়। পাকিস্তানি কনভয় দক্ষিণে কুমিল্লার দিক থেকে আসবে বলে সুবেদার ওহাব ধারণা করে নিয়েছিলেন। সুবেদার ওহাব নিজের অবস্থান বেছে নিলেন প্রধান সড়ক থেকে মাত্র ২৫-৩০ গজ দূরে ১টি বিদ্যুৎ পিলারসংলগ্ন উঁচু স্থানের আড়ালে। ৪টি দলের অধিনায়কদের নিজ নিজ অবস্থান দেখিয়ে দেওয়ার পর সবাইকে নিয়ে আবার একই স্থানে একত্র হলেন।
শক্রর কনভয়ের গাড়ির হেডলাইটের আলাে অনেক দূর থেকেই দেখা। যাবে। কাজেই নিজ নিজ অবস্থানে যেতে খুব একটা সময় লাগবে না। তা ছাড়া শত্রু যদি দক্ষিণ দিক থেকে না এসে উত্তর দিক থেকে আসে, সে ক্ষেত্রে অবস্থানের কিছুটা রদবদল হবে। ঐরূপ পরিস্থিতিতে কে কোথায় অবস্থান। নেবেন, তাও তিনি দলনায়কদের জানিয়ে যেন। সেনাদলটিকে একত্র রাখার পেছনে আরও কারণ ছিল। সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞ জেসিও সুবেদার ওহাব জানতেন যে অপারেশনের অনেক আগে সেনাদল নিজ নিজ অবস্থানে চলে গেলে ‘কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল এ চিড় ধরতে পারে। শত্রুর আগমনের সময় দীর্ঘায়িত হলে নিজ নিজ অবস্থানে অনেকেই ঘুমিয়ে পড়তে পারে। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কেউ কেউ আবার আগেই গুলি নিক্ষেপ শুরু করে দিতে পারে।
সুবেদার ওহাব প্রথমে তার এলএমজিটি থেকে গুলি ছুড়বেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর সাথে অন্যরা গুলি ছুড়বেন। তা ছাড়া উইথড্রলের জন্য তাঁর। সিগন্যাল পিস্তল থেকে পর পর দুবার গ্রিন ওভার গ্রিন ভেরিলাইট ফায়ার করার পরই ছেলেরা অবস্থান ছেড়ে সৈয়দপুর স্কুল এলাকার দিকে চলে যাবেন। কভারিং পার্টি উইথড্রলের নির্দিষ্ট সিগন্যাল দেখার পরও ৫ মিনিট কাল সময় কভারিং ফায়ার দিয়ে যাবেন। সুবেদার ওহাব সড়কসংলগ্ন বিদ্যুতের খুঁটির নিচে অবস্থান নিলেন। সুবেদার ওহাবের বামে উত্তর দিকে ছিল ২টি এলএমজি পজিশন। আরও উত্তরে নায়েক তােফাজ্জল হােসেন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে ১টি এলএমজি দিয়ে অন্য ১টি দলকে পাঠানাে হয়। একেবারে উত্তর দিকের অবস্থানে উইথড্রলের সময় কভারিং ফায়ার দেওয়ার জন্য ১জন ল্যান্স নায়েকের নেতৃত্বে ১টি দল পাঠানাে হয়। সব দিক থেকে পাকিস্তানির কনভয়টিকে অ্যামবুশ করার জন্য সুবেদার। ওহাব তৈরি হয়ে যান। অভিযান পরিচালনা। রাত ১২টার দিকে দক্ষিণ দিক থেকে অনেক গাড়ির হেডলাইটের আলােতে পুরাে এলাকা আলােকিত হতে লাগলাে। সুবেদার ওহাব দলনায়কদের নিজ নিজ অবস্থানে গিয়ে পজিশন নিতে নির্দেশ দেন।
কনভয়টি ধীর গতিতে অগ্রসর হচ্ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই একেবারে শালগড় গ্রাম এলাকার কনভয়টি প্রথম দিককার ৮-১০টি জিপ, পিকআপ, ও ট্রাক এসে পৌছায়। কনভয়টি শালগড় গ্রাম পেরিয়ে আসতেই সুবেদার ওহাব গণনা করে দেখলেন যে ঐ কনভয়টিতে মােট ২৭টি গাড়ি রয়েছে। এত বড়াে। ১টি শত্রুসেনা কনভয়ের ওপর মাত্র ২৪জন সৈনিক নিয়ে আক্রমণ পরিচালনা ছিল দুঃসাহসিক ব্যাপার। শত্রুর কনভয়ের প্রায় সব কটি গাড়িই যখন ফাদ এলাকার ভেতরে এসে পৌছাল, তখনই সুবেদার ওহাব তার অবস্থান থেকে প্রথম গুলি ছুড়লেন। সাথে সাথে সব কটি অস্ত্র থেকেই একযােগে গুলি নিক্ষেপ শুরু হয়ে যায়। উভয় পক্ষে ব্যাপক গুলিবিনিময় শুরু হয়। ২ ইঞ্চি মর্টারের গােলাগুলাে শক্রর ক্ষয়ক্ষতি করতে থাকে। শত্রুর কনভয়টির সামনের জিপটি ফায়ারিং রেঞ্জের বাইরে যাওয়ার কারণে তা নায়েক তােফাজ্জলের নিক্ষিপ্ত গুলির আঘাত থেকে রক্ষা পায়। বাকি ২৬টি গাড়িই সুবেদার ওহাবের অ্যামবুশ পার্টির টার্গেটে পরিণত হয়। আনুমানিক ৪ মিনিটকাল গােলাগুলি নিক্ষেপের পর সুবেদার ওহাব তার সিগন্যাল পিস্তল। থেকে পর পর দুটি গ্রিন ভেরিলাইট ফায়ার করেন। সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অ্যামিবুশ পাটির সদস্যরা সৈয়দপুর স্কুল এলাকার দিকে পশ্চাদপসরণ শুরু করে দেয়।
খুব দ্রুততার সাথে উইথড্রলের কাজ চলে। কভারিং পার্টি ফায়ার কভার দিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যামবুশ পাটির ১জন ল্যান্স নায়েক এবং গাইড জলিল ছাড়া সব সদস্যই সৈয়দপুর স্কুলে একত্র হন। এরপর প্রায় ২ মাইলের মতাে গ্রাম হাঁটাপথ ধরে সবাই সিদলাই গ্রামে চান্দ মিয়া মেম্বরের বাড়িতে পৌছেন। পৌছার পর ঐ ল্যান্স নায়েক এসে পৌছেন। নায়েক তােফাজ্জল ব্যাপক গােলাগুলির মধ্যে তাঁর এলএমজিটা একটা বাঁশঝাড়ের মধ্যে ফেলে এসেছিলেন। এ অপারেশনে নিজ পক্ষের ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে ছিল এটিই। সিদলাই গ্রামের লােকজন জলিল ফকিরের সহযােগিতায় অবশ্য এ এলএমজি পরে দেবীপুর ক্যাম্পে সুবেদার ওহাবের কাছে পৌছে দিয়েছিলেন। যুদ্ধের ফলাফল প্রত্যক্ষদর্শীদের দেওয়া তথ্যে জানা যায় যে এ অভিযানে শত্রুর ২টি গাড়িতে আগুন ধরে যায় এবং মােট ১৮টি গাড়ি কোনাে না কোনােভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১০টি গাড়ির ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। উঁচু রাস্তার আড়ালে অবস্থান নেওয়ার কারণে লােকবলের ক্ষয়ক্ষতি কম হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ১৫জনের মতাে হতাহত হয়েছিল। উঁচু রাস্তার পশ্চিম পাশে আশ্রয় নেওয়ার কারণে গুলির আঘাত থেকে অধিকাংশই রক্ষা পায়। গাড়ির কারণে রাস্তায় যানবাহন চলাচলের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। অভিযানের মূল্যায়ন ১টি ক্ষুদ্র দলের অ্যামবুশের ফলে শত্রুর উল্লেখযােগ্য ক্ষতি সাধিত হয়। এ অভিযানের বিশেষ দিকগুলাে হলাে: ১. অ্যামবুশ পার্টি তাদের যাতায়াত নিরাপত্তা এবং পাকিস্তানি সহযােগী স্থানীয় বাসিন্দা কর্তৃক চিহ্নিত না হওয়ার জন্য প্রয়ােজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করে। লােকজনের সন্দেহ এড়ানাের জন্য তারা তাদের গােলাবারুদ ও অস্ত্রগুলাে থলিতে ও পাটের গাইটের ভেতরে বহন করে।
২. অ্যামবুশ অপারেশনের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী বিভিন্ন দল নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে শত্রুর আগমনের জন্য প্রতীক্ষা করে। কিন্তু শালগড় গ্রামের বাসিন্দারা মানসিকতায় পাকিস্তানি সমর্থক এবং শত্রুর আগমনের সময় জানা না থাকার কারণে অভিজ্ঞ সুবেদার ওহাব শত্রুর কনভয়ের গাড়ির হেডলাইটের আলাে না দেখা পর্যন্ত তাঁর দলকে একত্র রেখেছিলেন। কাভারিং ফায়ার দেওয়ার জন্য মূল অ্যামবুশ স্থান থেকে অনেক দূরে। ১টি এলএমজি দিয়ে মাত্র ১জন সৈনিককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। পাকিস্তানিদের ব্যাপক গােলাগুলির আতঙ্ক তাকে পেয়ে বসেছিল। স্থানীয় গাইডকে সাথে নিয়ে তিনি এলএমজিটি ১টি বাঁশঝাড়ের ভেতর। রেখে অবস্থান ত্যাগ করে চলে যান। ৪. শক্রর অস্ত্রবল ও জনবলের সংখ্যাধিক্য বিবেচনা করে সুবেদার ওহাব
অপারেশন পরিচালনা করার সময় মাত্র ৪ মিনিটকাল স্থায়ী করেন। মূল ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার জন্য তিনি পর্যাপ্ত গুলি ও গােলা রিজার্ভ হিসেবে রাখেন। ফিরে যাওয়ার পথে শত্রু কর্তৃক অ্যামবুশ হলে যাতে তাদের প্রতিহত করা যায়, সেই ব্যবস্থা রেখেই তিনি গুলি খরচ করেন।
উপসংহার
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিককার এ অপারেশনের ফলাফল ছিল সুদূর প্রসারী। শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে প্রথাগত অপারেশন পরিচালনার চেয়ে গেরিলা অপারেশন যে অধিক ফলাফল বয়ে আনতে পারে, তা এ অ্যামবুশের মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়ে যায়। এ অপারেশনের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি দেশের জনগণের সহানুভূতির বিষয়টিও জানা যায়। | অন্যদিকে, দখলদার বাহিনীর প্রতিও জনগণের আনুপাতিক আনুগত্যের বিষয়টিও অনুমান করা সম্ভব হয়। নিশ্চিত বিপদ জেনেও সিদলাই গ্রামে সর্বস্তরের জনগণ অপারেশনটি পরিচালনার ব্যাপারে যে সাহায্য ও সহযােগিতা করেছিল, তা পরবর্তী অপারেশন পরিচালনার ব্যাপারে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছিল। বৃহত্তর জনগােষ্ঠী যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রয়েছে, তা এ অপারেশনটি পরিচালনার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়। (শালগড় অ্যামবুশের নকশাটি দেখুন ৮৬০ পাতায়)

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!