You dont have javascript enabled! Please enable it! চড়নলের যুদ্ধ,গণ-আন্দোলন ও অসহযােগ আন্দোলনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া,প্রতিরােধ সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া - সংগ্রামের নোটবুক
চড়নলের যুদ্ধ
বুড়িচং থানার রাধাপুর ইউনিয়নে চড়নল অবস্থিত। ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা চড়নল এলাকাটি মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ছিল। গুরুত্বপূর্ণ এ যুদ্ধক্ষেত্রে লেফটেন্যান্ট আবু কায়সার ফজলুল কবীরের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক শফিউল আহম্মেদ বাবুল ৪০-৫০জন মুক্তিবাহিনী নিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। | পাকিস্তানিরা কুমিল্লা-ঢাকা রেললাইনের পশ্চিম পাশে অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্সের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালালে এ যুদ্ধের সূচনা হয়। মুক্তিবাহিনী অসীম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করে এবং পাকিস্তানিদের পিছু হটে যেতে বাধ্য করে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ৭জন মারা যায় এবং বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। মুক্তিযােদ্ধা আলমগীর ও মুক্তিযােদ্ধা সাইদ আলম শহিদ হন। মুক্তিযুদ্ধকালে এ যুদ্ধ। চড়নলের যুদ্ধ হিসেবে খ্যাত ছিল। ঐ সময় এ যুদ্ধ মুক্তিবাহিনীর মনােবল চাঙা করতে বিপুল সাহায্য করেছিল।
উপসংহার
কুমিল্লা জেলায় মুক্তিযুদ্ধের সময় অগণিত মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হয়েছেন। তাঁদের সবার নাম ও ঠিকানা সংগ্রহ করা দুরূহ ব্যাপার। আমাদের উদ্ধারকৃত তথ্যের বাইরেও থাকতে পারে, মুক্তিসংগ্রামে আত্মদানকারী অনেক শহিদ। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের জানা অজানা আত্মত্যাগী মুক্তিযােদ্ধাদের পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশ্যে আমাদের সকল প্রয়াস ও প্রচেষ্টা উৎসর্গীকৃত। লাখাে শহিদের রক্তে কেনা স্বাধীনতার প্রভাব বাঙালি জীবনে যেমন গভীর তেমনি ব্যাপক। স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মদানকারী সেই সব অসীম সাহসী বীর যােদ্ধা আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বকালের প্রেরণার উৎস। বাঙালির জাতীয় ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা গৌরবােজ্জ্বল এ অধ্যায়টিতে আত্মদানকারী সেনাসদস্য ও সাধারণ মুক্তিযােদ্ধাদের ভূমিকা যেমন মহাকালের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, তেমনি জাতির সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে তারা বেঁচে থাকবেন চিরকাল মানুষের অন্তরে।
গণ-আন্দোলন ও অসহযােগ আন্দোলনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া
তিতাস বিধৌত ইতিহাস ও ঐতিহ্যে মণ্ডিত, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে অলংকৃত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সুদূরপ্রসারী ব্রিটিশ সরকারের গদি কাপানাে বিপ্লবী উল্লাস কর দত্ত, অখিলচন্দ্র দত্ত, অশােক নন্দী, বিভূতিভূষণ রায়, ললিত মােহন বর্মন, সুনীতি ঘােষ চৌধুরী, সত্যেন বর্ধন, অতিন্দ্রমােহন রায়, কৃষকনেতা আব্দুল মালেক ও দেলােয়ার হােসেন (সুরুজ মাস্টার) প্রমুখ। বিপ্লবীদের জন্মভূমি পলিমাটিতে উর্বর এ ব্রাহ্মণবাড়িয়া। তাদের সহযােদ্ধা স্বজাত্যবােধের চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে ৪৭-পরবর্তী ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে রাষ্ট্রভাষা বাংলা কায়েম করার জোর দাবি রাখে জেলার রামরাইল গ্রামের সন্তান অকৃত্রিম দেশপ্রেমিক একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্য কর্তৃক শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। এ দাবিকে কেন্দ্র করেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী তথা ভাষা আন্দোলন সারা দেশব্যাপী বহতা নদীর মতাে গতিশীল হয়ে ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক দিনটির সৃষ্টি হয়। এ আন্দোলনেও জাতীয়ভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন এ জেলার কৃতী সন্তান অলি আহাদ। বৃহত্তর জেলা কুমিল্লার ছাত্র নেতৃত্বে ছিলেন নবীনগরের আরেক কৃতী সন্তান অ্যাডভােকেট আহাম্মদ আলী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছাত্র নেতৃত্বে ছিলেন আবুল বাসার মৃধা। এমনিভাবে ১৯৬২, ১৯৬৪ ও ১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভূমিকা স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে ছিল অদ্বিতীয়। ১৯৬৯ সালে সাংগঠনিক সফরে এলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বর্তমান আব্দুল কুদুস মাখন মুক্তমঞ্চে স্বতঃস্ফূর্ত জনতার মাঝে রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে সচেতনতাসম্পন্ন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লাখাে জনতাকে করলেন তেজোদীপ্ত ও বেগবান।  ১৯৭০-এর নির্বাচন এ নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সব কয়টি জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের আসনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলাে। জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) হলেন অ্যাডভােকেট আলী আজম ভূইয়া, অ্যাডভােকেট সিরাজুল হক, অ্যাডভােকেট দেওয়ান আবু আব্বাস, তাহের উদ্দিন ঠাকুর। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) হলেন অ্যাডভােকেট সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম, অ্যাডভােকেট লুঙ্কল হাই সাচ্চু, অ্যাডভােকেট সৈয়দ এমদাদুল বারী, মােজাম্মেল হক (কাপ্তান মিয়া), অ্যাডভােকেট আহাম্মদ আলী, আকবর উদ্দিন। সিদ্দিকী, গােলাম মহিউদ্দিন আফতাব মিয়া এবং মহিলা এমপিএ মমতাজ বেগম। উল্লিখিত নেতারা এ জেলার প্রতিটি জাতীয় আন্দোলনে এবং মুক্তিযুদ্ধে পূর্বাঞ্চলে মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত করেছেন। নেতৃত্ব দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে করেছেন ঐতিহ্যমণ্ডিত। সে সময় জাতীয়ভাবে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মােড়াইল গ্রামের কৃতী সন্তান বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা আব্দুল কুদুস মাখন। নবীনগরের মমতাজ বেগম স্বাধীন বাংলা ছাত্রসগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় নেত্রী ছিলেন।
প্রতিরােধ সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া
প্রতিরােধ সংগ্রামেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ৭ মার্চের জনসভায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে বাসভর্তি করে অসংখ্য লােক ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যােগ দেন। রাতে তারা ঢাকা থেকে ফিরে এলে বাকি সবাই জনসভার পূর্ণ বিবরণ জানতে পারে এবং স্লোগানে স্লোগানে শহর প্রকম্পিত হতে থাকে। প্রায় সবগুলাে স্কুলকলেজ, বাজারে, উন্মুক্ত মাঠে প্রাক্তন সেনাসদস্য, মুজাহিদ, আনসার দিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু হলাে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইউওটিসির ছাত্ররা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন। অপর দিকে ৭ মার্চের পর পরই রাজনৈতিক নেতারা জরুরি বৈঠকে মিলিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করেন। তারা প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সংগ্রহ ইত্যাদি নিয়েও আলােচনা করেন। এ সময় যারা নেতৃস্থানীয় ছিলেন, তারা হলেন অ্যাডভােকেট আলী আজম ভূইয়া, লুণ্ডুল হাই সাচ্চু, ডা. ফরিদুল হুদা ভূঞা, সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ। হুমায়ুন কবীরকে আহ্বায়ক করে ১টি ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ পরিষদের উদ্যোগে ৯ মার্চ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ মাঠে প্রশিক্ষণ শুরু হয়।
১২ মার্চ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সাথে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক শামসুল হক ও জেলা পুলিশপ্রধান এ জেড এম সামসুল হক ব্রাহ্মবাড়িয়ায় এসে এক গােপন বৈঠকে মিলিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরােধ করার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা প্রশাসক রাকিব উদ্দিনও উপস্থিত ছিলেন। এ বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা জেলার অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের একত্র করে তাদের দিয়ে প্রতিরােধ বাহিনী তৈরি এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। সরকারি কর্মকর্তারা জেলা অস্ত্রাগার থেকে কয়েক শ অস্ত্র এদের হাতে তুলে দেন। এ সময় স্থানীয় টেক্সটাইল মিলের দারােয়ানের কাছ থেকেও ৬টি রাইফেল সংগ্রহ করা হয়। ২৩ মার্চ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতারা সম্মিলিতভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ান। ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবাঙালি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খিজির হায়াত খান ও ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি ষড়যন্ত্র করে ২৪ মার্চ মেজর খালেদ মােশাররফকে ২৬টি গাড়িতে ২৫০জন সৈনিককে প্রয়ােজনীয় অস্ত্র ও মালামাল সামগ্রীসহ সিলেটের শমসেরনগরে পাঠাতে চাইলে রাত আড়াইটায় তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে পৌছেন।
রাস্তায় অসংখ্য ব্যারিকেডের পরও কুরুলিয়া ব্রিজের সন্নিকটে অসংখ্য ছাত্র জনতা তাদের বাধা দেয়। ওয়াপদা ক্যাম্পে অবস্থানরত মেজর শাফায়াত জামিল বিক্ষুব্ধ জনতাকে বােঝাতে ও শান্ত করতে ব্যর্থ হয়ে বেশ কয়েক ঘণ্টা পর মেজর খালেদকে তার ক্যাম্পে নিয়ে এসে স্থানীয় নেতাদের সাথে আলােচনাক্রমে যখন বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হলেন যে, বাঙালি সৈন্যরা বাঙালি জাতির জন্য সময়মতাে ঠিকই অস্ত্র ধরবে, তখনই নেতারা মতামতের ওপর ভিত্তি করে ভাের সাড়ে ৫টায় তারা শমসেরনগরের দিকে যাত্রা করতে সমর্থ হন। ২৬ মার্চ ভোের থেকেই অন্নদা বাের্ডিং মাঠে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হতে থাকে। এরপরই শুরু হয় মুক্তিযােদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণ। এখানে প্রায় ১০ হাজার লােক স্বেচ্ছায় সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এ সময় অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য হামিদুর রহমানকে নিয়ে গঠিত হয় মহকুমা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। উপপ্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন কাজী আকতারুজ্জামান ও হাবিবুর রহমান হাবিব। ২৭ মার্চ সকালে স্থানীয় ওয়াপদা অফিসে মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করে। এ বিদ্রোহের সংবাদ পেয়ে মেজর খালেদ মােশাররফও দ্রুত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলে আসেন। এ দিনই বিকেলে মৌলভী পাড়ার লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম রেজা ও স্থানীয় নেতা। আলী আজম ভুঞা, লুৎফুল হাই সাচ্চু, মাহবুবুল হুদা ভূঞা ও ডা. ফরিদুল হুদা। ভূঞা ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের সাথে এক সভায় মিলিত হন। সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে তেলিয়াপাড়ার চা-বাগানে সদর দপ্তর স্থাপন করেন।
এ সময় মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এসে মেজর খালেদের সাথে যােগ দেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে শত্রুমুক্ত রাখতে লেফটেন্যান্ট হারুনকে উজানিসার ব্রিজে, ক্যাপ্টেন গাফফারকে এবং পরবর্তী সময় ক্যাপ্টেন মাহাবুবকে গােকর্ণঘাটে মােতায়েন করেন। আশুগঞ্জ এলাকায় অবস্থান নেন ক্যাপ্টেন নাসিম এবং সরাইল-নাসিরনগরের দায়িত্ব নেন ক্যাপ্টেন এম এ মতিন। কুরুলিয়া ব্রিজে অবস্থান নেন ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন।  পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালি সেনাদের স্বাধীনতার চেতনা দেখে মুগ্ধ জনতা আরও বিদ্রোহী হয়ে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দিতে লাগলাে সারা জেলার প্রতিটি গ্রামেগঞ্জে। এভাবেই সমগ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিযুদ্ধের ঘাটি তৈরি হয়। পাকিস্তানি বাহিনী ২৮ মার্চ সকালে ১জন পাঞ্জাবি মেজরসহ একদল সৈন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে তথ্য সংগ্রহের জন্য পাঠায়। পাঞ্জাবি সৈন্যরা কুরুলিয়া খালের দক্ষিণ পাড়ে আসার পর অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর আক্রমণ করলে মেজরসহ বেশ কিছু পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। ২৮ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন কেন্দ্রে ১টি বেতারকেন্দ্র চালু করা হয়। সুপার সামছুদ্দিন আহাম্মদের নেতৃত্বে এবং মাে. ইসমাইলের কারিগরি সহায়তায় স্থাপিত এ বেতারকেন্দ্রটি পরিচালনা করতেন অধ্যাপক এ কে এম হারুনুর রশিদ। এটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক কাজী। রকিব উদ্দিন আহমেদ।
১২ এপ্রিল পাকিস্তানি বিমান হামলা ৩ দিন চলার পরই বেতারকেন্দ্রটি নষ্ট হয়ে যায়।  এ সময় থেকে স্থানীয় গার্লস হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কক্ষটিকে কন্ট্রোল রুম করে মুক্তিযােদ্ধাদের কাজ শুরু হয়। ইউওটিসি কলেজের ছাত্ররা আনসার অ্যাডজুটেন্টের কাছ থেকে স্লিপ নিয়ে ট্রেজারি থেকে রাইফেল এনে প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন। স্থানীয় সবগুলাে স্কুলকলেজের বিজ্ঞান পরীক্ষাগার থেকে প্রয়ােজনীয় এসিড ও রাসায়নিক দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ করে বােমা তৈরি করা হয়। এ সময় মুক্তিযােদ্ধাদের সবরকম প্রস্তুতি ও তৎপরতা ছিল সমস্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় । সব প্রস্তুতিতেই সর্বাত্মক সহযােগিতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক কাজী রকিব উদ্দিন আহম্মেদের এবং তারই প্রচেষ্টায় ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনের নেতা শাহবাজপুরের রবিনাগ আগরতলা গিয়ে সেখানকার নেতাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সবকিছু জানিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত সরকারের সবরকম সহযােগিতা পাওয়ার জন্য উদ্যোগ নেন। ২৯ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসরমাণ পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে মেজর খালেদ মােশাররফের অগ্রবর্তী সৈন্যদের কোম্পানিগঞ্জে লড়াই হয়। এতে পাকিস্তানি সেনারা অনেক হতাহত হয়ে আবার কুমিল্লা সেনানিবাসের দিকে পশ্চাদপসরণ করে। ২৯ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শত্রু প্রথম বিমান হামলা চালায়। এতে মুক্তিবাহিনীর ১জন সদস্য শহিদ হন।
নেতারা শিল্পী, সাহিত্যিক, আইনজীবী, শিক্ষক বিভিন্ন শ্রেণির জনতাকে নিয়ে সভা করে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছেন। যার ফলে প্রথম থেকেই শত শত যুবককে শহরের বিশেষ পরিচিত কমিউনিটি হল অর্থাৎ পৌরভবন প্রাঙ্গণ থেকে জননেতা মাহাবুবুল হুদা ভূঞা, জাহাঙ্গীর ওসমান ভূঞা ও সঙ্গীরা মুক্তিযুদ্ধে ট্রেনিংয়ের জন্য রিক্রুট করে ট্রাকযােগে নিয়ে যেতেন তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম রেজার কাছে। স্বতঃস্ফূত জনতা চাঁদা তুলে স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে খাবার পাঠাতেন। ১৪, ১৫ ও ১৬ এপ্রিল উপর্যুপরি আকাশ, নদী ও স্থলে প্রচণ্ড আক্রমণ। চালিয়ে আশুগঞ্জ থেকে রেললাইন দিয়ে, কুমিল্লা থেকে সিলেট সড়ক দিয়ে এবং কুমিল্লা থেকে কসবা হয়ে একযােগে আক্রমণ চালিয়ে সমস্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাকিস্তানিরা দখল করে নেয়। পথিমধ্যে বাড়ি, মসজিদে তারা যাকে যেখানে। দেখেছে, তাকেই নির্মমভাবে হত্যা করেছে, বাড়িঘর পুড়িয়েছে, মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করেছে, নারী নির্যাতন করেছে। বিভিন্ন স্থানে পাকস্তানিদের আক্রমণের বিরুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করেছেন। সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করে আখাউড়া-দরুইন গ্রামে শহিদ হন বীরশ্রেষ্ঠ মােস্তফা কামাল। আশুগঞ্জে আহত হয়েছেন ক্যাপ্টেন নাসিমসহ আরও অনেকে। তারপর বাড়িঘর ছেড়ে লােকজন যেতে লাগলাে ভারতের দিকে। কেউ শরণার্থী শিবিরে, যুবক ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে, মহিলারা ক্যাম্পে হাসপাতালে সেবিকার কাজে, রাজনৈতিকভাবে সচেতন মহিলারা সংগঠক হিসেবেও যােগ দিয়েছেন।
