You dont have javascript enabled! Please enable it!
বিজয়পুর সেতু ধ্বংস
লাকসাম থানায় কুমিল্লা-লাকসাম সড়কে বিজয়পুর সেতু অবস্থিত। জুন মাসের মাঝামাঝি লেফটেন্যান্ট মাহবুব ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানি থেকে ১টি প্লাটুনকে শত্রুদের যাতায়াতের রাস্তা ধ্বংস করার জন্য কুমিল্লার দক্ষিণে প্রেরণ করেন। এ দলটি ১৮ জুন সন্ধ্যা ৬টায় কুমিল্লা-লাকসামের বিজয়পুর রেলসেতু এবং কুমিল্লার বাগমারা রােডের সেতু উড়িয়ে দেয়। এ সেতুগুলাে ধ্বংসের ফলে কুমিল্লার দক্ষিণে সড়ক ও রেলওয়ে যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। ঐ দিনই দলটি বিজয়পুর ও মিয়াবাজারের কাছে কয়েকটি ইলেকট্রিক পাইলন উড়িয়ে কাপ্তাই থেকে ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। শত্রুদের ১টি প্লাটুন সন্ধ্যার সময় চৌয়ারার কাছে প্যাট্রলিংয়ে আসে। শত্রুর এ দলটিকে। অ্যামবুশ করলে ২জন শত্রু নিহত হয়। শত্রুরা পরে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলাে জ্বালিয়ে দেয় এবং অত্যাচার চালায়।
মিয়াবাজার রেইড
চৌদ্দগ্রাম থানায় মিয়াবাজার অবস্থিত। কুমিল্লা-ফেনী সড়কটি চৌদ্দগ্রামের ওপর দিয়েই চট্টগ্রাম গিয়ে পৌঁছেছে। এ থানাতেই মিয়াবাজার অবস্থিত। মুক্তিবাহিনীর প্যাট্রল পার্টি খবর আনে যে, পাকিস্তানিদের প্রায় ১ কোম্পানি সৈন্য মিয়াবাজারের উত্তরে ১টি গােডাউনের মধ্যে অবস্থান করছে। প্যাট্রলটি এ গােডাউনটিতে পৌছানাের গােপন রাস্তা, পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও অন্যান্য বিস্তারিত খবর নিয়ে আসে। এ সংবাদ পেয়ে লেফটেন্যান্ট মাহবুব ৩৩জনের ১টি কমান্ডাে প্লাটুনকে ব্লেন্ডিসাইড ও মর্টারসহ রাত ৯টায় গুদামটি আক্রমণ করার জন্য পাঠিয়ে দেন। এ কমান্ডাে দলটি রাত ১২টার সময় শত্রু অবস্থানের কাছে পৌছে যায়। তারা ১টি ছােটো দল পাঠিয়ে অবস্থানটির সর্বশেষ খবর নেয় এবং জানতে পারে পাকিস্তানি সেনারা অবস্থানটিতে বেশি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়নি। রাত ১টায় মুক্তিবাহিনীর কমান্ডাে প্লাটুনটি অতর্কিতে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের ভেতর অনুপ্রবেশ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানিদের ওপর হালকা অস্ত্রের সাহায্যে গুলি চালাতে থাকে। পাকিস্তানিরা অনেকেই গুলিতে হতাহত হয়। তারা মুক্তিযােদ্ধাদের কমান্ডাে প্লাটুনের ওপর পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করে কিন্তু তা ব্যর্থ হয়ে যায়। ১৮ জুন রাত ৯টায় মিয়াবাজারের দক্ষিণে মুক্তিবাহিনীর আরেকটি প্লাটুন। পাকিস্তানিদের ২টি বাংকারের ওপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে ৭জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। পাকিস্তানি সেনারা এরপর সমস্ত রাত অবিরাম মর্টারের গােলা ছুড়তে থাকে। মুক্তিবাহিনীর এ দলটি খিলা’ রেলওয়ে স্টেশনের কাছে কয়েকটি ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন পুঁতে রাখে। পাকিস্তানিদের ১টি জিপ রাতে ঐ রাস্তায় যাওয়ার পথে মাইনের ওপর পড়লে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয় এবং ৫জন পাকিস্তানি নিহত হয়।
মন্দভাগ রেইড
সদর থানায় মন্দভাগ অবস্থিত। ১৯ জুলাই পাকিস্তানিদের ৩১ বালুচ । রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি শালদা নদী দিয়ে মন্দভাগের দিকে অগ্রসর হতে । থাকে। এ সংবাদ পেয়ে নায়েব সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর ১টি। প্লাটুন পাকিস্তানিদের অগ্রবর্তী দলটিকে বাধা দেওয়ার জন্য অগ্রসর হয়। সুবেদার ওহাব তাঁর প্লাটুন নিয়ে মন্দভাগ বাজারের কাছে পৌছে অতর্কিত। পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষের গুলিবিনিময়ে পাকিস্তানিদের। অন্তত ৬০জন হতাহত হয় বলে জানা যায়। | মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতায় পাকিস্তানিরা নদীতে ঝাঁপ দিলে । অধিকাংশই ডুবে মারা যায়। নিহত পাকিস্তানিদের মধ্যে ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের। অধিনায়ক কর্নেল কাইয়ুম, ৫৩ গােলন্দাজ বাহিনীর ক্যাপ্টেন বােখারী এবং আরও ৩-৪জন অফিসারসহ কয়েকজন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার ছিল বলে । পরে জানা যায়। আরও শােনা যায়, ২৫ মার্চের পর থেকে কুমিল্লা শহরে একাধিক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জঘন্যতম নায়ক ছিল এ নিহত ক্যাপ্টেন বােখারী।
মন্দভাগ রেল স্টেশন আক্রমণ
সদর থানায় মন্দভাগ রেল স্টেশন অবস্থিত। ক্যাপ্টেন গফফারের নেতৃত্বে ৩০  জুন সকালে শত্রুদের শক্তিশালী ঘাটি মন্দভাগ রেল স্টেশন আক্রমণ করা হয়।  ৫ ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলার পর দুপুর সাড়ে ১২টার সময় শত্রুরা মন্দভাগ রেল। স্টেশন ছেড়ে চলে যায়। মন্দভাগ রেল স্টেশন দখল করার পর ঐ দিনই আরও  ৪-৫টা গ্রাম মুক্ত করে নেয়। এভাবে প্রতিরক্ষাব্যুহ ডিস্ট্রিক্ট বাের্ডের রাস্তা বরাবর গড়ে তােলা হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত দুই বার শত্রুরা মুক্তিবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়, কিন্তু তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর শক্ররা অনেকবার চেষ্টা করেছিল এ এলাকা দখল করার জন্য, কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা সফল হয়নি। প্রায় ৪ লক্ষের মতাে লােক পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে পালিয়ে এসে এখানে আশ্রয় নেয়। তারা মুক্তিবাহিনীর মনােবল অনেকগুণ। বাড়িয়ে দিয়েছিল। তারা অনেক কাজে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্যও করতাে। শক্ররা মন্দভাগ রেল স্টেশন থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর তারা মন্দভাগে আশ্রয় নেয়। মন্দভাগ বাজার, আড়াইবাড়ি ও নয়নপুরে তারা সাঁজোয়া ও গােলন্দাজ বাহিনী নিয়ে আসে।
নয়নপুর রেল স্টেশনের কাছে গােডাউন আক্রমণ
সদর থানায় নয়নপুর রেল স্টেশন অবস্থিত। নয়নপুর রেল স্টেশনের কাছে। একটি গােডাউনের ভেতর শত্রুদের কিছুসংখ্যক সৈন্য তাদের ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। এ সংবাদ ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘এ’ কোম্পানি জানতে পারে। জুন মাসে মেজর সালেক ১টি প্লাটুনের সঙ্গে আরআর রাইফেল ও মর্টার দিয়ে এ ঘাটিটি আক্রমণের জন্য পাঠান। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় এ দলটি শত্রুদের অবস্থানে দক্ষিণ দিক দিয়ে পেছনে অনুপ্রবেশ করে এবং অতর্কিতে ঐ। গােডাউনের ওপর আক্রমণ চালায়। আরআর ও মর্টারের গােলা গােডাউনটির যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করে এবং কয়েকটি আরআর-এর গােলা গােডাউনের ভেতরে ফেলে বিস্ফোরণ ঘটায়। ঐদিন রাতেই হাবিলদার সালামের নেতৃত্বে নয়নপুরের রেল স্টেশনের দক্ষিণে আশাবাড়ি থেকে রাত দেড়টার সময় শক্র অবস্থানের ওপর আরআর, রাইফেল ও মর্টারের সাহায্যে আবার আক্রমণ চালানাে হয়। শক্ররা এ আক্রমণের জন্য মােটেই প্রস্তুত ছিল না, তারা দ্বিতীয়বার আক্রমণ আশা করেনি। এ আক্রমণের ফলেও শক্রদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়।
হােমনা থানা রেইড
কুমিল্লা জেলার সর্বশেষ উত্তর-পশ্চিমে হােমনা থানা অবস্থিত। হােমনা থানা শত্রুদের জন্য সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ঢাকায় যাওয়ার জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের গমন পথ ছিল হােমনা। শত্রুরা এ জন্যই দাউদকান্দি থেকে। লঞ্চযােগে হােমনায় টহল দিত। হােমনার পুলিশ দালাল ভূমিকা নিয়ে পাকিস্তানিদের বিভিন্ন খবরাখবর জানাত।  হােমনা থানা মুক্তিবাহিনীর জন্য নিরাপদ করতে হাবিলদার গিয়াস একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। অনুসন্ধান করে জানতে পারেন যে, থানায় দালাল পুলিশদের সাথে পাকিস্তানিদের সদস্যও আছে। তারা চারদিকে বাংকার খনন করেছে। কয়েকটি এলএমজিও স্থাপন করা হয়েছিল থানার চারদিকে। ১ জুলাই হাবিলদার গিয়াস তার দল নিয়ে রাত ১১টার সময় থানায় শক্রদের ওপর আক্রমণ চালান। পাকিস্তানিরা এলএমজি ফায়ারের মাধ্যমে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে পুরােপুরি ব্যর্থ হয়। যুদ্ধে থানার সবাই নিহত হয়। তাদের অস্ত্রগুলাে মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয় এবং থানাটিও শত্রুমুক্ত হয়।
মিয়াবাজার-ফুলতলী সড়কে অ্যামবুশ  
চৌদ্দগ্রাম থানার অন্তর্ভুক্ত মিয়াবাজার-ফুলতলী সড়ক। জুলাই মাস থেকে মুক্তিবাহিনী তাদের আক্রমণ আরও শক্তিশালী করে। ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত। গেরিলারা এতে যােগ দেয়। ২ জুলাই মিয়াবাজার-ফুলতলী সড়কে পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি গাড়ির ওপর আক্রমণ চালালে ৩জন অফিসারসহ ২১জন নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে ১জন লেফটেন্যান্ট কর্নেলও ছিলেন। এ খবর কুমিল্লায় । পৌছলে পাকিস্তানি বাহিনী কামানসহ অগ্রসর হয় এবং রাস্তার উভয় পাশের জনবসতির প্রচুর ক্ষতিসাধন করে। মুক্তিবাহিনী পিছু হটে যায়। | ৯ এপ্রিল শক্রদের ১টি প্লাটুন সকাল ৮টায় চৌদ্দগ্রামের উত্তর সড়কের। বালুজুরি ভাঙা পুলের কাছে এলে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি । সেনারা পুলের কাছ থেকে পিছু হটে যায় এবং পরে চৌদ্দগ্রাম থেকে আরও পাকিস্তানি সেনা এসে তাদের সাথে যােগ দেয়। এ অতিরিক্ত সৈন্যবলে বলীয়ান হয়েও পাকিস্তানিরা তেমন সুবিধা করতে না পেরে বিকাল ৫টার দিকে তারা আক্রমণাত্মক ভাব পরিত্যাগ করে পিছু হটতে থাকে। এখানে পাকিস্তানি সেনাদের আনুমানিক ৩০জন নিহত এবং ৬জন আহত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর। বহু অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
জয়পুর গ্রামে অ্যামবুশ
৬ জুলাই দাউদকান্দি থানার অন্তর্গত মাসিমপুর বাজারের আধা মাইল পশ্চিমে । জয়পুর গ্রামে গােমতীর শাখা নদীর পাড়ে হাবিলদার গিয়াস তাঁর দল নিয়ে শত্রুদের জন্য একটি অ্যামবুশ পাতে। সকাল ১০টার সময় শত্রুদের ২টি লঞ্চ দাউদকান্দির দিক থেকে গােমতী হয়ে এ শাখা নদীতে আসে। লঞ্চগুলাে অ্যামবুশের সামনে এসে পড়তেই মুক্তিযােদ্ধাদের দলটি অতর্কিতে গুলি ছুড়তে থাকে। শত্রুরা নদীর ভেতর থেকে অ্যামবুশ দলটির ওপর হামলা করতে অসমর্থ হয় এবং তীরে অবস্থিত অ্যামবুশ পার্টির তীব্র গােলাগুলিতে লঞ্চগুলাের যথেষ্ট। ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় ব্যাপক শত্রু হতাহত হয়। উপায়ান্তর না দেখে লঞ্চগুলাে পিছু। হটে যায় এবং দাউদকান্দির দিকে পালিয়ে যায়। পরে বিভিন্ন সূত্র থেকে মুক্তিযােদ্ধারা খবর পান যে, অন্তত ২০-২৫জন শক্র আহত বা নিহত হয়েছে। লঞ্চগুলাে অ্যামবুশের ভেতর পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে। দেওয়া সম্ভব হয়নি, কারণ অ্যামবুশ পার্টির কাছে রাইফেল ও হালকা মেশিনগান ছাড়া বড়াে অস্ত্র, যেমন রকেট লঞ্চার কিংবা কামান ছিল না, তবু অ্যামবুশের ফলাফল ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য একটি বিরাট সাফল্য। ফলে শত্রুরা এ এলাকায় চলাফেরা আরও কমিয়ে দেয়। এতে মুক্তিযােদ্ধাদের এবং স্থানীয় লােকের মনােবল আরও বেড়ে যায়। এরপর হােমনা ও দাউদকান্দি থানার। জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!