মিয়াবাজারের যুদ্ধ
কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম থানার অন্তর্গত মিয়াবাজার, যা কুমিল্লা শহরের ৮ কিলােমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। মুক্তিবাহিনী মিয়াবাজার এলাকার নিকটবর্তী স্থানে ফাঁদ পেতে শক্রর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। ১০ জুলাই শত্রুবাহিনীর আসার কথা থাকলেও পাকিস্তানি বাহিনী ঐদিন না এসে পরদিন আসে এবং ১১। জুলাই সাড়ে ১১টায় তাদের ওপর অ্যামবুশ করা হয়। পাকিস্তানিরা ২টি সামরিক যানবাহনসহ ১টি কোম্পানি নিয়ে মিয়াবাজারের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হতে থাকে। তখন মুক্তিবাহিনী পূর্বে দখলকৃত স্থান থেকে অতর্কিত শক্রর ওপর আঘাত হানে। এতে শত্রুর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। পাকিস্তানিরা পিছু হটে গিয়ে পুনরায় আক্রমণ চালায় এবং সারাদিন যুদ্ধ চলতে থাকে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের ১০-১৫জন আহত হয়। বিকাল ৩টা নাগাদ পাকিস্তানি সেনারা যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করে। মুক্তিযােদ্ধারা রাত ২টা পর্যন্ত পুনরায় আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এরপর বালুজুরির ভগ্নাবশেষ সেতুটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে লেফটেন্যান্ট ইমাম-উজ-জামান দলটি নিয়ে নিজ ঘাটিতে চলে আসেন। একটি সফল অ্যামবুশ করার পর শত্রুর মনােবল দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বিপুল পরিমাণ হতাহত হয় এবং শত্রুসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
তলুয়াপাড়ার অ্যামবুশ
সদর থানায় তলুয়াপাড়া অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে খবর আসে যে, শত্রুরা তলুয়াপাড়া ফেরিঘাট তাদের যাতায়াতের জন্য সাধারণত ব্যবহার করে থাকে। এ সংবাদ পেয়ে মেজর খালেদ মােশাররফ ১টি প্লাটুনকে ৯ জুন রাতে তলুয়াপাড়ায় পাঠান। এ প্লাটুনটি তলুয়াপাড়া ফেরিঘাটের কাছে শক্রদের জন্য অ্যামবুশ পাতে। ১০ জুন রাত ১১টার সময় শত্রুদের ১টি দল সেই ফেরিঘাটে আসে এবং নৌকাযােগে পার হতে থাকে। শত্রুরা যখন নদীর মাঝপথে, অ্যামবুশ দলটি সে সময় তাদের ওপর গুলি চালাতে শুরু করে। এর ফলে নৌকাটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনাদের আনুমানিক ২০জন। হতাহত হয়।
রাজারমার দিঘি আক্রমণ
কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম থানায় রাজারমার দিঘি অবস্থিত। পাকিস্তানিরা বিভিন্ন যুদ্ধে সুবিধা করতে না পেরে কুমিল্লা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক খােলার প্রচেষ্টা অব্যাহত। রাখে। যে-সব সেতু গেরিলারা ধ্বংস করেছিল, সেগুলাে পুনর্নির্মাণের চেষ্টাও করে। ১০ জুন লেফটেন্যান্ট মাহাবুবুর রহমানের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযােদ্ধা রাজারমার দিঘি ও জগমােহনপুর কাছারির শত্রু অবস্থানের ওপর হামলা। চালান। এখানে শত্রুপক্ষের ৮জন নিহত এবং ৫জন আহত হয়। পাকিস্তানিরা পিছু হটলে মুক্তিবাহিনী তাদের বাংকারগুলাে ধ্বংস করে দেয় এবং তাদের পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করে। ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানির ১টি প্লাটুন এবং ইপিআর মুজাহিদদের নিয়ে গঠিত ১টি যৌথ দল জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে মিয়ার বাজারের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের প্রতিরক্ষা। ব্যবস্থা শক্তিশালী করে। মিয়ার বাজার সেতুটি ধ্বংস করে দেওয়া হয়। পাকিস্তানিরা তাই মুক্তিবাহিনীর মিয়ার বাজার অবস্থানের প্রতি দৃষ্টি দেয়। তাই মুক্তিবাহিনীর অবস্থান চৌদ্দগ্রাম বাজারে নেয়া হয়। এখানে নতুন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলা হয়। তিন দিকে মুক্তিবাহিনী অবস্থান নেয়।