তাদের মধ্যে বেগম দিলারা হারুন, মমতাজ বেগম (নবীনগর), আম্বিয়া আজম, জাহানারা হক, আমেনা সুলতানা বকুল প্রমুখ। মমতাজ বেগম ও আমেনা সুলতানা বকুল ত্রিপুরার লেবুছড়া মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছেন। অধ্যাপক এ কে এম হারুনুর রশিদ গান রচনা করতেন। সুর দিতেন ও মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে গান গাইতেন। পলিটিক্যাল মটিভেটর হিসেবে কাজ করতেন। তা ছাড়া সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা হলেন আজিজুল্লাহ চকলেট, ফিরােজ আহমেদ, সুমিত্রা ভট্টাচার্য, ছবি পাল, শংকরী রায়, দেলােয়ার জাহান ঝন্টু, সৈয়দ শাহাজাদা প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র রণাঙ্গনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাটি ২ ও ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল। ২ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন মেজর খালেদ মােশাররফ এবং পরবর্তী সময় মেজর হায়দার। ৩ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন মেজর কে এম সফিউল্লাহ, পরবর্তী সময় মেজর এ এন এম নূরুজ্জামান। সদর দপ্তর ছিল যথাক্রমে মেলাগড় ও হেজামারা।
৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নিয়মিত বাহিনীর ২য় ও ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধারা শুরু থেকে এ জেলায় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলেন এবং পুরাে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস বহু সফল অভিযান পরিচালনা করে শত্রুকে ব্যতিব্যস্ত রাখেন এবং ভীতির সঞ্চার করেন। সময়ের পরিক্রমায় ২ নম্বর সেক্টরে ৯ম, ১০ম ও ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ৩ নম্বর সেক্টরে ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠনপূর্বক ২টি ব্রিগেড আকারের ফোর্স তাদের ফোর্স অধিনায়কদের নামের আদ্যক্ষর দ্বারা ‘কে’ ও ‘এস’ ফোর্স নামে পরিচিত হয় এবং নিয়মিত বাহিনীরূপে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সম্মুখসমরে লিপ্ত হয়। পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় কাজের সুবিধার্থে কিছু উপকমিটি ছিল। যেমন: রক্তদান কমিটির প্রধান ছিলেন অ্যাডভােকেট লুৎফুল হাই সাচ্চু। শহিদ মুক্তিযােদ্ধাদের লাশ দাফনের দায়িত্বে ছিলেন হামিদুর রহমান হামদু, নির্বাচিত এমএনএ ও এমপিএরা বিভিন্ন ক্যাম্পের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। পূর্বাঞ্চলীয় জোনের অর্থবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন অ্যাডভােকেট আলী আজম ভূইয়া। আগরতলায় গঠিত শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক হরলাল রায় ও অর্থবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন অধ্যক্ষ আবু আহমেদ। সমন্বয়কারীর দায়িত্বে ছিলেন মাহবুবুল হুদা ভূঞা, স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রধান ছিলেন প্রথমে মাে. শাহজাহান মিয়া এবং পরে মােহাম্মদ আলী।
ডা. ফরিদুল হুদা ত্রিপুরা সিপিএম এর নিযুক্ত শরণার্থী ক্যাম্পের চিকিৎসক এবং পরবর্তী সময় ‘জেড’ ফোর্সের চিকিৎসক ছিলেন। পাকিস্তানের খাদেম সেজে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করার পক্ষে এবং পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোেগ জাতীয় কাজে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং মুক্তিযােদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি নিধনে নীলনকশা তৈরি করে সক্রিয়ভাবে পাকিস্তানিদের সহযােগিতা করে কলঙ্কিত হয়েছিল এ জেলারই কিছু কুখ্যাত নেতা। ১৬ এপ্রিল সমগ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা যখন পাকিস্তানি সৈন্যদের দখলে চলে যায়, তখন থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সমগ্র জেলার সব স্তরের জনগণ পাকিস্তানিদের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বা অত্যাচারের শিকার হয়েছে।
পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহ ও মেজর আব্দুল্লার নেতৃত্বে স্থানীয় শান্তি কমিটি, আলবদর বাহিনী ও রাজাকারদের সহযােগিতায় অনুষ্ঠিত হয়েছে এসব হত্যাকাণ্ড। এমনকি স্বাধীনতাবিরােধীরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাম বদল করে রহমানবাড়িয়া করেছিল। সমগ্র জেলায় কয়েক হাজার নারী ধর্ষিত হয়েছেন। সামাজিক কারণে যার সঠিক পরিসংখ্যান বের করা সম্ভব হয়নি। কসবায় কুল্লাপাথর কবরস্থান সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র কবরস্থান, যুদ্ধকালীন যার।  পরিকল্পনা করা হয় এবং শহিদ মুক্তিযােদ্ধাদের কবরস্থ করা হয়। স্থানীয় দালালদের প্ররােচণায় ৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা অধ্যাপক লুৎফর রহমান ও সৈয়দ আকবর হােসেনসহ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের প্রায়  ৪৫জনকে কুরুলিয়া খালপাড়ে হত্যা করেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সমগ্র জেলার প্রায় লক্ষাধিক লােক প্রাণভয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ৫ হাজার যুবক ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের ভেতরে ও সীমান্তে পাকিস্তানি সেনাদের | বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছেন। ত্রিপুরায় স্থাপিত প্রায় ১৫টি যুব শিবিরে জেলার প্রায় ৩ হাজার লোেক অপেক্ষা করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য। মুক্তিযােদ্ধাদের মুষ্টিমেয় রাজাকার দালাল প্রকৃতির লােকজন ছাড়া জেলার সর্বস্তরের লােকজন সহযােদ্ধা হিসেবে কিংবা সাধ্যমতাে বিভিন্ন ধরনের। সহযােগিতা করেছেন। এসব সহযােগিতা করার জন্য অনেকে ঘরবাড়ি, | মালামাল হারিয়েছে এবং অনেকের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। এমনকি আত্মীয়স্বজনদেরও প্রাণ দিতে হয়েছে। ৬ ডিসেম্বর থেকে প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে মিত্রবাহিনীর সহযােগিতায় মুক্তিবাহিনী ৮ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত করতে সক্ষম হয়। ৯ ডিসেম্বর। আশুগঞ্জ, ১৯ ডিসেম্বর নবীনগর ও ২২ ডিসেম্বর বাঞ্ছারামপুর মুক্ত হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিপীড়িত জনগণ ত্যাগ ও তিতিক্ষাকে এবং প্রিয়জন হারানাের বেদনাকে স্বাধীনতার বেদিমূলে নিবেদন করেছেন সানন্দে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের মুষ্টিমেয় দালাল ছাড়া সমগ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সর্বস্তরের জনগণের ত্যাগ ও নিষ্ঠা ইতিহাস স্মরণীয়। যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান মেঘনা নদীর তীরবর্তী আশুগঞ্জ ও ভৈরব যথাক্রমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কিশােরগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। সড়ক ও রেলপথে যােগাযােগ ব্যবস্থা এবং নৌপথে বাণিজ্যিক সুবিধার কারণে এ স্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। ভৈরব রেলওয়ে ব্রিজের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকার সাথে সিলেট ও চট্টগ্রামের সাথে যােগাযােগ এবং সড়কপথে ফেরি পারাপারের সুবিধা থাকায় সামরিক কৌশলগত দিক থেকে এ স্থানের গুরুত্ব প্রচুর। যুদ্ধের পটভূমি নরসিংদীতে অবস্থানরত পাকিস্তানিদের সাথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও পাকিস্তানিদের যােগাযােগ ব্যবস্থা অক্ষুন্ন রাখার জন্য শক্র এ স্থানটিকে নিজেদের দখলে রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। রেল যােগাযােগ অকার্যকর হয়ে যাওয়ার ফলে ঢাকানরসিংদী-ভৈরব-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কপথ এবং মেঘনা নদীই থাকে শত্রুর ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌছার পথ। মুক্তিবাহিনী (২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) তাই আশুগঞ্জ-ভৈরব প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন ছিল নিম্নরূপ:
১. পাকিস্তানি বাহিনী | ক, ২৭ পদাতিক ব্রিগেড
• ৩৩ বালুচ রেজিমেন্ট (৩৩ বালুচ)।
• ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স (১২ ফ্রন্টিয়ার)। খ, ১ স্কোয়াড্রন ট্যাংক। গ, এফ-৮৬ স্যার জেট। ঘ. এমআই-৮ হেলিকপ্টার। উ. ল্যান্ডিং ক্রাফট ট্যাংক ও লঞ্চ। মুক্তিবাহিনী ক. ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। খ, ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। গ. ৪র্থ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল (ইপিআর)। ঘ, মুজাহিদ এবং আনসার ও ছাত্র প্লাটুন।
মুক্তিবাহিনীর অবস্থান
২৬ মার্চের পর জয়দেবপুর থেকে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করে। ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অধিনায়ক মেজর সফিউল্লাহ এবং ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অধিনায়ক মেজর খালেদ মােশাররফ যৌথভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট অঞ্চল মুক্ত করার জন্য। যৌথ অপারেশন পরিচালনা করে পরবর্তী সময় ঢাকার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘এ’ কোম্পানি ক্যাপ্টেন। নাসিমের অধীনে আশুগঞ্জে, ১ প্লাটুন নিয়মিত সৈন্যসহ ইপিআর সৈন্যরা লেফটেন্যান্ট হেলাল মােরশেদের অধীনে লালপুরে, ১জন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার (জেসিও)-এর অধীনে ইপিআর ও মুজাহিদের সংমিশ্রিত ১টি কোম্পানি ইজবপুরে অবস্থান গ্রহণ করে। এ ছাড়া ইপিআর-এর ১টি কোম্পানি ক্যাপ্টেন মতিনের অধীনে সরাইলে মােতায়েন করা হয়। ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘ডি’ কোম্পানি এবং ইপিআর সৈন্যরা ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিনের অধীনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এবং ক্যাপ্টেন মতিউরের অধীনে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ১ কোম্পানি নিয়মিত সৈন্যসহ ইপিআর সৈনিকেরা নরসিংদী ও ভৈরব এলাকায় অবস্থান নেয়। মুক্তিবাহিনীর পরিকল্পনা আশুগঞ্জ-লালপুর এলাকায় মুক্তিবাহিনীর শক্তিশালী সমাবেশ ঘটানাে হয়, যার  উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি বাহিনী যাতে সিলেট কিংবা কুমিল্লায় রেল ও নদীপথে শক্তিবৃদ্ধি করতে না পারে। লালপুর ও আশুগঞ্জে যদি শত্রুর চাপ বৃদ্ধি পায়, তবে সরাইলে অবস্থানকারী কোম্পানিকে তালশহর-গােকনঘাট প্রতিরক্ষা লাইনে শক্তিশালী করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ ছাড়া তখন তেলিয়াপাড়ায় অবস্থানরত মেজর মইনের অধীনস্থ ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডি কোম্পানি প্রয়ােজনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আশুগঞ্জে অবস্থানকারী সৈনিকদের সহযােগিতা করার। জন্য প্রস্তুত রাখা হয়। যেহেতু এলাকাটি নদীবিধেীত এবং চলাচলের জন্য একমাত্র সড়ক ও রেলপথ ছাড়া কেবল নৌযানের ওপর নির্ভর করা হয়, তাই মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুর চলাচল রােধকল্পে সেতু ধ্বংস করাসহ দেশীয় নৌকা নিজেদের দখলে রাখেন। অথবা ডুবিয়ে ফেলেন। শত্রুপক্ষ যেন মুক্তিবাহিনীর অবস্থান সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারে, সে জন্য ক্যামােফ্লেজ ব্যবস্থাসহ বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে প্রতিরক্ষা গ্রহণ করা হয়।
পাকিস্তানিদের পরিকল্পনা ও অবস্থান পাকিস্তানিরা মে মাসের মধ্যে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে আনার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সিলেটে অবস্থানকারী ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের (৩১ পাঞ্জাব) শক্তি বৃদ্ধির জন্য ৩১৩ ব্রিগেডকে বিমানে সিলেটে প্রেরণ করে। কুমিল্লা থেকে ৫৩ ব্রিগেডকে চট্টগ্রামে স্থানান্তর করে ১১৭ ব্রিগেডকে কুমিল্লায় প্রেরণ করা হয়। ১১৭ ব্রিগেডের ব্যাটালিয়নগুলাে কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুরের দিকে অগ্রাভিযান করে কিন্তু ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাধার মুখে তাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া অভিমুখে অগ্রাভিযান সাফল্যলাভ করতে পারেনি। | ২৭ ব্রিগেডের গন্তব্যস্থল ময়মনসিংহে যাওয়ার পূর্বে এ ব্রিগেডকে কুমিল্লাসিলেট সড়ক ও রেলপথ মুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ব্রিগেডটি ভৈরববাজারে মেঘনা নদী প্রবল গতিতে অতিক্রমের পরিকল্পনা করে। এ অভিযানে ট্যাংক, কমান্ডাে, হেলিকপ্টার ও জঙ্গিবিমানও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ ছাড়া ল্যান্ডিং ক্রাফট ট্যাংক, গানবােট ও লঞ্চের সমাবেশ ঘটানাে হয়। বেসামরিক ব্যক্তিদের সহযােগিতা ক্যাপ্টেন নাসিম আশুগঞ্জে শরিয়ত উল্লাহ হাজির লাল দালানে মুক্তিবাহিনীর স্থানীয় সদর দপ্তর স্থাপন করেন। ছাত্র ও যুবকসহ সর্বস্তরের জনতা সামরিক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। এদিকে আনসার, পুলিশ, ইপিআর এবং সেনাবাহিনীর ছুটি ভােগরত সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য এখানে জড়াে হতে থাকেন। তা ছাড়া প্রাক্তন ইপিআর ও সৈনিকেরাও এখানে এসে। মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেয়। ক্যাপ্টেন নাসিম এখানে ৬০০ মুক্তিযােদ্ধার ১টি বিরাট দল গড়ে তােলেন।
শফিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত সংগ্রাম কমিটি ক্যাপ্টেন নাসিমের বিশাল মুক্তিবাহিনীকে নিয়মিত খাদ্য সরবরাহসহ সকল প্রকার সাহায্য-সহযােগিতা প্রদান করতে থাকে। ভৈরবের তল্কালীন ওসি কুতুব উদ্দিন মুক্তিযােদ্ধাদের জুতা, লুঙ্গি, গামছা প্রভৃতি সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করেন। দলমত নির্বিশেষে আশুগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ সংগ্রাম কমিটিকে সব ধরনের সহায়তা প্রদান করে। যুদ্ধের বর্ণনা। ১৩ এপ্রিল বিকালে তেলিয়াপাড়া থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধা দল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌছায়। মেজর সফিউল্লাহ তাদের তখনই ভৈরববাজারে ক্যাপ্টেন মতিউরের শক্তি বৃদ্ধির জন্য পাঠিয়ে যেন। মুক্তিযযাদ্ধারা যাত্রার শুরুতেই প্রচণ্ড বিমান আক্রমণের সম্মুখীন হন। এর ফলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল। স্টেশনে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহি মহসিন এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১জন মুক্তিযােদ্ধা নিহত হন। ১৪ এপ্রিল সকালে নৌযানের একটি বহর লালপুরের কাছে মেঘনা নদীতে আসে। নৌযানের বহরটি অবতরণের স্থান নির্ণয় করার জন্য এসেছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরক্ষা বিন্যাস সম্পর্কে ওরা নিশ্চিত না হওয়ার কারণে অবতরণ পরিকল্পনা তখনাে সম্পন্ন করতে পারেনি। শত্রুরা আকস্মিকভাবে লালপুর থেকে গােলাবর্ষণে আক্রান্ত হয়। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে গুলিবিনিময় হয়। শক্ররা শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ দিকে ভাটির স্রোতে চলে যায়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজা তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে আগরতলায় অবস্থিত বাংলাদেশ সরকারের কাছে জমা দেওয়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। লালপুরে আক্রমণের সম্ভাবনায় সরাইলে অবস্থিত ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানিকে সেখানে অবস্থান নেয়ার জন্য কর্নেল রেজা নির্দেশ দেন। রাতের মধ্যেই ক্যাপ্টেন মতিন সেখানে পৌছে।
কিন্তু রাতের বেলা সৈন্যদের লালপুরে বিন্যস্ত করা সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া তার রিকয়েললেস রাইফেল (আরআর) আশুগঞ্জে ক্যাপ্টেন নাসিমের কাছে পরিবহন অসুবিধার কারণে ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানির ডান দিকে লেফটেন্যান্ট মােরশেদের কোম্পানি অবস্থান করছিল। শত্রুপক্ষের আসন্ন অবতরণের খবর পেয়ে মেজর সফিউল্লাহ রাত ২টায় মৌলভীবাজার ছেড়ে ১৫ এপ্রিল ভােরবেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছেন। ১৫ এপ্রিল ভাের সাড়ে ৫টায় আশুগঞ্জে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের ওপর শত্রুদের গােলাবর্ষণ শুরু হয়। একই অবস্থা চলে লালপুর ও ভৈরবে। অনুমিত হয়, খাসাবাড়ি রেল স্টেশনের কাছাকাছি এলাকা থেকে কামানের গােলা নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। লালপুরের সামনে আবারও শত্রুর নৌযানের বহর উপস্থিত হয়। প্রচণ্ড গোলাবর্ষণে মুক্তিযােদ্ধারা মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারছিলেন না। ক্যাপ্টেন মতিনের অধীনস্ত মুক্তিযােদ্ধাদের লক্ষ্য করে পাকিস্তানি সৈন্যরা সতর্কতার সাথে। মেঘনার ওপর দিয়ে এগিয়ে আসছিল। গােলন্দাজ বাহিনীর গােলাবর্ষণের ছত্রছায়ায় অবতরণের জন্য লালপুরের দিকে এগিয়ে চলছিল। নৌবহরের মধ্যে এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য, ২টি ল্যান্ডিং ক্রাফট ট্যাংক এবং ৪টি লঞ্চ ছিল। এ সময় ভৈরব বাজার রেললাইন দিয়ে আরেকটি শত্রু ব্যাটালিয়ন অগ্রসর হয়।
নদীর অপর পারে যুদ্ধের ওপর প্রভাব বিস্তার করার মতাে কোনাে উপায় মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে ছিল না। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, শত্রুকে প্রতিহত করে তাদের অগ্রগতি বিলম্বিত করার জন্য এবং শেষপর্যায়ে সেতুর ওপর দিয়ে এবং নৌকার সাহায্যে আশুগঞ্জে চলে যাওয়ার জন্যও পরামর্শ দেওয়া হয়। যুদ্ধ ভয়ংকর আকার ধারণ করে। নৌবহর আরও এগিয়ে আসে এবং আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। লালপুরে মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মতিন বিগত রাতে তার ১০৬ মিলিমিটার আরআর আশুগঞ্জে ক্যাপ্টেন নাসিমের কোম্পানির কাছে ফেলে এসেছিলেন। যাহােক, একটি ৭৫ মিলিমিটার আরআর গােকর্ণঘাট থেকে নিয়ে। এসে অবতরণকারী ট্যাংকের ওপর ৫টি গােলা নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু এতে শক্রর কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। নৌবহরটি অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে তখনাে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান নির্ণয় করার চেষ্টা করছিল, তখন ১জন মুক্তিযোেদ্ধা হঠাৎ তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা সঙ্গে সঙ্গে ট্যাংক থেকে একযােগে গােলাবর্ষণ শুরু করে। মুক্তিযােদ্ধাদের রকেট লঞ্চার ও মটারের ভারী গােলাবর্ষণ শত্রুদের প্রচণ্ড আঘাত করে। পাকিস্তানি বাহিনী হতভম্ব হয়ে তীর থেকে অন্যত্র চলে যেতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিবর্ষণ অব্যাহত থাকে। এর কিছুক্ষণের মধ্যে ৬টি স্যার এফ-৮৬ জঙ্গিবিমান ভৈরব, লালপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের ওপর বােমাবর্ষণ শুরু করে। বিমান আক্রমণের ফলে মুক্তিবাহিনীর সৈন্যরা বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়ে। একনাগাড়ে ৬ ঘণ্টা বিমান আক্রমণ চলে।
একই সাথে এক ঝাক এমআই-৮ হেলিকপ্টার। বিমান আক্রমণের ছত্রছায়ায় আশুগঞ্জ ও আজবপুরের মধ্যবর্তী সােহাগপুরে ছত্রীসেনা অবতরণ করাতে থাকে। ছত্রীসেনা অবতরণে বাধা দেওয়ার জন্য ক্যাপ্টেন নাসিম দ্রুতবেগে তার কোম্পানিকে পুনরায় একত্র করে বিমান আক্রমণ সত্ত্বেও শত্রুপক্ষের ওপর ঝাপিয়ে পড়েন। এমজি পােস্টের অধিনায়ক ল্যান্স নায়েক আব্দুল হাই রেলপথে স্থাপিত উন্মুক্ত পরিখা থেকে শত্রুদের ওপর গােলাবর্ষণ করতে থাকেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ থেকে সরাসরি নিক্ষিপ্ত গােলায় আব্দুল হাই শহিদ হয়। শত্রুরা মুক্তিবাহিনীর অবস্থানগুলাে ঘিরে ফেলে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের অজ্ঞাতেই তাদের কাছাকাছি এসে পড়ে। প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে হাতাহাতি যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে শত্রুপক্ষের কয়েকজন হতাহত হয়। এ সময় এক ঝাক এমইই-৮ হেলিকপ্টার আশুগঞ্জ ও আজবপুরের মাঝামাঝি শক্রর ১টি কোম্পানি। মুক্তিযােদ্ধার পেছনে অবতরণ করে। ক্যাপ্টেন নাসিম এবং লেফটেন্যান্ট মােরশেদ যুদ্ধ চলাকালে আহত হলে যুদ্ধক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটে। হেলিকপ্টার সাফল্যের সাথে অবতরণ করছে দেখে মেজর সফিউল্লাহ সৈন্যদের নিরাপদ এলাকায় সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন নাসিম সরাইলের দিকে পিছু হটে যান। শত্রুদের নৌবহর তিতাসের মুখে তাদের সৈন্যদের নামিয়ে দেয় এবং বাম দিকের রক্ষাব্যুহ ভেঙে ফেলে। ক্যাপ্টেন মতিন লালপুরে নাজুক অবস্থায় পড়েন। অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব নয় বুঝতে পেরে সন্ধ্যার দিকে রেলপথে হেঁটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছেন। পরে ক্যাপ্টেন মতিন সরাইলে গিয়ে দেখেন মুক্তিবাহিনীর কোনাে সদস্য নেই। ইতােমধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে ক্যাপ্টেন মতিউরের পক্ষেও ভৈরব ধরে রাখা সম্ভবপর ছিল না।
উপরন্তু মেঘনা রেলসেতু ও নদী পারাপারের রাস্তাও বন্ধ হয়ে যায়। তাই তিনি তার অধীনস্ত মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে উত্তর দিকে রেলপথ ধরে কুলিয়ার চরে গমন করেন। যুদ্ধের ফলাফল আশুগঞ্জে সংঘটিত লড়াই ছিল ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জন্য প্রথম প্রস্তুতিমূলক যুদ্ধ। প্রথম প্রস্তুতিমূলক যুদ্ধে পাকিস্তানিদের স্থল, জল ও বিমান হামলার মুখে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরােধ লড়াই টিকতে না পেরে কৌশলগত কারণে পশ্চাদপসরণ করে এবং তেলিয়াপাড়া সীমান্তবর্তী অঞ্চলে চলে আসে। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সুবেদার সিরাজুল ইসলাম, ল্যান্স নায়েক আব্দুল হাই, সিপাহি কফিল উদ্দিন ও সিপাহি আব্দুর রহমান সরকারসহ আরও মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। পাকিস্তানি বাহিনী আশুগঞ্জ বাজার দখল করার সময়ও অসংখ্য নিরস্ত্র নিরীহ লােক হত্যা করে। বিমান হামলায় মৃত্যুবরণ করেন আরও অনেক লােক। ১৫ এপ্রিল থেকে আশুগঞ্জ মুক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী। আশুগঞ্জে অবস্থান করে। আশুগঞ্জ বন্দরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত ওয়াপদা রেস্ট হাউস এবং পশ্চিম-দক্ষিণাংশে অবস্থিত সাইলাে গােডাউনে তারা শক্ত অবস্থান গড়ে তােলে। পাকিস্তানি বাহিনীর ১৪ ডিভিশনের অস্থায়ী সদর দপ্তর আশুগঞ্জে স্থাপিত হয়। পাকিস্তানি বাহিনী পাবর্তী গ্রামগুলােয় প্রায়ই আক্রমণ চালাত। গ্রামের নিরীহ, নিরস্ত্র, নিরপরাধ মানুষকে ধরে নিয়ে এসে নির্যাতন চালাত। ধৃত বন্দিদের ওপর চালাত অবর্ণনীয়, অমানুষিক অত্যাচার। তারা ভবানীপুর গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে ২৪জনকে এবং বিটঘর গ্রামে ১৬০জনকে হত্যা করে। আশুগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটিতে আক্রমণ করার মতাে শক্তি পার্শ্ববর্তী গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধারা তখনাে অর্জন করেন নি। সত্য, তবে পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য পার্শবর্তী এলাকাগুলাে মােটেও নিরাপদ। ছিল না। উভয় বাহিনীর মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের মূল্যায়ন ১. মুক্তিবাহিনীর দুর্বল দিক ছিল নিম্নরূপ: ক, এ যুদ্ধ ছিল মুক্তিবাহিনীর জন্য প্রাথমিক কালের যুদ্ধ।
তাদের নিজ ক্ষমতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা ছিল না, কিন্তু অস্ত্রের সীমাবদ্ধতা তাদের দুর্বল করে ফেলে। যুদ্ধকালে বিভিন্ন পর্যায়ে নতুন নতুন অধিনায়ক নিয়ােগ করা হয়েছিল, ফলে মুক্তিযােদ্ধারা নেতৃত্বের আংশিক সংকটে
ভােগেন। কিন্তু সে সময় এর কোনাে বিকল্প ছিল না। গ. প্রাথমিক পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধারা জনসাধারণের সর্বাত্মক
সহযােগিতা পেয়েছিলেন, কিন্তু এ সাহায্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার
করা যায়নি। ঘ, মুক্তিযােদ্ধাদের নিজস্ব দলগুলাের মধ্যে যােগাযােগের জন্য পর্যাপ্ত
বেতারযন্ত্র ছিল না, ফলে সঠিক সময়ে প্রয়ােজনীয় তথ্য পৌছায়নি। স্থল, জল ও আকাশপথে এ ত্রিমাত্রিক আক্রমণ বিশেষ করে। বিমান হামলা এবং ছত্রীসেনাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে
মুক্তিযােদ্ধারা ব্যর্থ হন। | চ, নতুন মুক্তিযােদ্ধাদের প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ ছিল না। ২. পাকিস্তানি বাহিনীর সবল দিক ছিল নিম্নরূপ: ক. পাকিস্তানি বাহিনী যে-কোনাে মূল্যে কৌশলগত দিক থেকে
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আশুগঞ্জকে নিজ আয়ত্তে আনার জন্য বদ্ধপরিকর ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী আশুগঞ্জ দখল করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ।
সৈন্য নিয়ােগ করে। গ, স্থল, জল ও আকাশপথে তারা সমন্বিত ত্রিমাত্রিক আক্রমণ
পরিচালনা করে সাফল্য অর্জন করে। ঘ, নতুন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিবাহিনীর তুলনায় তারা অনেক বেশি | প্রশিক্ষিত ছিল।
৬. ছত্রীসেনা ব্যবহারের মাধ্যমে তারা সাফল্য অর্জন করে। ৩. যুদ্ধের মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় ছিল নিম্নরূপ:
ক. গােটা প্রতিরক্ষাকে সমন্বিত করা যায়নি। খ. নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ স্বভাবতই প্রতিরক্ষার ধরন ও বিস্তৃতির জন্য | দুর্বল ছিল। গ, হেলিকপ্টারে শত্রু অবতরণের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা রাখা
হয়নি। অবতরণের পর তাদের মােকাবিলার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। লালপুর নদীভিত্তিক প্রতিরক্ষা অকার্যকর ছিল এবং তাদের অগােচরে পশ্চাদপসরণ শত্রুকে নদীপথে তীরে নামার স্বাধীনতা দেয়।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড