You dont have javascript enabled! Please enable it!
চিত্তরা গ্রাম আক্রমণ
চৌদ্দগ্রাম থানায় চিত্তরা গ্রাম অবস্থিত। পাকিস্তানিদের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল জগন্নাথদিঘিতে। ২৩ আগস্ট মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বে ১টি দল এ ঘাটির ওপর আক্রমণ চালায়। চিত্তরা গ্রামে শত্রুদের অবস্থানের ওপরও তিনি আক্রমণ চালান। এ আক্রমণের ফলে চিত্তরা গ্রামে অবস্থিত শত্রুরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং ২৪জন নিহত হয়। জগন্নাথদিঘিতে ৪টি বাংকার মুক্তিবাহিনী ধ্বংস করে ফেলে। নয়াপুর রেল স্টেশনে শত্রুদের ওপর ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘এ’ ও ‘সি’ কোম্পানি তাদের চাপ আরও জোরদার করে। কোম্পানি ২টি যৌথভাবে স্টেশনের উত্তর। ও দক্ষিণ দিক থেকে মর্টার ও ১০৬ মিলিমিটার আরআর নিয়ে পাকিস্তানিদের ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানিদের বেশ কয়েকটি শক্র বাংকার বিধ্বস্ত হয়। এ আক্রমণ সফল হয় এবং পাকিস্তানিরা এ আক্রমণের জবাব না দিয়ে পালিয়ে যায়। ৩০ আগস্ট সকালে পাকিস্তানিদের ১টি শক্তিশালী দল লাকসাম থেকে চৌদ্দগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সারা দিন ধরে যুদ্ধ চলে। পাকিস্তানিরা পার্শ্ববর্তী সমস্ত গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। এ দিনের যুদ্ধে ২০জন শত্রু নিহত এবং অনেকে আহত হয়। মুক্তিবাহিনী চৌদ্দগ্রাম-লাকসাম সড়কের ৮০ ফুট রাস্তা উড়িয়ে দেয়। ফলে চৌদ্দগ্রাম-লাকসাম যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঐদিন মুক্তিবাহিনী বিবির বাজারের কাছে পাকিস্তানিদের টহল জিপ মাইনের সাহায্যে উড়িয়ে দেয়। এতে ১জন ক্যাপ্টেনসহ ৩জন শত্ৰু নিহত হয়।
চালনা অভিযান
ব্রাহ্মণপাড়া থানায় চালনা একটি দুর্গম গ্রাম। এখানে রয়েছে কাঁচা রাস্তা ও উঁচু। ব্রিজ কালভার্ট। ৩০ আগস্ট ভারতের কোনাবন ক্যাম্পে সুবেদার ওহাবের সাথে । দেখা করতে আসেন ৩জন লােক। এঁদের মধ্যে ১জন চালনার ছিদ্দিক মেম্বার। তারা জানালেন বড়দুষিয়া গ্রামের দক্ষিণ ও পশ্চিমের গ্রামগুলােয় পাকিস্তানি মিলিটারি এসেছে। বড়দুষিয়া গ্রামটি যে-কোনাে মুহূর্তে পাকিস্তানিদের দখলে। চলে যাবে। বড়দুষিয়া গ্রামের পরই চালনা গ্রামের অবস্থান। চালনা গ্রামটি ছিল ঐ এলাকার সবচেয়ে বড়াে গ্রাম। তা ছাড়া চারদিকে রয়েছে খােলা মাঠ। তাদের ভয়, পাকিস্তানিরা অবশ্যই চালনা গ্রামটি দখল করে নেবে। চালনা। গ্রামটিকে বাঁচানাের জন্য এঁরা কাকুতিমিনতি করতে থাকলেন। এ সময় বড়দুষিয়া গ্রামে প্রতিরক্ষা নিয়ে অবস্থান করছিলেন ৪র্থ ইস্ট। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার নজরুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন ১টি দল। এঁদের। বিশ্বাস, সুবেদার নজরুল পাকিস্তানিদের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে পারবেন না। সুবেদার ওহাব ছিদ্দিক মেম্বারকে সাথে নিয়ে কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন।
গাফফারের সাথে দেখা করে চালনা গ্রামে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তার সাথে ৩ ইঞ্চি মর্টারের ডিটাচমেন্টটি দেওয়ার অনুরােধ জানান। ক্যাপ্টেন গাফফার এতে সম্মতি দিলেন। ১ অক্টোবরে সকালের দিকে সুবেদার ওহাব তার ৭ নম্বর প্লাটুনের ৫০জন। সৈনিক এবং মর্টার ডিটাচমেন্টের ৭জন সৈনিকসহ মােট ৫৭জন সেনা সদস্যের দলটি নিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ চালনা গ্রামে পৌছান। চালনা গ্রামের মাঝখানে ছিল। ভূইয়াবাড়ি। সুবেদার ওহাব ভূইয়াবাড়িতেই তার সদর দপ্তর স্থাপন করেন। এ গ্রামটি ছিল খুবই বড়াে। তাই সেকশন অধিনায়ককে সাথে নিয়ে গ্রামটির। চারদিকে ঘুরে তাদের নিজ নিজ সেকশন এলাকার প্রতিরক্ষা অবস্থান দেখিয়ে। দেন। রাতের মধ্যেই প্রতিটি সেকশনের নিজ নিজ অবস্থানে পৌঁছে যাওয়ার নির্দেশ দেন। ঐ রাতে সময় কম থাকায় পরদিন সকাল থেকেই সবাইকে । মজবুত বাংকার খননের সাহায্যে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিতে বলে দেন। ঐ রাতে। ১ নম্বর সেকশনটিকে চালনা গ্রামের দক্ষিণে চাবিপাড়া গ্রামকে সামনে রেখে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিতে বলা হয়েছিল।
চাবিপাড়া গ্রামের দক্ষিণেই ছিল বড়দুষিয়া গ্রামটি। ১ নম্বর সেকশন ব্যতীত অন্য সেকশনগুলাে বাংকার খননের সাহায্যে ঐ রাতে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিতে পারেনি। মর্টার ডিটাচমেন্টের লােকজনকে ভূইয়াবাড়ির তিন দিক ঘিরে অবস্থান নিতে নির্দেশ দেওয়া হলাে। উদ্দেশ্য, পরদিন দিনের বেলায় এরা নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে বাংকার খননের সাহায্যে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেবে। ২ অক্টোবর। তখন ভাের ৪টার মতাে হবে। চালনা গ্রামের উত্তর-পশ্চিম। দিকের পাড়া থেকে এক লােক এসে খবর দিলেন যে, তাঁদের বাড়িতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর লােকজন নৌকায় করে এসে উঠেছে এবং চালনা গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। লােকটি এ সংবাদ দেওয়ার পর পরই পাকিস্তানিদের ঐ দলটিকে ওপরের দিকে গুলিবর্ষণ করে চালনা গ্রামে মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি জানিয়ে দিল। সুবেদার ওহাব তার কর্তব্য ঠিক করে নিলেন। ত্বরিত সবাইকে নিজ নিজ এলাকা বণ্টন করে দিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থানে চলে যেতে নির্দেশ দিলেন। নিজে ৩ নম্বর সেকশনটি নিয়ে শত্রুর অবস্থানের পূর্ব দিকে গিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিলেন। শত্রুর অবস্থান যাচাই করে এমনভাবে প্রতিরক্ষা অবস্থানগুলাের রদবদল ঘটান, যাতে শত্রুর যে দলটি ইতােমধ্যে চালনা গ্রামে পৌছে গেছে, তারা যাতে পালাতে না পারে। তা ছাড়া নতুন কোনাে শত্রু সেনাদলও যাতে নৌকায় করে চালনা গ্রামে পৌছাতে না পারে, সেদিকে লক্ষ্য রেখে এমজি, এলএমজি, রকেট লঞ্চার এবং ২ ইঞ্চি মর্টারের অবস্থানগুলাে ঘুরে ঘুরে দেখিয়ে দিলেন। ২ অক্টোবর ভাের ৪টার মতাে হবে। সুবেদার ওহাব পূর্বনির্ধারিত পিস্তলের গুলি নিক্ষেপের মাধ্যমে শক্রর অবস্থানের ওপর একযােগে আক্রমণের সংকেত দিলেন। শুরু হলাে ব্যাপক গােলাগুলি নিক্ষেপ। শক্রর অবস্থান সুবেদার ওহাবের অবস্থানগুলাের ৭০ গজের মধ্যেই ছিল। ৩ ইঞ্চি মর্টারটিও কার্যকরভাবেই গােলা নিক্ষেপ শুরু করলাে।
সে এক ভয়াবহ সম্মুখযুদ্ধ। শত্রুপক্ষ সিগন্যাল সেটের মাধ্যমে তাদের অবস্থান জানালে কিছুক্ষণের মধ্যেই কালাডুমুরিয়া ব্রিজ এলাকা থেকে ব্যাপক মিডিয়াম আর্টিলারির গােলা চালনা গ্রামের দিকে আসতে শুরু করলাে। কিন্তু গােলাগুলাে গ্রাম ছেড়ে ধানক্ষেতে পানিতে পড়তে থাকলাে। শক্রর অবস্থান ও সুবেদার ওহাবের অবস্থান এতই নিকটবর্তী ছিল যে আর্টিলারির গােলাগুলাে চালনা গ্রামে ফেলতে গেলে নিজ পক্ষের সৈন্যদের হতাহতের সমূহ আশঙ্কা ছিল। অভিজ্ঞ সুবেদার ওহাবের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, শত্রু নিতান্তই ভয় দেখানাের জন্য আর্টিলারির গােলা নিক্ষেপ করছে। ৩ অক্টোবরে ভােরের আলাে দেখার আগেই চালনা গ্রামটি সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়ে পড়েছিল। সুবেদার ওহাব চালনা গ্রামবাসীকে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, নারী নির্যাতন, লুটপাট, বাড়িঘরগুলাে পুড়িয়ে ছাই ভস্ম করে দেওয়া থেকে রক্ষা করতে পেরেছেন ভেবে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায়। করলেন। ৪ অক্টোবর সকাল থেকেই অভিজ্ঞ সুবেদার ওহাব পাকিস্তানিদের ১টি ব্যাপক হামলার অপেক্ষায় ছিলেন। চারদিকে নৌকায় করে সংবাদ সংগ্রহের জন্য লােক পাঠালেন। সংবাদ পেলেন যে, পাকিস্তানিদের ৩ কোম্পানি শক্তিসম্পন্ন ১টি বিরাট বাহিনী ৩ দিক থেকে চালনা গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছে। বিনা বাধায় চালনা গ্রামের অবস্থান ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ছিলেন না। সুবেদার ওহাব। সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বললেন। নিরাপদে কোনাবনে পৌছার। জন্য গ্রামের পূর্বকোণে পর্যাপ্তসংখ্যক নৌকা রাখলেন । সকাল ১০টা থেকেই শুরু হলাে একটানা শত্রুর আর্টিলারির গােলা। নিক্ষেপ। আর্টিলারির গােলা নিক্ষেপের ব্যাপকতা এমনই ছিল যে, মনে হচ্ছিল। গােলার আঘাতে গ্রামটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
১টি গােলা এসে পড়লাে। ভূইয়াবাড়িতে ৩ ইঞ্চি মর্টারের অবস্থানটির ওপর। মর্টার অপারেটর সিপাহি আজাহার আলীর দেহটি গােলার আঘাতে টুকরাে টুকরাে হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। মর্টার অবস্থানের পাশেই অবস্থানকারী সিপাহি আব্দুল সাত্তারও গুরুতর আহত হলেন। ৩ ইঞ্চি মটারটি গােলার আঘাতে অকেজো হয়ে পড়লাে। আর্টিলারির গােলা নিক্ষেপ বন্ধ হওয়ার পর পরই শক্রর অগ্রগামী দলটিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। ৭০-৭৫ গজের মধ্যে শত্রুর নৌকাগুলাে আসা মাত্রই সুবেদার ওহাবের বাহিনী গুলি ছুড়তে শুরু করল। নৌকাগুলাের কয়েকটিকে গুলির আঘাতে ঝাঝরা হয়ে ধানক্ষেতে ডুবে যেতে দেখা গেল। ব্যাপক হতাহতের পর শত্রুদের বুকপানিতে নেমে মাঠের ধান ও পাটগাছের আড়াল নিয়ে অগ্রসর হতে দেখা গেল। অন্য দুই দিক থেকে যারা আসছিল, তাদেরও নৌকা ছেড়ে পানিতে নেমে পড়তে দেখা গেল। শত্রু যে-কোনাে ক্ষতির বিনিময়ে হলেও চালনা গ্রামে যে উঠে পড়বে, তা বুঝতে সুবেদার ওহাবের অসুবিধা হলাে না। চালনা গ্রামে একটানা যুদ্ধ করার পর সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সুবেদার ওহাব তার বাহিনীকে অবস্থান ছেড়ে কোনাবনের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার নির্দেশ দিলেন। পিছু হটার কাজটি ধাপে ধাপে সম্পন্ন করলেন। শত্রু যাতে কোনােভাবেই বুঝতে না পারে, সে জন্য একটি দলকে গুলিবর্ষণের কাজে। নিয়ােজিত রাখলেন। রিয়ার পার্টির এ ক্ষুদ্র দলটির সাথে সুবেদার ওহাব থেকে গেলেন। সবাইকে নিরাপদ দূরত্বে পাঠিয়ে দেওয়ার পরই সুবেদার ওহাব ১০জনের এ দলটি নিয়ে দ্রুতগতিতে চালনা গ্রামের অবস্থান ত্যাগ করলেন। কোনাবনে সন্ধ্যার মধ্যেই সবাই ফিরে গেলেন। কিন্তু ফিরলেন না সিপাহি আজাহার আলী। তাঁকে ভূইয়াবাড়ির কবরস্থানেই দাফন করা হয়েছিল। গুরুতর আহত সিপাহি সাত্তারের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলাে। আর এরই মধ্য দিয়ে শেষ হলাে ৩ দিনব্যাপী চালনা গ্রামের অপারেশন।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!