১টি প্লাটুন রাখা হয় মিয়ার বাজারের কাছে, যাতে পাকিস্তানি বাহিনী কুমিল্লা থেকে এলে তাদের বাধা দেওয়া যায়। ১০ জুন কুমিল্লা থেকে শত্রুপক্ষের ২টি কোম্পানি চৌদ্দগ্রামের দিকে আসার। সময় মুক্তিবাহিনী বাধা দেয়। এতে শত্রুপক্ষের ১জন নিহত হয় এবং তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ১৪ জুন শত্রুর ১টি দল নয়াবাজার হয়ে চৌদ্দগ্রামে আসার চেষ্টা করলে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের বাধা দেন। এতে পাকিস্তানিদের ৩০জন। হতাহত হয় এবং তারা পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। পরবর্তীকালে কুমিল্লার এ পথে সুবিধা না করতে পেরে ১৯ জুন পাকিস্তানিরা ২ ব্যাটালিয়ন সৈন্যসহ ফেনী-লাকসাম সড়কে আসার চেষ্টা করে। ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানিদের আনুমানিক ২০০জন হতাহত এবং মুক্তিযােদ্ধাদের ২জন শহিদ ও ৪জন আহত হন। পাকিস্তানিদের প্রবল আক্রমণের মুখে অবশ্য সন্ধ্যার দিকে মুক্তিবাহিনী তাদের অবস্থান পরিত্যাগ করে। ২৭ জুন চৌদ্দগ্রামের বিভিন্ন বাংকারে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে শত্রুদের প্রচুর ক্ষতিসাধন করা হয়।
চৌদ্দগ্রামের অ্যামবুশ
কুমিল্লা জেলা শহরের দক্ষিণে চৌদ্দগ্রাম থানা। এ থানার উত্তরে কুমিল্লা সদর থানা, উত্তর-পশ্চিমে লাকসাম থানা, পশ্চিমে লাঙ্গলকোট থানা এবং দক্ষিণে ফেনী সদর থানা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশেই থানা সদর দপ্তরের অবস্থান। তাই বন্দরনগর চট্টগ্রামের সঙ্গে যােগােযাগের ক্ষেত্রে চৌদ্দগ্রাম থানার গুরুত্ব অপরিসীম। অন্যদিকে, নােয়াখালী ও ফেনীর সঙ্গেও এ থানার মাধ্যমে যােগাযােগ রক্ষা করা হয়। ১৪ জুন সকাল ৬টার সময় শত্রুরা নয়াবাজার হয়ে চৌদ্দগ্রামের দিকে। অগ্রসর হয় কিন্তু তারা নয়াবাজারের কাছে মুক্তিবাহিনীর একটি অ্যামবুশে পড়ে। শক্রদের প্রায় ৩০জন হতাহত হয় এবং তাদের অগ্রগতি ব্যাহত হলে পিছু হটে যায়। ১৯ জুন সকাল ৬টায় শত্রুরা আনুমানিক ২টি ব্যাটালিয়ন নিয়ে দুই দিক থেকে (লাকসাম ও ফেনীর দিক থেকে) প্রবল আক্রমণ শুরু করে। কামানের তীব্র গােলার মুখে মুক্তিযােদ্ধাদের সম্মুখবর্তী সৈনিকেরা পিছু হটে আসতে বাধ্য। হয়। শত্রুদের আক্রমণ সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতে থাকে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত শক্রদের আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর চৌদ্দগ্রামের অবস্থানটি সংকটময় হয়ে পড়ে। আর বেশিক্ষণ এ অবস্থানটিতে থাকলে রাতের অন্ধকারে শক্রসেনা দ্বারা পরিবেষ্টিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। যদিও সারাদিনের যুদ্ধে শত্রুদের অন্তত ২০০জন হতাহত হয়েছিল এবং মুক্তিযােদ্ধাদের ২জন শহিদ ও ৪জন আহত হয়েছিলেন, তবু চৌদ্দগ্রাম অবস্থানটি শত্রুদের প্রবল আক্রমণের মুখ থেকে আর রক্ষা করা যাবে না ভেবে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় মুক্তিযােদ্ধারা অবস্থান পরিত্যাগ করেন।
ফকিরহাট রেল স্টেশন আক্রমণ
সদর থানায় ফকিরহাট রেল স্টেশন অবস্থিত। ১৪ জুন রাতে ফকিরহাট রেল স্টেশন থেকে ৭০০-৮০০ গজ উত্তরে শত্রুর ১টি দল দুপুরে বখশিমাইল গ্রামে প্যাট্রলিংয়ের জন্য গিয়েছিল। আরেকটি দল গাজীপুরের কাছে মুক্তিযােদ্ধারা যে কাঠের পুল জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন, সেটি মেরামত করছিল। বখশিমাইল গ্রাম থেকে সন্ধ্যার সময় শত্রুদের দলটি ফকিরহাটে নিজেদের অবস্থানে ফেরার পথে মুক্তিবাহিনীর পুঁতে রাখা মাইনের মধ্যে পড়ে যায় এবং মাইনগুলাে বিস্ফোরিত হয়। এতে তাদের অনেক লােক হতাহত হয় এবং তাদের