হাসনাবাদ পাকিস্তানি ঘাঁটি আক্রমণ
লাকসাম থানার অধীনে হাসনাবাদ নামক জায়গায় পাকিস্তানি বাহিনী একটি ঘাঁটি তৈরি করে। তাদের সঙ্গে বেশ কিছুসংখ্যক রাজাকারও ছিল। এ ক্যাম্প থেকে তারা চাদপুর-লাকসাম-কুমিল্লা রাস্তায় অনবরত টহল দিয়ে বেড়াত। ফলে চাঁদপুর এবং দক্ষিণ ঢাকা ও ফরিদপুরে অনুপ্রবেশকারী মুক্তিযােদ্ধা গেরিলাদের জন্য মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। এ ঘাঁটিটি ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য। ক্যাপ্টেন মাহবুবকে নির্দেশ দেওয়া হয়। ক্যাপ্টেন মাহবুব এ ঘাটি সম্পর্কে পুরােপুরি সংবাদ সংগ্রহ করেন। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানি ও গেরিলাসমন্বিত একটি শক্তিশালী দল লাকসাম এলাকায় অনুপ্রবেশ করে এবং পরদিন শক্রদের হাসনাবাদ ঘাটির ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে। ফলে প্রায়। ২৫জন শত্রু ও ৩০জন রাজাকার নিহত হয়। শত্রুরা ক্যাম্প ছেড়ে কুমিল্লার দিকে পালিয়ে যায়। হাসনাবাদ অবস্থান থেকে অনেক অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে আসে। এ সংঘর্ষের ১দিন পর মুক্তিযােদ্ধাদের দলটি হাজিগঞ্জে অবস্থিত রাজাকারদের ১টি বিরাট ট্রেনিং ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়ে ৩০জন রাজাকারকে হত্যা করে। এর ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রবেশ পথটি আবার বিপদমুক্ত হয়।
আমড়াতলী, কৃষ্ণপুরের যুদ্ধ
গােমতী নদীর উত্তর পারে আমড়াতলী ও পাঁচথুবি ইউনিয়ন দুটি সীমান্তসংলগ্ন। সীমান্তের অপর পারে ছিল মতিনগর ও কোনাবল ট্রেনিং ক্যাম্প। তাই এ দুটি ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল প্রায়ই পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ চালাতাে। ১০ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানিরা ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৪০০ জনবল নিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করে। পাঁচথুবি ইউনিয়নের সীমান্তসংলগ্ন কৃষ্ণপুর ও ধনঞ্জয় গ্রামে পাকিস্তানিদের সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন দিদারুল আলম। তাকে সহযােগিতা করেন যুদ্ধকালীন থানা অধিনায়ক আবদুল মতিন। মুক্তিযােদ্ধারা সংখ্যায় ছিলেন ৭০৮০জন। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরােদিন যুদ্ধ চলে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানিদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলেও মুক্তিবাহিনীর কোনাে গেরিলা হতাহত হয়নি। তবে মুক্তিযােদ্ধারা চলে গেলে রাতের দিকে পাকিস্তানিরা ধনঞ্জয় গ্রামের একটি বাড়িতে আশ্রয়গ্রহণকারী প্রায় ৩০-৪০জন পুরুষ-মহিলাকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। যাদের পরে মুক্তিবাহিনী গ্রামের লােকজনের সহায়তায় খন্দকারবাড়ির গােবর ফেলার গর্তে মাটি চাপা দিয়ে গণকবর দেয়। তাদের মধ্যে ২৮জনের নাম জানা গেছে।
চান্দিনার যুদ্ধ
শত্রুরা কসবায় বিপর্যস্ত হওয়ার পর কুমিল্লা থেকে চান্দিনা থানার কাছে সৈন্য সমাবেশ করে। শত্রুদের এ সমাবেশের মূল কারণ ছিল মন্দভাগকে পুনর্দখল করা। ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানি এ সময় মন্দভাগের প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত ছিল। ১৮ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৩টায় শত্রুরা প্রায় ১ কোম্পানি শক্তি নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরক্ষার ওপর আক্রমণ চালাতে শুরু করে। প্রায় ৩ ঘন্টা যুদ্ধের পর সকাল সাড়ে ৬টা পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধারা এ আক্রমণকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। শক্ররা প্রতিহত হয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরক্ষাব্যুহের সামনে থেকে গােলাগুলি চালাতে থাকে। বেলা ১০টার সময় শত্রুরা আরও ২টি কোম্পানি। নিয়ে দুই বার আক্রমণ চালায়। শক্রর এ শক্তিশালী দলগুলো গােলন্দাজ। বাহিনীর সহায়তায় প্রবল বাধার মাঝে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। অগ্রসর হওয়ার সময় মুক্তিবাহিনীর গুলিতে তাদের অনেকে হতাহত হয়। অবশেষে শত্রুরা মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরক্ষাব্যুহ ভেদ করতে সক্ষম হয়। প্রায় ২ ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর দুর্ধর্ষ সৈনিকেরা তাদের প্রতিরক্ষাব্যুহ প্রবেশকারী শত্রুদের সাফল্যের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে পর্যদস্ত করতে সক্ষম হয়।
পাকিস্তানি সেনারা তাদের মৃতদেহ ফেলে রেখেই পলায়ন করতে বাধ্য হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরক্ষাব্যুহের চতুর্দিকের কর্দমাক্ত নিম জলাভূমি দিয়ে পালানাের পথে তারা আরও অধিকভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। মুক্তিবাহিনী এ যুদ্ধে ৩৩ বালুচ রেজিমেন্টের সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পাতেজ খানসহ ৮জন শক্রকে বন্দি করে। এ ছাড়া অফিসারসহ প্রায় ৫০জন শত্ৰু নিহত হয়। ৬টি এমজি এ-৩, ২০টি ৭.৬২ মিলিমিটার চাইনিজ রাইফেল, ৪টি জি-৩ রাইফেল, ১টি হালকা পিস্তল, ৫টি সাব-মেশিনগান, ১৫ বক্স মেশিনগানের গুলি, ৩১টি ৯৪ এলাগা গ্রেনেড, ২০টি ৩৬ এইচই গ্রেনেড, ১০টি এমএম বােমা, অনেক বেয়নেট, বেশ কিছু জি-৩ রাইফেলের ম্যাগাজিন, ১৫টি বিভিন্ন দলিলপত্রসহ বেশকিছু ফাইল মুক্তিবাহিনী দখল করে নেয়। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ৫জন সৈনিক গুরুতর আহত হন, তবে কেউ শহিদ হন নি।
গােবিন্দমানিক্যের দিঘি রেইড
চৌদ্দগ্রাম থানায় গােবিন্দমানিক্যের দিঘি অবস্থিত। বাতিসা ও গৌবিন্দমানিক্যের দিঘিতেও শত্রুদের দুটি ঘাঁটি ছিল। ১৯ সেপ্টেম্বর ঘাঁটিগুলাের ওপর লেফটেন্যান্ট ইমাম-উজ-জামানের দল আক্রমণ করলে ২টি বাংকার ধ্বংস হয়, ৬জন শত্ৰু নিহত এবং ২জন মুক্তিযােদ্ধা আহত হন। ২৩ সেপ্টেম্বর লেফটেন্যান্ট ইমাম-উজ-জামানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী আবার গােবিন্দমানিক্যের দিঘিতে অবস্থিত পাকিস্তানিদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাদের ১৫জন নিহত ও ১০জন আহত হয়। ৪ অক্টোবর চৌদ্দগ্রামের ৫ মাইল উত্তরে হারিসর্দার বাজারে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণ চালান। এ আক্রমণে শত্রুর ৭টি বাংকার ধ্বংস হয়। ২৫জন পাকিস্তানি সৈনিক ও ৭জন রাজাকার হতাহত হয়। এ সময় মুক্তিযাদ্ধারা চৌদ্দগ্রামের ৩ মাইল দক্ষিণে ১টি সেতু ধ্বংস করে দেয়।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড