You dont have javascript enabled! Please enable it!
বালুজুরি ভাঙা পুলে অ্যামবুশ
চৌদ্দগ্রাম থানায় বালুজুরি ভাঙা পুল অবস্থিত। ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানির ১টি প্লাটুন চৌদ্দগ্রাম এলাকায় শত্রুদের বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। শত্রুরা কুমিল্লা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক খােলার জন্য তাদের প্রচেষ্টা দিন দিন বাড়িয়ে যাচ্ছিল। যে-সব সড়ক ও সেতু মুক্তিযােদ্ধারা ধ্বংস করে দিয়েছিলেন, সেগুলাে পুনর্নির্মাণ করার চেষ্টা করছিল। ৯ জুলাই সকাল ৮টায় মুক্তিবাহিনীর প্লাটুনটি চৌদ্দগ্রামের উত্তরে সড়কের ওপর বালুজুরি ভাঙা পুলের কাছে অ্যামবুশ পাতে। সকাল ১১টার সময় শত্রুরা ১টি SRB ট্রাক এবং ২টি জিপে করে রাস্তা দিয়ে আসে এবং ভাঙা পুলের কাছে থামে। পুলটি মেরামত করার কাজের প্রস্তুতি চলতে থাকে। ঠিক সে সময় মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশ পার্টি তাদের ওপর গুলি চালাতে থাকে। এর ফলে শত্রুদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। অ্যামবুশ পার্টির গুলিতে তাদের অনেক লােক হতাহত হয়। শত্রুরা পুলের কাছ থেকে পিছু হটে অবস্থান নেয় এবং পরে চৌদ্দগ্রাম থেকে আরও শক্র এসে তাদের সঙ্গে যােগ দেয়। এরপর শক্ররা মুক্তিযােদ্ধাদের অ্যামবুশ অবস্থানের ওপর আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। মুক্তিযােদ্ধাদের দলটিও একটু পিছু হটে উঁচু জায়গায় আরও শক্ত অবস্থান গড়ে তােলে। শত্রুপক্ষ বিকাল ৩টার সময় মর্টার, কামান, মেশিনগানের সহায়তায় মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ করে। মুক্তিযােদ্ধাদের দলটি সাহসিকতার সাথে এ আক্রমণ মােকাবিলা করে। মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিতে শক্ররা। পর্যুদস্ত হয়ে ৩-৪ ঘণ্টা প্রচণ্ড যুদ্ধের পর বিকাল ৫টায় আক্রমণ পরিত্যাগ করে। পিছু হটে যায়। যুদ্ধে শক্রদের ৩০জন নিহত ও ৬জন আহত হয়।
যুদ্ধক্ষেত্রের চারদিকে মৃতদেহগুলাে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ফেলে রেখে তারা পালিয়ে যায়। শত্রুরা পিছু হটার পর মুক্তিযােদ্ধাদের দলটি অনেক অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নেয় এবং শক্রদের ক্ষস্তি ট্রাকটিও নিয়ে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু ট্রাকটির এত বেশি ক্ষতি হয়েছিল যে সেটি আনা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ট্রাকটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। শত্রুদের যে ২জন দালাল যুদ্ধের সময় পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল, তারাও গুলিবিদ্ধ হয়। শত্রুরা পিছু হটে যাওয়ার পর মুক্তিযােদ্ধাদের দলটি তাদের ২৩টি প্যাট্রল ও পর্যবেক্ষণ ঘাটিতে অবস্থিত শক্রদের তাড়িয়ে দেয় বিকাল সাড়ে ৪টার সময় শক্রদের ১টি জঙ্গিবিমান যুদ্ধক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ করে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের দলটিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের দলটি সেখান থেকে একটু দূরে সরে যাওয়ায় জঙ্গিবিমানটি কিছুক্ষণ ঘােরাফেরা করে ফেরত চলে যায়।
ফান্ধুনকরের অ্যামবুশ
চৌদ্দগ্রামের ২-৩ কিলােমিটার দক্ষিণে ফান্ধুনকর অবস্থিত আগস্টের ৭-৮ তারিখ মুক্তিযােদ্ধারা লক্ষ্য করেন যে, প্রতিদিন শত্রুর ৪-৫টি লরি ফেনী থেকে চৌদ্দগ্রাম থানায় যায়। গাড়িগুলাে চলাচলের সময় ছিল বেলা ১১টা-১২টা। চলাচলের সময় গাড়িগুলাের সামনে ১ট সাদা জিপ থাকে। ক্যাপ্টেন আবু জাফর মােহাম্মদ আমিনুল হক, লেফটেন্যান্ট ইমাম-উজ-জামান, সুবেদার মেজর ইদ্রিস মিয়া, সুবেদার মাহবুব, সুবেদার সুলতান, গণযােদ্ধা আফজাল খান এবং আরও প্রায় ৪০জন মুক্তিযােদ্ধা এ তথ্য বিভিন্ন সময়ে রেকির মাধ্যমে নিশ্চিত করেন। তারা এটাও নিশ্চিত হন যে, গাড়িগুলাে বিকাল ৩টার মধ্যে আবার একই পথে ফেরত আসে। তারা অন্ধকার রাতে রাস্তার ওপর অবস্থিত একটি ছােটো কালভার্টের উভয় পাশে অ্যান্টি-পার্সোনাল ও অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন স্থাপন করে রাস্তার পূর্ব পাশে সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় অ্যামবুশ অবস্থান গ্রহণ করে। পরদিন ভােরে তারা অ্যামবুশ অবস্থান আরও কাছে নিয়ে যান। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ১টি সাদা জিপ ও ৫টি ৩ টনি লরি ধীর গতিতে আসতে দেখা যায়। গাড়িগুলাের মধ্যে। দূরত্ব ছিল ২৫-৩০ গজ। সামনের সাদা জিপটি কালভার্টের কাছে আসতেই মাইনের ওপর পড়ে। বিকট শব্দে এবং প্রচণ্ড ধুলা উড়িয়ে জিপটি মুহূর্তেই শূন্যে উঠে যায়। সাথে সাথেই পেছনের সব গাড়ি থেমে যায়।
লরিগুলাে থেকে শত্রু সৈন্যরা নেমে রাস্তার ওপরে (পশ্চিম দিকে) অবস্থান। নিয়ে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ শুরু করে। একপর্যায়ে তারা ক্রলিং করে রাস্তা পার হয়ে  গুলি ছুড়তে ছুড়তে মুক্তিযােদ্ধাদের অ্যামবুশ অবস্থানের দিকে আসতে থাকে। তাদের এগিয়ে আসা দেখে বােঝা যায়, তারা মুক্তিযােদ্ধাদের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করতে পারেনি। এ অবস্থায় তাদের প্রচুর হতাহত হতে থাকে। এ সময় ক্যাপ্টেন আমিনুল হক জমির উচু আইলের নিচ দিয়ে পশ্চাদপসরণের আদেশ দেন। গণযােদ্ধা আফজাল খান শত্রুর ওপর গুলিরত অবস্থায় এ আদেশ শুনতে না পেয়ে তার অবস্থানে রয়ে যান। সীমান্ত কয়েক’শ গজ দূরে হওয়ায় তারা। সহজেই সীমান্ত অতিক্রম করেন। শত্রু অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে আফজাল খানের দিকে এগিয়ে আসে। আফজাল খান নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান এবং সীমান্ত অতিক্রম করেন। পরদিন ক্যাপ্টেন আমিন ও আফজাল খান উঁচু গাছে ওঠে শত্রুর কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করেন। শক্ত প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে তখন গােটা বসন্তপুর গ্রাম আগুনে জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
শাহপুরের যুদ্ধ
বিবির বাজারের উত্তরে গােমতী নদীর পশ্চিম প্রান্তে সীমান্তবর্তী গ্রাম শাহপুর  পাকিস্তানিরা বিবির বাজার প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে সীমান্তবর্তী ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্যাট্রলিং করতাে। ১৩ আগস্ট রাতে লেফটেন্যান্ট কবির ধনপুর ক্যাম্পে মুক্তিযােদ্ধাদের ডেকে বলেন যে আগামীকাল ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। এ দিন ওদের আক্রমণ করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে তিনি প্রায় ১২০জনের ১টি বড়াে দল তৈরি করেন। ধনপুর থেকে ২টি বড়াে ট্রাকে করে প্রায় ২০ কিলােমিটার উত্তরে ভারতের সােনামুড়ার পশ্চিমে সীমান্ত এলাকায় তারা অবতরণ করে। সে সময় ভারতীয় ভূখণ্ডের ভেতর অবস্থিত মসজিদে ফজরের আজান ধ্বনিত হচ্ছিল। পশ্চিমে বাংলাদেশের ভেতর শাহপুর গ্রাম, শত্রুর বিবির বাজার প্রতিরক্ষা অবস্থানের উত্তর দিকে মুক্তিযােদ্ধারা ৩টি পাটুনে বিভক্ত হয়ে গােমতী নদীর উত্তরে বাঁধের ওপর অবস্থান নেন। এমন সময় শত্রুর ১জন সৈনিককে বাংকার থেকে বেরিয়ে এসে খােলা জায়গায় ফজরের আজান দিতে দেখা যায়। পর পরই অন্য সৈনিকেরা নামাজের জন্য জড় হতে থাকে। প্রায় ১০জন শত্রু নামাজে দাড়িয়ে যায়। এরা সবাই তখন মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্রের কার্যকর দূরত্বের মধ্যে। এমন সময় ১জন মুক্তিযােদ্ধা মুজিবুল হক তার মাঝারি মেশিনগান দিয়ে নামাজরত শত্রুর ওপর গুলি করতে উদ্যত হন।
অন্যরা তাকে নামাজরত শত্রুর ওপর গুলি করা থেকে বিরত রাখেন। তারপর ১৫-২০ মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর ১জন ২জন করে শত্রুর সৈন্য নীচে নদীর পানির কাছে নেমে আসে। একপর্যায়ে তাদের সংখ্যা ২৫-২৬জনে উন্নীত হয়। এ মােক্ষম সময়ে মুক্তিযােদ্ধারা অবিশ্রান্ত ধারায় গুলিবর্ষণ শুরু করেন। শত্রুর ১-২জন ছাড়া কেউ বাচেনি। এ অবস্থায় শত্রুর মূল প্রতিরক্ষা থেকে তাদের সব অস্ত্রের ফায়ার আসতে থাকে। তাদের। আর্টিলারি ও মর্টার ফায়ার মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর পড়তে শুরু করে। মুক্তিযােদ্ধারা তখন ফায়ারিং বন্ধ করে দেন এবং দৃষ্টির আড়ালে গিয়ে পশ্চাদপসরণ শুরু করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের পেছনে সীমান্ত ঘেঁষে পাহাড়ের ওপর ছিল বিএসএফ ক্যাম্প। সেখান থেকে তাঁরা দুরবিন দিয়ে এবং খালি চোখে এ মনােমুগ্ধকর দৃশ্য অবলােকন করছিল। তাদের ১জন নায়েব সুবেদার এসে মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে। জানতে চান, তাঁদের অধিনায়ক কে? তারা বলেন যে, তাদের অধিনায়ক কর্নেল উপেন্দ্র পাল সিং। মুক্তিযােদ্ধাদের অধিনায়ক এবং সবাইকে তাঁর ক্যাম্পে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
লেফটেন্যান্ট কবির কর্নেল উপেন্দ্রর ক্যাম্পে গেলে তিনি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তিনি বলেন যে, তিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধাদের এ যুদ্ধ সচক্ষে অবলােকন করেছেন। মুক্তিযােদ্ধাদের সাহস ও যুদ্ধকৌশল দেখে তিনি মুগ্ধ। বিশেষ করে নামাজরত শত্রুর ওপর গুলি না করার চালাকি আচরণ দেখে তিনি অভিভূত হয়েছেন। তিনি তখন মুক্তিযােদ্ধাদের দুপুরের খাবারে তার মেহমান হওয়ার আহ্বান জানান। পােলাও, মাংসসহ অন্যান্য উপাদেয় খাবারে তিনি তাদের আপ্যায়ন করেন। পরে তিনি বিএসএফ-এর গাড়িতে সব। মুক্তিযােদ্ধাদের ধনপুরে পৌছে দেন।
আপানিয়া পুল ধ্বংস
লাকসাম থানায় আপানিয়া পুল অবস্থিত। ১৬ আগস্ট পুনরায় পাকিস্তানিদের দ্বারা মেরামত করা আপানিয়া পুলটি নায়েক শহিদ ধ্বংস করে লাকসামনােয়াখালী যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। ২৬ আগস্ট মিলিশিয়া ও রাজাকার বাহিনীর ১টি বিরাট দল আমিনবাজার থেকে আমিশাপাড়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, এ খবর পাওয়ার পর মুক্তিযােদ্ধারা তাদের চতুর্দিক দিয়ে ঘেরাও করার পরিকল্পনা করেন। সুবেদার ওয়ালীউল্লাহ  ত্রিমুখী আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেন এবং সুবেদার লুৎফর রহমান ১ প্লাটুন। জনবল নিয়ে পেছন দিক থেকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। শত্রুরা আমিন বাজারের দিকে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে সুবেদার ওয়ালীউল্লাহ ত্রিমুখী আক্রমণ শুরু করে। ফলে শত্রুরা পিছু হটতে থাকে। সুবেদার লুৎফর রহমান পেছন থেকে আক্রমণ করেন। আক্রমণ চারদিক থেকে চলতে থাকে। কাজেই শত্রুরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এদিকে জনসাধারণ ছত্রভঙ্গ হয়ে চারদিকে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে গােলাগুলি করা বিরাট প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এ সুযােগে শত্রুরা হাতের অস্ত্র ফেলে জনসাধারণের মধ্যে মিশে যায় এবং অনেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ৬জন রাজাকার নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়। রাজাকারদের লাশ কাচিহাটিতে দাফন করা হয়। রাজাকার মিজানুর রহমান। অক্ষত অবস্থায় অস্ত্রসহ মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। তার কাছে থেকে শক্রদের অনেক গোপন তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এখানে কয়েকটি চাইনিজ রাইফেলও মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!