মধ্যে ভয়ংকর বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। এ মাইনগুলাের বিস্ফোরণের শব্দ নিকটবর্তী অবস্থান থেকে শক্ররা শুনতে পায়। রাতের অন্ধকারে তারা ঠিক বুঝতে পারছিল না এ বিস্ফোরণের সঠিক কারণ কী। মুক্তিবাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে ভেবে শক্ররা প্রচণ্ড গােলাগুলি ছুড়তে থাকে এবং রাত ৮টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত চলে। শত্রুরা নিজেদের লােকের ওপর শত শত মর্টার ও কামানের গােলা ছুড়তে থাকে। পরে মুক্তিযোদ্ধারা পার্শ্ববর্তী গ্রামের লােকমুখে শুনতে পান যে, মুক্তিযােদ্ধাদের মাইনে এবং শত্রুদের নিজেদের গােলাগুলিতে অন্ততপক্ষে ৪০-৫০জন শত্রু হতাহত হয়েছে। পরদিন সকালে শত্রুদের ১জন ব্রিগেডিয়ার কুমিল্লা থেকে ঐ অবস্থানটি পরিদর্শন করতে আসে।
বুড়িচং থানা আক্রমণ
কুমিল্লা জেলা সদর থেকে উওর-পশ্চিমে বুড়িচং থানা অবস্থিত। পাকিস্তানি বাহিনী সীমান্তের নিকটবর্তী থানাগুলােয় পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশ ও মিলিশিয়া নিয়ােগ করতে শুরু করে। এসব থানাগুলােতে তারা বাংকার তৈরি করে অবস্থানকে শক্তিশালী করতে থাকে। কুমিল্লার উত্তরে সব থানাকেই তারা। এভাবে শক্তিশালী করে। মেজর খালেদ মােশাররফ থানাগুলােকে আক্রমণ করে পাকিস্তানিদের শাসনযন্ত্রকে অচল করে দেওয়ার একটা পরিকল্পনা করেন। মেজর খালেদের অবস্থানের নিকটবর্তী বুড়িচং থানা তার জন্য একটা বাধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, কেননা বুড়িচংয়ের ভেতর দিয়েই তাঁর গেরিলারা গােপন পথে ঢাকা, কুমিল্লা ও ফরিদপুরে যাতায়াত করতাে। এ থানাটির অবস্থানের গােপন পথগুলাে মােটেও নিরাপদ ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশরা শত্রুদের খবরাখবর পাঠাত। মেজর খালেদ বুড়িচং থানা আক্রমণ করার জন্য ১৬জনের ১টি দলকে পাঠায়। ১৪ জুন রাত ১টায় এ দলটি অতর্কিত বুড়িচং থানার ওপর আক্রমণ চালায়। থানায় প্রহরারত পুলিশ যথেষ্ট বাধা দেয় কিন্তু অবশেষে মুক্তিযােদ্ধাদের রেইড পার্টির হাতে তারা পরাস্ত হয়। এ সংঘর্ষে শত্রুদের ৮জন নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর ১জন গুরুতর আহত এবং ১জন নিখোঁজ হন। এর ফলে বুড়িচং থানা শত্রুমুক্ত হয় এবং ঢাকা ও কুমিল্লা যাওয়ার গােপন পথ নিরাপদ হয়।
নয়াবাজারের যুদ্ধ
কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম থানার অন্তর্গত নয়াবাজার। নয়াবাজার কুমিল্লা শহরের দক্ষিণে ১৮ কিলােমিটার দূরে অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধে নয়াবাজার এলাকা সামরিক দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অগ্রাভিযানে সম্মিলিত বাহিনীর অবস্থানের ফলে তাদের অগ্রগতি ব্যাহত হয়। ১৪ জুন সকাল ৬টায় পাকিস্তানি সেনারা নয়াবাজার হয়ে চৌদ্দগ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। এ অগ্রাভিযানে অংশ নেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২টি পদাতিক কোম্পানি। পাকিস্তানিরা নয়াবাজারের কাছে পৌছালে মুক্তিবাহিনীর ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানির ১টি প্লাটুন এবং ইপিআর ও মুজাহিদদের নিয়ে গঠিত সংঘবদ্ধ দলটির অ্যামবুশে পড়ে। অ্যামবুশে পাকিস্তানিদের ৩০জন হতাহত হয়। ১৯ জুন সকাল ৬টায় শক্ররা লাকসাম ও ফেনীর দিক থেকে প্রবল আক্রমণ করে। সারাদিনের যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ২০০জন হতাহত হয়। মুক্তিবাহিনীর ২জন শাহাদতবরণ করেন এবং ৪জন আহত হন। পরবর্তী সময় মুক্তিযােদ্ধারা অবস্থানটি রক্ষা করা যাবে না ভেবে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় অবস্থান ত্যাগ করেন।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড