You dont have javascript enabled! Please enable it!
সাহেবজাদার পুল ধ্বংস
লাকসাম থানায় লাকসাম-নােয়াখালী সড়কে সাহেবজাদার পুলটি সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানি ও মুক্তিবাহিনী উভয়ের জন্য রণকৌশলগতভাবে সাহেবজাদার পুলটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৮ মে ওয়ালীউল্লাহর নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি দল সাহেবজাদার পুলটি মাইন দ্বারা ধ্বংস করে লাকসামননায়াখালীর যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
দেবিদ্বার থানা আক্রমণ
কুমিল্লা জেলা সদর থেকে উত্তর-পশ্চিমে দেবিদ্বার থানা অবস্থিত। মে মাসে যখন মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে শত্রুদের সম্মুখযুদ্ধ চলছিল, সে সময় মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুদের বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। ২১ মে মুক্তিযােদ্ধা জামাল ও খােকন কুমিল্লার কাছে ১টি অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন পুঁতে শত্রুদের ১টি ট্রাককে উড়িয়ে দেন। গেরিলাদের আরেকটি দল দেবিদ্বার থানা আক্রমণ করে ৬জন দালাল পুলিশকে হত্যা করে। গেরিলাদের হাতে হাজিগঞ্জ থানার ১জন সাবইনস্পেকটর ও ২জন দালাল (পুলিশ) নিহত হয়। পুলিশ নিহত হওয়ার সংবাদ পেয়ে পাকিস্তানিদের ১টি ছােট দল (আনুমানিক ১০জন) হাজিগঞ্জ থানা পাহারায় নিযুক্ত হয়। গেরিলারা ১ দিন আক্রমণ চালিয়ে তাদের ৪জনকে হত্যা করে।
নােয়াপাড়া গ্রামে আক্রমণ
কুমিল্লা জেলা শহরের দক্ষিণে চৌদ্দগ্রাম থানা। এ থানার উত্তরে কুমিল্লা সদর থানা, উত্তর-পশ্চিমে লাকসাম থানা, পশ্চিমে লাঙ্গলকোট থানা ও দক্ষিণে ফেনী সদর থানা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশেই থানা সদর দপ্তরের অবস্থান। তাই বন্দরনগর চট্টগ্রামের সঙ্গে যােগাযােগের ক্ষেত্রে চৌদ্দগ্রাম থানার গুরুত্ব। অপরিসীম। অন্যদিকে নােয়াখালী ও ফেনীর সঙ্গে এ থানার মাধ্যমে যােগাযােগ রক্ষা করা হয়। তাই থানাটি পাকিস্তানি বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী উভয়ের জন্য রণকৌশলগতভাবে ছিল সমান গুরুত্বপূর্ণ। ২৬ মে পাকিস্তানিরা চৌদ্দগ্রাম থানার চিওড়া ইউনিয়নের নােয়াপাড়া গ্রামে আক্রমণ চালায়। হত্যা করে গ্রামের বহুসংখ্যক নিরীহ মানুষকে। এ দিনই তাদের হাতে যারা নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞের শিকার হন তাঁরা হলেন: শফিকুর রহমান (প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক), আমির মিয়া (বিত্তবান কৃষক) এবং নাম না। জানা ১জন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক, যিনি এ গ্রামেই থাকতেন। ২জন অজ্ঞাত পথচারীও (যারা বাঁচার আশায় পালাচ্ছিলেন) হত্যার শিকার হন। হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি চলে অবাধ লুটতরাজ ।
জগন্নাথদিঘির পাকিস্তানি ঘাঁটি আক্রমণ
চৌদ্দগ্রাম সীমান্তবর্তী থানা। পাকিস্তানিদের অত্যাচারের শিকার বহু শরণার্থী এ থানা অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নেয়। তা ছাড়া নেতা, কর্মী ও মুক্তিযুদ্ধে ট্রেনিং প্রত্যাশীরাও এ পথে ভারতে যান। এ কারণে পাকিস্তানিদের এ থানার ওপর বিশেষ দৃষ্টি ছিল। এ থানার জগন্নাথদিঘি এলাকায় পাকিস্তানিরা গড়ে তােলে একটি শক্তিশালী ঘাটি। অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনী তাদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করার জন্য এ এলাকায় অন্যত্র গড়ে তােলে একটি ঘাঁটি।  ৩ এপ্রিল জসীমউদ্দিন আহমেদের উদ্যোগে জগন্নাথদিঘিতে ক্যাম্প স্থাপিত হয়। ভারতীয় সীমান্তের ১ মাইল ভেতরে ডিমাতলী (বড়ােটিলা) অঞ্চলে এ ক্যাম্পের অবস্থান ছিল। এখানে গড়ে তােলা হয় চৌদ্দগ্রাম থানার মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ’ এ ক্যাম্পের উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি ছিলেন গণপরিষদ সদস্য অ্যাডভােকেট মীর হােসেন চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জসীমউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী এবং সদস্য ছিলেন আবুল হাসেম মজুমদার, রফিকুল ইসলাম মজুমদার, জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া (প্রাক্তন এমপি), সানাউল্লাহ ভূইয়া, জহিরুল কাইয়ুম, শাহজাহান কবির (ইঞ্জিনিয়ার), জহিরুল হক, গােলাম কিবরিয়া, নজির আহমেদ ভূঁইয়া (প্রাক্তন চেয়ারম্যান), মােহাম্মদ ইসহাক ভূইয়া (চেয়ারম্যান), আবদুল মালেক, আবুল হাসেম ভূইয়া, মীর হােসেন, আব্দুল হক, সামছুল হক, অহিদুর রহমান, মফিজুল মান্নান ও পেয়ার আহমেদ প্রমুখ।  ৫ মে ডিমাতলী (বড়ােটিলা) ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’-এর অনুমােদনের জন্য মুজিবনগর সরকারের পূর্বাঞ্চলীয় কাউন্সিলের কাছে গণপরিষদ সদস্য অ্যাডভােকেট মীর হােসেন চৌধুরীর মাধ্যমে দরখাস্ত করা হয়। তৎকালীন মুজিবনগর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নিয়মানুযায়ী ইয়ুথ ক্যাম্প বা অভ্যর্থনা ক্যাম্প ছাড়া অন্য কোনাে নামের সংগঠন বা সংস্থাকে অনুমােদন দেওয়া হতাে না। তবে বিশেষ বিবেচনায় ২৪ জুলাই এ ক্যাম্পটির অনুমােদন দেওয়া হয়। জসীমউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীকে শিবিরের প্রধান নিযুক্ত করা হয়।
চৌদ্দগ্রাম থানার মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ’ ক্যাম্পের ৩টি শাখা ছিল। শাখাগুলাে ছিল: (১) সাধারণ মুক্তিবাহিনী (গেরিলাসহ), (২) গােয়েন্দা শাখা ও (৩) রাজনৈতিক শাখা। প্রথম শাখার কাজ ছিল সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে অপারেশন করা। দ্বিতীয় শাখার কাজ ছিল বাংলাদেশের ভেতরে শত্রুপক্ষের অবস্থান নির্ণয়, মানচিত্র তৈরি ও গােপন খবরাখবর সংগ্রহ করা। তৃতীয় শাখার কাজ ছিল ব্যাপক। এ শাখা যুবকদের সংগঠিত করে প্রথমে যুব শিবিরে প্রেরণ করে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করত। তা ছাড়া বাঙালি শরণার্থীদের অভ্যর্থনা, আশ্রয় ও খাদ্যের ব্যবস্থা করত। এ ক্যাম্পের সঙ্গে পরবর্তীকালে সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও ভারতীয় অফিসারদের যােগাযােগ স্থাপিত হয়। এ ক্যাম্পের উদ্যোগে চৌদ্দগ্রামের বিভিন্ন ইউনিয়ন ও বিভিন্ন গ্রামে সভা সমিতির দ্বারা জনগণের মনােবল বৃদ্ধি এবং যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার ব্যবস্থাও করা হয়। উল্লেখ্য, এ ক্যাম্প থেকে মাত্র ২ মাইল দূরে জগন্নাথদিঘিতেই ছিল পাকিস্তানিদের ঘাটি। মুক্তিযােদ্ধারা যুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানিদের গতিরােধ করার জন্য ঢাকাচট্টগ্রাম রেললাইনের ক্ষতিসাধন করে। যুদ্ধের পুরাে সময় জুড়ে রেল চলাচল প্রায় বন্ধই ছিল। তবে পাকিস্তানি বাহিনী বারবার রেললাইন পুনরায় স্থাপনের চেষ্টা চালায়। মুক্তিবাহিনীর প্রথম অভিযান সফল হয় ২৬ মে। জগন্নাথদিঘির শত্রুঘাঁটির অবস্থানের ওপর লেফটেন্যান্ট ইমাম-উজ-জামানের প্লাটুন রাত ১১টায় অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ১৯জন শত্রুকে হত্যা করে। ২৮ মে ভােরে রাজারমার দিঘিতে শত্রুদের বাংকারে গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হলে ৪জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং তাদের রাইফেল ও অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিবাহিনী দখল করে নেয়।
২৯ মে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাইওনিয়ার পার্টি লাকসাম ও নােয়াখালীর মধ্যবর্তী স্থানে ৩টি রেলওয়ে বগি সম্পূর্ণ বিনষ্ট করে দেয়। ফেরার পথে এ দলটি চৌদ্দগ্রামের একটি সদ্য মেরামত করা ব্রিজে মাইন। পুঁতে রাখে। রাত ৮টায় ১টি জিপে ৫জন শক্রসহ ফেনীর দিকে যাওয়ার পথে ব্রিজটি সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়। এর ফলে ১জন অফিসারসহ ৩জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং ২জন গুরুতর আহত হয়। ঐদিনই মুক্তিবাহিনীর ৩জন। গেরিলা চৌদ্দগ্রাম থানার পাশে শত্রু বাহিনীর বাংকারে আক্রমণ চালালে ৩জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। ৩০ মে চৌদ্দগ্রাম মিয়াবাজারে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানির ১টি প্লাটুন পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে ৩জন শত্রু নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। এদিন ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানির ১টি প্লাটুন চৌদ্দগ্রাম থানায় অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এখানে শত্রুপক্ষের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। মিয়াবাজারের কাছে একটি সেতু পুনরায় চালু করার জন্য পাকিস্তানিদের ২ কোম্পানি সৈনিক এলে দুপুরে মুক্তিবাহিনী তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। ৩ ঘণ্টা স্থায়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং কুমিল্লায় পালিয়ে যায়। এখানে শক্রদের ৫০জন হতাহত হয়। মুক্তিবাহিনী গােলাবারুদসহ ১টি গাড়ি ধ্বংস এবং অপর ১টি গাড়ি দখল করে নেয়। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ২জন শহিদ এবং ১জন আহত হন। শত্রুপক্ষ কুমিল্লা বিমানবন্দর থেকে আক্রমণ। চালাতে থাকে। অন্যদিকে, পাকিস্তানি বাহিনীর অন্য দল চিওড়ার কাছে মুক্তিবাহিনীর মুখােমুখি হয়। লেফটেন্যান্ট কবিরের নেতৃত্বে পরিচালিত এ যুদ্ধে শত্রুপক্ষের ১০জন নিহত এবং অবশিষ্টরা পিছু হটতে বাধ্য হয়।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!