বেতিয়ারা গ্রামের যুদ্ধ
চৌদ্দগ্রাম থানার জগন্নাথদিঘি ইউনিয়নে বেতিয়ারা গ্রামের অবস্থান। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষপর্যায়ে কুমিল্লায় গেরিলা তৎপরতা জোরদার হয়ে ওঠে। ১১ নভেম্বর চৌদ্দগ্রাম থানার জগন্নাথদিঘি ইউনিয়নের বেতিয়ারা গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে ৯জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। শহিদ মুক্তিযােদ্ধারা ছিলেন ন্যাপকমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা দলের সদস্য। এ দলের ৭৮জন সদস্য বিভিন্ন ক্যাম্পে ট্রেনিং শেষে একসঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেন। তারা বিপুল অস্ত্রসহ ভারতের বাহিকোরা বেইজ ক্যাম্প থেকে ১০ নভেম্বর রাত ৮টায় চৌদ্দগ্রাম (চৌখােলা ক্যাম্পের শাখা) পেীছেন। এ দলের উদ্দেশ্য ছিল নােয়াখালী জেলার মুক্তিযােদ্ধা সংগঠক শ্রমিকনেতা রুহুল আমিন ভূইয়ার সাথে যােগাযােগ করে নােয়াখালীর সেনবাগ ও কানকিরহাট এলাকায়। ১টি মুক্তাঞ্চল গঠন করা । ঐ রাতেই তারা ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করে। বাংলাদেশে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেন। ভৈরবনগর সাব-ক্যাম্পের ২জন মুক্তিযােদ্ধা আবু তাহের ও শামসুল আলম ঐ রাতেই শত্রু অবস্থানে প্রবেশের পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। তাঁদের প্রণীত পরিকল্পনা অনুযায়ী ঐ সাব-ক্যাম্পের ৮জন মুক্তিযােদ্ধাকে দুভাগে ভাগ করে বেতিয়ারা চৌধুরীবাড়ির দুই পাশে অ্যামবুশ পাতা হয় এবং স্থানীয় ২জন। মুক্তিযােদ্ধা আব্দুল কাদের ও আবদুল মান্নাফকে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক শত্রুমুক্ত কি , তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য পাঠানাে হয়।
রাত ১২টার দিকে তারা পরীক্ষা শেষে মূল বাহিনীকে এগিয়ে যাওয়ার সংকেত দেন। মুক্তিযােদ্ধা দলটি তাদের গমন পথ শত্রুমুক্ত ভেবে বেতিয়ারা গ্রামের পথ ধরে নিশ্চিন্তে এগিয়ে আসতে থাকে দলটি ঘন অন্ধকারে মাঝরাতে মহাসড়কের পাশে এসে পৌছায়। গাছের আড়ালে সুবিধাজনক অবস্থান থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা তিন দিক থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ শুরু করে। মুক্তিযােদ্ধারা সরাসরি গুলির হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য কোনাে বাংকার বা সুবিধাজনক জায়গা পায় নি। মুক্তিযােদ্ধারা আসন্ন মৃত্যু জেনেও সামান্য অস্ত্রসহই প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। কিন্তু ঘটনাস্থলে এ দলটির ৯জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। তারা হচ্ছেন: নিজামউদ্দিন আজাদ, আওলাদ হােসেন, সিরাজুম মুনির, জহিরুল হক দুদু, বশিরুল ইসলাম, শহিদুল্লাহ, কাইয়ুম, সফিউল্লাহ ও আবদুল কাদের। অবশিষ্টরা নিরাপদে সরে যান। সেদিন মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে আসা। অধিকাংশ অস্ত্রই প্যাকেটবন্দি থাকায় তারা জোরালাে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে পারেন নি।
মুক্তিযােদ্ধারা যে-সব অস্ত্র ফেলে পিছু হটে যান, তার মধ্যে ছিল ১টি ৩ ইঞ্চি মর্টার, ২টি এলএমজি, ৬টি স্টেনগান, বেশ কিছু রাইফেল, ৪ বক্স। গ্রেনেড, রাইফেলের কয়েক বক্স গুলি, ১ ডজন অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন এবং ব্রিজ। ও দালান ধ্বংসের কাজে ব্যবহৃত বিস্ফোরক। এ অস্ত্রগুলাে পাকিস্তানি বাহিনী দখল করে নেয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, গুলিতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া লাশগুলাের ওপর পাকিস্তানি বাহিনী বেয়নেট চার্জ করে, গুলি চালিয়ে সেগুলাে ঝাঁঝরা করে ফেলে। পরদিন লাশগুলাে মাঠে পড়েছিল। বেতিয়ারাবাসীরা স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আগা আজিজুল হক চৌধুরীর সহযােগিতায় লাশগুলাে একটি গর্তে মাটি দিয়ে রাখেন। স্বাধীন হওয়ার পর লাশগুলাের কঙ্কাল ও হাড় ইত্যাদি গর্ত থেকে উদ্ধার করে বেতিয়ারার বর্তমান স্মৃতিসৌধের পাশে গণকবর দেওয়া হয় । ৯জন শহিদের মধ্যে শহিদ আবদুল কাদেরের বাড়ি চৌদ্দগ্রামের সাতবাড়িয়া গ্রামে। বাকি সবাই দেশের বিভিন্ন জায়গার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। বেতিয়ারায় মুক্তিবাহিনী চরম বিপর্যয়ের পর নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। চৌদ্দগ্রামের জগন্নাথদিঘিতে পাকিস্তানিদের শক্তিশালী ঘাঁটির নেতৃত্বে ছিল ক্যাপ্টেন জং। জগন্নাথদিঘির ২ মাইল উত্তর ও দক্ষিণে কালিকাসার ও ভাজনকরায় মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ তীব্র হয়ে উঠলে ২৮ নভেম্বর ভােরে ক্যাপ্টেন জং তার বাহিনী নিয়ে ৪ মাইল দক্ষিণে লাটিমা গ্রামে চলে যায় এবং দুপুরের দিকে ফেনী পালিয়ে যায়। এ খবর ডিমতলি ওয়ার্কার্স ক্যাম্পে পৌছলে জসিমউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৬জন মুক্তিযােদ্ধা জগন্নাথদিঘির ডাকবাংলাের সামনে এসে পৌঁছেন। এ অভিযানে অ্যাডভােকেট মশিউর হােসেন চৌধুরী (গণপরিষদ সদস্য), হাজন আলী আকবর মজুমদার (গণপরিষদ সদস্য), হাজী জালাল আহমেদ। (গণপরিষদ সদস্য) এবং আবদুল আওয়ালও (গণপরিষদ সদস্য) শরিক। ছিলেন। জগন্নাথদিঘির পাকিস্তানি ক্যাম্প মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে এবং সেখানে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানাে হয়।
হাড়াতলীর যুদ্ধ
লাকসাম থানার ২ নম্বর ভুলইন ইউনিয়নে হাড়াতলী অবস্থিত। ২১ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধের প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়। মাত্র ৩৪জন মুক্তিযােদ্ধা। মুক্তিযােদ্ধাদের নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান, আশরাক আহমেদ ও স্থানীয় অধিনায়ক মাে. জহিরুল ইসলাম। প্রায় ২০০জন পাকিস্তানির সৈয়ারভাঙ্গা যাওয়ার খবর পেয়ে মুক্তিযোেদ্ধারা পথিমধ্যে তাদের প্রতিরােধ করে। মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি দল বাতাবাড়িয়ার পুকুরপাড়ে এবং অন্য গ্রুপ হাড়াতলী গ্রামে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি বাহিনী হাড়াতলী রাস্তায় পৌছার সাথে সাথে মুক্তিবাহিনী তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ এবং বেলা ১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলতে থাকে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং ৫জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। তারা হলেন মােখলেছুর রহমান, হারুনুর রশিদ, দেলােয়ার হােসেন, মনােরঞ্জন সিংহ ও আজ্জত আলী।
লাকসামের যুদ্ধ-২
বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলের অন্তর্গত লাকসাম জেলা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত ছিল। ডাকাতিয়া নদীর পশ্চিম পাশে এর অবস্থান। লাকসাম ২ নম্বর সেক্টরের নির্ভয়পুর সাব সেক্টরের আওতাধীন ছিল। সাব-সেক্টর অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান এবং ডেপুটি অধিনায়ক ছিলেন মুক্তিযােদ্ধা আশরাক আহমেদ। পাকিস্তানিদের ২৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এ এলাকার দায়িত্বে নিযুক্ত ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনীর ৪ কোরের ২৩ মাউন্টেন ডিভিশন ও ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনকে সম্মিলিতভাবে লাকসাম এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলােকে শত্রুমুক্ত করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এদের সঙ্গে ছিল ‘কে’ ফোর্সের ৪র্থ এবং ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। ৪ ও ৫ ডিসেম্বর এ এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের সাথে সম্মিলিত বাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ডিসেম্বরের প্রথম দিকেই ৮৩ মাউন্টেন ব্রিগেড লাকসাম এলাকা দখল করে নেয়।
কুমিল্লা বিমানবন্দর আক্রমণ
৭ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে কুমিল্লা বিমানবন্দরে আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে ২৬-২৭জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হয়ে সেনানিবাসে আশ্রয় নেয়। কিছু সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। লেফটেন্যান্ট দিদারুল আলমের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর ১টি দল বিবির বাজারে প্রবেশ করে। ৮ ডিসেম্বর সারা কুমিল্লা মুক্ত হলেও চৌদ্দগ্রাম মুক্ত হয়েছিল ২৮ নভেম্বর। চৌদ্দগ্রামে বেসামরিক থানা প্রশাসনের উদ্যোগে ১৩ ডিসেম্বর চৌদ্দগ্রাম রাজকাছারি মাঠে জনসমাবেশের মাধ্যমে চৌদ্দগ্রাম মুক্ত দিবস পালিত হয়। সেই সমাবেশে পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জহুর আহমদ চৌধুরীসহ অন্যান্য নেতা উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন ডিমাতলী কর্মী শিবির উল্লেখযােগ্য ও প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে। এ শিবিরে ১৭,৫০০ শরণার্থীকে অভ্যর্থনা জানানাে হয়। ৮০০ যুবককে বিভিন্ন যুব শিবির ও ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠানাে হয়। ৩৫০জন ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধাকে বাংলাদেশের ভেতরে পাঠানাে হয়। মুক্ত এলাকায় ৪৪,০০০ মানুষকে নিরাপদে চলার সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। শত্রুমুক্ত হওয়ার পর এখানে আড়াই মাস যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন কার্যক্রম চালানাে হয়।
ঘাগুটিয়ার যুদ্ধ
বাঞ্ছারামপুর থানা থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ১৭৫জন ঢাকার দিকে পশ্চাদপসরণ করছিল। ১৩ ডিসেম্বর হােমনা থানার ঘাগুটিয়া নামক স্থানে মুক্তিবাহিনীর সাথে মুখােমুখি হলে যুদ্ধ শুরু হয়। হােমনা থানায় মুক্তিবাহিনীর সব দল একত্রে চারদিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে ঘেরাও করে ফেলে। মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব দেন নায়েব সুবেদার ইব্রাহিম ও নায়েব সুবেদার ফজলুল হক। ১৩ ডিসেম্বর থেকে এ যুদ্ধ ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে। পরে মিত্রবাহিনীর। সহযােগিতায় ৩টি ট্যাংকসহ পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করানাে হয়।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড