পাঠানকোট অ্যামবুশ
পাঠানকোট হচ্ছে পুরাতন কুমিল্লা-চট্টগ্রাম রােডে ৮ কিলােমিটার। ২৮ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টায় ৪০জন মুক্তিযোেদ্ধার সমন্বয়ে হাবিলদার সিরাজ পাঠানকোটে একটি অ্যামবুশ পরিচালনা করেন। কুমিল্লা-চট্টগ্রাম রােডটি শত্রুদের চলাচলের প্রধান রাস্তা হওয়ায় এবং পাঠানকোট ঐ রাস্তার ওপর অবস্থিত হওয়ায় সামরিক বিবেচনায় এ অ্যামবুশের গুরুত্ব অনেক। মুক্তিবাহিনীর সাথে ৪টি এলএমজি, ২ ইঞ্চি মর্টার, ৮২ মিলিমিটার ব্লেন্ডিসাইড এবং অন্যান্য চীনা অস্ত্র ছিল। মুক্তিবাহিনী শত্রুদের ১টি জিপ ও ১টি ৩ টনি লরিকে ধ্বংস করে এবং ৮১০জন শত্রুকে হত্যা করে। এতে শত্রুদের অনেক অস্ত্রই মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়।
বগাদিয়া সেতু অ্যামবুশ
লাকসাম থানায় বগাদিয়া সেতুর কাছে নায়েক সিরাজ ১ প্লাটুন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে একটি অ্যামবুশে অবস্থান গ্রহণ করেন। এ জায়গায় ১টি জিপসহ ৩টি ৩ টনি লরি কিছু দূরত্ব বজায় রেখে অগ্রসর হওয়ার সময় নায়েক সিরাজ পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ চালান। প্রথম ও শেষ গাড়ির ওপর অনবরত গুলি চালালে ৩ টনি ১টি গাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। এখানে ১৫-২০জন শত্রু নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়। পরক্ষণে শক্ররা ৩ ইঞ্চি মর্টার ও মেশিনগান দিয়ে অবিরাম গুলিবর্ষণ করতে থাকে। দীর্ঘসময় যুদ্ধের পর নায়েক সিরাজ প্লাটুন প্রত্যাহার করেন। শত্রুরা এখানে কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং একজন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এ যুদ্ধে হাবিলদার নূরুল আমিন ও অপর একজন মুক্তিযােদ্ধা গুরুতর আহত হন। নায়েক সিরাজ অসীম সাহস ও বীরত্বের সাথে এ যুদ্ধ পরিচালনা করেন। ৯ মে ফেনাকাটা অপারেশনের পর জনসাধারণ ও মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে নতুন করে সাহসের সঞ্চায় হয়। নায়েব সুবেদার ওয়ালীউল্লাহকে বাগাদিয়ায় অ্যামবুশ করার নির্দেশ দিয়ে নায়েব সুবেদার জাবেদকে সঙ্গে নিয়ে মাে. আবু তাহের মির্জা শত্রুদের কর্তব্যপরায়ণতা ও অবস্থান লক্ষ্য করার জন্য চৌমুহনী। রওনা হন। চৌমুহনীতে পাকিস্তানিদের গতিবিধি লক্ষ্য করে বগাদিয়া ফেরার আগেই নায়েব সুবেদার ওয়ালীউল্লাহ পাকিস্তানিদের ১টি পিকআপ ভ্যানের ১জন জেসিওসহ ৬জনের ওপর অ্যামবুশ করেন। এ আক্রমণে ২জন শত্রু সৈন্যসহ উক্ত জেসিও নিহত হয়। গাড়িটি রাস্তার পাশে পড়ে যায়। ইতােমধ্যে মুক্তিযােদ্ধারা সেখানে পৌছে যান। ঠিক সেই মুহূর্তে শত্রুদের আরও ২টি গাড়ি এসে পড়ে। আরম্ভ হলাে উভয় পক্ষের আক্রমণ আর প্রতি-আক্রমণ। ৫ ঘন্টা গুলি বিনিময় হয়। অবশেষে শক্ররা হতাহত সৈন্যদের নিয়ে চৌমুহনীর দিকে চলে যায়। এখানে শত্রুপক্ষের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। সুবেদার ওয়ালী এ যুদ্ধে অসামান্য সাহস ও বীরত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এ যুদ্ধে নায়েব সুবেদার ওয়ালীউল্লার কপালে গুলি লাগে এবং তিনি আহত হন।
কটকবাজারের যুদ্ধ
কোতােয়ালি থানার জগন্নাথপুর ইউনিয়নে কটকবাজার অবস্থিত। কুমিল্লার বিবির বাজার বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত এলাকা হওয়ায় এলাকাটি মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানিদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কুমিল্লা শহরের নিকটবর্তী হওয়ায় এ এলাকা থেকে মুক্তিবাহিনীর ছােটো ছােটো কমান্ডাে পার্টি গােমতী নদী অতিক্রম করে কুমিল্লা শহরে পাকিস্তানিদের অবস্থানের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালাতাে এবং তাদের ব্যতিব্যস্ত রাখতাে। | তৎকালীন ২ নম্বর সেক্টর অধিনায়ক মেজর খালেদ মােশাররফ ও ক্যাপ্টেন। রেজাউল আহম্মেদের নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি, ইপিআর-এর ৩টি কোম্পানি, মুজাহিদ, ছাত্র ও আনসারের ১টি কোম্পানি ও কুমিল্লা জেলার মুক্তিযােদ্ধারা প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে ভিপি শাহ আলম, সুবেদার মান্নান, শফিউল আহমেদ বাবুল ও অধিনায়ক সিরাজুল ইসলামের কার্যক্রম প্রশংসার দাবি রাখে। পাকিস্তানিদের ৩১ পাঞ্জাব ও ৩১ বালুচ রেজিমেন্ট এ এলাকায় যুদ্ধে নিয়ােজিত ছিল। ৯ মে এখানে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকিস্তানিদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় এবং পাকিস্তানি বাহিনীর ১০০১৫০জন সৈনিক নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর হাবিলদার জুম্মা খান, ল্যান্স নায়েক আবদুল কাদের মােল্লা ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ইমতিয়াজ উদ্দিন শহিদ হন।
চৌদ্দগ্রাম বাজারের যুদ্ধ
চৌদ্দগ্রাম বাজার মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে ছিল। এ স্থানে ক্যাপ্টেন আমিনুল হক ও লেফটেন্যান্ট ইমাম-উজ-জামানের নেতৃত্বে ২টি কোম্পানি প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিল। ১৪ মে ভােরে পাকিস্তানিদের ৩৯ বালুচ রেজিমেন্ট মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ করে এবং সেখানে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী। আর্টিলারি ফায়ার করে। পাকিস্তানিদের আনুমানিক ৩৫-৪০জন নিহত হয় এবং মুক্তিবাহিনীর ৮জন শহিদ হন। পরে পাকিস্তানিদের সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে মুক্তিবাহিনী স্থান পরিবর্তন করে রাধানগরে চলে যায়।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড